Site icon BnBoi.Com

সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা – আহমদ শরীফ

সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা - আহমদ শরীফ

অন্ন ও আনন্দ

ব্যুৎপত্তিগত তাৎপর্যে যা মানুষকে ধরে রাখে অথবা মানুষ যা ধরে বেঁচে থাকে তা-ই ধর্ম। দরাজ অর্থে সৃষ্টিমাত্রেরই ধর্ম রয়েছে। এই কারণে ধর্মের অপর অর্থ স্ব-ভাব। স্ব-ভাবও একপ্রকার বন্ধন, যা ছিন্ন করা অসম্ভব। আবার ধর্ম, দীন কিংবা Religion (< Religare) শব্দের মধ্যেও রয়েছে বন্ধনের ভাব। আধুনিক অর্থেও ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস-সংস্কার, নিয়ম-নীতি, আদর্শ ও পদ্ধতি, ব্যবহাররীতি ও চিন্তাভাবনার নিয়ন্ত্রণ-বিধির সমষ্টি। কাজেই যে-কোনো তাৎপর্যে ধর্ম মানুষকে ধরে রাখে–কিন্তু ভরেও যে তুলতে পারে–তা নিশ্চিত করে বলা চলে না।

অন্য জীব ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ধর্ম প্রাকৃতিক। কিন্তু মানুষের ধর্ম অনেকখানিই স্বসৃষ্ট। সে স্বেচ্ছায় নিয়মের শৃঙ্খলে নিজেকে বেঁধেছে যৌথজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার তাগিদে। এ তার অন্ন, প্রাণ, মন, জ্ঞান ও আনন্দের প্রয়োজনে নির্মিত। প্রাণ-মন-প্রজ্ঞা দিয়ে সে অন্ন ও আনন্দের সুব্যবস্থা করতে চেয়েছে, আবার এই অন্ন আর আনন্দই হয়েছে তার প্রাণ-মন ও প্রজ্ঞার পোষক। তাই উপনিষদ বলেশ্ৰহ্ম হচ্ছেন অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময়। ঔপনিষদিক তাৎপর্যে জীবই ব্ৰহ্ম। কাজেই জীবনে প্রাণ, মন ও আনন্দের জন্যে চাই অন্ন। অন্ন উৎপাদনের জন্যে চাই জ্ঞান। পাঁচরুহ বা পঞ্চপ্রাণ তত্ত্বের উৎসবিন্দুতেও হয়তো রয়েছে এ বোধ। এ পঞ্চকোষের সমন্বয়ে মেলে পূর্ণাঙ্গ জীবন। এগুলোর ভারসাম্যে অভিব্যক্তি পায় সত্য ও সমগ্র সত্তা। এ লক্ষ্যেই চিরকাল পরিচালিত হয়েছে মানুষের চেতন ও অবচেতন প্রয়াস।

প্রাণ বাঁচানোর জন্যে অন্ন আর মন রক্ষার জন্যে আনন্দ–এ দুটোর সাধনাই মানুষের কর্ম ও চিন্তার ইতিহাস। মানুষ বাইরে লড়েছে অন্নের জন্যে আর ভেতরে সগ্রাম করেছে তত্ত্ব নিয়ে। জনসংখ্যা বর্ধিষ্ণু, জীবিকা ক্ষয়িষ্ণু– তাই তার সগ্রাম করতে হয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে, উদ্ভাবন করতে হয়েছে উৎপাদনের নতুন নতুন উপায়, কাড়তে হয়েছে অন্য মানুষের খাদ্য–বেড়েছে তার জ্ঞান-প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞতা, ব্যাপক হয়েছে তার ভাব-চিন্তা-কর্ম। এভাবে একদিকে প্রকৃতির প্রায় সবকিছুর উপযোগ সৃষ্টি করে সে বৃদ্ধি করে চলেছে জীবন-জীবিকার উপকরণ; অন্যদিকে জীবিকার সু-উপভোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন-লক্ষ্যে সে তৎপর রয়েছে সমাজ-বিন্যাস চিন্তায়। একদিকে ক্রম সাফল্যে মৃগয়া ও ফলজীবী মানুষ আজ নভোচর, অন্যদিকে Totem-Taboo-Magic ছেড়ে Animist, Pagan ও Religious মানুষ আজ নাস্তিক–Anarchist.

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমবর্ধিষ্ণু জীবন-চেতনা মানুষকে প্রবর্তনা দিয়ে চলেছে নতুন ভাবনায়, মননে, কর্মে ও আবিষ্কারে। অন্ন ও আনন্দের অভাব মিটাতেই হয়। অতএব, মানুষের চলমানতার মূলে রয়েছে অন্বেষা। সে-অন্বেষা : অন্নের ও আনন্দের। আর এ দুটোর জন্যেই চলছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রাম, সৃষ্টি হচ্ছে ন্যায়-নীতি-নিয়ম, উচ্চারিত হচ্ছে সাম্য, করুণা ও মৈত্রীর বাণী, ধ্বনি উঠছে সহযোগিতা-সহ-অবস্থান ও সমদর্শিতার, গড়ে উঠছে জীবিকার রকমারি উপকরণ। এভাবে চলছে সমাধানের মানস ও ব্যবহারিক নানা প্রয়াস। আজ অবধি মানুষের যা কিছু সৃষ্টি ও নাশকতা; যা কিছু লজ্জা ও গৌরবের, যা কিছু চিন্তা ও কর্মে অভিব্যক্ত, তা এই অন্ন ও আনন্দ সংস্থানের জন্যেই।

এ প্রয়োজনের তাগিদেই দেশে দেশে নতুন ধর্মের উদ্ভব। চেতনা যার গভীর, সে-মানুষ সচেতনভাবে উপলব্ধি করে দেশ-কালের প্রয়োজন। তাই সে হয় পিতৃধর্মও সমাজ-দ্রোহী। পরিবর্তিত পরিবেশে মানুষের অন্ন ও আনন্দের চাহিদা মিটিয়ে সমাজ-শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব এই সংবেদনশীল মনীষীর। এমনি করে দেশ-কালের প্রয়োজনেই সেকালে হত নতুন নতুন ধর্মের উদ্ভব,–একালে যেমন হয় নতুন নতুন মত ও রীতি-পদ্ধতির প্রচলন।

কিন্তু দেশ-কালের প্রয়োজন-নিরপেক্ষ কোনো ধর্মের যে উদ্ভব হয়নি এবং কোনো ধর্মই যে, সর্বকালিক, সর্বদৈশিক কিংবা সর্বমানবিক হতে পারে না, ধর্মকে অপরিবর্তিতরূপে আঁকড়ে ধরে রাখলে, তা যে জীবনের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তার যুগোপযোগী সংস্কার কিংবা পরিবর্তন যে দরকার, তা সাধারণ লোক বোঝে না। তাই তারা মনে করে ধর্মনিষ্ঠা ও অধার্মিকতাই মানুষের ব্যক্তিক, সামাজিক, জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রিক জীবনে উত্থান-পতনের একমাত্র কারণ। তাদের মতে, মানুষের সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে দুর্দিন ও সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন মানুষ অবহেলা করে ধর্মের বিধি-নিষেধ। সেন্ট অগাস্টাইন, ইবনে খলদুন থেকে শুরু করে আজকের দিনের অনেক ঐতিহাসিক, মনীষী এবং দেশনায়কও পোষণ করেন এ ধারণা।

অথচ এ ধারণা যে কত ভিত্তিহীন তা বলে শেষ করা যায় না। যেহেতু ধর্মমতের উদ্ভবের মূলে রয়েছে দেশ-কালের চাহিদা, সেজন্যে নতুন ধর্মমত মাত্রেই বিদ্রোহজাত এবং আঞ্চলিক মানুষের জীবন-জীবিকার তথা সমাজ-সমস্যার সমাধান। তাই অঞ্চল বহির্ভূত জগতে এ প্রচারিত হয়ে প্রসার লাভ করেছে বটে, কিন্তু মানুষের কোনো প্রয়োজন মিটিয়ে তার ব্যবহারিক কিংবা মানস জীবনে কোনো বিপ্লব ঘটাতে পারেনি। যদিও ধর্মমাত্রেই তার উদ্ভবক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে জন্ম দেয় নতুন যুগের; চিত্তলোকে নতুন বোধ ও প্রেরণা জাগিয়ে মানুষকে করে কর্মপ্রবণ, দায়িত্ব-সচেতন ও কর্তব্যনিষ্ঠ, আর করে বাহুবলে বলীয়ান, নৈতিক চেতনায় মহীয়ান, ব্যবহারিক সম্পদে ঐশ্বর্যবান এবং মানসজীবনে ঋদ্ধ।

হযরত মুসার পাপবোধ সেদিন হয়তো কেনানে-মিশরে মানুষকে পীড়নমুক্ত করেছিল, কিন্তু অন্যত্র তা প্রভাব ছড়ায়নি হয়তো সে-পরিবেশের অনুপস্থিতির দরুনই। ধনলির ক্রুর লোভ ও নিষ্ঠুর পীড়নপ্রবণতার বিরুদ্ধে লড়েছেন হযরত ঈসা। সেকালের প্যালেস্টাইনের সামাজিক পরিবেশে এ দ্রোহের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেশান্তরে রোমা খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেও রোধ করতে পারেনি তাদের পতন কিংবা য়ুরোপে কোনো অঞ্চলের মানুষেরই মানসোকর্ষের কারণ হয়নি যিশুর ধর্ম। এমনকি তা ব্যবহারিক জীবন-প্রয়াসের অথবা নৈতিকজীবন ও মানবিকবোধ বিকাশের সহায়ক হয়েছিল বলেও তেমন দাবী করা চলে না।

বর্ণে বিন্যস্ত সমাজে ব্রাহ্মণ্য পীড়ন-শোষণ থেকে নির্যাতিত মানুষকে মুক্ত করে মানুষের ব্যক্তিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী ছিলেন দেব-দ্বিজ-বেদ-দ্রোহী মহাত্মা বুদ্ধ ও বর্ধমান। তাঁদের বাণী বিপ্লব ঘটিয়েছিল উত্তরপূর্ব ভারতে। তাদের সাম্য, মৈত্রী ও করুণার বাণী সেদিন এ অঞ্চলের মানবিক সমস্যার সমাধান দিয়েছিল। কিন্তু তাঁদের বাণী দেশান্তরে ভিন্ন পরিবেশে মানুষের মনের ও সমাজের রূপান্তর ঘটিয়ে কোনো নতুন যুগের সূচনা করেনি, মধ্য এশিয়ার রক্তপিপাসু শক-হূন-ইউচিদের চরিত্রে দেয়নি করুণা ও কোমলতার প্রলেপ কিংবা জীবন-রসিক চীনাদের করেনি বৈরাগ্যপ্রবণ।

একক স্রষ্টার নামে হযরত মুহম্মদের সাম্য ও ঐক্যের বাণী যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছিল মক্কা-মদিনায়। এই নবলব্ধ ঐক্য তাদের করেছিল অদম্য অপরাজেয় শক্তির অধিকারী। বন্যার বেগে তারা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। আত্মবিকাশ ও আত্মবিস্তারের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। কিন্তু সিরিয়া-ইরাক-ইরানে কিংবা মিশরে-মরোক্কে অথবা মধ্য এশিয়ায় ও ভারতে দীক্ষিত মুসলিম জীবনে সে-প্রাণপ্রাচুর্য, সে-বৈষয়িক উন্নতি, সেই মনোবল কখনো দেখা যায় নি। উল্লেখ্য যে, তুর্কী মুঘলের আত্মপ্রসার ইসলামের দান নয়। শক-হন-ইউচি-মোঙ্গলের এই বংশধরেরা বেঁচে থাকার দায়েই বাহুবল ও মনোবল-সম্বল জীবনযাপন করত। এদের পূর্বপুরুষেরাই কোরআনের ইয়াজুজ মাজুজ, এদের ভয়েই গড়তে হয়েছে চীন-ককেসাসের প্রাচীর। তবু এদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি চারদিককার জগৎ। সিরিয়া-ইরাক-ইরান-আর্মেনিয়া-রাশিয়া-ভারত-চীন চিরকালই যুগিয়েছে এদের পিপাসার রক্ত আর উদরের অন্ন। অনুর্বর মধ্য এশিয়ায় যখনই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অথবা অনাবৃষ্টির জন্যে চারণভূমির ও খাদ্যবস্তুর অভাব ঘটেছে তখনই তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছে মরীয়া হয়ে। অনিবার্য আসন্ন মৃত্যু থেকে বাঁচবার গরজপ্রসূত বলেই এই অভিযানে তারা ছিল অপ্রতিরোধ্য ও অপরাজেয়। কেননা, তারা জানত সামনে তাদের জীবন–পশ্চাতে মৃত্যু।

জীবনে-সমাজে-রাষ্ট্রে যখনই গ্লানি ও বিপর্যয় আসে, তখনই সাধারণ নায়কেরা মানুষকে স্বধর্মে তথা পিতৃপুরুষের ধর্মে নিষ্ঠ হতে উপদেশ দেন, তাঁদের মতে একমাত্র এ পথেই বিপন্মুক্তি সম্ভব। সবদেশে সবযুগেই সাধারণ মানুষের ধারণায় সঙ্কট উদ্ধারের এ-ই একমাত্র উপায়। তারা যদি নতুন ধর্মের প্রবর্তন চাইতেন, অন্তত গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করতেন, তা হলেই সুবুদ্ধির পরিচয় দিতেন। মোহগ্রস্ত চিত্তে পুরোনোই শ্রদ্ধেয়, নতুনমাত্রই অবেজ্ঞয় ও অনভিপ্রেত। অথচ তারা ভেবে দেখেন না যে হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি কোনো যুগের কোনো দেশের কোনো চিন্তানায়ক ও সমাজকর্মীই পিতৃপুরুষের ধর্মে সন্তুষ্ট ও সুস্থির ছিলেন না। তাঁরা সবাই পুরোনো ধর্মদ্রোহী ও নতুন ধর্মের প্রবর্তক। যারা তেমন অসামান্য মননশীল কিংবা সৃজনশীল নন, তাঁরাও reform করেছেন পুরোনো ধর্ম যুগের চাহিদা পূরণের জন্যেই।

কাজেই কোনো জ্ঞানী-মনীষীর কাছেই ধর্ম সর্বকালিক বলে বিবেচিত হয় নি কখনো। আল্লাও দেশ-কালের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন বাণী পাঠিয়েছেন তার নবীদের মুখে। সাধারণভাবে দেখতে গেলে ধর্ম-সমাজ-রাষ্ট্র কিংবা বিজ্ঞান-দর্শনের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যা কিছু নতুন হয়েছে, সবকিছুই এই পিতৃপুরুষের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-দর্শন প্রভৃতির অস্বীকৃতির তথা অগ্রাহ্যের ফল। এই দৃষ্টিতে যুগে যুগে দ্রোহী-নাস্তিকেরাই বিশ্বমানব ভাগ্যের দিশারী–দেশ-কালের মানবিক সমস্যার সমাধানদাতা। মানব সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছে এমনি দ্রোহীদের দানে।

পরিবেশবিরহী ধর্মের সৃষ্টি ও স্থিতি তথা আয়ু যে নেই, তার প্রমাণ পরিবর্তিত পরিবেশে ওগুলো উপযোগ হারিয়ে স্বদেশেই লোপ পায়, যেমন জন্মভূমিতেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে জরথুস্ত্রীয়, ইহুদী, খ্রীস্টীয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম।

কাজেই ধর্মনিষ্ঠাই মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে শক্তি, সম্পদ ও উন্নতির উৎস এবং ধর্মাচারহীনতাই বিপর্যয় ও অবক্ষয়ের কারণ–এ তত্ত্বে তথ্য নেই।

সত্য হচ্ছে এই, যে ক্রমপরিবর্তমান, ক্রমবর্ধমান ও ক্রমঅসমঞ্জস প্রয়োজন-সচেতনতা ও আয়োজন-বুদ্ধি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় সামর্থ্য না থাকলে রূঢ়িক কিংবা যৌগিক জীবন সমস্যাসঙ্কুল হয়ই–আর তাতে অভাব-অন্যায়-উৎপীড়ন দেখা দেয় এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত-দ্রোহও এড়ানো যায় না।

ইংরেজ আমলে মুসলিম-মানসের পরিচয়-সূত্র

পাক-ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয় মুখ্যত সূফী সাধকের দ্বারা। ইরানে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার পর কোরআনের ইসলামের উপর ইরানী অধ্যাত্মতত্ত্বের প্রভাব পড়ে সুপ্রচুর। কোরআনের ইসলামের মূলকথা : স্রষ্টা ও সৃষ্টি আলাদা, পরস্পরের সম্বন্ধ হচ্ছে বান্দা ও মনিবের। আল্লাহর নির্দেশিত বিধি নিষেধ মেনে চলাই মানুষের একমাত্র কর্তব্য। নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি অনিবার্য। আল্লাহর দেয়া বিধি-নিষেধও কোনো অধ্যাত্ম-জীবনের ইঙ্গিত বহন করে না, তা একান্তভাবেই মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার সম্পর্কিত। কাজেই কোরআনের শিক্ষায় কোথাও কোনো অস্পষ্টতা বা হেঁয়ালি নেই। সূফী মতবাদে কিন্তু বান্দা-মনিব সম্পর্কটি প্রায়ই অস্বীকৃত হয়েছে এবং ঘোষিত হয়েছে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে পরমাত্মা ও জীবাত্মার প্রণয় সম্পর্ক। এর পরিণাম দ্বৈতাদ্বৈতবোধে। অথচ ইসলামের মৌল কথা দ্বৈতবাদ। ফলত ইসলাম আর মুসলমানধর্ম এক থাকে নি। পাক-ভারতে এই মুসলমান ধর্মই প্রচলিত হয়েছিল, তার উপর শিয়ামতবাদও এখানে অপ্রচলিত ছিল না।

জনসাধারণ ছিল অশিক্ষিত, আর প্রচারক ছিলেন পীর-দরবেশ, কাজেই যুক্তি প্রয়োগে নয়– কেরামতি, সামাজিক-সাম্য ও ভাবালুতা সম্বল করেই প্রচারিত হয়েছিল ইসলাম। তাই অধ্যাত্ম মহিমামুগ্ধ তত্ত্বপ্রবণ মনে ইসলামের ব্যবহারিক শিক্ষা বিশেষ সক্রিয় হতে পারে নিঃ যেমন শিয়া, ইসমাইলী সম্প্রদায় কিংবা চিশতিয়া-আদি সূফী খান্দানীদের ধর্মবোধ আজো পীরকেন্দ্রী। মারফত-পন্থ নামে চিহ্নিত করে ইত্যাকার মতবাদকে শরীয়তী-ইসলামেরও উপরে স্থান দেয়া হয়েছে।

ফলে পাক-ভারতের দীক্ষিত মুসলমান কোনোদিন দৃঢ়-প্রত্যয়ী মুসলিম হতে পারে নি। তাই নানক-কবীর-চৈতন্যের মাহাত্ম্য-মুগ্ধ মুসলমান ইসলাম ছেড়ে তাদের শিষ্য হয়েছিল। যারা রইল, তারাও পূর্বপুরুষের বিশ্বাস-সংস্কার পুরো ত্যাগ করতে পারে নি।

তাই বাঙলা দেশে আমরা কিছুকাল আগে পর্যন্ত সত্যপীর, বনবিবি কালুগাজী, ওলাবিবি প্রভৃতি মুসলিম-পূজ্য উপদেবতা পাচ্ছি। এভাবে পাক-ভারতে একপ্রকার লৌকিক ইসলাম দাঁড়িয়ে যায়। মাদার-পন্থী ফকিরেরা ও শাহ বু-আলি কলন্দরের যোগমার্গ আরো বাড়িয়ে দিল এ-বিকৃতি। যোগপন্থী দেহাত্মবাদী বাউল-বিকৃতিও মুসলিম সমাজকে পেয়ে বসেছিল। একে তো মুসলমান শাসকজাতি-শাসিত সম্প্রদায়ের তুলনায় ঐশ্বর্যবান–সবক্ষেত্রে ধনে না হোক, মানে ও মনে তো বটেই! তাই আবার ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার একান্ত অভাব। কাজেই বিকৃতি ও উজ্জ্বলতা ছিল প্রকট ও প্রবল। আকবরের আমলে রাজশক্তির প্রশ্রয়ে তা আরো বেড়ে গেল। আকবরের রাষ্টচেতনা ছিল সে যুগের পক্ষে অভিনব। তিনি রাজ্যের স্থায়িত্বের খাতিরে এক-জাতিতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে স্বধর্ম ও সংস্কৃতি ত্যাগ করলেন। সম্রাটদের মধ্যে তিনিই প্রথম দাড়ি চাঁছলেন, রাজপুতদের মতো পোশাক পরলেন, দরবারে নানা হিন্দুয়ানী তথা রাজপুত আচার চালু করলেন আর সামাজিকভাবে হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক পাতলেন।

ইলাহি মত আসলে একজাতি এক রাষ্ট্র-তত্ত্বের বাস্তবায়নের উপায়রূপেই পরিকল্পিত। না ব্রাহ্মণ্য, না-ইসলামী আবহাওয়ায় মানুষ হলেন জাহাগীর। ফলে মুসলিম প্রজা-সাধারণের মধ্যে ধর্মানুরাগের অভাব লক্ষ্য করে কিছু সংখ্যক আলেম বাদশাহর ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য ব্যাখ্যায় আত্মনিয়োগ করলেন মোজাদ্দেদ-ই আফিসানি শেখ আহমদ সিরহিন্দ। এ আন্দোলন পুরুষ পরম্পরায় চলেছিল এবং সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। তারই ভাবশিষ্য ছিলেন শাহ ওয়ালী উল্লাহ। এঁর সংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানবুদ্ধি ইসলাম এবং মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রবোধের একটি আশ্চর্য সুন্দর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিল। কিন্তু পতন-যুগের শিথিল-চরিত্র মুসলমান সমাজে তা বিশেষ কার্যকর হয়নি। তারপর কিছুকালের মধ্যেই ঘুণে-ধরা। রাষ্ট্রশক্তির পতন অনিবার্য হয়ে উঠল। একদিন বাঙলা-বিহারে দণ্ডধর হল বিদেশী বেনে-শক্তি। ভারতের সর্বত্র ক্রমে খসে পড়তে লাগল দেশী শাসন-দণ্ড। তা পড়ল বটে; কিন্তু মুসলমান চরিত্র হারালেও মর্যাদা ও অভিমান হারায় নি তখনো। বৃটিশ মুসলমানের এই মনোভাব টের পেয়েছিল গোড়াতেই। তাই কার্যত দণ্ডধর হয়েও তারা নামত দেওয়ানই রইল বহুকাল। তারা জানত মুসলমান তাদের রাজশক্তি হিসেবে স্বীকার করতে চাইবে না। এরূপ ঘটনা আমরা ইতিহাসে আগেও দেখেছি; মুসলমানেরা তখত নিয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করেছে, কিন্তু কোনো হিন্দু প্রশ্রয় পায়নি। তাই মালিক কাফুর, গণেশ টিকতে পারেন নি আর জগৎশেঠ-রাজবল্লভ মসনদ দখল করতে সাহস করেন নি।

মুসলমান নিজেদের জীর্ণতার কথা বহুকাল টের পায় নি, যদিও মারাঠা, শিখ ও ইংরেজ কার্যত ভারতের মালিক হয়ে উঠেছিল। যখন টের পেল তখন সব শেষ হয়ে গেছে। তবু তারা নিঃশেষে ভেঙে পড়ে নি। হৃত রাজ্য ও গৌরব ফিরে পাবার সংগ্রামে তারা মেতে উঠল নতুন উদ্যমে। এবার নেতৃত্ব দিলেন সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী। ইনি ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভাবশিষ্য এবং আরবের সংস্কার-নেতা মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের মতবাদে মুগ্ধ। মুসলমান আমলে যা ছিল একান্ত ধর্ম-সংস্কারান্দোলন, তা-ই এখন ধর্মসংস্কারের আবরণে রূপ নিল আযাদী সংগ্রামের। তাঁরও যতটা ইসলামী জোস্ ছিল, রাষ্ট্রনীতিক দৃষ্টি ততটা ছিল না। তাই তিনি ঘরের পাশের বৃটিশকে শত্রু ভাবলেন না, যুদ্ধ করতে গেলেন বালাকোটে ক্ষয়িষ্ণু শিখ-শক্তির বিরুদ্ধে। ভাবী শত্রু শিখ এভাবে হতবল হচ্ছে দেখে সৈয়দ আহমদের প্রতি হয়তো বৃটিশ সহানুভূতিশীল ছিল। পরে নানা সঙ্গত কারণেই ওহাবীরা বৃটিশ বিরোধী হয়। আযাদী সংগ্রামে মুসলমানদের আত্যন্তিক উত্তেজনা দানের জন্যেই তিনি ভারতকে দারুলহরব বলে ঘোষণা করেছিলেন। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সদিচ্ছা ছিল; কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টি ছিল না। তাই তলিয়ে দেখবার বা বুঝবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর মোকাবেলা করবার এতটুকু যোগ্যতাও আর মুসলমানদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। যোগ্যতা বা কৌশল ছাড়া কেবল মনের বলে কিংবা গায়ের জোরে কিছু হবার নয়। এই সামগ্রিক দূরদৃষ্টির অভাবে তাঁর সাধনা ও সংগ্রাম ব্যর্থ হল। যদিও আযাদী-লুব্ধ গাঁয়ের তরুণও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই যেহাদে। স্বেচ্ছায় প্রাণ দিয়েছে হাজার হাজার আযাদীমত্ত তরুণ। একই কারণে ব্যর্থ হল বাঙলা দেশে তাঁর শিষ্য তীতুমীরেরও সগ্রাম।

সৈয়দ আহমদ ও তীতুমীরের শাহাদতের পরেও চেষ্টা চলেছিল সংগ্রাম চালিয়ে যাবার। কিন্তু বৃটিশের ভয়ে বিত্তবানেরা ওহাবীদের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাদের বিরত হতে হল। কিন্তু ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন তারা ত্যাগ করে নি; ফলে অন্তত বাঙলা, বিহার ও সেকালীন উত্তর ভারতে শরীয়তী ইসলাম দৃঢ়মূল হল। এও একটা বড় লাভ। বাঙলা দেশে এ আন্দোলন বিশ শতকের প্রথম দুদশক পর্যন্ত বেশ প্রবলভাবেই চলেছিল, তার রেশ কোনো কোনো অঞ্চলে যেমন চাটগাঁয়ে ও উত্তরবঙ্গে এখনো বর্তমান। এ ক্ষেত্রে কেরামত আলী, হাজী শরীয়ৎ উল্লাহ, দুদুমিয়া, ইমামুদ্দিন, মুন্সী মেহেরুল্লাহ প্রমুখের কৃতিত্ব এবং আহলে হাদীস, শর্ষিনা ও ফুরফুরার প্রভাব স্মরণীয়।

বাঙলা দেশে যাকে ফকির বিদ্রোহ বলে, উত্তরবঙ্গে মজনু শাহর নেতৃত্বে সেই অবাধ লুটতরাজও বৃটিশ-বিরোধী মনোভাব প্রকাশের বা বৃটিশশাসন অস্বীকারের প্রচেষ্টামাত্র। এক শ্রেণীর আলেমের মতে বিজাতি ও বিদেশী রাজের শাসন অমান্য করা ও দেশের বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রাখা মোমেনের কর্তব্যেরই অঙ্গ। মজনু শাহ ও তাঁর অনুচরদের মনে এ শিক্ষাই ক্রিয়া করেছিল। তাই তাদের আচরণ ও কাজের পশ্চাতে এই আদর্শই সক্রিয় ছিল। ঢাকার সরফরাজ খান, বীরভূমের আসাদুজ্জামান খান, মুর্শিদাবাদের উজীর আলী প্রমুখের বিদ্রোহও মুসলমানের আযাদী-উদ্যমের সাক্ষ্য বহন করছে। আজিমুদ্দিনের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ও অর্থপূর্ণ ভূমিকাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। অতএব দেখা যাচ্ছে, নদীর পাড়ভাঙার মতই অতর্কিতে যখন আযাদী গেল, তখন মুসলিম মনে জাগল এক অসহ্য গ্লানিবোধ এবং তা-ই লাভ-ক্ষতির পরওয়াহীন বিক্ষোভে, বিরোধিতায় ও সংগ্রামে রূপ পেল।

এদিকে বাঙলাদেশে ইংরেজ সুকৌশলে সরকারি দপ্তর থেকে মুসলিম তাড়ন শুরু করে দিল। এতে শাসন পরিচালনে কোনো অসুবিধেও হল না তাদের। গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলিম নিয়োগ ছিল নিষিদ্ধ। পুরোনো আমলা অবসর নিলে তার পদে হিন্দুই নিযুক্ত হত। নতুন প্রভুর অযাচিত অনুগ্রহে আপুত হিন্দুসমাজ সোৎসাহে ইংরেজিও শিখতে লাগল। ফলে ১৮২০ খ্রীস্টাব্দের দিকে মুসলিম-শূন্য হল সরকারি দপ্তর। কাজেই ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে ইংরেজিকে দরবাবি-ভাষা রূপে চালু করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। মুসলিম কাযীর পদও বাতিল হল ১৮৩৮ খ্রীস্টাব্দে।

আমরা মুখে যাই বলি না কেন, আসলে লেখা-পড়ার মুখ্য উদ্দেশ্য চাকরি- এক কথায় লেখাপড়াও বৃত্তিমূলক। চাকরির আশা নেই দেখে অভিভাবকদের কাছে সন্তানদের লেখাপড়ার কোনো গুরুত্ব রইল না, এভাবে লক্ষ্যহীন-ভরসাহীন শিক্ষা চলতে পারে না।

তার উপর ১৮২৮ খ্রীস্টাব্দে জনহিতকর দাঁতব্য লাখেরাজ আয়েমা বাজেয়াপ্ত হওয়ায় মুসলমানের শিক্ষার পথও হয়ে গেল রুদ্ধ। এরূপে মুসলমানদের শেষ আশা এবং আশ্রয়ও নষ্ট হল। কাজেই ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দের দিকে অশিক্ষিত কুলি-কাঙালে পরিণত হল মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা। এভাবে যে দুর্ভাগ্যের দুর্দিন নেমে এল তা সুদীর্ঘ ষাট-সত্তর বছরকাল স্থায়ী হয়েছিল, তারপর ক্রমে ক্রমে সুদিনের সূর্যরশ্মি দেখা দিতে থাকে।

পলাশীর প্রান্তরে জয়লাভ করে ইংরেজরা দেশের ভাগ্যবিধাতা হল বটে, কিন্তু তারা এদেশ শাসন করবে কি শোষণ করবে, তা তখনই স্থির করতে পারে নি। মনস্থির করতে পুরো পঁচিশটি বছর লেগেছিল তাদের। অবশেষে সাব্যস্ত হল তারা শাসন ও শোষণ দু-ই সমানে চালিয়ে নেবে। এসবের চমকপ্রদ দলিল ও বিবরণ পাওয়া যাবে ডক্টর ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের Early Administrative System of East India Company নামক মূল্যবান গ্রন্থে। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেই শাসন-শোষণের সুবিধার জন্যে ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে সরকার যে নতুন ভূমিস্বত্ব ও রাজস্বব্যবস্থা চালু করে, তাতে কাঁচা মুদ্রার অভাবে অভিজাত মুসলমানেরাও জমিদাবি ক্রয় করে সম্পদশালী থাকতে পারল না।

১৮৫৭-৫৮ খ্রীস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবে ওহাবী আন্দোলনের মনোভাবও যে সহায়তা করেছিল, তা অবশ্যস্বীকার্য। সিপাহী বিপ্লবকালে স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজ-পক্ষে ছিলেন। এই দূরদর্শী মনীষীই প্রথম উপলব্ধি করলেন, হিন্দুরা যখন বৃটিশের সহযোগিতা করছে, তখন মুসলমানদের এই বৃটিশ-বিদ্বেষ, অসহযোগ ও সগ্রাম আত্মধ্বংসী বই কিছুই নয়। এই সর্বনাশ থেকে উদ্ধারের উপায়। হিসেবে বৃটিশ-প্রীতি ও সহযোগের মনোভাব সৃষ্টির জন্যে তিনি মুসলিম সমাজে প্রচারণা চালাতে লাগলেন। তাঁর মতবাদ মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজে অভিনন্দিত হল। তখন থেকেই মুসলমানেরা আচরণে বৃটিশ-বিদ্বেষ ত্যাগ করে এবং অভিমান ছেড়ে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু তখন কাঙাল মুঠে-মজুরের সমাজে ইংরেজি শেখার গুরুত্ব বুঝবার ও ব্যয়ভার বহন করবার মতো যোগ্যতা আর বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না, তাই অর্ধশতাব্দীকালের মধ্যেও বিশেষ কোনো ফল দেখা গেল না।

এ সময় থেকেই শিক্ষিত হিন্দুসমাজে স্বাজাত্য ও অধিকারবোধ জাগতে থাকে। ফলে বৃটিশ সরকার এখন থেকে মুসলমানের প্রতি প্রসন্ন ও হিন্দুর সম্পর্কে সতর্ক হতে থাকে।

আমরা মুসলিম মনের বিক্ষোভ, বৃটিশ-বিদ্বেষ ও ইংরেজি বর্জনকে মুসলমান-জাতির বোকামি বলব না; মর্যাদাবান মানুষের মতো তারা নির্ভীকচিত্তে ও সমুন্নত শিরেই দুর্ভাগ্যকে জয় করতে চেয়েছিল। বাইরের দাসত্ব তখনো তাদের মনের মহিমাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। কারণ আত্মসচেতন ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ মাত্রেরই কাছে জানের চেয়ে মান বড় এবং তার চাইতেও বড় স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা হারিয়ে যদি তারা লাভ-ক্ষতির বেনেসুলভ খতিয়ান তলিয়ে না দেখে, তবে তাদের ব্যবহারিক জীবনের লোকসান যত বেশিই হোক না কেন, অন্তৰ্জীবনের ঐশ্বর্যের প্রভাব আমাদের আনন্দিত করে। অবশ্য ক্ষতি যা হল, তা অপরিমেয় এবং এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ যুগেও আমাদের পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় লাগবে।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে ১৮৬০ থেকে ১৯৪৭ সন অবধি সাধারণভাবে ইংরেজি শিক্ষিত অভিজাত ও নেতৃস্থানীয় মুসলমানেরা বৃটিশবিরোধী ছিল না। কিন্তু আরবি-ফারসি শিক্ষিত মুসলমানদের আযাদী স্পৃহা এতই তীব্র ছিল যে, আযাদী লাভের আশায় মৌলবী-মোল্লারাই সাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন কাফের বলে নিন্দিত হিন্দুদের সঙ্গে। এঁরা শেষ অবধি কংগ্রেস-পন্থী তথা হিন্দু মুসলিমের একজাতীয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন। কংগ্রেস, খেলাফত সমিতি বা মুসলিম লীগের আহ্বানে অশিক্ষিত নিঃস্ব মুসলমান যেভাবে অকপট সাড়া দিয়েছিল, অশিক্ষিত অমুসলমান কোনোদিন স্বাধীনতা সগ্রামে সেভাবে সাড়া দেয়নি।

বিশ্বাসের অঙ্গীকারে জন্মায় ধর্মবোধ। আস্তিক মানুষের জীবন চালিত হয় ধর্মবিশ্বাসের আনুগত্যে। এবং ধর্মমাত্রই পুরোনো। কাজেই আস্তিক মানুষ জীবনযাত্রার নীতি-আদর্শ খোঁজে অতীতে। এমন মানুষ পরিবেষ্টনীকে অবহেলা করে এবং দেশ-কালের চাহিদা ও প্রভাব এড়িয়ে আদর্শ জীবনের অদ্ভুতস্বপ্ন রচনা করে স্বস্তি পায়। সম্মুখদৃষ্টিকে পশ্চাতে নিবদ্ধ করার মতো কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় নিহিত থাকে তাদের ব্যর্থতার বীজ। ইসলামের উদ্ভবযুগের ঋজু অবিকৃত ধর্মবিশ্বাসই আরবদের দিগ্বিজয়ী করেছিল–মুসলমানেরা এ-কথা ভুলতে চায় নি। এবং একেই আত্মোন্নয়নের একমাত্র ও ধ্রুব উপায় বলে মেনেছে। তাই ধর্মবোধের মাধ্যমে মুসলমানদের প্রেরণাদানের ও পতনরোধের চেষ্টা হয়েছে সর্বত্র। পাক-ভারতের ইতিহাসের ধারায় আমরা তাই বারবার একই আহ্বান শুনেছি, শেখ আহমদ সিরহিন্দী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, তিতুমীর, কেরামত আলী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদুমিয়া, হালী-ইকবাল-জলন্ধরী-ফররুখ প্রভৃতি ধর্মবেত্তা, সমাজনেতা ও কবি-দার্শনিকের মুখে। ওহাবী-ফরায়েজীর পিউরিটানিক গোঁড়ামির তথা গ্রহণবিমুখতা ও বর্জন-প্রবণতার কারণও ছিল এ-ই। কল্যাণচিন্তায় এঁদের আন্তরিকতা ছিল, কিন্তু কালিক জীবনচেতনা ছিল না, ছিল না স্থানিকবোধও। তাই তেরোশ বছর আগের মরুভূ আরব তারা কখনো অতিক্রম করতে পারেন নি।

আত্মপ্রত্যয়হীন মানুষ আত্মসংকোচনকেই আত্মরক্ষার উপায় বলে জানে। স্বশক্তিতে আস্থাবান মানুষ চারদিককার সবকিছু আত্মসাৎ করে হয় বড়ো। অতএব যদিও তাদের লক্ষ্য ছিল মহান কিন্তু সামর্থ্য ছিল সামান্য, মনন ছিল সীমিত এবং পথ ছিল ভ্রান্ত। গ্রহণ, বরণ, বর্জন ও সমন্বয় সাধনের মধ্যেই যে ব্যক্তিজীবনের বৃদ্ধি এবং জাতীয় জীবনের প্রগতি পন্থা নিহিত, তা বুঝিয়ে দেবার জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদের মতো আরো অনেক ব্যক্তিত্ব ও চিন্তানায়কের স্থানিক ও কালিক প্রয়োজন ছিল।

ওহাবী-ফরায়েজী আন্দোলন প্রবল হলেও সর্বশ্রেণীর লোকের যে এতে সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল না, তা না বললেও চলে। বিশেষ করে উচ্চবিত্তের অভিজাত মুসলমানের ভূমিকা এতে দুর্লক্ষ্য। ফলে ধর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমান সমাজের দারিদ্র-মুক্তি ও আযাদী স্বপ্ন সফল হয়নি। এমনকি তাঁদের প্রচেষ্টায় এদেশী মুসলমানের পতন পথ রুদ্ধ হয়েছিল বলেও প্রমাণ নেই। বরং ইংরেজ বিদ্বেষহেতু ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের বিরূপতা মুসলিম মধ্যবিত্ত ঘরে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। ফলে অর্থাগমের পথ রুদ্ধ রইল দীর্ঘদিন। এমনকি এই বিরূপতা বশে মাদ্রাসায়ও নাম-ঠিকানা লেখা ও পড়ার জন্যে ইংরেজি হরফও শেখানো হয় নি। অথচ প্রশাসনিক ভাষার সঙ্গে এই লৈপিক পরিচয় বৈষয়িক কারণেই জরুরী ছিল।

অবশ্য মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এতেই রোধ করা যেত না, যেমন জাত নষ্ট ও সমাজ বিচ্যুতিভয় হিন্দুদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ ও বিলেত গমন রোধ করতে পারে নি। কিন্তু এর বিস্তার মন্থর হল অন্য কারণে। হিন্দুসমাজে নিম্নবর্ণের মধ্যে যেমন, পুরুষানুক্রমে নিম্নবিত্তের দেশজ মুসলমানদের মধ্যেও তেমনি শিক্ষার ঐতিহ্য ছিল না। তারা বাঙলা বা আরবি শিক্ষাও গ্রহণ করে নি কোনোদিন। অতএব মসজিদ-কেন্দ্রী আরবি ফারসি শিক্ষায়ও তাদের কোনো কালে আগ্রহ ছিল না। নিরক্ষরতা ছিল সর্বব্যাপী। কেবল গায়ে গায়ে দু-চারটি লোক লেখাপড়া জানত। এরাই হত নায়েব গোমস্তা পীর-মুনশী-মুয়াজ্জিন। বিহারে-উত্তরপ্রদেশে উচ্চবিত্তের অভিজাত বেশি ছিল, তাই ওহাবী আন্দোলনের কেন্দ্র হয়েও সেখানে ইংরেজি শিক্ষা প্রসার লাভ করেছিল এবং বাঙলার উচ্চবিত্তের অভিজাত মুসলমানরা ও রাজসরকারের পদস্থ কর্মচারীরা ছিল অবাঙালি। তাঁদের অধিকাংশই সিরাজদ্দৌলা-মীরকাশেমের পতনের পর উত্তর বিহারে ও উত্তর ভারতে চলে যায়। আর যারা নানা কারণে রয়ে গেল, তারা গোড়া থেকেই ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করছিল। তাদের এবং দেশী মধ্যবিত্ত মুসলমানের সংখ্যা ছিল নগণ্য। আবার পড়তে গেলেও পড়া হয় নি অধিকাংশের। তাই ব্রিটিশ আমলে বাঙলার মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়েনি। আবার মৌলানা কেরামত আলী, ইমামুদ্দিন প্রভৃতি ধর্ম-সংস্কারকদের প্রবর্তনায় চট্টগ্রাম বিভাগে আরবি শিক্ষা বিস্তার পায়।

আঠারো শতকের শেষার্ধ থেকেই য়ুরোপে দৈশিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। উনিশ-বিশ শতকে ঘটে তার উগ্রবিকাশ এবং পৃথিবীব্যাপী বিস্তার। এর আগে ধর্মীয় ঐক্যবোধ ভিত্তিক একপ্রকার জাতীয়তাবোধ মানুষের ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবমুক্ত এদেশী হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ ছিল প্রবল। এমনকি প্রতীচ্য শিক্ষার আলো প্রাপ্ত অনেক চিন্তাবিদ মনীষী-কবি-সাহিত্যিকও এ সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন না। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-স্যার সৈয়দ আহমদ-আমীর আলী প্রভৃতি অনেকের জাতি-চেতনা এ সূত্রে স্মর্তব্য। তাই সে-যুগে দৈশিক জীবন-চেতনা ছিল দুর্লভ। ভৌগোলিক পরিবেষ্টনীগত জীবনের ও প্রয়োজনের অস্বীকৃতিতে হিন্দু আত্মত্রাণের প্রেরণা খুঁজেছে স্বধর্মে ও উত্তরভারতের বৈদিক, রাজপুত ও মারাঠা ঐতিহ্যে এবং মুসলমানও ত্রাণ সন্ধান করেছে তার স্বধর্মে ও আরব-ইরানে। এটির নাম স্বাধর্ম– প্যান হিন্দুইজম ও প্যান ইসলামইজম। ফলে মধ্য ও উচ্চবিত্তের হিন্দু-মুসলমান নানা কাজে একত্রিত হয়েছে কিন্তু তাদের মিলন হয় নি। যদিও তারা একই হাটে বেচা-কেনা করেছে একই বাটে হেঁটেছে, একই মাঠে ফসল তুলেছে, একই বন্যায় পীড়িত হয়েছে এবং মরেছে একই মহামারীতে। তারা পাশাপাশি বসেছে, ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়েছে,– বাইরে সর্বত্র মিলেছে, সহযোগিতা করেছে, অন্য সব কিছুই দেয়া-নেয়া করেছে, মনটাই কেবল দেয়া-নেয়া করে নি, তারা মনটা ফিরিয়ে রেখেছিল দেশবহির্ভূত ধর্মের ও ঐতিহ্যের আনুগত্যবশে। ওটার নাম স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধর্ম যার অপর নাম দেশকালহীন আদর্শিক জাতীয়তা। কিন্তু এই আদর্শিক জাতীয়তা কোন্ শ্ৰেয়সের সন্ধান দিয়েছে!

ইতিহাস পাঠকের দু-একটি জিজ্ঞাসা

এ যুগের মতবাদের মতোই ধর্মমাত্রেই কোনো বিশেষ অঞ্চলের মানুষের বিদ্রোহ-বিপ্লবের দান। কোন বিশেষ অঞ্চলের মানুষের সামাজিক, আর্থিক নৈতিক কিংবা প্রশাসনিক বিপর্যয়ের প্রতিকারকল্পে জ্ঞানী-মনীষীর চিন্তা ও প্রয়াস প্রথমে মনন-বিপ্লবরূপে এবং পরে জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে দ্ৰোহরূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিপ্লব-বিদ্রোহের অবসানে দ্রোহীদের জয়ে তাদের পরিকল্পিত ও অনুসৃত নিয়ম-পদ্ধতি ও নীতি-আদর্শ পরিণামে নবধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। বিপ্লবের আগুনে দগ্ধ হয়ে মানুষ সোনার মতোই জীবনে পায় লাবণ্য, মননে পায় ঔজ্জ্বল্য। সে তাপ অবসিত হলে আবার নেমে আসে গ্লানি। ম্লান হয়ে উঠে সমাজ-সংস্কার। নবতর অভাব ও প্রয়োজনবোধ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় মাথা উঁচু করে। নতুন ভাব-চিন্তা ও আয়োজন-বুদ্ধি নিয়ে পূরণ করতে হয় প্রয়োজন। উদ্ভব হয় নতুনতর ধর্মের। যারা প্রয়োজন-সচেতন ও আয়োজনে তৎপর তারা তরে, আর যারা প্রয়োজন মতো আয়োজনে অসমর্থ তারা মরে।–এ-ই প্রকৃতির নিয়ম। তাই ধর্মের অকারণ উদ্ভব যেমন নেই, তেমনি নেই কালান্তরে তার উপযোগ। হৃত-উপযোগ ধর্ম কালান্তরে প্রাণের প্রেরণা নয়, জীবনের অবলম্বন নয় সমাজের উপসর্গ–প্রগতির অন্তরায়।

স্বদেশে ধর্মমাত্রেই জীবন-চেতনারই প্রতিরূপ। তাই স্বদেশে যে-নতুন ধর্ম Practice, দেশান্তরে তা theory মাত্র। স্বদেশে যা real, দেশান্তরে তা-ই ideal এবং কালান্তরে তা। একটা idea, একটা কল্পনাসাধ্য Philosophy-র বেশি নয়। মানুষের সামান্য ধর্মের সাদৃশ্যবশে অঞ্চললাদ্ভূত ধর্ম দেশান্তরে প্রসার লাভ করে বটে, কিন্তু জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তা সম্পদ ও সম্বল হয়ে ওঠে না। যেহেতু তা theory হিসেবেই মন ভোলায়, তাই দেশান্তরে ব্যাপ্ত ও কালান্তরে স্থিতি পায়। কিন্তু ধর্ম যেখানে বাস্তব জীবনে সমস্যার সমাধান রূপে উদ্ভূত, সেখানে তা কালান্তরে হয় বিলুপ্ত। পশ্চিম এশিয়ার হযরত ইব্রাহিম থেকে হযরত ঈসা অবধি সকল চিন্তানায়ক। প্রবর্তিত ধর্ম-সমাজ এভাবে হয়েছে নিশ্চিহ্ন। স্বদেশে জরথুস্ত্রীর-জৈন-বৌদ্ধধর্মের পরিণামও স্মর্তব্য।

দেশ-কালের প্রতিবেশে উদ্ভূত বলেই তথা সামাজিক-নৈতিক-আর্থিক কিংবা প্রশাসনিক সমস্যার সমাধানের তাগিদজাত বিপ্লব-বিদ্রোহ প্রসূত বলেই ধর্ম তার উদ্ভব ক্ষেত্রের মানুষকে দেয় আত্মপ্রকাশের প্রেরণা ও আত্মবিস্তারের শক্তি। ইসলামের উদ্ভবে মরুভূ মক্কা-মদিনার জনগণ একদিন এমনি জীবন-স্বপ্নের বাস্তবায়নে বন্যার বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল অমোঘ শক্তিরূপে। চারদিককার ভুবন এলো তাদের দখলে। সিরিয়া-ইরাক-ইরান-মিশর-মরোক্কো-স্পেন-সিন্ধু-তুরান প্রভৃতি কত কত দেশ এল তাদের হাতে। পাঁচশ বছর ধরে চলল তাদের শাসন। পরিবর্তিত পরিবেশে তাদের ইসলামী প্রেরণা গেল উবে। মক্কা-মদিনার ঐতিহাসিক ভূমিকার হল অবসান। স্বদেশী ধর্ম মক্কা-মদিনার লোককে দিল ঐশ্বর্য ও সম্মান, করল শাসক, আর দেশান্তরে দীক্ষিত মুসলমানদের রাখল পরপদানত। স্বদেশে ইসলামের মুখ্যদান জিগীষা। কিন্তু দেশান্তরে দীক্ষিত মুসলমানদের মক্কা-মদিনাবাসীর মতো জিগীষু করেনি ইসলাম। অতএব দেশান্তরে ও কালান্তরে ধর্ম যে মানুষের জীবন-প্রয়াসে প্রেরণার উৎস হতে পারে না– কেবল আচার ও আচরণই নিয়ন্ত্রণ করে,–এ তথ্য ও তত্ত্ব নতুন প্রত্যয়ে গ্রহণ করা আবশ্যিক। নইলে বিভ্রমমুক্ত পথ মিলবে না এগুবার।

প্রায় আড়াইশ বছর ধরে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আবদুল আজিজ, আবদুল কাদির সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, বেলায়েত আলী, তিতুমীর, মক্কার মুহম্মদ ইবন্ আবদুল ওহাব, জামালউদ্দিন আফগানী, শরীতুল্লাহ, দুদুমিয়া, কবি হালী, কবি ইকবাল প্রমুখ বহু জ্ঞানী, মনীষী, চিন্তানায়ক ও দেশনেতা দুনিয়াব্যাপী মুসলমানদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, ধর্মনিষ্ঠা ও ধর্মাচারহীনতাই জাতীয় উত্থান ও পতনের কারণ। ইতিহাসের সমর্থন বিহীন এই ধারণায় গলদ ছিল বলেই তাদের প্রয়াস কোথাও সফল হয় নি। গত আড়াইশ বছর ধরে ধর্মীয় প্রেরণার মাধ্যমে তথা ধর্ম-সংস্কারের পন্থায়। মুসলমানদের উন্নতি বা আযাদী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বার বার। ধর্মের নামে তথা ধর্মভাবের মাধ্যমে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক উন্নতি লাভ করতে হলে দেশজ নতুন ধর্মের প্রয়োজন। কেননা দেশজ নতুন ধর্মই কেবল প্রাণে দিতে পারে প্রেরণা, বাহুতে দিতে পারে বল।

এ কারণেই সুলতান মাহমুদ থেকে আরম্ভ করে নওয়াব সিরাজদ্দৌলা অবধি সাতশ বছরের মধ্যে আমরা জ্ঞানী-গুণী কিংবা রাজা-বাদশা বা পদস্থ দেশী মুসলমান পাইনে। বহিরাগত নবধর্ম তাদের জীবনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল বলে প্রমাণ নেই। অথচ ভারতে অমুসলমানেরা রাজসরকারে যথাযোগ্য পদও পেয়েছেন, আবার স্বাধীন রাষ্ট্রও গড়ে তুলেছেন একাধিক। আর জ্ঞানী-মনীষীর তো কথাই নেই।

ভারতের অধিকাংশ মুসলমান নিম্নবর্ণের ও বিত্তের হিন্দু-বৌদ্ধ থেকে দীক্ষিত হলেও উচ্চবর্ণের লোকও নগণ্য ছিল না। তাদেরও তো কোনো দান ও উন্নতি জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সুলভ নয়। অতএব এর কারণ খুঁজতে হবে অন্যত্র।

আমরা দেখেছি মধ্য এশিয়ার নানা গোত্রীয় লোকই ভারতে আধিপত্য করেছে। তুর্কী-মুঘল ইরানীরাই দখল করেছিল রাজ-সরকারের সব উচ্চপদ। এজন্যে শাসকদের এ-দেশী স্বজাতির সহযোগিতা দরকার হয় নি। ফলে অমুসলমানের অংশ দেশী অমুসলমানেরা পেয়েছে এবং মুসলমানের অংশ সাতশ বছর ধরে ভোগ করেছে তুর্কী-মুঘল-ইরানীরাই। এভাবে বঞ্চিত রইল দেশী মুসলমানেরা। পদলাভের পথ রুদ্ধ ছিল বলেই হয়তো তাদের শিক্ষার প্রেরণাও ছিল না– ছিল না ধনাগমেরও সহজ উপায়। তাই অর্থে-বিত্তে কিংবা বিদ্যায় তারা সমাজের উঁচুস্তরে উঠতে পারে নি কখনো। এখনকার দিনে যেমন পূর্ব পাকিস্তানে কল-কারখানা গড়ে উঠেছে অনেক, কিন্তু মালিকানা রয়েছে অবাঙালির হাতে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান সমৃদ্ধ হচ্ছে, কার্যত বাঙালির দুঃখ ঘোচে নি। ঠিক এমনি অবস্থা ছিল ব্রিটিশ-পূর্ব যুগেও। দেশে ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু সে ঐশ্বর্য ছিল বিদেশাগত মুসলিমদের হাতে। আমাদের এ ধারণার পরোক্ষ সমর্থন পাই আরাকানের ইতিহাসে। সাময়িক বিচ্যুতি থাকলেও ১৬৬৫ সন অবধি চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অংশ। সেখানে তুর্কী-মুঘল-ইরানীর স্থায়ী প্রভাব ছিল না বলেই চট্টগ্রামবাসী বাঙলাভাষী বাঙালি মুসলমান রোসাঙ্গের শাসনকার্যে তাদের যথাযোগ্য স্থান পেয়েছে। তাই আমরা সতেরো শতকে আশরাফ খান, শ্রীবড় ঠাকুর, সৈয়দ মুসা, সোলায়মান, মাগন ঠাকুর, নবরাজ মজলিস প্রভৃতি দেশী মন্ত্রী পাই।

ইংরেজ আমলে দেশী খ্রীস্টানের ক্ষেত্রেও আমরা এমনি এক বিশেষ অবস্থা লক্ষ্য করি। ব্রিটেন থেকে স্বজাতি আনয়ন সম্ভব না হলে ইংরেজরা দেশী খ্রীস্টানকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে আশ্বস্ত হত, কিন্তু তেমন কোনো প্রয়োজন না হওয়ায় যদিও প্রচারকদের উৎসাহে ও তৎপরতায় খ্রীস্টান হয়েছে অনেক, কিন্তু শাসকের স্বজাতি বলে অনুগ্রহ পেয়েছে সামান্য। স্বজাতির পোষণে তাদের আত্মবিকাশ ছিল দুর্লক্ষ্য।

কাজেই সময় এসেছে নতুন দৃষ্টিতে ইতিহাস পাঠের। তুকী-মুঘল মুসলিম শাসনে আর্থিক, শৈক্ষিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দেশী মুসলমানের সুযোগ ও সুবিধা, অবস্থা ও ভূমিকা, কৃতি ও সংস্কৃতি কী ছিল তা যাচাই করা প্রয়োজন। আমরা সাদা চোখে দেখছি পল্লী-আগ্রায় কিংবা দক্ষিণাত্যে অথবা গৌড়-সোনার গা-ঢাকা-মুর্শিদাবাদে পদস্থ দেশী মুসলমান অনুপস্থিত।

বাংলা দেশের ইতিহাসের যে-অংশের বিস্তৃত বিবরণ আমাদের হাতে এসেছে সে-অংশেও অর্থাৎ নওয়াবী আমলেও আমরা খাঁটি দেশজ বাঙালি পাইনে। বিদেশী মামলুকের মর্যাদা আর সুযোগও পায় নি দেশী গেরস্থ। উত্তর ভারত থেকে আগত ব্যক্তির পুত্র হুগলীবাসী জাস্টাস সৈয়দ আমীর আলী নওয়াবী আমলের বাংলার উচ্চ বর্ণের মুসলমানদের বংশধর সম্পর্কে বলেছেন,

These are called Hidustanis and few of them ever understand Bengali. In most of the districts of upper Bengal, such as Beerbhoom, Midnapur, Dinajpur, Maldah, Purneah and to some extent the English district of twenty four pergunnahs, the Mohammedans speak urdoo, though not with the same purity as a native of Lucknow or Delhi, and know only enough of Bengali for the purposes of social intercourse with their Hindoo neighbours.

নওয়াবী আমলে এই বহিরাগত মুসলমান বড় চাকুরেরা ও তাদের পরিজনেরা (This class of Muslims) treated the language of the subject races with contempt….. they were as ignorant of native vernaculars as any English administrator of the day.

এও সত্য যে সিরাজদ্দৌলা-মীর কাসেমের পতনের পর বিদেশাগত অনেক অভিজাতই উত্তর ভারতে চলে যায়, যারা নানা অসামর্থে যেতে পরে নি, সেই স্বল্প সংখ্যক পরিবারের কথাই বলেছেন সৈয়দ আমীর আলী ও ডক্টর মল্লিক।

অতএব, এই তুর্কী-মুঘল-ইরানী অবতংসরা ইংরেজ প্রশাসকদের মতোই সযত্নে স্বাতন্ত্র রক্ষা করেই প্রজা-সাধারণের সুখ-দুঃখ করেছিলেন প্রত্যক্ষ, আর পীড়ন-শোষণ চালিয়ে ছিলেন সর্বপ্রকার ছোঁয়া বাঁচিয়ে। দেশী খ্রীস্টান ও গোরা খ্রীস্টানের যেমন রয়েছে সমাজে ও ধর্মশালায় স্বাতন্ত্র, তেমনি শাসক ও শাসিত মুসলমানে ছিল দুস্তর ব্যবধান। সে-স্বাতন্ত্রের প্রাচীর অতিক্রম করে সাতশ বছরেও মিলতে পারে নি তারা। তাই রাজদরবারের বিদেশী মামলুক আর হাবসী দাসেও বর্তেছে তখৃতের অধিকার, হিন্দুরও ছিল বিদ্রোহের সুযোগ, কেবল দেশী মুসলমানেরই ছিল না পাত্তা। এখানে হাসান গঙ্গা বাহমন, ঈশা খান, কালা পাহাড়, মালিক কাফুর, মালিক খসরু, জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ (যদু) প্রভৃতি দেশী হিন্দুর বংশধরদের দৃষ্টান্ত দেওয়া হবে অসঙ্গত। কেননা, তাঁরা হিন্দু হিসাবেই বড়ো হয়েছিলেন অথবা ছিলেন বড়ো হিন্দু পরিবারের সন্তান।

দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস লেখক ডাব্লিউ. এ. হান্টারের ভূমিকা ছিল অনেকটা পশ্চিম এশিয়ার টি, ই, Lawrence-এর মতোই। মুসলিম মনে হিন্দু-বিদ্বেষ ও ব্রিটিশ-প্রীতি জাগানোর অভিনব কৌশল হিসেবে চমকপ্রদ নানা বানানো কথা তিনি তথ্যের আকারে সাজিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। একশ বছর ধরে মুসলমানরা তাই কপচিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। এ-গ্রন্থে যদি কোনো সত্য থেকেও থাকে তবে তা বিদেশাগত শাসকশ্রেণী সম্পর্কেই প্রযোজ্য–দেশী মুসলমান সম্পর্কে নিশ্চিতই নয়।

তাছাড়া নওয়াবী আমলের বাঙলা কখনো ১৯০৫ সনের পরবর্তীকালের ভৌগোলিক বাঙলা ছিল না। বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যা মিলেই বাঙলা, অন্তত সিরাজুদ্দৌলার বাঙলা ছিল বাঙলা-বিহার। আর তা ১৯০৫ সন অবধি ছিল স্থায়ী। কাজেই একালের বাঙলার ইতিহাস চর্চায় বিহারকে বাদ দেয়া যায় না। পলাশী-উত্তর বাঙলায় হিন্দু ও ইংরেজের ভূমিকা ও তাদের শাসন-পীড়ন কিংবা পোষণ-শোষণ নীতি বাঙলা-বিহারে সমভাবে ছিল কার্যকর। বিহারকে বাদ দিয়ে কোম্পানী আমলের বাঙালি মুসলমানের বিত্তবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে-সব কথা ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্যরূপে চালু রয়েছে, তা ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসার ফল নয়, হান্টার শ্রেণীর ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রশাসনিক প্রয়োজনপ্রসূত দান, সাম্রাজ্যিক নীতি প্রেরণাপ্রসূত বিশ্লেষণ। এজন্যে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বাঙালি মুসলমানের তথাকথিত অনীহা, লাখরাজ, আইমা, তঘমা, মদদ-ই মাশ ইত্যাদি হারানোর প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম প্রভৃতি বিহারী মুসলিম-জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য।

তখন হয়তো দেখা যাবে ইংরেজের প্রতি বিরূপতা কিংবা ইংরেজির প্রতি অনীহাই বাঙালি মুসলমানকে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বিরত রাখে নি, শিক্ষার Tradition ছিল না বলেই তারা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠায় নি। অবশ্য উচ্চবিত্তের মুসলমানরাও যথাসময়ে সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে দিয়েছিল এবং তাদের অনেকের শিক্ষা পূর্ণতা পায় নি পরিবেশের অভাবেই। কেননা ইংরেজি শিক্ষা চালু হয়েছিল কোলকাতায়। সেখানে উচ্চবিত্তের মুসলমান ছিল অনেককাল অনুপস্থিত। কোলকাতা ও তার চার পাশের হিন্দুরাই পেয়েছিল ইংরেজি শিক্ষা প্রথমদিকে এবং ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ব্যতীত বৈদ্য, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানের কাছে ইংরেজি শিক্ষার দ্বার পারিবেশিক কারণেই রুদ্ধ ছিল বহুকাল। বিহারে বিদেশাগত মুসলিম অভিজাতের সংখ্যা ছিল বেশি, তাই ইংরেজি শিক্ষায় তারা পিছিয়ে পড়েনি।

কেউ কেউ মনে করেন, মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বিরূপতা ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবপ্রসূত। কিন্তু ওহাবী আন্দোলনের কেন্দ্র বিহার ও উত্তর প্রদেশে তৎসত্ত্বেও ইংরেজিশিক্ষা প্রসার লাভ করেছিল। আমরা জানি কোনো আন্দোলনের প্রভাবই সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী হয় না। মুসলিম সমাজে ওহাবী প্রভাবও সর্বাত্মক ছিল না। তাছাড়া, ১৮৬০ সনের পরে ওহাবী আন্দোলন স্তিমিত এবং সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুসলমান সমাজে ইংরেজ ও ইংরেজি প্রতি প্রবল হতে থাকে। তবু বিশ শতকের দ্বিতীয়পাদের আগে বাঙলার মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষা লক্ষণীয়ভাবে প্রসারলাভ করে নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কালাপানি পার হলে জাত-যাওয়া ও সমাজ-চ্যুতি নিশ্চিত জেনেও উনিশ শতকে কোনো হিন্দু বিলেত যাওয়ার সুযোগ ছাড়ে নি। ওহাবী প্রভাব নিশ্চয়ই হিন্দুর ঐ ধর্মীয় সংস্কার ও লাঞ্ছনাভীতির চেয়ে প্রবল ছিল না কখনো। আসলে নিম্নবর্ণের হিন্দুর যেমন, নিম্নবিত্তের মুসলমানেরও তেমনি লেখাপড়ার ঐতিহ্যই ছিল না।

ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুর নতুন বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক পরিবেশে অর্থাগম হল অপরিমেয়। বিত্তশালী শ্রেণী গড়ে উঠল তাদের নিয়ে। অন্যান্য হিন্দু ও মুসলমানের অবস্থা রইল অভিন্ন। তাদের দারিদ্রদুঃখ বাড়ল ভিন্ন কারণে। গ্রামীণ কৃষি-শিল্পজাত পণ্য বিনিময় (Bartar) নীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের প্রভাবে মুদ্রা বিনিময় (Money currency) রীতিতে পরিবর্তিত হওয়াতে আর্থনীতিক কাঠামোতে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া দেশের কৃষি-শিল্প নিয়ন্ত্রণের সাম্রাজ্যিক নীতির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিদেশী পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য হয় তারা। এভাবে আয়ের পথ হল রুদ্ধ-ব্যয়ের পথ হল বিস্তৃত। তাই দারিদ্র্য হল ক্রমবর্ধমান। অন্যদিকে বুর্জোয়া রাজত্বে ইংরেজি জানা হিন্দু দালাল-মুৎসুদ্দী-বেনিয়ান-চাকুরে বেতন, ঘুষ ও সুদের আকারে কাঁচামুদ্রা অর্জন করে ঐশ্বর্যবান হতে থাকে যখন, তখন বিদেশাগত মুসলমানের স্বল্পসংখ্যক বংশধর ছোট লোকদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে পৈত্রিক-সম্পত্তি-নির্ভর নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে মশগুল। কাজেই উচ্চবিত্তের ব্রাহ্মণ-কায়স্থের মতো বহিরাগত উচ্চবিত্তের মুসলমানও যে কোম্পানী রাজত্বের প্রসাদ পেয়ে ধনী-মানী শ্রেণীরূপে গড়ে উঠতে পারত, সে-সম্ভাবনা হল তিরোহিত। তাদের ঔদাসীন্যে হিন্দু বুর্জোয়া শ্ৰেণীই কেবল গড়ে উঠল-হিন্দু-মুসলিম মিশ্র বুর্জোয়া শ্রেণী আর গড়ে উঠতে পারল না। এবং এই শ্রেণীতে মুসলিম নামধারীর অনুপস্থিতিই ছিল ধর্মীয় স্বাজাত্যগর্বী বাঙালি মুসলমানের ক্ষোভের কারণ। কিন্তু বহিরাগত মুসলিম অবতাংসরা বুর্জোয়া বিত্তের অংশ পেলে দেশী মুসলমানের বাস্তব ও বৈষয়িক কী উপকার হত–কেবল জাতীয় গৌরব-গর্ব করবার মতো নির্বোধ আত্মপ্রসাদ পাওয়া ছাড়া। যে-কয়টি পরিবার ইংরেজ আমলের দুশ বছর ধরে জমিদার হিসেবে টিকে ছিল, তারা দেশী মুসলমানের শিক্ষা বিস্তারে কী সহায়তা করেছে, স্কুল-কলেজ গড়েছে কয়খানা, ছাত্রবৃত্তি দিয়েছে কয়টি! অবশ্য পার্থিব নেতৃত্ব এবং অপার্থিব পুণ্য অর্জনের জন্য দান করেছে প্রচুর-লিল্লাহ দিয়েছে বটে। এরাই আরব-ইরানের খোয়াব দেখিয়ে, সমরকন্দ-বোখারার স্মৃতি জাগিয়ে, উর্দুর মহিমা কীর্তন করে স্বস্থ হতে দেয় নি বাঙালি মুসলমানকে। বারবার বহির্মুখখা ও ছিন্নমূল করবার সচেতন প্রয়াসে তারা দেশী লোকের অগ্রগতির পথ করেছিল রুদ্ধ; দৈশিক জীবন-চেতনা প্রসারে দিয়েছিল বাধা। সে-প্রয়াসে আজো তাদের বিরতি-বিরাম নেই।

অতএব মুসলিম শাসনকালে বিদেশাগত মুসলিম চাকুরে ও অভিজাতদের দ্বারা দেশী মুসলমানের কী উপকার হয়েছিল, আর ইংরেজ আমলে এদের তমঘা, আইমা মদদ-ই মাশ ও জমিদারী বাজেয়াপ্তির বা হারানোর ফলে বাঙালি মুসলমানের কী ক্ষতি হল, তা আজ খুঁটিয়ে দেখবার-বুঝবার প্রয়োজন আছে। নতুবা স্বধর্মীকে স্বজাতি মনে করে অভিন্ন স্বার্থের সুবাদে আস্থা রাখার বিড়ম্বনা কখনো ঘুচবে না।

1. Syed Ameer Ali; A Cry from the Indian Mohammedans Nineteenth Century, London. August 1882, PP 199-200 as quoted by Dr. Muin-ud Din Ahmed Khan, Islamic Studies P.P. 284 Journal of the Islamic Research Institute of Pakistan Vol. VI no 3 for September, 1967.

2.. Dr. A. R. Mullick-British Policy and the Muslims in Bengal 1757 1856. Asiatic Society of Pakistan Publication 1961, Dacca P. 48.

চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা

প্রত্যেক মানুষেরই চলনে-বলনে-করনে নিজের মনের মতো নীতি-পদ্ধতি রয়েছে। অন্যকথায় বলা যায়, প্রত্যেকেরই জীবনে স্ব স্ব পছন্দসই মত ও পথ আছে। এর সাধারণ নাম আদর্শবাদ। Men are born-Philosophers বলে যে-কথাটি চালু আছে, তার সোজা অর্থ দাঁড়ায় প্রত্যেক মানুষই স্ব স্ব জগতে ও জীবনে দার্শনিক। এ দৃষ্টিতে দেখলে, কোনো আদর্শই মিথ্যা বা নিরর্থক বলে মনে হবে না। কাজেই প্রত্যেক আদর্শেরই ব্যক্তিক, স্থানিক ও কালিক উপযোগ থাকে। এ সূত্রেই স্বীকার করতে হয়, যে-কোনো আদর্শেরই সর্বজনীন ও শাশ্বত হবার যোগ্যতা নেই। এ কারণেই যুগে যুগে দেশে দেশে আদর্শবাদের জন্ম ও মৃত্যু হয়েছে।

আগেই বলতে চেয়েছি, আদর্শবাদ একান্তই উপযোগ-ভিত্তিক। এবং সে-উপযোগ কোনো অবস্থাতেই মানুষের বিচিত্র প্রয়োজনানুগ হতে পারে না। কেননা, এমন কোনো একক আদর্শ থাকা সম্ভব নয়, যা জীবন ও জীবিকার সর্বক্ষেত্রে ফলপ্রসূ। প্রয়োগ, প্রয়োজন এবং স্থান-কাল-ব্যক্তি ভেদে এর ফলাফলও বিভিন্ন ও বিচিত্র। কাজেই কোনো আদর্শই নিরঙ্কুশ কিংবা নির্ভেজাল ভালও নয়, মন্দও নয়। অতএব, আদর্শবাদের ক্ষেত্রে কোনো কিছু চরম কিংবা পরম বলে মনে করা কেবল অবাঞ্ছিত নয়, অকল্যাণকরও। এমনকি আল্লাহর দান–রোদ-বৃষ্টিও সব সময় সবার কাছে অভিপ্রেত নয়।

একটি দৃষ্টান্ত নিলেই আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট হবে। শারদীয় কিংবা বাসন্তী জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য ও উপভোগ্যতা সম্বন্ধে কারুর দ্বিমত নেই। তবু যে-ছেলেকে পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে হবে, জ্যোত্স যতই পর্যাপ্ত ও আকর্ষণীয় হোক না কেন–তাকে ঘরের কোণে দীপের আশ্রয় নিতেই হবে। বাহ্যত চাদে আর দীপে তুলনাই হয় না। তবু এ ক্ষেত্রে কেউ যদি ছেলেটিকে রুচিহীন নির্বোধ মনে করে, তা হলে নিশ্চয়ই তার প্রতি অবিচার করা হবে।

প্রতিবেশ ও প্রয়োজনমত আদর্শবাদের পরিবর্তন যে হয় বা হতে যে পারে তার আভাস একটি হাদিসেও আছে: তোমরা এখন এমন এক কালে আছ, যখন যেসব বিধি-নিষেধ তোমাদের জন্য নির্দেশিত হয়েছে, তার দশভাগের একভাগ অমান্য করলেও তোমরা ধ্বংস হবে, কিন্তু এমন যুগও আসবে, যখন এসব আদেশ-নির্দেশের দশভাগের নয়ভাগ অবহেলা করলেও তোমরা মুক্তি পাবে।

মূলত একটি অপরটির পরিপূরক হলেও আগেকার দিনে ধর্মাদর্শ, সমাজাদর্শ নৈতিকজীবনাদর্শ ও শাসনাদর্শের মধ্যে বাহ্যত সমন্বয়-সামঞ্জস্যের রূপ প্রায়শই প্রকট হয়ে উঠত না। তার কারণ, হয়তো তখনো বিজ্ঞতর মানুষেরও জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে পূর্ণদৃষ্টি ও সামগ্রিক ধারণার অভাব ছিল।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজান্দোলন ও রাষ্ট্র বিপ্লবের ফলে, মানুষের মধ্যে ক্রমে জীবনযাত্রার নানাক্ষেত্রের বৈচিত্র্যের মধ্যেও এক অখণ্ড জীবনচর্যার বোধ জন্মেছে। ফলে সামগ্রিক জীবনবোধ যেমন জেগেছে, তেমনি আবিষ্কৃত হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের জীবন জিজ্ঞাসা ও জীবন প্রচেষ্টার ঐক্যসূত্র।

আগেকার অবস্থায় তাই গড়ে উঠেছিল ধর্মের ক্ষেত্রে পুরোহিততন্ত্র, এবং সমাজের সঙ্গে মাতব্বরতন্ত্র; আর দেশ হয়েছিল রাজার রাজ্য। তাই এগুলো মূলত মানুষের জীবন-নিয়ন্ত্রী সংস্থা ও শক্তি হলেও ঐক্য ও সহযোগিতার অভাবে কোনো কোন ক্ষেত্রে প্রায়ই দ্বান্দ্বিকশক্তিরূপে দেখা দিয়েছে।

তাই রুশোর সামাজিক চুক্তি–যতই অপ্রাকৃত বোধ হোক, মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসার পথে যুগান্তকর উপলব্ধি। এতে মানুষের বোধের ক্ষেত্র হয়েছে প্রসারিত, জীবনের পরিপূর্ণ রূপ জানবার ও বুঝবার উদ্যম হয়ে উঠেছে দুর্নিবার।

এ বোধের সুসন্তান গণতন্ত্র। ব্যষ্টি দিয়ে সমষ্টি এবং ব্যষ্টির প্রয়োজনে সমাজ, ব্যষ্টির প্রয়োজনেই ধর্ম আর ব্যষ্টিস্বার্থে শাসন-সংস্থার প্রয়োজন–এ বোধ মানুষের অগ্রগতির মূল ভিত্তি। তা হলে ব্যষ্টির তথা ব্যক্তিক স্বার্থ সংরক্ষণই অর্থাৎ ব্যক্তিজীবনের নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন বিকাশের সুযোগদানের মৌল স্বীকৃতিই গণতন্ত্রের বুনিয়াদ।

অতএব কথা দাঁড়ায় : ব্যক্তিক জীবনে নিরাপত্তা ও সুযোগ লাভের জন্যেই মানুষ সমাজ গড়ে তুলেছে এবং ব্যক্তিক জীবন সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রণের জন্যেই ধর্ম-বিধির গরজ বোধ করেছে। আর ব্যক্তিক জীবন উপভোগের ও বিকাশের সহায়রূপে গঠন করেছে শাসনসংস্থা তথা রাষ্ট্র। এ যদি সত্য হয়, তা হলে এসব প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য ব্যষ্টির জীবন-যাপনে সুযোগ ও সহযোগিতা প্রাপ্তি। অতএব স্বীকার করতে হয়, সমাজ-সংস্থা, ধর্ম-বিধান কিংবা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা হচ্ছে মূলত ও লক্ষ্যত সমবায় সমিতি। ব্যক্তিক সুযোগ লাভ ও পারস্পরিক সহযোগিতা দানই এর আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।

এ দৃষ্টিতে দেখলে পারস্পরিকতাই (Reciprocity) সব কিছুর ভিত্তি বলে সহজেই উপলব্ধ হবে। এই পারস্পরিক হবে ব্যক্তিক সুযোগ লাভের বিনিময়ে সামষ্টিক সহযোগিতা দান। অতএব, প্রতিজ্ঞাগুলো এরূপ দাঁড়ায় : ব্যষ্টির জন্যে সমাজ এবং সমাজের জন্যে ব্যষ্টি, ব্যষ্টির স্বার্থে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের জন্যেই ব্যষ্টি (People for the state and state for the people)। অন্যকথায়, ব্যষ্টির সমষ্টিতে সমাজ এবং সমাজের একতম সদস্য ব্যষ্টি। জনস্বার্থেই জনগণের জন্যে জনগণের সমবায়েই গড়ে উঠেছে রাষ্ট্র।

অতএব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রতত্ত্বে শাসক-শাসিত বলে কোনো শ্রেণী নেই। জনগণের হাতেই রয়েছে সার্বভৌম ক্ষমতা। এ অর্থেই রাষ্ট্র হচ্ছে সমবায় প্রতিষ্ঠান আর রাষ্ট্র-সংস্থা তথা সরকার হচ্ছে জনচর্যার প্রতিরূপ। অন্যকথায়, জনমানস লালন ও নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আচরণ নিয়ন্ত্রণ আর জনস্বার্থের রক্ষণ ও পোষণই এর দায়িত্ব। তা হলে রাষ্ট্রই জনগণের জীবন ও জীবিকার প্রতীক। জীবন বলতে ব্যষ্টির ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা বুঝায়, যা বিকাশোনুখ এবং স্বচ্ছন্দ বিহার প্রয়াসী। কাজেই যা ব্যক্তিজীবনের বিকাশে, প্রসারে ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে প্রয়াসী, তা-ই গণ-সরকার। বেঁচে থাক এবং বাঁচতে দাও, আর ভাল হও এবং ভাল চাও– এই হচ্ছে এর মৌল নীতি। এ ভাবে এ উদ্দেশ্যে আর এই নীতিতে গণ-জীবন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনই গণ-সরকারের ব্রত। যেহেতু গণ-গরজে, গণ-স্বার্থে ও গণ-নির্দেশেই সরকার পরিচালিত হয়, সেজন্যে জনগণের সাধারণ (Common) ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্র সংস্থার নীতি ও কৃতির মাধ্যমেই রূপায়িত হয়। কাজেই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আলাদা ধর্মীয়, সামাজিক বা নৈতিক আদর্শ-চর্চার কোনো প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রই যখন জীবন-জীবিকার প্রতিভূ এবং প্রতীক, তখন সমাজে, সাহিত্যে, শিল্পে, স্থাপত্যে সেই আদর্শ একান্তই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রাদর্শানুগ তথা গণতান্ত্রিক হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

কেননা ব্যক্তিস্বার্থে ও আদর্শে কোনো বিরোধ নেই। মৌল ও বৃহত্তর অর্থে যা ব্যষ্টির তাই রাষ্ট্রের আর যা রাষ্ট্রের তাই ব্যষ্টির। এ উপলব্ধি থেকেই আজকাল কেবল সার্বভৌমত্বই রাষ্ট্রের চরম ও পরম লক্ষ্য বলে গণ্য হয় না, নাগরিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকেও সমগুরুত্ব দেয়া হয়। এজন্যেই সার্বভৌমত্বের অভিযান ত্যাগ করে কোনো কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র জনকল্যাণের খ্যাতিরে অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত বা যৌথ সংস্থাও গঠন করেছে। বিশেষ দৃষ্টিতে UNO-ও রাষ্ট্র কল্যাণের বনামে জনকল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান।

এখন একটি কঠিন প্রশ্ন জাগছে : রাষ্ট্রের আদর্শ নির্ণয় ও নির্ধারণ করবে কে? যারা ভোট পেয়ে রাষ্ট্র পরিচালক হন তাঁরা, না যারা ভোট দেয় সেই জনসমাজ? এর সহজ জবাব হয়তো এই যে যেহেতু জনসাধারণ তাদের পছন্দসই লোককে রাষ্ট্র পরিচালনের ভার দেয়, অর্থাৎ তাদের পক্ষ হয়ে চিন্তা ও কর্ম করবার দায়িত্ব অর্পণ করে, অন্যকথায় তাঁদের রাষ্ট্রিক চিন্তায় ও কর্মে প্রতিনিধিত্ব করবার অধিকার দেয়, সেজন্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রাদর্শ নির্ধারণ ও শাসন পরিচালন ব্যাপারে সার্বিক ক্ষমতার অধিকারী। আপাতদৃষ্টিতে এ জবাব যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও এ একান্তই স্কুলবোধ প্রসূত। কেননা, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি নির্বাচকরা শিক্ষিত হলেও প্রয়োজনানুরূপ দায়িত্ব সচেতন ও চৌকশ নয় এবং নির্বাচিত ব্যক্তি মাত্রেই যোগ্য নয়। কাজেই এ ব্যাপারে ভোটাধিক্যে গুরুত্ব দেয়া যাবে না, মেধা-মাহাত্মে তথা মনীষাকেই মূল্য দিতে হবে। তাহলে সমাজের চিন্তানায়ক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, মনীষী প্রভৃতি গুণী-জ্ঞানী বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের মতামতকে জনমত বলে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হয়। এঁদের নির্ভরযোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব এই যে এঁরা বাক-চাতুর্যে, চিন্তার প্রাখর্যে, বুদ্ধির দীপ্তিতে দূর ও অখণ্ড দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় বর্তমানের স্বরূপ এবং ভবিষ্যতের দিশা সহজেই খুঁজে পান, আর সহজেই মন ও মত গঠন করতে পারেন। জনমত সৃষ্টি ও পুষ্টি সাধনে বা বিনষ্ট করণে, কিংবা সভা, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বা ভাঙ্গনে এঁদের জুড়ি নেই। এঁরা যথার্থ অর্থে জনগণ মন অধিনায়ক। পৃথিবীর ইতিহাস-ধৃত চিন্তানায়কগণের কথা স্মরণ করলেই এর যাথার্থ বোঝা যাবে। কাজেই রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই দেশের ঐতিহাসিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী প্রভৃতি গুণী-জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীদের অবাধ চিন্তার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক।

পাকিস্তানে একজন রাষ্ট্রপতি একবার এর ন্যায্য গুরুত্ব উচ্ছ্বাসবেশে উচ্চারণ করেছিলেন : Feel free in your mind, act freely in your expression and react freely to the environments around you. Let not the edge of your sensitivity be blunted by any sense of fear or expediency. On my behalf I cannot do better than assure you in the spirit of Voltair, that I may differ, even protest, against what you say but I will defend your right to say it unless it is directed against the very existence of our homeland.

এ উদাত্তবাণী কেবল শ্লাঘ্য নয়, যুগান্তকরও। এ নীতি সরকার কর্তৃক অনুসৃত হলে জীবনে ও সমাজে শান্তি ও মুক্তির স্বাচ্ছন্দ্য আসত।

জাতিবৈর ও বাঙলা সাহিত্য

আদিম মানুষের মন-বুদ্ধির বিকাশের ফলে তাদের মধ্যে জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই প্রয়োজন-বুদ্ধিই তাদের সংহতি দান করে। সেদিনকার হাতিয়ার-বিরল অজ্ঞ মানুষ জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে সংহতি ও সহযোগিতার মধ্যেই সন্ধান পায় নতুন শক্তির ও সম্ভাবনার। স্বনির্ভর অসহায় জীবনে এভাবে নতুন ভরসা ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে প্রসারিত জীবন সম্ভাবনায় আশ্বস্ত হল মানুষ।

তখন জনসংখ্যা ছিল কম। পৃথিবী ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। মানুষের জীবন ছিল অঞ্চলের সীমায় আবদ্ধ। এভাবে তাদের এক একটি দল নিজেদের খণ্ড ক্ষুদ্র জগতে যাপন করত স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর জীবন। কুলপতিই ছিল তাদের নেতা–শাসন-পোষণ ও দণ্ডমুণ্ডের মালিক—-ভয়-ভরসার আকর।

এই গোত্রীয় সংহতি এককালে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের ছিল শ্রেষ্ঠ উপায়। তারপর ক্রমে বেড়ে গেছে জনসংখ্যা। জীবনবোধ হয়েছে প্রসারিত। প্রয়োজন গেছে বেড়ে। জীবিকা হয়েছে দুর্লভ। প্রয়োজনের তাগিদে তখন অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করতে শিখেছে মানুষ। তখন গোত্রে গোত্রে জীবিকার অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হল শুরু। কেননা তখনও জাগেনি গোত্রীয় সহঅবস্থান এবং সহযোগিতার সুবিধা ও সুফলের চেতনা। কাজেই অন্য গোত্রের প্রতি বিরূপতা ও বিমুখতা এবং বিগ্রহই আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের একমাত্র উপায় বলে হত বিবেচিত। অনেক কাল হল সেই গোত্রীয় গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়েছে। তার ঠাই নিয়েছে ধর্মীয় সম্প্রদায়। স্বাধৰ্ম গোত্রীয় চেতনারই আর এক রূপ। তাই গৌত্রিক বিরোধ-বিদ্বেষের ঠাঁই নিয়েছে ধর্মমতবাদীর বিরোধ, বিদ্বেষ ও স্বাতন্ত্র চেতনায়। এজন্যে আজো মানুষের সেই আদিম মনোভাবের ও জীবন-চেতনার পরিবর্তন দুর্লক্ষ্য। ধর্মীয় ঐক্য সংহতি দেয় আর অনৈক্য বিরোধ ও হানাহানি ঘটায়–এ-ই হচ্ছে মানুষের কয়েক হাজার বছরের ব্যবহারিক জীবনের ইতিহাসের সারকথা। কাজেই পাক-ভারতের হিন্দু-মুসলানের সম্পর্কের ইতিহাসও স্বতন্ত্র হতে পারেনি। তার উপর সম্পর্কটি বিজিত-বিজেতার বলেই বিদ্বেষ বিরূপতাও ছিল তীব্রতর।

বাঙলা দেশেও হিন্দু-মুসলমানে যে আন্তরিক সম্প্রীতি ছিল না, তার প্রমাণ রয়েছে বাঙলা সাহিত্যে। এতে কিন্তু অস্বাভাবিক বা নিন্দনীয় কিছু দেখতে পাইনে আমরা। কেননা সাধারণ মানুষের জীবন চিরকালই ধর্ম নিয়ন্ত্রিত। ধর্ম হচ্ছে সাধারণের জন্যে বিধি-নিষেধের সমষ্টি; ইহলোকে পরলোকে প্রসারিত জীবনের দিশারী। স্থূলবুদ্ধি ও অজ্ঞ সাধারণ মানুষ যুক্তি ও চেতনা দিয়ে জীবনোপভোগ করে না–লব্ধ নিয়ম-নীতির অনুসরণেই সে যাপন করে জীবন। বিধি নিষেধের বেড়ার সীমিত পরিসরে বিবেক-বুদ্ধিকে সে-সব নীতির অনুগত রেখে সে থাকে আশ্বস্ত ও নিশ্চিত। সে হয়ে উঠে পোষমানা প্রাণী–তার জীবনও তাই যান্ত্রিক। সেজন্যে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে ধার্মিক তথা আস্তিক মানুষের একটিমাত্র মতই আছে–তা হচ্ছে ধর্মমত। ধর্ম তার ঐহিক ও পারত্রিক জীবনে কল্যাণ ও শ্রেয়সের উৎস। এর বাইরে কোনো ভাল থাকতে পারে কিংবা তার ধর্মবিধানে কোনো ত্রুটি থাকা সম্ভব, তা সে ভাবতেও পারে না। এমনকি তা ভাবা পাপও। যেহেতু মানুষের ধর্মবুদ্ধি গোত্রীয় সংহতি ও কল্যাণ চেতনায় আচ্ছন্ন, সেহেতু ভিন্ন ধর্মের লোককে সে পর ও শত্রু না ভেবেই পারে না। এবং শক্রর প্রতি প্রীতি কেবল আত্মধ্বংসী অকল্যাণই যে আনে তা নয়, সে-কারণে স্বধর্মে নিষ্ঠাহীনতার পাপও স্পর্শ করে। তাই পরধর্ম ও বিধর্মী বিদ্বেষ বা ঘৃণাই ধার্মিক মানুষের স্বধর্ম নিষ্ঠার এবং আদর্শজীবনের লক্ষণ। এজন্যেই সাধারণত ধার্মিকেরা গোড়া, অনুদার ও বিবেক-বুদ্ধিহীন। স্বাধীন চিন্তা, উদার দৃষ্টি ও নিরপেক্ষ বিচার-বুদ্ধি কিংবা বিশুদ্ধ মানবতাবোধ জন্মাতেই পারে না তাদের রুদ্ধদ্বার মনে।

বাঙলা সাহিত্যেও তাই দেখতে পাই, ধার্মিক মানুষেরাই বিধর্ম ও বিধর্মী বিদ্বেষী। এক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যিকদের সমভাবেই উৎসাহী দেখি। মধ্যযুগে নিরঞ্জনের রুম্মাতেই প্রথম বৌদ্ধ-হিন্দুর বিদ্বিষ্ট সম্পর্কের সংবাদ পাই। বিজয়গুপ্ত প্রভৃতির মনসামঙ্গলে, বৃন্দাবনদাস, জয়ানন্দ, লোচনদাস প্রভৃতির চৈতন্যচরিত গ্রন্থে, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে, কৃষ্ণরামের অন্নদামঙ্গলে, সহদেব চক্রবর্তীর অনিল পুরাণ প্রভৃতিতে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। আবার জায়নুদ্দীনের রসুলবিজয়ে, শাবারিদ খানের রসুলবিজয়ে ও হানিফার দিগ্বিজয়ে, সৈয়দ সুলতানের জয়কুম রাজার লড়াই-এ, গরীবুল্লাহর সোনাভানে, সৈয়দ হামজার জৈগুনের কিস্সাতে এবং কোনো কোনো পীরপাচালীতে হিন্দু ও হিন্দুয়ানীর, কাফের ও পৌত্তলিকতার প্রতি অবজ্ঞা অসৌজন্য সুপ্রকট।

আধুনিক কালে প্যারীচাঁদ মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, যোগীন্দ্রনাথ বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ অনেকের রচনায় যেমন মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, বিদ্রূপ ও অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ (অমিয় ধারার তিনটে কবিতায় অশ্লীল ভাষায় হিন্দুর নিন্দা করা হয়েছে), ইসমাইল হোসেন শিরাজী, ডাক্তার আবুল হোসেন, শেখ ইদরিস আলী প্রভৃতির রচনায় হিন্দু বিদ্বেষ সুপ্রকট। এছাড়া প্রায় সব হিন্দু ও মুসলমান লেখকের রচনায় প্রতিবেশী বিধর্মীর প্রতি কটাক্ষ, অশ্রদ্ধা কিংবা অবহেলা দৃশ্যমান।

এসব লেখকদের কেউ নাস্তিক নন, তাঁরা ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী। তাঁদের জীবন গোত্রীয় সংহতি চেতনার আধুনিক রূপান্তর ধর্মীয় ঐক্যবোধে নিয়ন্ত্রিত। তাই বাঙালি হিন্দু প্রেরণা খুঁজেছে উত্তর ভারতের আর্য ও রাজপুত ঐতিহ্যে এবং বাঙালি মুসলমানের প্রেরণার উৎস হয়েছে আরব ইরানীর ঐতিহ্য। দেশগত জীবন ও ঐতিহ্য বিশেষ শ্রদ্ধা পায়নি কারো। এই মনে বিধর্মী-বিদ্বেষ না থেকেই পারে না, কেননা তাদের স্বাজাত্য দেশগত নয়, ধর্মগত। কাজেই তাদের স্বাজাত্য স্বাধর্মেরই নামান্তর। মনের দিক দিয়ে কোনো আস্তিক মানুষই স্বাধীন ও স্বস্থ নয়। তাই বিবেক, বুদ্ধি ও বিচারশক্তির স্বাধীন ও যৌক্তিক তথা নিরপেক্ষ মানবিক প্রয়োগ তাদের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই এঁদের এই মানস অভিব্যক্তির মধ্যে নিন্দনীয় কিছু নেই–মোহপাশবদ্ধ মানুষের আত্মিক অপমৃত্যুর জন্যে আমরা কেবল বেদনাবোধ করতে পারি, তাদের জড় বিবেকে চেতনা সঞ্চারের চেষ্টাও হয়তো করা সম্ভব, কিন্তু সাফল্যের আশা সামান্য। গোত্রীয় উত্তন্মন্যতা, ধর্মীয় জাতীয়তা, রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা কিংবা আধুনিক মতবাদ প্রসূত ঐক্যবোধ তথা গোষ্ঠী-চেতনা আজ বিশ্বমানবের স্বস্তি ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে এক মারাত্মক হুমকি। আজ পৃথিবীব্যাপী এ সমস্যা দুষ্ট ক্ষতের মতো বিরাজমান। বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্র-চেতনা এই তিনটেই মানবিকতা ও মানবতার দুশমন। আজকের দুনিয়াব্যাপী খুনোখুনি ও কাড়াকাড়ির মূল কারণ। অধিকাংশ মানুষ এই বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্যবোধের ঊর্ধ্বে না উঠলে অর্থাৎ এসব ব্যাপারে স্বাতন্ত্র্যবোধ পরিহার না করলে অশান্তি ও বিপর্যয় থেকে আজকের পৃথিবীর মুক্তি নেই।

মানুষের এই শোচনীয় অবস্থায় সব দেশেই কিছু সংখ্যক মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিক, মানবতাবাদী ও মানবদরদী জ্ঞানী-মনীষী ও কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক কল্যাণের পথে, শ্রেয়সের দিকে, উদারতার খোলা প্রাঙ্গণে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন শান্তি, প্রীতি ও মানবতার নামে। কিন্তু তাদের প্রভাব দুর্লক্ষ্য।

সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে কেউ কেউ অনুযোগ করছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিবেশী মুসলমান সমাজকে অবহেলা করেছেন (এমনকি মুসলিম বিদ্বেষের অভিযোগও আছে)। শরৎচন্দ্র সম্বন্ধেও অনুরূপ কথা শোনা যায়। যারা এই নিন্দা উচ্চারণ করেন, তাঁরা কবি-সাহিত্যিক। তারাই আবার দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচারক। তাহলে হিন্দুর কাছে তাঁরা এই দাবী করছেন কেন? বঙ্কিমচন্দ্রের মতো এঁরা মুসলমানকে গালি দেননি, এটাই কি যথেষ্ট সৌজন্য ও উদারতা নয়? এদিকে তারা নিজেরা গত বিশ-ত্রিশ বছর ধরে হিন্দু-বিদ্বেষ প্রচার করেছেন। তাঁদের কোনো লেখায় হিন্দু-প্রীতি কিংবা সহিষ্ণুতার আভাস মাত্র নেই। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানীর শতকরা দশজন হিন্দুর নাগরিকত্ব তারা মুখে স্বীকার করেন বটে, কিন্তু ওদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক অধিকারও কার্যত অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই তাদের। নইলে ভাষা বদলাও, হরফ বদলাও, আরবি-ফারসি শব্দ বসাও কিংবা বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ বর্জন করো প্রভৃতি যখন তারা বলেন তখন তাঁরা দেশী হিন্দুর কথা ভাবেন না। সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে মুসলমানদের যা বর্জনীয়; হিন্দুর তাই বরণীয়। কাজেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিজের স্বার্থে অন্যের অধিকার হরণ কিংবা অন্যকে সমসুযোগ থেকে বঞ্চিত করা নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক অবিচার। আশ্চর্য, সর্বক্ষণ হিন্দু-বিদ্বেষ ও হিন্দুভীতি মনে পোষণ করেন যাঁরা, তাঁরাই রবীন্দ্রনাথের কাছে আশা করেছেন উদারতা ও প্রতিবেশীসুলভ প্রীতি, অথচ নিজেরা সে-উদারতা, সৌজন্য ও প্রীতির সুনশীলনে অনিচ্ছুক। মানুষের অবিবেচনারও একটা সীমা আছে। এ অনুযোগ যেন তাও অতিক্রম করছে। আমার বাড়ি যেতে কী নিয়ে যাবে আর তোমার বাড়ি গেলে কী খাওয়াবে-ন্যায়ের মতো এটিও একপেশে ন্যায়। রবীন্দ্রনাথেরা যে-ভুল ও অন্যায় করেছেন বলে তাঁরা মনে করেন, নিজেদের সে-ক্রটি থেকে মুক্ত রেখে ভবিষ্যতের মানুষের জন্যে আদর্শ স্থাপন করাই ছিল তাদের কর্তব্য। কিন্তু সে-ঔচিত্যবোধের আভাস নেই তাঁদের চিন্তনে কিংবা বচনে।

আরো একটি অপযুক্তি তারা প্রয়োগ করে থাকেন। তারা বলেন নজরুল এ ব্যাপারে আদর্শ। তিনি অসূয়ামুক্ত থেকে হিন্দু-মুসলমান ও তাদের ঐতিহ্যকে সমভাবে ভালবেসেছেন। তারা ভুলে যান যে মুসলমানেরা দেশগত পরিবেষ্টনীর প্রভাব এড়াতে পারেননি, তাই মুসলমানমাত্রেরই রচনায় দেশীয় ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটেছে। মধ্যযুগ থেকে বিশ শতকের প্রথম পাদ অবধি মুসলমানদের রচনায় এ মিশ্রণ দৃশ্যমান। হিন্দুর দেশ ও ধর্ম অভিন্ন অঞ্চলের, তাই যা দেশী তা ধর্মীয়ও বটে। এইজন্যেই হিন্দুর রচনা পুরোপুরি হিন্দুয়ানী বলে চিহ্নিত করা যেমন সহজ; তেমনি কঠিন নয় মুসলিম মনের উদারতা ও গ্রহণশীলতা প্রমাণ করাও। উভয়েই ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে মানবতাবাদী হওয়া সত্ত্বেও নজরুল ইসলামের অবচেতন উদারতার কারণ এই তত্ত্বেই নিহিত এবং রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির হিন্দুয়ানীর রহস্যও এ-ই। অতএব একের সৌজন্য ও উদারতা এবং অপরের সংকীর্ণচিত্ততা ও অনুদারতার সাক্ষ্য নয় এসব।

কাজেই আস্তিক মানুষের মধ্যে স্বধর্মনিষ্ঠ কেউ যদি প্রকাশে বিজাতি-বিদ্বেষ ব্যক্ত না করে থাকে–হোন না তিনি প্রতিবেশীর প্রতি অবহেলাপরায়ণ, তাহলেও তাকে উদার-হৃদয় সহিষ্ণু-সুজন বলে তারিফ করা উচিত।

জাতীয়তা

০১.

দার্শনিক পরিভাষায় প্রতিটি মানুষ হচ্ছে বিশিষ্ট দ্বৈতাদ্বৈত সত্তা। সামান্য তাৎপর্যে, দেশ, কাল, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, নীতি ও আদর্শের অভিন্নতা যেমন বিশেষ দেশ, ধর্ম ও রাষ্ট্ৰান্তৰ্গত মানুষকে অদ্বৈত বর্ণে ও গুণে প্রতীয়মান করে; তেমনি আবার ঘরের, দেশের, সমাজের, ধর্মের কিংবা আদর্শের প্রভাব প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র রাখে। বর্ণে ও অবয়বে, চলনে ও বলনে কিংবা স্বভাবে ও আচরণে যেমন প্রতিটি মানুষ অনন্য, তেমনি আবার আপাত অভিন্ন জীবন-রীতি মানুষকে করেছে সমষ্টির নিরূপ অংশ। প্রথমটির নাম ব্যক্তিত্ব (Personality) এবং দ্বিতীয়টি জাতিত্ব (Nationality)। এভাবে ব্যষ্টি (individual) নিয়ে গড়ে উঠে সমষ্টি (Nation)। অতএব, প্রতি মানুষের রয়েছে এই দ্বৈতসত্তা। একটি ব্যক্তিসত্তা, অপরটি জাতি-পরিচয়। একটির জন্যে অপরটি অস্বীকার বা অবলুপ্ত করবার প্রয়োজন হয় না। একাধারে এই দ্বৈতসত্তার নির্দ্বন্দ্ব সহাবস্থান বা সংস্থিতি সম্ভব। এ জাতীয়তা অবশ্যই অভিন্ন দেশ, ধর্ম, ভাষা ও সমাজ ভিত্তিক।

.

০২.

আধুনিককালে অভিন্ন গোত্র, ভাষা, সমাজ, ধর্ম ও ভৌগোলিক সংস্থান নিয়ে যেসব রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, সেখানকার সমস্যা ভিন্নতর। সেখানে দ্বন্দ্ব জনকল্যাণ সম্পর্কিত আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগত। আর বিভিন্ন গোত্র, ভাষা, সমাজ ধর্ম ও ভৌগোলিক-চেতনা ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোর সমস্যা মূলত রাষ্ট্রিক-চেতনাজাত অভিন্ন জাতির পরিচয়, বিশ্বাস ও সংস্কার দৃঢ়মূল করার উপায় ও প্রয়াস পদ্ধতির। আজকের পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র ও এ অসমাধ্য সমস্যায় পীড়িত। বস্তুত এ সমস্যা এ যুগেরই। আগের কালে রাজা-প্রজার সম্পর্ক ছিল শাসক ও শাসিতের, প্রবলের ও দুর্বলের, শোষক ও শোষিতের, সেজন্যে সে-যুগে এ সমস্যা ছিল না। শাসকের শক্তির তারতম্যে রাজ্য-সাম্রাজ্যের স্থিতি ও ভাঙা-গড়া চলত। এ যুগ গণতন্ত্রের ও জাতীয়তার এবং রাজ্যের নয়–রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রে প্রতি মানুষের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের স্বীকৃতিতে জাতি-চেতনা ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ও স্থিতি। অনেকাংশে এ এক সমবায় সংস্থা। এজন্যেই একক অভিন্ন জাতি-চেতনায় জাতীয়তাবোধ না জন্মালে, এ যুগে কোনো রাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় বাস করা ও স্বাভাবিক আনুগত্য রাখা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই রাষ্ট্রমাত্রেই হবে mono-national state-এক জাতি এক রাষ্ট্র।

উনিশ শতকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কৃত্রিম জাতীয়তা সৃষ্টির প্রয়াসে য়ুরোপ-আমেরিকায় বহু রক্তারক্তি হয়ে গেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ প্রয়াস নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ শতকে আবার তার পুনরাবৃত্তি চলছে আফ্রো-এশিয়ায়। হয়তো কেবল পরিণামে ব্যর্থ হবার জন্যেই।

আবার এর উল্টো সাধনাও লক্ষ্য করি– দেশ ভাগ করে জাতি-চেতনাকে খণ্ডিত করার অভিনব অপপ্রয়াস-সিরিয়া, কোরিয়া, জার্মানী, ইন্দোচীন প্রভৃতি স্মর্তব্য।

এই উভয়বিধ অপপ্রয়াস চলছে রক্তের অভিন্নতার প্রমাণে, ভৌগোলিক অবিচ্ছেদ্যতার যুক্তিতে অথবা আদর্শের ধ্বনি তুলে, ধর্মের দোহাই দিয়ে কিংবা আর্থনীতিক প্রয়োজনের গুরুত্ব দেখিয়ে। আসল কারণ শাসন-শোষণের লোভ। নইলে বিচ্ছিন্নতার প্রয়োজনে এক প্রকারের যুক্তি, আর সংহতির-বাঞ্ছয় বিপরীত যুক্তি একই কালে একই মুখ দিয়ে বের হতে পারত না। তাই কোথাও রক্ত, কোথাও ভাষা, কোথাও ধর্ম, আবার কোথাও আদর্শ কিংবা অর্থনীতি গুরুত্ব পাচ্ছে। দুষ্টবুদ্ধি প্রসূত না হলে নীতির ও যুক্তির এ অসঙ্গতি থাকত না।

.

০৩.

আমাদের পাকিস্তানও এ সমস্যার স্বীকার। বৃটিশ আমলে হিন্দুর পীড়নজাত প্রতিক্রিয়ার ফলে ভারতে মুসলমানেরা ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়ে উঠে। এর ফলে গড়ে উঠে পাকিস্তান রাষ্ট্র। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিবেশে আগের আবেগ ও স্বপ্ন অবলুপ্ত। তাই নতুন করে দেখা দিয়েছে জাতীয়তাবোধ সুষ্ঠু করার প্রয়োজন।

ধর্মীয় অভিন্নতাই পাকিস্তানী জাতীয়তার একমাত্র ভিত্তি। শাসন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিষম নীতি অনুসৃতির ফলে কেবল ধর্মীয় বন্ধন জাতীয়তার ভিত দৃঢ় রাখতে পারছে না। প্রবল পক্ষের প্রতি দুর্বল পক্ষের বর্ধিষ্ণু বিরূপতা রোধ করবার প্রয়াসে তাই সমাজ-সংস্কৃতির অভিন্নতা প্রমাণের অপচেষ্টা শুরু করেছেন সবল পক্ষ।

রাজনীতিক স্বার্থে গড়ে উঠেছে স্ব-ধর্মভিত্তিক এ জাতীয়তা। প্রীতিপ্রসূত নয় বলেই আত্মরতি হয়েছে প্রবল। শাসক-শাসিত তথা পীড়ক-পীড়িত সম্পর্কের উচ্ছেদ সাধন করে সাম্য ও সমদর্শিতার ভিত্তি রচনায় তাই আগ্রহ নেই তাদের। শোষণ কায়েম রাখবার কুমতলবে তারা শোষণ ও সম্প্রীতির ভারসাম্য স্থাপনে প্রয়াসী। এজন্যে তাঁরা এককালে একক ভাষার ফজলিয়ত বয়ান করেছেন, তারপর চালু করতে চেয়েছেন অভিন্ন হরফ, তারও পরে শুরু করেছেন আরবি ফারসি শব্দের মহিমা প্রচার। এ সঙ্গে রয়েছে বর্ণ ও বানান সংস্কারের জিকির। নায়ক রয়েছেন নেপথ্যে। ছদ্মনায়ক সেজেছেন যাঁরা, তাঁরা সব আমাদের ঘরের লোক। তাই যন্ত্রী ও যন্ত্র-চালিতের পার্থক্য বোঝা কঠিন। বিড়ম্বনাও বাড়ছে এজন্যেই। শিক্ষিত সরলজনেরা তাই বিভ্রান্ত কিংবা বিমূঢ়।

তবু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব যে বর্ণে-অবয়বে, মনে মেজাজে, বিশ্বাসে-সংস্কারে, আহার্যে-পোশাকে, আচার-আচরণে, ভাষায়-সংস্কৃতিতে–এককথায় জীবন-চর্যার সর্বক্ষেত্রে যে পার্থক্য ঘটায় তা ঢাকা দেবার জন্যে তাই এবার সেই পুরোনো জিকির আবার শুরু হয়েছে পাকিস্তান হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানের জন্যেই, ইসলাম দেশ-কাল-জাত জন্মের পার্থক্য স্বীকার করে না। অতএব, সারা পাকিস্তানে মুসলমানের জীবন-চর‍্যা হবে অভিন্ন। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানে যা নেই, পূর্ব পাকিস্তানে তা চলবে না–চলা উচিত হবে না। কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানীরা হচ্ছে আদমের আমল থেকেই মুসলমান আর পূর্ব পাকিস্তানীরা হচ্ছে ইসলামোত্তর যুগের দীক্ষিত মুসলমান! কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানীর অভিভাবকত্বে চলবে পূর্ব পাকিস্তানীর মুসলমানী জীবন। পশ্চিম পাকিস্তানের পাকা মুসলমানেরা যা কিছু করে, তা-ই হবে পূর্ব পাকিস্তানের অনুকরণীয়–কেননা এই কাঁচা মুসলমানের জন্যে তা-ই শ্রেয়। অতএব, রবীন্দ্ৰতিথি, বসন্তোৎসব কিংবা নববর্ষ বেদাৎ বলেই মুমীনের পরিহার্য। বাঙলাদেশ, বাঙলা ভাষা, বাঙালি প্রভৃতি আমল-ই-জাহিলিয়তের নামগুলো ভুলে যেতে হবে। সত্যের আলোক প্রাপ্ত মুমীন বলবে–পাকিস্তান, পাকজবান, পাকিস্তানী। মুসলমান হওয়া কি যেমন-তেমন কথা! মুসলমান করার ও মুমীন রাখার মহান ব্রত ও দায়িত্ব নিয়েই পাক সরজমিনে গড়ে উঠেছে ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামের অছি-সরকার। এ-ই যদি না হল তাহলে যে সবই বৃথা!

কথাগুলো শুনতে বিদ্রুপাত্মক বটে, কিন্তু এসব হাস্যকর যুক্তিই অত্যন্ত গুরু-গম্ভীর ভাষায় উচ্চারিত হয়। অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও সরল লোকেরা শুনে মুগ্ধ হয়, চরিত্রবান অক্ষম দেশহিতৈষীরা বেদনাবোধ করে, আর বিষয়ীরা এর থেকে ফায়দা উঠায়।

কিন্তু এ যুগে এটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ানোর কোনো কারণ ছিল না। কেননা, সমস্বার্থে মিলিত হওয়া, ঐক্যবদ্ধ হওয়া, সহ-অবস্থান করা এ যুগেই সম্ভব ও সহজ। বলতে গেলে এ যুগ কেবল জাতীয়তার নয়–আন্তর্জাতীয়তারও। ভৌগোলিক দূরত্ব, গোত্রীয় বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র, ভাষার পার্থক্য ও ধর্মীয় প্রভেদ এ যুগে মিলনের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সৌজন্য, সমদর্শিতা ও সমস্বার্থের ভিত্তিতে আজকাল পৃথিবীর দুই বিপরীত প্রান্তের লোকও একরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় একক জাতি গড়ে তুলতে পারে। আবার দুষ্টবুদ্ধি যে একক দেশ ও জাতিকে সহজেই বিভক্ত করতে সমর্থ তা আগেই বলেছি।

.

০৪.

আবার এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার ছিদ্রপথে আরো ক্ষতিকর বিভ্রান্তির প্রসার ঘটছে। আমাদের রাষ্ট্রবাসীরা সুযোগ-সুবিধে মতো কখনো ইসলামী জাতীয়তার, কখনো বা রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার অঙ্গীকারে চলে। এমনকি গোত্রভিত্তিক জাতীয়তাও চেতনার গভীরে ক্রিয়াশীল। তাই প্রায় প্রতি নাগরিকই এই দ্বৈতসত্তার পীড়ায় অসুস্থ। ফলে পাঠান-বালুচ-সিন্ধি-পাঞ্জাবি বাঙালি সত্তার সঙ্গে কখনো মুসলিম-চেতনার কখনো বা পাকিস্তানী-চেতনার যোগে-বিয়োগে রাষ্ট্রিক জাতীয়তা দৃঢ়মূল হবার অবকাশ পাচ্ছে না। প্রত্যয় ও অঙ্গীকারের মেল-বন্ধন না হলে সমস্যার সমাধান নেই।

মনকে চোখ ঠাওরিয়ে যদি গোঁজামিলে মিলনসেতু তৈরি করি, কিংবা ফাঁকি দিয়ে ফাঁক পূরণ করি, তাহলে না-ঘরকা না-ঘাটকা-চেতনা প্রশ্রয় পাবেই এবং তাতে রাষ্ট্রিক স্বার্থ ব্যাহত হবেই।

অজ্ঞতা, অন্ধতা ও ভাবাবেগ মানব-চৈতন্যের স্থায়ী অবস্থা নয়, কাজেই অবাস্তব-অযৌক্তিক কিছু বেশিদিন টেকে না। সে-যুগ আর নেই, যখন ইসলাম-বিদ্বেষী কামাল আতাতুর্ক ছিলেন পাক ভারতীয় মুসলমানের চোখে জাতীয় বীর ও ইসলামের ত্রাণকর্তা। তিনি কোরান, মসজিদ ও আরবি-অসহিষ্ণু হলেও তাকে নিয়ে স্বধর্মীর গৌরব-গর্বে ও এদেশের মুসলমানের মাতামাতির অন্ত ছিল না। প্যান-ইসলামী সে-আবেগ আজ বিলুপ্ত। তাই খ্রীস্টান রাষ্ট্রগুলো তো বটেই। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও–মিশর, মরোক্কো, সুদান, আলজিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতিও ধর্মীয় আবেগ থেকে মুক্ত। আজ দুনিয়ার সব রাষ্ট্রই–ধর্মভিত্তিক নয়-রাষ্ট্রসীমা ভিত্তিক জাতীয়তায় আস্থাবান এবং এ অঙ্গীকারেই সমৃদ্ধিকামী।

আমাদের ছাত্ররা দেশের ইতিহাস ও সাহিত্য-গ্রন্থে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার এই বিভ্রান্তিকর দ্বৈতবোধই লাভ করে। ফলে তাদের জাতীয়তাবোধ প্রয়োজনানুরূপ ঋজু, পষ্ট ও দৃঢ় হয় না। এ জাতীয়তাবোধের ভিত্তি চোরাবালি, ফলত রাষ্ট্রের পক্ষে মারাত্মক।

ধর্মীয় জাতীয়তায় আস্থা রাখলে, ইরানী, আফগানী প্রভৃতি যে-কোন বিদেশী স্বধর্মীর শাসনে এ দেশের লোক নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করবে, যেমন তুর্কী-মুঘল আমলে দেশী মুসলমানরা শাসকের স্বাধৰ্ম গর্বে খুশি থাকত। আজকের জগতে এহেন নির্বোধ আত্মপ্রসাদ কাম্য কি! অতএব, তুর্কী-মুঘল আমলে দেশী মুসলমান স্বাধীন ছিল কি-না, গৌড়ের স্বাধীন সুলতানী আমল বাঙালিরও স্বাধীনতার যুগ কি-না, মুঘল সুবাদার আলীবর্দী-সিরাজদ্দৌলার শাসন বাঙলাদেশে বাঙালির স্বরাজের প্রতীক কি-না বিচার-বিবেচনা করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সময় এসেছে।

আরো একটি ভাববার কথা আছে। বিধর্মীর সঙ্গে রাষ্ট্রিক যুদ্ধে যেহাদী-প্রেরণা-পন্থা গ্রহণ করলে স্বধর্মীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধে কোন্ প্রেরণা কাজ করবে? মনে রাখা দরকার যে রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবোধ দৃঢ়মূল হলেই মানুষ স্বদেশের স্বার্থে সর্বাবস্থায় সংগ্রামী প্রেরণা পায়। কাজেই আশুপ্রয়োজন মিটানোর জন্যে জাতীয়তাবোধের মতো অতি গুরুতর ধারণার সংকোচন-প্রসারণে যথেচ্ছ অপব্যবহার পরিণামে অহিতকর।

জীবন, সমাজ ও সাহিত্য

কলাবিদেরা বলেন, যেখানে Photography-র শেষ; সেখান থেকেই চিত্রকলার শুরু। যেখানে কথার শেষ, সেখান থেকেই সুরের আরম্ভ। প্রয়োজন ছাড়িয়েই সৌন্দর্যের প্রতিষ্ঠা, নকশা অতিক্রম করেই সাহিত্যের সৃষ্টি। স্বাভাবিক ভঙ্গির অস্বীকৃতিতেই নৃত্যের উদ্ভব। কাজেই কলা মাত্রেই কৃত্রিম। তুচ্ছকে উচ্চ করে তোলা, ক্ষুদ্রকে বৃহৎ করা, কৌৎসিত্যে লাবণ্য দেয়া, সরলকে জটিল করা, ঋজুকে বক্র করে তোলা, সামান্যকে অসামান্যতা দেয়া, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা কলা-শিল্পীর দান। যা নেই তা সৃজন করা, যা কাম্য তা পাইয়ে দেয়াই শিল্পীর দায়িত্ব। অতএব, স্বাভাবিকতায় শিল্প নেই। অতিক্রান্ত স্বভাবই শিল্পকলা। তাই শিল্পীমাত্রেই স্রষ্টা। এবং স্রষ্টা কখনো অনুকারক হতে পারেন না। অথবা কোনো অনুকারকই স্রষ্টার সম্মান পান না। অতএব সৃষ্টি মাত্রেই মৌলিক।

যা আছে তা নয়, যা থাকা উচিত, যা শ্রেয় কিংবা প্রেয়, এমনকি যা প্রয়োজন তার স্বপ্ন দেখা, অন্যের মনে সে-স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাই শিল্পীর ব্রত। এই অর্থে সাহিত্যাদি কলা একাধারে জীবন স্বপ্নের উৎস, আধার ও প্রতিচ্ছবি। অতএব, শিল্পকলা চিরকালই জীবন-স্বপ্নের রূপায়ণ ঘটিয়েছে, জীবনের প্রয়োজনই মিটিয়েছে। কাজেই Art for arts sake বলে যে-বাজে কথাটা রটেছিল, তাতে না ছিল ইতিহাসের সমর্থন, না ছিল শিল্পবোধের পরিচয়।

কেননা মানুষের কোনো কর্ম বা আচরণ প্রয়োজন-নিরপেক্ষ হতে পারে না। এ প্রয়োজন অবশ্যই মানস অথবা ব্যবহারিক হবে। এ প্রয়োজন নিয়ম-নীতি-নিয়ন্ত্রণ মানে না এবং মানুষে মানুষে তা অভিন্নও নয়। এ প্রয়োজন স্কুল কিংবা সূক্ষ্ম, বাহ্য কিংবা আন্তর, বৈষয়িক কিংবা মানসিক, পার্থিব কিংবা আধ্যাত্মিক হতে পারে। তাই এ প্রয়োজন বিচিত্র ও বহু। মানুষের জীবনবোধ ও প্রয়োজনবুদ্ধি বিশ্বাস, সংস্কার, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অজ্ঞতা, বিস্ময়, কল্পনা, বোধ, বুদ্ধি, ভীতি, সাহস, ভাব-চিন্তা, উপলব্ধি, উপযোগবুদ্ধি, রূপচেতনা প্রভৃতি অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। সেজন্যেই তা আপেক্ষিক। এগুলোর আনুপাতিক উপস্থিতি ও অভাবই মানুষের জীবনবোধে ও শ্ৰেয়োচেতনায় বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন দান করে। তাই কারো ভাল কারো কাছে মন্দ, একের কাছে যা অপরিহার্য, তা-ই অন্যের কাছে বিলাস মাত্র। ফলে সমাজে, সাহিত্যে, শিল্পে ও দর্শনে জীবনবোধের ও জীবনদৃষ্টির প্রকাশ বিচিত্র ও বহুধা। এজন্যেই শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনকে জাতীয়, ধর্মীয়, নৈতিক কিংবা সামাজিক রূপ দেয়ার নির্দেশ দান নির্বুদ্ধিতায় পরিচায়ক। কেননা জীবনবোধ ও উপযোগবুদ্ধি ফরমায়েশে তৈরি হয় না। চেতনানুসারেই মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্ম অভিব্যক্তি পায়। ফলে কেউ জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ, কেউ ধর্মীয় বোধে অনুপ্রাণিত, কেউ সমাজচিন্তায় বিব্রত, কেউবা জীবনের নৈতিক গুরুত্বে আস্থাবান। তাই সবাইকে নির্দেশে নিবর্ণ করার অভিপ্রায় শিল্পতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান প্রজ্ঞা-মননের দৈন্যপ্রসূত। মানুষ মেশিন নয়, কাজেই তার কাছে অভিন্ন ভাব-চিন্তা-কর্মের পৌনপুনিকতা কিংবা অভীষ্ট রূপ বা ফল, আশা করা বাতুলের দিবাস্বপ্ন মাত্র।

অতএব শিল্পমাত্রেই প্রয়োজন প্রসূত। কলার উদ্ভবতত্ত্বেও পাই এ তথ্য। গান থেকেই সাহিত্যের বিকাশ। শ্রমসাধ্য যৌথ কর্মের অনুষঙ্গ হিসেবেই গানের উৎপত্তি। তেমনি যাদু ও সর্বপ্রাণতত্ত্বে আস্থাবান মানুষের বাঞ্ছা-সিদ্ধির অবলম্বন হিসেবে উদ্ভূত নৃত্য ও চিত্রকলা। এভাবে প্রয়োজনের কর্মের সঙ্গে সৌন্দর্যের ও আনন্দের যোগসাধন করে মানুষ কর্মে পেয়েছে উৎসাহ এবং শ্রম করেছে সুবহ। নৃত্য, গীত, বাদ্য ও চিত্র বা মূর্তি আজো তাই অনেকেরই উপসানা বা ধর্মাচারের অঙ্গ। যাদের উপাসনা ও কর্মপদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে, অথচ তারা নাচ, গান, বাজনা কিংবা চিত্র ও প্রতিমার আকর্ষণ হারায় নি, তাদের কাছেই এগুলো কেবল সৌন্দর্যবুদ্ধি ও রূপচেতনা প্রসূত আনন্দের অবলম্বন। তারাই Art for arts sake তত্ত্বের প্রবক্তা। আসলে আদি মানব সমাজে যা ছিল জীবন ও জীবিকার স্কুল অবলম্বন, তা-ই মানবীয় শক্তি ও মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় মানস প্রয়োজনে উন্নীত। সম্পর্ক হয়েছে দূরান্বিত, সম্বন্ধ সূত্র হয়েছে অদৃশ্য। ফলে জীবনপ্রয়াসের অনুষঙ্গ হিসেবে যা সৃষ্ট, তা-ই উত্তরকালে ব্যবহারিক জীবন-নিরপেক্ষ খেয়ালী মনের রূপ ও রসচর্চা বলে বিবেচিত। কিন্তু এ ধারণাও সত্য নয়, কেননা রূপকথায়ও দেখি ভাল মন্দর দ্বন্দ্ব। সেখানেও মন্দশক্তির প্রতীক দুবৃত্ত-দুয়োরানী, দৈত্য-রাক্ষস ও সাপ-বাঘের পরাজয় নিয়তি-নির্দিষ্ট। সেখানেও নৈতিক আদর্শ সর্বত্র বন্দিত। আদ্যিকালের গানে-গাথায়-ছড়ায়, রূপকথা-উপকতা-পুরাণকথায় ন্যায়-নীতিবোধ জাগানোর–মহৎ আদর্শ দানের প্রয়াস সর্বত্র লক্ষণীয়।

সেকালে সাধারণ্যে জীবন-চেতনার প্রসার ছিল না। জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও খাদ্যবস্তুর অভাব তখনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নি। কেনা অসহায় মানুষের জীবন তখনো সর্ব ব্যাপারে দৈবানুগ্রহ-নির্ভর ও নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত। সুখ-শোক, ভোগ-রোগ, ধন-দৈন্য, বিপদ-সম্পদ, আনন্দ-বেদনা প্রভৃতি তখনো দেবতার কৃপা ও দেবতার মার বলে বিবেচিত। কাজেই সমাজে মানুষের নৈতিক জীবন-সমস্যা ছাড়া অন্য সমস্যা সমাধানে হাত ছিল না মানুষের। এজন্যেই মানুষের মনন-চিন্তন ব্যক্তির নৈতিক জীবন উন্নয়নে ছিল নিয়োজিত। মধ্যযুগের ধর্ম ও সাহিত্যাদি কলা তাই ভাল-মন্দ, ভোগ-ত্যাগ, ন্যায়-অন্যায় ও পাপ-পুণ্যের ফল; ঘৃণা-হিংসা-দ্বেষ, ছলনা-ক্রতা-প্রতিহিংসা প্রভৃতির পরিণাম এবং প্রেম-প্রীতি-স্নেহ, ক্ষমা-সহিষ্ণুতা, ধৈর্য-অধ্যবসায়, উদারতামহত্ত্ব, শক্তি-সাহস প্রভৃতির মহিমা মাহাত্ম্যের বর্ণনায় ও চিত্রণে ছিল পরিপূর্ণ।

তারপর ক্রমে মানুষের জীবনধারা পাল্‌টে গেছে। এর কারণ অনেক। জনসংখ্যার বৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার, বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়া, যন্ত্রায়ত শিল্প, মুদ্রা বিনিময় রীতির বিস্তার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশিক শোষণ, যন্ত্রবিজ্ঞানে অসম অধিকার, ভৌগোলিক অবস্থান, কৃষিজাত ও খনিজদ্রব্যের প্রাচুর্য ও অপ্রতুলতা প্রভৃতি নানা কারণে দেশে দেশে ও সমাজে সমাজে ধন-বৈষম্য ও তজ্জাত শক্তি বৈষম্য, দারিদ্র্য, শোষণ, কর্মকুশলতার অভাব প্রভৃতি নানা সমস্যা দেখা দেয়। অতএব এ যুগের মানবিক সমস্যা রাষ্ট্রিক কিংবা প্রশাসনিক নয়–মূলত অর্থনীতিক এবং ফলত সামাজিক।

আগের যুগে নিয়তি-নির্ভর মানুষের সামাজিক শৃঙ্খলা কিংবা বিপর্যয়ের কারণ ছিল ব্যক্তির নৈতিক চরিত্রের উন্নতি বা অবনতি। এ যুগে আর্থিক বৈষম্যই সামাজিক মানুষের দুঃখ-বেদনার মুখ্য কারণ। তাই এ যুগের নাচ-গান-চিত্র-সাহিত্য-দর্শন প্রভৃতি সমাজ ভিত্তিক। অন্যকথায় সমাজবদ্ধ মানুষের দুঃখ নিবারণ ও স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন লক্ষ্যেই এযুগে মানুষের শিল্প ও মনন প্রয়াস নিয়োজিত। অর্থাৎ মানুষের চিন্তা-ভাবনা পুরাতনকে স্বরূপে ও স্বস্থানে ধরে রাখার জন্যে নয়, পুরাতনের প্রয়োজন মতো বর্জন, শোধন ও নতুনের প্রতিষ্ঠার জন্যেই।

অতএব শিল্পীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও প্রসারণ। পুরোনো সমাজকে ভেঙে-অতিক্রম করে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন জাগানো, পরিকল্পনা প্রদান; চালু সংস্কৃতির মানোন্নয়ন ও নতুন সংস্কৃতি সৃজন; যে-ঐতিহ্য প্রগতির অন্তরায়, অনুপ্রেরণা দানে অক্ষম, তা পরিহার করে নতুন ঐতিহ্যের সন্ধান ও সৃজন প্রভৃতিই হবে শিল্পী, সাহিত্যিক ও দার্শনিকের আদর্শ, লক্ষ্য ও ব্রত।

চিত্র-শিল্পের ক্ষেত্রে য়ুরোপীয় activism, abstractism, surrealism প্রভৃতি চালু হয়েছে। সংগীতের মধ্যেও বিদেশী সুর-তাল-যন্ত্র গৃহীত হয়েছে সাদরে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে য়ুরোপীয় ভাল-মন্দ সবকিছুই নির্বিচারে আত্মসাৎ করছে সবাই–যদিও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার মৌখিক আস্ফালনও বাড়ছে সেই অনুপাতে। ভাবে ও আঙ্গিকে (In form and spirit) গত একশ বছরের বাঙলা সাহিত্য তো দেশী ভাষার আবরণে বিলেতি বস্তুই। ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা য়ুরোপীয় শব্দের পরিভাষা নিয়েছি ও নিচ্ছি সংস্কৃত থেকেই। তবু আরবি-ফারসির জিগির ছাড়িনে। য়ুরোপীয় শব্দের পরিভাষা হিসেবে গৃহীত বলেই পুরোনো সংস্কৃত শব্দ নতুন তাৎপর্যে নতুন। কিন্তু আরবি-ফারসি শব্দের পুনর্ব্যবহারে নতুন ব্যঞ্জনা দুর্লভ। আমরা ভুলে যাই যে পুরোনো উপকরণে নতুন জিনিস তৈরি করলে তার রঙ বিশেষ খোলে না,–জৌলুস তো অভাবিত।

সাহিত্যে সমাজচিত্র দেয়া মানে যা আছে, কেবল তাই চিত্রিত করা নয়– যা হওয়া উচিত তারই সংকেত দেয়া–প্রেরণা দেয়া, নইলে রচনা নকশাই থেকে যায়। তেমনি ভাষা ও বাক-ভঙ্গি যেমনটি আছে তেমনটিই রক্ষার প্রয়াসেই লেখকের কর্তব্য সীমিত রাখলে চলে না, তার উন্নয়ন ও বিকাশের চেষ্টাও করতে হয়। সংস্কৃতিও যা আছে তা নয়, যা কাম্য তারই দিশা দান সাহিত্যিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

অতএব, দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচর্যা ও দেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে শিল্পী সাহিত্যিকের জীবনের যোগসাধন মানে দেশের সমাজ-সংস্কৃতির বর্তমান স্বরূপ তুলে ধরা নয়, বাঞ্ছিত সমাজ-সংস্কৃতির রূপ এঁকে দেয়া। এজন্যে বাজ্জাল বিস্তার কিংবা কাল্পনিক অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির ও চরিত্রাঙ্কনের প্রয়োজন নেই। বর্তমান সমাজ ও সংস্কৃতির অসঙ্গত, অসুন্দর ও অকল্যাণপ্রসূ দিক উদঘাটিত হলেই এ উদ্দেশ্য সহজেই সিদ্ধ হয়। প্রীতি ও প্রত্যয়ই এ কর্মে সাফল্যের সম্বল। কেননা প্রীতিহীন হৃদয় ও প্রত্যয়হীন কর্ম দু-ই অসার্থক।

যারা দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অতীতরূপের ধ্যানে আসক্ত, কিংবা বর্তমান রূপের অনুরাগী ও অনুগত, তাঁরা জীবন-বিমুখ, প্রগতি-ভীরু। তাঁদের বুদ্ধি স্বল্প, দৃষ্টি ক্ষীণ ও বোধ অগভীর। শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে তেমন লোকের সংখ্যা যত কম হয়, ততই মঙ্গল।

পঁচিশে বৈশাখে

আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। কলম হাতে নিয়েছি তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করব বলেই। কিন্তু তার : আগে দু-একটা কথা সেরে নিই।

সাহিত্য শাস্ত্র নয়, জ্ঞানভাণ্ডার নয়, বিষয়-বিদ্যা তথা অর্থকর বিদ্যাও নয়। সব মানুষের মধ্যে অল্প-বিস্তার রসপিপাসা থাকলেও তারা পরচর্চা করেই তা মিটিয়ে নেয়,–বড়োজোর গান-গল্প কাহিনী মুখে মুখে শুনেই তারা তৃপ্ত থাকে। কাজেই সাহিত্য সবার জন্যে নয়। সাহিত্যানুরাগ আবাল্য অনুশীলন সাপেক্ষ। যারা সচেতনভাবে সাহিত্যরস গ্রহণে উৎসুক নয়, সাহিত্য তাদের জীবনে অপ্রয়োজনীয়। এজন্যে লেখাপড়া-জানা লোক মাত্রেই সাহিত্যপাঠক বা সাহিত্যানুরাগী নয়। এমন শিক্ষিত লোকও আছে, যারা পাঠ্যবইয়ের বাইরে একটি গ্রন্থও পড়ে নি জীবনে।

সাধারণ মানুষ চলে প্রাণধর্মের তাকিদে। প্রাণীর প্রাণধারণের পক্ষে যা প্রয়োজন, তা পেলেই প্রাণী সন্তুষ্ট। সমাজবদ্ধ সাধারণ মানুষও জীবন ও জীবিকার অবলম্বন পেলেই আর কিছুরই তোয়াক্কা করে না। পশুর জীবন যেমন প্রবৃত্তি ও প্রকৃতিচালিত, সাধারণ মানুষের জীবনও তেমনি নীতি ও নিয়ম নিয়ন্ত্রিত। এ নিয়ন্ত্রণে বিচলন ঘটায় কেবল লিলা। বৈষয়িক জীবনে প্রয়োজন কিংবা সামর্থ্যাতিরিক্ত লিপ্সাই বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় আনে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে। এই লিপ্সা নিয়ন্ত্রণের জন্যেই মানুষ গড়ে তুলেছে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। আর এই নিয়ন্ত্রিত জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌন্দর্য বিধানের জন্যেই মানুষ সৃষ্টি করেছে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি প্রভৃতি।

এগুলোর মধ্যে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শন মনুষ্যত্ব ও মানবতা বিকাশের সহায়ক। মনুষ্যত্বের ও মানবতার অনুশীলন ও বিকাশ সাধনের জন্যে এগুলোর চর্চা ছিল প্রত্যেক মানুষের পক্ষেই আবশ্যক। কিন্তু সাধারণ মানুষ সে-প্রয়োজন ও দায়িত্ব স্বীকার করে নি কখনো। তাই সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কিংবা দর্শন চিরকালই গুটিকয় মানুষের সাধ্য-সাধনায় রয়েছে সীমিত।

সাহিত্য, শিল্প,সঙ্গীত ও দর্শন মানুষের আত্মার উপজীব্য। সাধারণ মানুষ অবশ্য আত্মা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা জানেও না ওটা কী বস্তু। সমাজ-ধর্মের সংস্কারবশেই তারা আত্মার অবিনশ্বরত্ব স্বীকার করে এবং সে-কারণেই পারত্রিক জীবনে আস্থা রাখে। তাই সমাজ-ধর্ম নির্দেশিত পাপ-পুণ্যবোধেই তাদের আত্মতত্ত্ব সীমিত। যারা জীবনের গভীরতর তাৎপর্য-সচেতন, তারা জানে, চেতনাই আত্মা। এবং এ চেতনা পরিশীলন ও পরিচর্যার অপেক্ষা রাখে। কেননা, পরিসুত ও পরিমার্জিত চেতনাতেই মনুষ্যত্ব ও মানবতার উদ্ভব। বলতে গেলে—-সাহিত্য শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শন একই সঙ্গে বীজ, বৃক্ষ ও ফল। কেননা সাহিত্যদর্শনাদি যেমন পরিসুতি ও পরিমার্জনার উপকরণ, তেমনি আবার পরিশীলিত চেতনার ফলও বটে। তাই সাহিত্যদর্শনাদি একাধারে আত্মার খাদ্য ও প্রসূন।

মানুষের মধ্যে যে-সব জীবনযাত্রী–বিষয়ে নয়–চেতনার মধ্যেই জীবনকে অনুভব ও উপভোগ করতে প্রয়াসী; সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শন তাদেরই আত্মার খাদ্য। এসব তাদের জীবনের অপরিহার্য অবলম্বন। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কিংবা দর্শন চর্চা করে এ ধরনের লোকই শান দেয় তাদের চেতনায়। মনুষ্যত্বের দিগন্তহীন উদার বিস্তারে মানস-পরিভ্রমণ তাদের আনন্দিত করে, আর মানবতাবোধের অসীম অতল সমুদ্রে অবগাহন করে ধন্য হয় তারা।

মনুষ্যত্ব ও মানবতার সাধনা ফলপ্রসূ নয় ব্যবহারিক জীবনে, বরং ক্ষতিকর। এজন্যে লোকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলে এ সাধনা। তাই এ পথ যাত্রীবিরল। তারা পরিহার করে চলে বটে, কিন্তু তাচ্ছিল্য করে না–কেবল বিষয়-লিপ্সাবশে এ পথ গ্রহণে উৎসাহ পায় না–এ-ই যা।

যে-স্বল্পসংখ্যক লোক মানুষের আত্মার খাদ্যরূপে এ ফসল ফলায়, আর যারা এর গ্রাহক, তারা বিষয়ে রিক্ত হলেও যে অন্তরে ঋদ্ধ, তা সাধারণ মানুষও উপলব্ধি করে তাদের অনুভবের সুন্দরতম মুহূর্তে। এজন্যেই তারা হেলা করে বটে, কিন্তু শ্রদ্ধাও রাখে।

এগুলোর মূল্য সম্বন্ধে তাদের অবচেতন মনের স্বীকৃতি রয়েছে বলেই লিলুর বিষয়বুদ্ধি নিয়ে তারা এগিয়ে আসে এগুলোর মূল্যায়নের জন্যে এবং স্বার্থবুদ্ধিবশে বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায় এগুলোর উপর। এমনকি ফরমায়েশ করবার ঔদ্ধত্যও প্রকাশ হয়ে পড়ে কখনো কখনো। স্বার্থপরের বিষয়বুদ্ধিপ্রসূত এই নিয়ন্ত্রণ-প্রচেষ্টা সময়ে সময়ে জুলুমের পর্যায়ে নামে। এবং তখনই শুরু হয় মনুষ্যাত্মা, মনুষ্যত্ব ও মানবতার দুর্দিন।

সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শন আত্মার উপজীব্য বলেই যারা চেতনা-গভীর জীবন কামনা করে, এগুলোর স্রষ্টা তাদের আত্মীয়। আত্মার জগতে দেশ-কাল-জাত-ধর্ম নেই। তাই দেশ, কাল, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র কিংবা জাতীয়তায় চিহ্নিত নয় এ চেতনালোক। এখানে যে কেউ আত্মার খাদ্য যোগায় সে-ই আত্মীয়। যা কিছু এ চেতনার বিকাশবিস্তারের সহায়ক, তা-ই বরণীয়।

সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শনের ক্ষেত্রে মানুষের যা কিছু সার্থক সৃষ্টি তা চেতনা-প্রবণ বিশ্বমানবের সাধারণ সম্পদ, রিথ ও ঐতিহ্য। একক চন্দ্র-সূর্য যেমন সবার এজমালি হয়েও প্রত্যেকের অখণ্ড সম্পদ, এবং দ্বন্দ্ব না করেই প্রত্যেকেই নিজের ইচ্ছা ও প্রয়োজন মতো পেতে পারে এগুলোর প্রসাদ; তেমনি সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত আর দর্শনও দেশ-কাল-জাত-ধর্ম নিরপেক্ষ সর্বমানবিক সম্পদ। কল্যাণ ও সুন্দরের ক্ষেত্রে কোনো মানবতাবাদীই মানে না জাত ও ভূগোল।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতকার ও দার্শনিক। তাই রবীন্দ্রনাথ চেতনা-প্রবণ মানুষমাত্রেরই আত্মীয়। পাক-ভারতে ইতিপূর্বে মানবাত্মার এত বিচিত্র খাদ্য আর কেউ রচনা করেননি। পৃথিবীর ইতিহাসেও এমন রকমারি ফসলের স্রষ্টা সুদুর্লভ! এত বড়ো মানবতাবাদীও ঘরে-ঘরে জন্মায় না। পৃথিবীর আত্মীয়-সমাজে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পরমাত্মীয়। কেননা, যে-ভাষা আমাদের জীবনানুভূতির ও জীবনোপভোগের বাহন, যে-ভাষা আমাদের জীবনস্বরূপ, সেই আত্মার ভাষাতেই আমাদের আত্মার উপজীব্য দিয়ে গেছেন তিনি। এত বড়ো সুযোগ ও সৌভাগ্যকে হেলা করার মতো নির্বোধ হই কী করে! জীবনের সঙ্গে জীবনের যোগ সাধনের যে-দিশা ও দীক্ষা আমরা তাঁর কাছে পেয়েছি, আজকে গরজের সময়ে যদি তা আমাদের পাথেয় করতে পারি, তবেই ঘটবে আমাদের মনের মুক্তি। আর আমাদের চেতনায় পাব মানবতার স্বাদ।

সম্প্রতি জাতির হিতকামী, কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রভাবের মধ্যে অমঙ্গলের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করে শঙ্কিত, আতঙ্কিত কিংবা দুর্ভাবনাগ্রস্ত। রবীন্দ্রসাহিত্য নাকি আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংসী। অন্য কোনো বিদেশী সাহিত্যের কু-প্রভাব কিংবা কুফল সম্বন্ধে কিন্তু চিন্তিত নন তারা। অন্তত তাঁদের কর্মে ও আচরণে এখনো প্রকাশ পায়নি সে-ত্রাস। নইলে ইসলামী রাষ্ট্রের মুমীন নাগরিকের উপর চীন-রাশিয়ার ধনসাম্যবাদী নাস্তিক্য সাহিত্যের প্রভাবের মধ্যে নিশ্চয়ই অমঙ্গল দেখতেন তারা এবং শঙ্কিত হতেন মার্কিনী যৌন ও গোয়েন্দা সাহিত্যের জনপ্রিয়তা দেখে। এ বিষয়ে হিতবুদ্ধিপ্রসূত কোনো অসন্তোষও তাঁদের মুখে প্রকাশ পায় নি কিংবা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা করেছেন বলেও আমাদের জানা নেই।

তাদের এই নিশ্চিন্ত উদারতা দেখে মনে হয়, তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে, একাকিত্বে কিংবা স্বাতন্ত্রে মন-বুদ্ধি-আত্মার বিকাশ নেই, এবং বহির্বিশ্বের আলো-বাতাসের লালন না পেলে জ্ঞান প্রজ্ঞা-বোধের উন্মেষ হয় না কিংবা গণসংযোগ ব্যতীত ভাব-চিন্তা-কর্মের প্রসার অসম্ভব। কেননা, মানুষের জীবন পরিবেশ ও পরিবেষ্টনী নির্ভর। সে-পরিবেষ্টনী যার জগৎ-জোড়া, তার জীবনের বিস্তার ও চেতনার গভীরতা নিশ্চয়ই বেশি। তা হলে তাঁদের রবীন্দ্র-সাহিত্য বিরোধিতার কারণ অন্য কিছু। আমরা অন্তর্যামী নই। কাজেই সে-কথা থাক।

কিন্তু আমাদের অন্য প্রশ্নও আছে। স্বধর্মী বলেই যদি ভারতের জাতীয় কবি গালেব-হালি নজরুল পাকিস্তানী মুসলমানদের প্রিয় ও প্রেরণার উৎস হতে পারেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের অমুসলমান নাগরিকরাই বা কেন তাদের স্বধর্মী বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ প্রভৃতির সাহিত্য পড়ার সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে! হিন্দু-রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পড়ে যদি মুসলমানের সংস্কৃতি নষ্ট হয়, তা হলে হিন্দুর সংস্কৃতি নিশ্চয়ই প্রাণ পায়। পাকিস্তানের অমুসলমানেরও যদি সমনাগরিকত্ব স্বীকৃত হয়, তা হলে তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিচর্চার অধিকারও মেনে নিতে হবে। সংখ্যাগুরুর স্বার্থে সংখ্যালঘুর অধিকার হরণ নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক। অতএব শিশু, ছাত্র, মহিলা, সৈনিক, বুনিয়াদী গণতন্ত্রী প্রভৃতির জন্যে যেমন রেডিয়ো-টেলিভিশনে স্বতন্ত্র আসরের ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনি শক্তি বৈষ্ণব ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরও থাকা উচিত। কেননা, সমদর্শিতাই সুবিচারের পরিমাপক।

মহৎচিত্তের ভাব-চিন্তা জ্যোৎস্নার মতোই সুন্দর, স্নিগ্ধ ও প্রীতিপদ। জ্যোৎস্না কখনো ক্ষতিকর হয় না। ও কেবল আলো ও আনন্দ দেয়, স্বস্তি ও শান্তি আনে আর দূর করে ভয় ও বিষাদ। মহৎসৃষ্টিও মানুষের মনের গ্লানি মুছে দিয়ে চিত্তলোকে আশা ও আনন্দ জাগায়, প্রজ্ঞা ও বোধি জন্মায়, আর জগতে ও জীবনে লাবণ্যের প্রলেপ দিয়ে বৃদ্ধি করে জীবন-প্রীতি,–দীক্ষা দেয় মনুষ্যত্বে ও মানবতার মহিমায় চেতনায়। এই কারণেই তো সাহিত্যরস তথা কাব্যরস ব্রহ্মাস্বাদ সহোদর। জীবনে মানুষ ও প্রকৃতির দেয়া দুঃখ-যন্ত্রণার অন্ত নেই। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শন এসব জীবন-যন্ত্রণা ভুলবার অবলম্বন। তা থেকে বঞ্চিত হলে কী করে বাঁচবে হৃদয়বান চেতনা-প্রবণ মানুষ!

এজন্যেই দেশী লেখক-প্রকাশকের নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন তরী বাঞ্ছায় বিদেশী গ্রন্থের আমদানি বন্ধের আমরা বিরোধী। জীবনের আর আর ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতি ও ব্যবহারিক অসুবিধা স্বীকার করেও দেশী শিল্প ও সম্পদের আনুকূল্য করব। কিন্তু মনের চাহিদার ক্ষেত্রে দইয়ের সাধ ঘোলে মিটানো অসম্ভব। এখানে রস-পিপাসা মিটাতে অকৃত্রিম রসেরই প্রয়োজন। জৈব চাহিদা আর মানস-প্রয়োজন অভিন্ন নয়। লা মিজারেবল, ওয়ার এ্যান্ড পিস, মাদার, জঁ ত্রিস্তফ কিংবা ঘরে বাইরে পড়ার সাধ আনোয়ারা, মনোয়ারা, সোনাভান পড়ে মিটবে না। তাছাড়া এ যখন আমার শখের ও সাধের পড়া, এখানে বাধ্য করা পীড়নেরই নামান্তর। আমি পড়ি–আমার বৈষয়িক, আর্থিক, জৈবিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভুলে থাকবার জন্যে, আর আমার চিত্তের সৌন্দর্য-অন্বেষা ও রসপিপাসা চরিতার্থ করবার জন্যে। আমি পড়ি–আমার আত্মার বিকাশ কামনায়–আমার চেতনার প্রসার বাঞ্ছয়,–আমার মানবিকবোধের উন্নয়ন লক্ষ্যে ও আমার মানবতাবোধের বিস্তার করে।

যাতে আমি আনন্দ পাইনে, তা দিয়ে আমি কী করে সৃষ্টি করব আমার পলাতক মনের আনন্দ-লোক! কাজেই বইয়ের ক্ষেত্রে স্বাদেশিকতা কল্যাণকর নয়। দেশের ভালো বই পড়ব তো নিশ্চয়ই, গর্বও বোধ করব তার জন্যে। সে-বইয়ের যে প্রতিযোগিতার ভয় নেই, তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।

রবীন্দ্রনাথের জন্মথিতিতে তাঁর সম্বন্ধে কিছু লিখে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা প্রকাশ করব বলেই কলম হাতে নিয়েছিলাম। নানা কথার চাপে মূল বিষয় হারিয়ে গেছে বটে, তবে মূল উদ্দেশ্য হয়তো ব্যর্থ হয় নি। কেননা, রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রীতিই এসব বাজে কথা জাগিয়েছে আমার মনে। সবভাষা আমাদের জানা নেই। বিশ্বের সেরা বইগুলো কখনো পড়া হবে না জীবনে। এইসব বই যে-সব মহত্মনের সৃষ্টি, সে-সব মনের ছোঁয়াও মিলবে না কখনো। রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের সে-সব মহৎ মনের প্রতিনিধি রূপে গ্রহণ করে বঞ্চিত আত্মাকে প্রবোধ দিতে চাই আমরা। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্রষ্টাদের চিত্তদূত-মানবতার দিশারী, আমাদের সামনে এক আলোকবর্তিকা, এক অভয়শরণ, এক পরম সান্ত্বনা। আমার ভাষাতেই তার বাণী শুনতে পাই, তাঁর ভাষাতেই আমার প্রাণ কথা কয়–আমার এ সৌভাগ্যের তুলনা নেই। জয়তু রবীন্দ্রনাথ।

বাঙলা প্রণয়োপাখ্যানের উৎস

মুসলমানেরাই যে এদেশে মানবিক-রসাশ্রিত সাহিত্যধারার প্রবর্তন করেন, এ তথ্য এখন আর কারুর কাছেই নতুন নয়। এটি হচ্ছে ইরানী সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। দরবারের ইরানী ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এদেশের হিন্দু-মুসলমানের পরিচয় একই সূত্রে ও একই সময়ে ঘটলেও প্রভাবের তারতম্য ঘটেছে বিস্তর। অপেক্ষাকৃত সংস্কারভারমুক্ত একেশ্বরবাদী মুসলমানের স্বাজাত্যবোধ ইরানী সংস্কৃতি স্বীকরণে সহায়তা করেছে প্রচুর, কিন্তু সংস্কার-পঙ্গু হিন্দুর পক্ষে ছয়শ বছরেও তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাই মুসলমানেরা যখন আধুনিক সংজ্ঞার বিশুদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি করছিল, তখনও হিন্দুরা দেবতা ও অতিমানব জগতের মোহ ত্যাগ করতে পারেনি। চর্যাকার থেকে করিওয়ালা অবধি হিন্দুর হাতে দেবমাহাত্মজ্ঞাপক ধর্মীয় প্রচার সাহিত্যই পেয়েছি। ধর্মভাগ জাগানো এর লক্ষ্য-সাহিত্য-শিল্প এর আনুষঙ্গিক রূপ এবং সাহিত্য রস এর আকস্মিক ফল। অপরদিকে মুসলমানদের হাতে বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা বিচিত্রভাবে সৃষ্ট ও পুষ্ট হতে থাকে।

মুসলমান রচিত সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিক রস বা মানবতা। একালে মানবতা বলতে যা বোঝায়, এ কিন্তু তা নয়। এ মানবতা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নির্দেশ করে। অর্থাৎ বিস্ময়-চঞ্চল কল্পচারী মানুষের প্রকৃতি, নিসর্গ ও মানস-সৃষ্ট দেব-দানব সম্বন্ধীয় আদিম কৌতূহল চোখে-দেখা মানবমুখী হয়ে উঠে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে ওরাও রইল মানুষকেও জিজ্ঞাসার বিষয় করে নিল। প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত, লৌকিক ও অলৌকিক, স্বপ্ন ও কল্পনা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষের কোনো সীমারেখা স্বীকৃত নয় এ লোকে। নদী-নগরী, গিরি-মরু-কান্তার, আকাশ-মাটি-সাগর ও স্বর্গ-মর্ত্য পাতালের পরিসরে দেব-দানব রক্ষা-যক্ষের সমবায়ে গড়ে উঠেছে এ জগৎ। বাহুবল, মনোবল আর বিলাস-বাঞ্ছাই সে জীবনের আদর্শ। সংগ্রামশীলতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা সে-জীবনের ব্রত এবং ভোগই লক্ষ্য। এক কথায়, সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্বিক জীবনের উল্লাসই এ সাহিত্যে প্রকটিত।

সংস্কৃতের পাক-ভারতিক ভাষায় প্রথম বিশুদ্ধ সাহিত্যিক শালীন রচনা হচ্ছে আবদুর রহমানের সংনেহয়-রাসয় বা সন্দেশ রাসক। এটি হচ্ছে একটি দূতকাব্য এবং বারো শতকে অপভ্রংশে বা অবহট্টে রচিত। মূলতানবাসী কবি আবদুর রহমান তাঁতি মীর হোসেনের সন্তান। অতএব দেশজ মুসলমান।

অপভ্রষ্টে বা অবহট্টে রচিত দ্বিতীয় কাব্যের নাম পহুরিরায় রাসউ বা পৃথ্বীরাজ রাসক। এর রচয়িতা চন্দ বলি বা চন্দ বরদাই। জনপ্রিয়তার ফলে ভাষা ক্রমে আধা-হিন্দিতে রূপান্তরিত হওয়ায়, এটি কালে আদি হিন্দি কাব্যরূপে প্রখ্যাত হয়। এ দুটোই দিওয়ান জাতের কাব্য। আনন্দ ধর রচিত সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ মিশ্রিত কাব্য মাধবানল-কামকলাও এখানে উল্লেখ্য।

এদিকে দাক্ষিণাত্যে তেলেগু ভাষাতে দণ্ডলির সংস্কৃত দশা কুমার চরিত-এর তেরো শতকে কৃত একটি পদ্যানুবাদ পাওয়া গেছে। পাঞ্জাবি লৌকিক ভাষায় রচিত গানের আদি নিদর্শন মিলেছে শিখ গুরু অর্জুনের আদিগ্রন্থে। এ অধ্যাত্মসঙ্গীত রচনা করেছেন নিযামুদ্দীন আউলিয়ার মুর্শিদ, সাধক কবি শেখ ফরীদুদ্দীন শক্করগঞ্জ (মৃ. ১২৬৭ খ্র.)। হিন্দি ভাষায় প্রথম কবি লোদী দরবারের আমীর খসরু (১২৫৪-১৩২৫ খ্র.)। ইনি হিন্দিতে কবিতা, গান ও প্রহেলিকা রচনা করছেন।

কবি দামোর লক্ষ্মণ সেন পদ্মাবতী কথা রচনার কাল নিয়ে মতভেদ আছে। রচনা শুরুর কাল কারুর মতে ১৫২৬ সংবৎ তথা ১৪৫৯ খ্রীস্টাব্দ, আবার কেউ কেউ মনে করেছেন ১৫৭০ সংবৎ বা ১৫১৩ খ্রীস্টাব্দ। এটি উপাখ্যান। শাহ ফিরোজ তুগলকের আমলে মালিক নাসিরের আদেশে লোকগাথা ভিত্তি করে হিন্দি-মসনবী চান্দাইন রচনা করেন কবি মোল্লা দাউদ। রচনা সন ৭৮১ হিজরি বা ১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ।

এটি সুফী কবির তত্ত্বরসাত্মক মরমী গাথা। কিন্তু মিয়া সাধনের মৈনাস ও হয়তো দাউদের মসনবীর পরেরকার রচনা নয়। এ অনুমানের সমর্থন মিলেছে ৯১১ হিজরি বা ১৫০৬ খ্রীস্টাব্দের লেখা মানের পাণ্ডুলিপি প্রাপ্তিতে।৭

অনুলিপিই যখন ১৫০৬ খ্রীস্টাব্দের, তখন মূল রচনার তারিখ নিঃসংশয় অনুমানে বিশ-পঁচিশ বছর পিছিয়ে দেয়া যায়। পনেরো শতকের প্রথমার্ধের সিন্ধি মরমী কবি সাধন মৈনাসৎ-এর কবি মিয়া সাধন অভিন্ন ব্যক্তি বলে মনে করবার কারণ নেই। সাধন পূর্ব-উত্তর ভারতের কবি, এবং ভাষা ঠেঠ-হিন্দি ( ভোজপুরী-অবধীঃ)। সাধন ভগৎ যদি এ কাব্যের রচিয়তা হতেন, তাহলে সিন্ধি কবির হিন্দি বিশুদ্ধতর হত। অবশ্য মৈনাসৎ ও অধ্যাত্মরূপক কাব্য। লোর চান্দাইনের অপর কবি সয়ফুলমূলক বদিওজ্জামান ( ১৬২৬ খ্র.) ও তুতিনামা (১৬৪০) রচয়িতা গাওয়াসি, ইনি গোলকুণ্ডার সুলতান আবদুল্লাহ কুতুব শাহর দরবারে ছিলেন।

লোর-চন্দ্রানী উপাখ্যানের পরে রচিত হয় অধ্যাত্মরূপকাশ্রিত আখ্যায়িকা মৃগাবতী। গৌড় সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আশ্রিত জৌনপুরের শর্কী সুলতান হোসেন শাহর সভা কবি কুতবন ৯০৯ হিজরি বা ১৫০৪ খ্রীস্টাব্দে এটি রচনা করেন :

নউ সউ নব জব সংবত অহী।
জিব মোহরম চান্দ উজিয়ারী
য়হ কবি কহী পূরী সংয়ারী
গাহা দোহা অবেল অরজ
সোরঠা চৌপছ কই সরজ
সাস্তর অখির বহুতই আয়ে
অউ দেসী চুনি চুনি কছলায়ে।  [সুকুমার সেনের পাঠ : ইসলামি বাঙলা সাহিত্য]

অতএব, এটিও লোককাহিনী ভিত্তিক। আঠারো-বিশ শতকের কোনো কোনো বাঙলা উপাখ্যানে মৃগাবতীর অনুসরণ আছে। আঠারো শতকের কবি মুহম্মদ মুকিম মৃগাবতী বাঙলায় অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু এ কাব্য আজও পাওয়া যায়নি।

এর পরে লোকসাহিত্যের জনপ্রিয় পুরোনো উপাখ্যান নিয়ে রূপকাশ্রিত মাধবানল-কামকলা কাব্য রচনা করেন গণপতি (১৫২৭ খ্রী.)। কুতবন প্রভাবিত জায়সীর পদ্মাবৎ রচিত হয় ১৫৪০ খ্রস্টাব্দে। পদ্মাবৎ রূপকাশিত হলেও অতি উৎকৃষ্ট কাব্য।

অতএব, সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশের পাক-ভারতিক আর্য ভাষায় পনেরো শতকের আগে রচিত ধর্মনিরপেক্ষ উপাখ্যান একটিও নেই। পনেরো শতকের শেষার্ধের রচনা বলে চিহ্নিত করা যায় মাত্র একটি। সেটি মোল্লা দাউদের মরমী গাথা চান্দাইন (১৪৮০ খ্রী.); এবং এ-সময়কার বলে অনুমান করা যায় আরও দুটো : দামোর লক্ষণ সেন পদ্মাবতী কথা (১৫৪৯ খ্রী.?) এবং মিয়া সাধনের মৈনাস (১৫৭০-৮০ খ্রী.?) আর সাধারণভাবে তেরো শতকের আগেকার রচনার কোনো নিদর্শনই বাঙলা ছাড়া অপর কোনো আধুনিক পাক-ভারতিক আর্য ভাষায় মেলেনি। সে দিক দিয়ে দেখলে চর্যাগীতি যেমন আধুনিক পাক-ভারতিক আর্য ভাষার আদি নমুনা, তেমনি শাহ মুহম্মদ সগীরের (১৩৮৯-১৪১০ খ্রী.) ইউসুফ জোলায়খাই আদি প্রণয়োপাখ্যান। কেননা, কবি দাউদের চান্দাইন অধ্যাত্মতত্ত্বরসাশ্রিত মসনবী কাব্য আর দামো ও সাধনের কাব্যের রচনাকাল অনিশ্চিত। নতুন কোনো তথ্য-প্রমাণ না-মেলা অবধি আমাদের এ মতই পোষণ করতে হবে। চর্যাগীত যেমন পাক-ভারতিক ভাষা-জগতে নবযুগের স্মারক স্তম্ভ, তেমনি ইউসুফ জোলায়খাও রোমান্টিক সাহিত্যের গৌরব-মিনার।

ভারতে মুসলমান অধিকার যেমন ইরানী সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এদেশবাসীর পরিচয় ঘটিয়েছে, তেমনি একচ্ছত্র শাসন ভারতের অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এরূপে বাঙালিরা ইরানী ও হিন্দি ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে এবং ঐ দুটোর আদর্শে ও অনুসরণে নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচর্যা করে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হয়েছে।

বাঙালি মুসলমান রচিত সাহিত্যও মূলত অনুবাদ সাহিত্য। ফারসি-হিন্দি অবলম্বনে গড়ে উঠেছে রোমান্টিক সাহিত্য এবং আরবি-ফারসি থেকে অনূদিত হয়েছে ধর্ম ও যুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ। অনুবাদ বলতে আধুনিক সংজ্ঞায় যা, বোঝায়, সবক্ষেত্রে ঠিক তা ছিল না। অনুবাদ ছিল তিন প্রকারের : কায়িক, ছায়িক ও ভাবিক অর্থাৎ আক্ষরিক, স্বাধীন অনুসৃতি ও ভাবাবলম্বন।

ফারসি প্রণয়োপাখ্যানগুলো (কোনো কোনো হিন্দু আখ্যায়িকাও) প্রধানত সূফীতত্ত্বের রূপকাশ্রিত হলেও বাঙলায় তর্জমা হয়েছে লৌকিক প্রণয়োপাখ্যানরূপেই। তত্ত্বকথাকে এভাবে রস কথায় রূপান্তরের প্রবণতার মধ্যে জীবনবাদী বাঙালি মানসের স্বরূপ ধরা পড়েছে। চর্যা-বাউল বৈষ্ণব-মুর্শিদী প্রভৃতি অধ্যাত্মগীতির উদ্ভবক্ষেত্র বাঙলায় এ মানবিক-রসপ্রীতি লক্ষণীয় ও বিশেষ অর্থপূর্ণ।

সে-যুগের হিসেবে বাঙলা রোমান্টিক সাহিত্য পরিমাণে প্রচুর, যদিও বৈশিষ্ট্যে বিচিত্র নয়। চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে যার শুরু, বটতলার বদৌলতে আজ অবধি তার ইতি ঘটেনি। অধিকাংশ রোমান্স উনিশ-বিশ শতকে দোভাষী রীতিতে রচিত এবং রূপে-রসে নিতান্তই তুচ্ছ, আর ভাবে ও ভঙ্গিতেও বৈশিষ্ট্যহীন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত লোকের সাহিত্য সৃষ্টি হওয়ার পর ওসব রচনার আর কোনো সাহিত্যিক মূল্যই নেই এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্যও নগণ্য। তাই আমরা ওগুলো বাদ দিয়ে আঠারো শতক অবধি রচিত ও জ্ঞাত রোমান্সগুলোর নাম করছি।

চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে কিংবা পনেরো শতকের প্রথম দশকে রচিত হয় শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ-জোলায়খা। ষোল শতকে পাচ্ছি দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু, মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী, শাহ বারিদ খানের বিদ্যা সুন্দর। সতেরো শতকের উপাখ্যান হচ্ছে : দোনা গাজীর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান, কাজী দৌলতের সতীময়না লোর চন্দ্রানী, আলাউলের পদ্মাবতী, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান, সপ্তপয়কর, রতন-কলিকা-আনন্দ-বর্মা, মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবতী, আবদুল হাকিমের লালমতী সয়ফুল মুলুক, ইউসুফ-জোলেখা, নওয়াজিশ খানের গুলে বকাউলী, পরাওলের শাহপরীর কেচ্ছা, মঙ্গল চাঁদের শাহ্ জালাল-মধুমালা। (এতে মঙ্গল কাব্যের মর্মগত অনুকৃতি আছে), সৈয়দ মুহম্মদ আকবরের জেবল মুলুক-সামারোখ, শরীফ শাহ্র লালমতী সয়ফুল মুলুক আর আঠারো শতকে রচিত হয়েছে খলিলের চন্দ্রমুখী, মুহম্মদ মুকিমের গুলে-বকাউলী, কালাকাম, মৃগাবতী, মুহম্মদ আবদুল করিম খোন্দকারের তামিম আনসারী, রফিউদ্দিনের জেবলমুলুক সামারোখ, শাকের মাহমুদের মধুমালা-মনোহর, নুর মুহম্মদের মধুমালা, রামজয়ের শশিচন্দ্রের পুঁথি, দ্বিজপশুপতির চন্দ্রাবলী, গরীবুল্লাহর ইউসুফ-জোলেখা, সোনাভান, সৈয়দ হামজার মধুমালতী, জৈগুনের কেচ্ছা, মুহম্মদ আলী রাজার তমিমগোলাল চৈতুন্ন সিলাল, মিশরী জামাল, মুহম্মদ আলীর শাহ পরী মল্লিকা জাদা, হাসান বানু, আবদুর রজ্জার্কের সয়ফুল মুলুক লালবানু, শমশের আলীর রেজওয়ান শাহ, মুহম্মদ জীবনের বানু হোসেন বাহরাম গোর কামরূপ কালাকাম প্রভৃতি।

বাঙলা ভাষার প্রতি সেকালের লোকের মনোভাব

॥ ভাষা বিদ্বেষ ॥

ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন না হলে আগের যুগে কোনো বুলিই লেখ্যসাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হত না। আদিযুগে সংস্কৃতই ছিল পাক-ভারতের ধর্মের, শিক্ষার, দরবারের, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের ভাব-বিনিময়ের বাহন। বৌদ্ধ ও জৈনমত প্রচারের বাহনরূপেই প্রথম দুটো বুলি–পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যিক ভাষার স্তরে উন্নীত হয়। তারপর অনেককাল রাষ্ট্রশাসন কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগেনি বলে আর কোনো বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি। পরে সাহিত্যের প্রয়োজনে নাটকে শৌরসেনী, মারাঠী ও মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতে থাকে। আরো পরে রাজপুত রাজাদের প্রতিপোষকতায় শৌরসেনী অপভ্রষ্ট বা অবহট্ঠ সাহিত্যের ভাষার রূপ পায়।

এরপরে মুসলমান আমলে ফারসি হল দরবারী ভাষা। মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এদেশী জনজীবনে যে ভাব-বিপ্লব এল, বিশেষ করে তারই ফলে আধুনিক পাক-ভারতিক আর্যভাষাগুলোর দ্রুত সাহিত্যিক বিকাশ সম্ভব হল। এক্ষেত্রে ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই সব কয়টি আঞ্চলিক বুলি লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এ ব্যাপারে রামানন্দ, কলন্দর, নানক, কবীর, দাদু, একলব্য, রামদাস, চৈতন্য, রজব প্রভৃতি সন্তগণের দান মুখ্য ও অপরিমেয়।

এদিক দিয়ে পূর্বী বুলিগুলোর ভাগ্যই সবচেয়ে ভাল। এসব বুলি যখন সৃজ্যমান তখন এদের জননী অর্বাচীন অবহট্ঠ বৌদ্ধ বজ্রযান সম্প্রদায়ের যোগ-তন্ত্র-শৈবমত প্রভাবিত এক উপশাখার সাধন-ভজনের মাধ্যম হবার সুযোগ পায়–যার ফলে আধুনিক আর্য ভাষার (অবহট্ঠ থেকে ভাষাগুলোর সৃষ্টিকালের বা দুইস্তরের অন্তর্বর্তীকালের বা সন্ধিকালের) প্রাচীনতম নিদর্শন-স্বরূপ চর্যাগীতিগুলো পেয়েছি।

তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন-সাহিত্যের বাহন হল। আর এর দ্রুত বিকাশের সহায়ক হল চৈতন্য-প্রবর্তিত মত। আবার আঠারো-উনিশ শতকে খ্রীস্ট ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারের, হিন্দু সমাজ সংস্কারের এবং কোম্পানীর শাসন পরিচালনের প্রয়োজনে বাঙলা গদ্যের সৃষ্টি ও দ্রুত পুষ্টি হয়। এসব আকস্মিক সুযোগ সুবিধা পেয়েও বাঙলা ভাষা স্বাভাবিক ও স্বাধীন বিকাশ লাভ করেনি; কারণ পর পর সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজির চাপে পড়ে বাঙলা কোনোদিন জাতীয় ভাষার বা সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ভাষার মর্যাদা পায়নি। আজ অবধি বাঙলা একরকম অযত্নে লালিত ও আকস্মিক যোগাযোগে পুষ্ট।

হয়তো দেশ শাসনের প্রয়োজনেই দেশীভাষার অনুশীলনের প্রবর্তনা দিয়েছিলেন সুলতান সুবাদারগণ। যেমনটি ফোর্ট-উইলিয়াম কলেজে দেখেছি পরবর্তীকালে। কিন্তু সুলতান-সুবাদারের প্রবর্তনা সত্ত্বেও সাধারণভাবে অনেক কাল অভিজাতরা বাঙলাভাষার প্রতি বিরূপ ছিল। হয়তো বুলি বলেই এ অবজ্ঞা। ফলে উনিশ শতকের আগে বাঙলা কোনোদিন শক্তিমানের পরিচর্যা পায়নি, তাই অন্তত দশশতক থেকে বাঙলাভাষায় সৃষ্টিকর্ম শুরু হলেও তা সময়ের অনুপাতে অগ্রসর হতে পারেনি। শেক্সপিয়র যখন তাঁর অমর নাটকগুলো রচনা করছিলেন, তখন আমাদের ভাষায় মুকুন্দরাম ও সৈয়দ সুলতানই শ্রেষ্ঠ লেখক। প্রতিভার অভাব হেতুই আমাদের হিন্দু-মুসলমানের রচনা পুচ্ছগ্রাহিতায় তুচ্ছ।

মধ্যযুগে হিন্দুরা বাঙলাকে ধর্মকথা তথা রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ও লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহনরূপেই কেবল ব্যবহার করতেন। মালাধর বসুর কথায়–পুরাণ পড়িতে নাই। শূদ্রের অধিকার। পাঁচালী পড়িয়া তর এ ভব-সংসার–এ উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। অতএব, তারা গরজে পড়ে ধর্মীয় প্রচার-সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সাহিত্য-শিল্প গড়ে তুলবার প্রয়াসী হননি। দেবতার মাহাত্ম্যকথা জনপ্রিয় করবার জন্যেই তারা প্রণয়-বিরহ কাহিনীর আশ্রয় নিয়েছেন, এবং এতে সাহিত্য-শিল্প যা গড়ে উঠেছে তথা সাহিত্যরস যা জমে উঠেছে, তা আনুষঙ্গিক ও আকস্মিক, উদ্দিষ্ট নয়। কাজেই বলতে হয়, মধ্যযুগে হিন্দুদের বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ছিল না। লৌকিক ধর্মের প্রচারই লক্ষ্য ছিল। এর এক কারণ এ হতে পারে যে শিক্ষা ও সাহিত্যের বাহন ছিল সংস্কৃত। কাজেই শিক্ষিত মাত্রই সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করত। তাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টির গরজ কেউ অনুভব করেননি। তারা অশিক্ষিতদেরকে ধর্মকথা শোনানোর জন্যে ধর্ম-সংপৃক্ত পাচালী রচনা করতেন। তাতে রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণের অনুসৃতি ছিল। পরে সংস্কৃতের প্রভাব কমে গেলেও এবং বাঙলা প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব পেলেও পূর্বেকার রীতির বদল হয়নি আঠারো শতক অবধি। আঠারো শতকেই আমরা কয়েকজন হিন্দু প্রণয়োপাখ্যান রচয়িতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি।

বাঙলাদেশের প্রায় সবাই দেশজ মুসলমান। তাই বাঙলা সাহিত্যের উন্মেষ যুগে সুলতান সুবাদারের প্রতিপোষণ পেয়ে কেবল হিন্দুরাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টি করেননি; মুসলমানরাও তাঁদের সাথে সাথে কলম ধরেছিলেন এবং মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে, দেব ধর্মপ্রেরণাবিহীন নিছক সাহিত্যরস পরিবেশনের জন্যে তারাই লেখনী ধারণ করেন। আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধসাহিত্য পেয়েছি তাদের হাতেই। কাব্যের বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্যদানের গৌরবও তাঁদেরই। কেননা, সবরকমের বিষয়বস্তুই তাঁদের রচনার অবলম্বন হয়েছে। মুসলমানের দ্বারা এই মানবরসাশ্রিত সাহিত্যধারার প্রবর্তন সম্ভব হয়েছে ইরানী সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে। দরবারের ইরানী ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় এ দেশের হিন্দু-মুসলমানের একই সূত্রে এবং একই কালে হলেও একেশ্বরবাদী মুসলমানের স্বাজাত্যবোধ ইরানী সংস্কৃতি দ্রুত গ্রহণে ও স্বীকরণে তাদের সহায়তা করেছে প্রচুর। কিন্তু রক্ষণশীল হিন্দুর পক্ষে ছয়শ বছরেও তা সম্ভব হয়নি। তাই মুসলমান কবিগণ যখন আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধ সাহিত্য প্রণয়োপাখ্যান রচনা করছিলেন, হিন্দু লেখকগণ তখনো দেবতা ও অতিমানব জগতের মোহমুক্ত হতে পারেননি। যদিও এই দেবভাব একান্তই পার্থিব জীবন ও জীবিকা সংপৃক্ত।

মুসলমান রচিত সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিকতা–যা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নির্দেশ করে। বাহুবল, মনোবল আর বিলাসবাঞ্ছই সে-জীবনের আদর্শ। সগ্রামশীলতা ও বিপদের মুখে আত্মপ্রতিষ্ঠা সে-জীবনের ব্রত এবং ভোগই লক্ষ্য। এককথায়, সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্বিক জীবনের উল্লাসই এ সাহিত্যে অভিব্যক্ত।

পাক-ভারতে মুসলমান অধিকার যেমন ইরানী সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এ দেশবাসীর পরিচয় ঘটিয়েছে, তেমনি একচ্ছত্র শাসন ভারতের অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এরূপে বাঙালিরা ইরানী ও হিন্দুস্তানী ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতি হবার সুযোগ পেয়ে এ দুটোর আদর্শে ও অনুসরণে নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচর্যা করে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হয়েছে।

অবশ্য হিন্দু-মুসলমানের প্রায় সব রচনাই (বৈষ্ণবসাহিত্যও) মূলত অনুবাদ ও অনুকৃতি এবং মুখ্যত পৌনপুনিকতা দুষ্ট। মৌলিক রচনা দুর্লক্ষ্য। এর কারণ প্রতিভাধর কেউ সাধারণত বাঙলা রচনায় হাত দেননি, অর্থাৎ সংস্কৃতে কিংবা ফারসিতে লিখবার যোগ্যতা যার ছিল, তিনি বাঙলায় সাধারণত লেখেননি। বাঙলা তখনো তাঁদের চোখে বুলি মাত্র। এ যুগে শিক্ষিত জনেরা যেমন লোকসাহিত্য সৃষ্টিতে কিংবা পাঠে বিমুখ, সে যুগে তেমনি তারা বাঙলা ভাষা ও বাঙলা রচনার প্রতি বিরূপ ছিলেন। তাচ্ছিল্যজাত এ অবহেলা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ মন্থর করেছিল।

এছাড়াও আর দুটো প্রবল কারণ ছিল : ক. সেন রাজারা বাঙলায় উত্তর ভারতিক ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনে তৎপর ছিলেন। পাছে দেশী সংস্কৃতি সৃজ্যমান ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে বিকৃত করে, সম্ভবত এই আশঙ্কায় শূদ্রের শিক্ষাগ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিলেন, এভাবে দেশী লোককে মূর্খ রেখে দেশের ভাষাচর্চার পথ রুদ্ধ রেখেছিলেন তারা। আর তখন বস্তুত অবহট্ঠ-এর যুগ। তাই অবহট্ঠ এর যুগে সংস্কৃত চর্চায় উৎসাহ দান করা রাজকীয় ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

খ. অপরদিকে দেবভাষা সংস্কৃতি ও স্বর্গীয় ভাষা আরবি থেকে শাস্ত্রানুবাদ পাপকর্ম বলে গণ্য হত; ভাষান্তরিত হলে মন্ত্রের বা আয়াতের মহিমা ও পবিত্রতা নষ্ট হবে–এ ধারণা আজো প্রবল। মুসলমানদের অতিরিক্ত একটা বাধা ছিল, তারা বাঙলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা বলে জানত। এদিকে বিজাতি-বিধর্মী রাজার সমর্থন ছিল বলে ব্রাহ্মণদের পক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব হয়নি বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণ্য সমাজ নৈতিক প্রতিরোধের দ্বারা বাঙলা চর্চা ব্যাহত করবার প্রয়াসী ছিলেন। তাঁরা পাতি দিলেন:

অষ্টাদশ পুরাণানি চ রামস্য চরিতানি চ
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।

আঠারো শতক অবধি এ বিরূপতা যে ছিল, তার প্রমাণ মিলে অবজ্ঞাসূচক একটি বাঙলা ছড়ায়। এতে কাশীরাম দাসের নাম রয়েছে :

কৃত্তিবেসে কাশীদেসে আর বামুণ-ঘেঁষে
–এ তিন সর্বনেশে।

শাস্ত্রকথার বাঙলা তর্জমার প্রতিবাদে মুসলমান সমাজও সতেরো শতক অবধি মুখর ছিল, তার আভাস রয়েছে বিভিন্ন কবির কৈফিয়তের সুরে। এদের কেউ কেউ তীব্র প্রতিবাদীও।

শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৩১০ খ্রীস্টাব্দে) বলেন :

নানা কাব্য-কথা-রসে মজে নরগণ।
যার যেই শ্ৰধাএ সন্তোষ করে মন।
না লেখে কিতাব কথা মনে ভয় পায়
দূষিব সকল তাক ইহ না জুয়ায়।
গুনিয়া দেখি আহ্মি ইহ ভয় মিছা
হয় ভাষায় কিছু হয় কথা সাচা।

সৈয়দ সুলতান [১৫৮৪ খ্রী.) বলেছেন :

কর্মদোষে বঙ্গেত বাঙ্গালী উৎপন
বুঝে বাঙ্গালী সবে আরবি বচন।

ফলে,

আপনা দীনের বোল এক না বুঝিলা
প্রস্তাব পাইয়া সব ভুলিয়া রহিলা।

কিন্তু,

যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন
সেই ভাষা হয় তার অমূল্য রতন।

তবু,

যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে
পঞ্চালি রচি করি আছত দূষিতে।
মুনাফিক বোলে মোরে কিতাবেতে পড়ি
কিতাবের কথা দিলু হিন্দুয়ানি করি।

অবশ্য,

মোহোর মনের ভাব জানে করতারে
যথেক মনের কথা কহিমু কাহারে।

আমাদের হাজী মুহম্মদও [ষোল শতক) নিঃসংশয় নন, তাই তিনি দ্বিধামুক্ত হতে পারেন নিঃ

যে-কিছু করিছে মানা না করিঅ তারে
ফরমান না মানিলে আজাব আখেরে।
হিন্দুয়ানি লেখা তারে না পারি লিখিতে
কিঞ্চিৎ কহিলু কিছু লোকে জ্ঞান পাইতে।

মনের দিক দিয়ে নিঃসংশয় না হলেও যৌক্তিক বিচারে এতে পাপের কিছু নেই বলেই কবির বিশ্বাস। তাই তিনি পাঠক সাধারণকে বলছেন :

হিন্দুয়ানী অক্ষর দেখি না করিঅ হেলা
বাঙ্গালা অক্ষর পরে আঞ্জি মহাধন
তাকে হেলা করিবে কিসের কারণ।
যে-আঞ্জি পীর সবে করিছে বাখান
কিঞ্চিৎ যে তাহা হোন্তে জ্ঞানের প্রমাণ।
যেন তেন মতে যে জানৌক রাত্র দিন।
দেশী ভাষা দেখি মনে না করিও ঘীণ।

এঁর পরবর্তী কবি মুতালিবেরও (১৬৩৯ খ্রী.) ভয় :

আরবিতে সকলে না বুঝে ভাল মন্দ
তে কারণে দেশী ভাষে রচিলু প্রবন্ধ।
মুসলমানি শাস্ত্র কথা বাঙ্গালা করিলু
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু।
কিন্তু মাত্র ভরসা আছএ মনান্তরে।
বুঝিয়া মুমীন দোয়া করিব আমারে।
মুমীনের আশীর্বাদে পুণ্য হইবেক
অবশ্য গফুর আল্লা পাপ ক্ষেমিবেক।

আমীর হামজা (১৬৮৪ খ্র.) রচয়িতা আবদুন নবীরও সেই ভয় :

মুসলমানী কথা দেখি মনেহ ডরাই
রচিলে বাঙ্গালা ভাষে কোপে কি গোঁসাই।
লোক উপকার হেতু তেজি সেই ভয়।
দৃঢ়ভাবে রচিবারে ইচ্ছিল হৃদয়।

রাজ্জাক নন্দন আবদুল হাকিমের (সতেরো শতক] মনে কিন্তু কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব তো নেই-ই পরন্তু যারা এসব গোঁড়ামি দেখায়, তাদের প্রতি তাঁর বিরক্তি তীব্র ভাষায় ও অশ্লীল উক্তির মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন তিনি।

যেইদেশে যেই বাক্য কহে নরগণ
সেইবাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন
মারফত ভেদে যার নাহিক গমে।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবেরগণ।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মন না জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ না যায়।
মাতা-পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।

হিন্দুয়ানী মাতৃভাষার প্রতি এতখানি অনুরাগ সে-যুগের আর কোনো মুসলিম কবির দেখা যায় না।

অতএব, সতেরো শতক অবধি মুসলমান লেখকেরা শাস্ত্রকথা বাঙলায় লেখা বৈধ কি-না সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন না। আমরা শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম প্রমুখ অনেক কবির উক্তিতেই এ দ্বিধার আভাস পেয়েছি। সুতরাং যারা বাঙলায় শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেছেন, তাঁরা দ্বিধা ও পাপের ঝুঁকি নিয়েই করেছেন। এতে তাদের মনোবল, সাহস ও যুক্তি-প্রবণতার পরিচয় মেলে।

উন্নাসিক ব্রাহ্মণ্য অভিজাতদের কাছে বাঙলা ছিল ভাষা। উন্নাসিক মুসলিমদের কাছে হিন্দুয়ানী ভাষা। কারুর চোখে প্রাকৃত ভাষা (দ্বিজ শ্রীধর ও রামচন্দ্র খান ১৬ শতক), কারুর মতে লোক ভাষা (মাধবাচার্য ১৬ শতক), কেউ বলেন লৌকিক ভাষা (কবিশেখর ১৭ শতক), অধিকাংশ লেখক দেশী ভাষা এবং কিছুসংখ্যক লেখক বঙ্গভাষা বলে উল্লেখ করতেন। বহিরাঞ্চলে এ ভাষার নাম গৌড়িয়া!

.

০৩.

মধ্যযুগে হিন্দুয়ানী ভাষার প্রতি মুসলমানদের বিরূপতা ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস প্রসূত। কিন্তু উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে সে বিরূপতাও রাজনৈতিক যুক্তিভিত্তিক হয়ে আরো প্রবল হবার প্রবণতা দেখায়।

তুর্কী ও মুঘলেরা এদেশে মুসলিম শাসন দৃঢ়মূল করবার প্রয়োজনে বিদেশী ও দেশী মুসলিম মনে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ জিইয়ে রাখতে প্রয়াসী হন। ধর্মের উৎসভূম আরব এবং শাসক ও সংস্কৃতির উদ্ভবক্ষেত্র ইরান-সমরখন্দ-বুখারার প্রতি জনমনে শ্রদ্ধাবোধ ও মানস-আকর্ষণ সৃষ্টির ও লালনের উদ্দেশ্যে কাফের-বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে স্বাতন্ত্র্যবোধ জিইয়ে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠীর একটি সচেতন প্রয়াস ছিল। আলাউল হক, তাঁর পুত্র নুরকুতবে আলম, জাহাগীর সিমনানী, আলসানী, শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ প্রভৃতির পত্রে এ মনোভাবের আভাস আছে। আর মুসলিম রচিত ইতিহাসের ভাষায় আর ভঙ্গিতেও হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষ এবং অবজ্ঞা প্রায় সর্বত্র পরিস্ফুট। অনুকূল পরিবেশে এই বহির্মুখী মানসিকতা মুসলিম মনে ক্রমে দৃঢ় হতে থাকে। ইরানে সাফাবী বংশীয় রাজত্বের অবসানে কিছুসংখ্যক বাস্তুত্যাগী ইরানী নাকি বাঙলায়ও বসবাস করতে এসেছিল। সম্ভবত তাদের সাহচর্য আভিজাত্যলোভী দেশী মুসলমানদের বহির্মুখী মানসিকতাকে আরো প্রবল করেছিল। ফারসি ভাষার বাস্তব গুরুত্বে ও সংস্কৃতির মর্যাদায় প্রলুব্ধ বাঙালি তা গ্রহণে-বরণে (উনিশ শতকের বাঙালির ইংরেজি ও বিলেতি সংস্কৃতি গ্রহণের মতোই) আগ্রহ দেখাবে–এ-ই ছিল স্বাভাবিক।

এমনিতেই আভিজাত্যলোভে শিক্ষিত দেশী মুসলমানরা চিরকাল নিজেদের বিদেশাগত মুসলমানের বংশধর বলে পরিচয় দিয়ে আসছে। ফজলে রাব্বী খান বাহাদুর তাঁর হকিকতে মুসলমানে বাঙ্গালা (অনুবাদ : The Origin of the Musalmans of Bengal, 1895 A. D.) গ্রন্থে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বাঙালি মুসলমানেরা প্রায় সবাই বহিরাগত। আঠারো শতকে কোম্পানী শাসন প্রবর্তিত হলেও নবাবী আমলের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া অনেককাল বিলীন হয়নি। ফারসি ছিল ১৮৩৮ খ্রীস্টাব্দ অবধি দরবারী ভাষা। কাজেই ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত সমাজ তখনো মধ্যযুগীয় আমীরী স্বপ্নে বিভোর, যদিও তাদের অজ্ঞাতেই তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছিল। তখন দুর্ভাগ্যের দুর্দিন সত্যই তাদের সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল, তখনো হৃতসর্বস্ব মুসলমান উত্তর ভারতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল জ্ঞাতির ঐশ্বর্যগর্বে নিজের দীনতা ভুলবার নিষ্ফল আশায়। তখন আরবি নয়, এমনকি ফারসিও তত নয়, উর্দু প্রীতিই তাদের মানসিক সান্ত্বনার অবলম্বন হল। উর্দু ভাষা না থাকিলে আজ ভারতের মোসলমানগণ জাতীয়তাবিহীন ও কিরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হইত, তাহা চিন্তা করিবার বিষয়। বাংলা দেশের মোসলমানদিগের মাতৃভাষা বাংলা হওয়াতে, বঙ্গীয় মোসলমান জাতির সর্বনাশ হইয়াছে। এই কারণে তাহারা জাতীয়তাবিহীন নিস্তেজ দুর্বল ও কাপুরুষ হইয়া দিয়াছে। [১৯২৭ সন, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার জীবন চরিত : ভূমিকা, মোহাম্মদ রেয়াজদ্দিন আহমদ। ইনি নিজে ছিলেন বাংলা লেখক ও সাংবাদিক। তাই নওয়াব আবদুল লতিফের (১৯২৬-৯৪) মুখে শুনতে পাই: বাঙলার মুসলিম ছোটলোকদের ভাষা বাংলা। আর অভিজাতদের ভাষা উর্দু।

বাঙলার প্রতি মুসলমানদের মনোভাব কত বিচিত্র ছিল তার দু-একটি নমুনা দিচ্ছি: A Muhammadan Gentelman about 1215 B. S. (1808 A. D.) enjoined in his deathbed that his only son should not learn Bengali, as it would make him effiminate. … Muhammadan gentry of Bengal too wrote in Persian and spoke in Hindustani.

(JASB, 1925 PP 192-93; A Bengali Book written in Persian Script : Khan Saheb Abdul Wali). মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদের পূর্ব উদ্ধৃত উক্তিও স্মর্তব্য।

মীর মশাররফ হোসেন তাঁর আমার জীবনী (১৩১৫ সন) গ্রন্থে লিখেছেন : মুন্সী সাহেব (তাঁর শিক্ষক) বাঙ্গালার অক্ষর লিখিতে জানিতেন না। ….বাঙ্গালা বিদ্যাকেও নিতান্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন। …. আমার পূজনীয় পিতা বাঙ্গালার একটি অক্ষরও লিখিতে পারিতেন না।

মীর মুশাররফ হোসেনের গৌরাই ব্রীজ বা গৌরীসেতু গ্রন্থের সমালোচনা প্রসঙ্গে বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমচন্দ্র? যে মন্তব্য করেছিলেন তাতেও মুসলিম সমাজমনের পরিচয় পাই: যতদিন উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদিগের মধ্যে এমত গর্ব থকিবে যে তাঁহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না বা বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দু-ফারসির চালনা করিবেন, ততদিন সে (হিন্দু-মুসলমান) ঐক্য জন্মিবে না।

[হিন্দু মুসলমান ঐক্য তখনো ছিল না– শাসক-শাসিত সুলভ অবজ্ঞা বিদ্বেষের জেরই বিদ্যমান ছিল!]

বাঙ্গালা ভাষা হিন্দুগণের ভাষা। (নবনুর; ভাদ্র ১৩১০ সন : মুসলমানের প্রতি হিন্দু লেখকের অত্যাচার লেখক কেন চিৎ মর্মাহতের হিতকামিনা। ইনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।)

আমি জাতিতে মোসলমান,–বঙ্গভাষা আমার জাতীয় ভাষা নহে। [হিন্দু মুসলমান (ঢাকা ১৮৮৮ সন) গ্রন্থে লেখক শেখ আবদুস সোবহান। ইনি ইসলাম সুহৃদ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।].

শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ, তাঁর পুত্র শাহ্ আবদুল কাদির ও ওয়াহাবী (মুহম্মদী) আন্দোলনের প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আন্দোলনের বাহন ছিল উর্দু। সে সূত্রেও ইসলামি সাহিত্যের আধারূপে উর্দু ধর্ম ও জাতি-প্রাণ মুসলিম চিন্তাবিদদের প্রিয় হয়ে উঠেছিল। এ কারণে শেখ আবদুর রহিম, নওশের আলি খান ইউসুফজাই, মৌলানা আকরম খান প্রমুখ অনেক বাঙলা লেখকও উর্দুর প্রয়োজনীয়তা (পাকিস্তান পূর্বযুগেও) অনুভব করতেন। শেখ আবদুর রহিম বলেছেন:….বঙ্গীয় মুসলমানদিগের পাঁচটি ভাষা শিক্ষা না করিলে চলিতে পারে না–ধর্ম ভাষা আরবি, তৎসহ ফারসি এবং উর্দু এই দুইটি, আর রাজভাষা ইংরেজী তৎসহ মাতৃভাষা বাঙ্গালা। (৮ই পৌষ ১৩০৬ সন– মিহির ও সুধাকর)।

মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খান বলেছিলেন–উর্দু আমাদের মাতৃভাষাও নহে, জাতীয় ভাষাও নহে। কিন্তু ভারতবর্ষে মোছলেম জাতীয়তা রক্ষা ও পুষ্টির জন্য আমাদের উর্দুর দরকার। (তৃতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সম্মেলন : অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণ।)

সাধারণভাবে বলতে গেলে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বাবধি (১৯২০ খ্র;) এক শ্রেণীর বাঙালি মুসলমান উর্দু-বাঙলার দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এঁদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষিত এবং জমিদার অভিজাতরাই ছিলেন বেশি। বাঙালি মুসলমানের অশিক্ষার সুযোগ ঊনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথম তিন দশক অবধি স্ব-আরোপিত (Self assumed) অবাধ নেতৃত্ব পেয়েছিলেন নবাব আবদুল লতিফ, আমীর হোসেন (বিহারী), সৈয়দ আমির আলি, নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নবাব আলি প্রমুখ বহিরাগত মুসলিমের উর্দুভাষী বংশধরগণ। তাঁরাই বাঙালি মুসলমানের মুখপাত্র হিসেবে উর্দুকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা রূপে বিদ্যালয়ে চালাবার স্বপ্ন দেখতেন। পাকিস্তান-উত্তর যুগে তাঁদেরই বংশধর কিংবা জ্ঞাতিত্ব লোভীরাই উর্দুকে বাঙালির উপর চাপিয়ে দেবার প্রয়াসী ছিলেন। আজো একশ্রেণীর শিক্ষিত লোক ও সাহিত্যিক বাঙলায় আরবি-ফারসি শব্দের বহুল প্রয়োগ দ্বারা উর্দুর স্বাদ পাবার প্রয়াসী!

অতএব, গোড়া থেকেই বাঙলা ভাষার অনুশীলনে মুসলমানরা বিবিধ কারণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আজো সে-দ্বিধা থেকে তাদের অনেকেই মুক্ত নয়। এভাবে বাঙলা মুসলিম গুণী-জ্ঞানীর আন্তরিক পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত ছিল। তার ফলে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য-ক্ষেত্রে মুসলিম অবদান যতখানি থাকা বাঞ্ছনীয় ও স্বাভাবিক ছিল, তা মেলেনি। সৈয়দ সুলতানও এই দ্বিধাগ্রস্তদেরই অন্যতম। বহু যুক্তি দিয়ে তিনি একদিকে নিজেকে বাঙলা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, অপরদিকে বিরূপ সমালোচনা প্রতিহত করার প্রয়াস পেয়েছেন।

বাঙলা-সাহিত্যের আঁধার-যুগের ইতিকথা

চর্যাগীতিকে দশ থেকে বারো শতকের বাঙলা রচনা বলে ধরা হয়। এর পরে তেরো শতক থেকে চৌদ্দশ পঞ্চাশের মধ্যেকার কোনো বাঙলা রচনার নিশ্চিত নিদর্শন মেলে না। তাই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ মনে করেন, এ সময় বাঙলায় কিছুই রচিত হয়নি এবং তারা তুর্কী বিজয়কেই এ-জন্যে দায়ী করেন। তাঁরা বলেন, তুর্কী বিজয়ের ফলে বাঙলা দেশে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চলে। দেড়শ, দুশ কিংবা আড়াইশ বছর ধরে হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার চালানো হয়। কাফেরদের উপর। তাদের জীবন-জীবিকা এবং ধর্ম-সংস্কৃতির উপর চলে বেপরোয়া ও নির্মম হামলা। উচ্চবিত্ত ও অভিজাতদের মধ্যে অনেকেই মরল, কিছু পালিয়ে বাঁচল, আর যারা এর পরেও মাটি কামড়ে টিকে রইল, তারা ত্রাসের মধ্যেই দিন-রজনী গুনে গুনে রইল। কাজেই ধন, জন ও প্রাণের নিরাপত্তা যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে প্রাণ নিয়ে সর্বক্ষণ টানাটানি, সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার বিলাস অসম্ভব। ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্মেষ-বিকাশের কথাই উঠে না। এই হল তাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত।

ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন থেকে ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় অবধি সব ইতিহাসকারেরই একই সিদ্ধান্ত। বাংলা দেশে তুর্কী বিজয় সম্বন্ধে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতাদের মনে একটা বিজাতীয় বিরূপতা সব সময় সক্রিয় থাকে, ফলে তাঁদের সহজ বিচারবুদ্ধি এখানটায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। নইলে তাঁদের রচনায় উক্তির অসঙ্গতি, তথ্যের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার ফিরিস্তি এমন উল্কট হয়ে ফুটে উঠত না।

যে তুর্কী বর্বরতার বরাত দিয়ে বাঙলা সাহিত্যের বন্ধ্যাযুগের ইতিকথা তৈরী হয়েছে, সে তুকী-বিজয় ও তুর্কী শাসনের খসড়াচিত্র এখানে তুলে ধরছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রকাশিত History of Bengal-কে সাধারণত নির্ভরযোগ্য ইতিহাস বলে স্বীকার করা হয়। তারই দ্বিতীয় খণ্ডের আলোকে এ সময়কার রাজনৈতিক ইতিহাসের আভাস ও ফলশ্রুতি দেবার চেষ্টা করব।

মধ্যযুগের ইতিহাস সে-যুগের আবহেই যাচাই করতে হবে। সে-যুগে পরমতসহিষ্ণুতার কিংবা বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সৌজন্যমূলক শ্রদ্ধার একান্ত অভাব ছিল। পরাক্রান্ত শক্তি মাত্রেই পরপীড়ক ছিল। তার উপর ছিল ফৌজী বর্বরতা–যা এ-যুগেও বিরল নয়। এটিলা, চেঙ্গিজ, হালাকু থেকে তৈমুর-নাদির অবধি এশিয়ার যে-কোন দিগ্বিজয়ীর কথা স্মরণ করলেই এ তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শাসক কিংবা বিজেতার কোনো জাতধর্ম নেই। তাদের লোভের কিংবা ক্ষোভের কবলে যে পড়ে সেই উৎপীড়িত হয়। তাই দুনিয়ার রাজবংশাবলীর ইতিহাসে আত্মীয় হত্যার নজিরই বেশি। দুনিয়াতে চিরকাল রাজা-প্রজা, শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিত–এই দুই শ্ৰেণীই আছে। সেই রাজা শাসক বা শোষক স্বদেশী-স্বজাতি হোক কিংবা বিদেশী-বিজাতি হোক তাতে কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্মীয় ও জ্ঞাতি হত্যার নজির হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান প্রভৃতি পৃথিবীর রাজবংশের ইতিহাস মাত্রেই বিদ্যমান।

ঐতিহাসিক মধ্যযুগে মুসলমানরাই প্রধানত পরাক্রান্ত ও দিগ্বিজয়ী। কাজেই তাদের অন্যায়, উৎপীড়ন ও বর্বরতার দৃষ্টান্ত সহজেই চোখে পড়ে। আসলে সে-যুগের সভ্যজগতের ইতিহাস সর্বত্রই একরূপ। পনেরো শতকের ইটালিতে পোপ পঞ্চম নিকোলো (১৪৪৭-৫৫) পেগান, মন্দির, মূর্তি, ইমারত ও শিল্পকৃতি ভেঙে প্রাসাদ ও গির্জা তৈরি করিয়েছিলেন। ফরাসী বিপ্লবকালে লুই ও রাজবংশীয়দের হত্যা, গ্রীক-তুর্কী যুদ্ধে গ্রীকদের আনাতোলীয়া অঞ্চলে তুর্কী নিধন, হিরোসিমা নাগাসাকির হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি পুরোনো প্রবৃত্তিরই নতুন প্রকাশ। উত্তেজনাবশে ভাল মানুষও যে হিংস্র শ্বাপদ হয়ে উঠতে পারে তার চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের পাক-ভারতে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬-৫০এর বেপরওয়া হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজে। সেকালের যুদ্ধনীতি ও শাসনরীতি ছিল ভিন্ন। রাজা-প্রজা তথা শাসক-শাসিতের কর্তব্য, দায়িত্ব এবং অধিকারবুদ্ধিও ছিল অন্যরকম। জাতি ও বর্ণ-দ্বেষণা আজো সুসভ্য আমেরিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ও ভারতে তীব্র সমস্যা হয়েই রয়েছে। সে যুগে যে ছিল–তা এমন আর ক্ষোভের কি! তবু যারা ক্রীতদাসকেও নিজের সমান মর্যাদা দিয়েছে, উচ্চপদে বসিয়েছে, জামাতা করেছে, সিংহাসন দিয়েছে, তারা কি একেবারে অমানুষ হতে পারে? উদারতা ও মানুষের প্রতি নিঃসঙ্কোচ শ্রদ্ধার এমনি দৃষ্টান্ত আর কোনো জাতির মধ্যে পাওয়া যায় না। সত্য বটে, মুসলমানেরা অমুসলিম দেশ জয় করতে গিয়ে ধনের লোভে ও ফেরারী শত্রুর খোঁজে গির্জা-মন্দির-বিহার আক্রমণ করেছে, মন্দির ও মূর্তি ভেঙেছে, ধন-রত্ন লুট করেছে। যেখানে স্থায়ী আস্তানা গেড়েছে সেখানে মন্দিরকে মসজিদ করেও নিয়েছে। আত্যন্তিক স্বধর্মপ্রীতি ও বিধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা এমনি অপকর্মে সেনাদলকে চিরকালই অনুপ্রাণিত করে। পৌত্তলিক সমাজ থেকে গড়ে ওঠা নিরাকার একেশ্বরবাদী মুসলিম মানসে পৌত্তলিকতার প্রতি অবজ্ঞাটাও ছিল তীব্রতর। কাজেই যুদ্ধকালে বর্বর ফৌজী-উত্তেজনার সময় মন্দির-মূর্তি ভাঙা ও ধনরত্ন লুট করা সে-যুগের কোনো বিজেতা-বাহিনীর পক্ষে কলঙ্কের কথা নয়। বিজাতি বিধর্মী বিজেতারা চিরকালই তা করেছে, দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বত্র এর নজির রয়েছে। মুসলমানেরা এর ব্যতিক্রম নয়। যুদ্ধ ছাড়া শান্তির সময়ে খেয়ালের বশে কিংবা বিজাতি-বিদ্বেষের প্রাবল্যে কোনো মুসলমান শাসক মন্দির মূর্তি ভাঙেননি। বরং কেউ কেউ পাপের ভয় উপেক্ষা করেও মন্দির তৈরিতে অর্থসাহায্য করেছেন, দেবোত্তর জমি দিয়েছেন। এদেশে আসিয়া মুসলমান রাজারা সংস্কৃত হরফে মুদ্রা ও লিপি ছাপাইয়াছেন, বহু বাদশা হিন্দু মঠ ও মন্দিরের জন্য বহু দানপত্র দিয়াছেন। সে-সব ঐতিহাসিক নজির দিন-দিন নূতন করিয়া বাহির হইতেছে। (ক্ষিতিমোহন সেন)। তারপর যখন হিন্দু মুসলমান অধ্যুষিত দেশে রাজায়-বাদশায় যুদ্ধ হয়েছে, তখন ধর্মস্থানের উপর হামলা (বিশেষ কারণ না ঘটলে–যেমন মন্দিরে শত্রুর আশ্রয় নেয়া, আত্মগোপন করা ইত্যাদি) হয়নি। ভারতের কোনো মুসলমান বিজেতাই স্বধর্মপ্রচারের মহৎ উদ্দেশ্যে দেশ জয় করেননি— রাজত্বলোভেই অস্ত্রধারণ ও প্রয়োগ করেছেন। মুসলমান বিজেতারা এদেশে রাজ্য স্থাপন করেই হিন্দু পাইক (পদাতিক সৈন্য) ও কর্মচারী নিয়োগ করতে থাকেন। রাজ্য শাসনে ও রাজস্বব্যবস্থায় এমনকি সৈনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এবং গৌড়ের সুলতানেরা মুসলমান হইলেও রাজকার্য প্রধানত হিন্দুর হাতেই ছিল। (সুকুমার সেন)। অধিকাংশ আফগানই তাঁহাদের জায়গীরগুলি ধনবান হিন্দুদের হাতে ছাড়িয়া দিতেন।–এই জায়গীরগুলির ইজারা সমস্ত ধনশালী হিন্দুরা লইতেন এবং ইহারা ব্যবসায় বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন। (স্টুয়ার্টের বাঙলার ইতিহাস)। পাঠান রাজত্বকালে জায়গীরদারেরা দেশের ভিতরে রাজস্ব আদায়ের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। দেশে শাসন ও শান্তিরক্ষার জন্য হিন্দুদের উপরেই তাদের নির্ভর করতে হত। সেইজন্য পাঠান আমলে হিন্দু ভূস্বামী ও অধিকারীদের যথেষ্ট উল্লেখ দেখা যায়। (বাঙলার নব জাগৃতি, বিনয় ঘোষ পৃ. ২৮।)

কাজেই তখনকার নতুন অভিযানে মন্দির ভাঙায় বাস্তব বাধা ছিল। আর ফৌজী বর্বরতার কথা বাদ দিলেও শাসকদের কেউ হয় নরদেবতা আবার কেউ বা নরদানব–এ একান্তভাবে ব্যক্তিক চরিত্রের কথা। সুশাসন-কুশাসন ব্যক্তিক যোগ্যতা ও স্বভাবের উপরই নির্ভরশীল। এজন্যে জাত তুলে খোঁটা দিলে বুদ্ধির তারল্যই প্রকাশ পায়। এবার আমরা বাঙলার শাসকদের পরিচয় নেব।

(ক) খালজী আমীরদের শাসনে (১২০২-২৭ খ্রী.)

১। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী (১২০২-৭) ১২০২ কিংবা ১২০৬ সনে নুদিয়া জয় করেন। তিনি রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই এদেশ জয় করেন। তাই শাসনক্ষমতা হাতে পেয়েই ইনি সামন্ততান্ত্রিক শাসন-সংস্থা গড়ে তুলেন। আর একদিকে মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে গঠনমূলক কাজে যেমন যত্নবান হন, তেমনি শক্তি সঞ্চয় করে রাজ্যবিস্তারে মনোযোগী হন। Malik Ikhtyar-uddin Muhammad devoted the next two years (1203–05) to the peaceful administration of his newly founded kingdom. He followed the usual practice of Muslim conquerors by pulling down idol temples and building mosques on their ruins, endowing Madrasa or Colleges of Muslim learning and evincing his zeal for religion by converting the infidels. But he was not blood-thirsty and took no delight in massacre or inflinching misery on his subjects (PP 8–9)… (He) was indeed the maker of the medieval history of Bengal-He was a born leader of men, brave to recklessness and Generous to a fabulous extent. (P. 12)

২। মালিক ইজুদ্দিন মুহম্মদ শিরান খালজী (১২০৭-৮) এক বছরের মতো রাজত্ব। Shiran was a man of extra-ordinary courage, sagacity and benevolence (P. 15)

৩। মালিক হুসামুদ্দীন গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ (১২০৮-১০ খ্রী.)–ইনি বিদ্রোহী আমীর আলি মর্দানের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থেকেও দক্ষ শাসক বলে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। (He) was the most level headed politician, steadfast in ambition, unfettered by any scruple or sentiment, possessed of the rare gift of making himself acceptable even to his prospective rivals and too clever to place all his cards on the table a minute too soon. (P. 18)

৪। মালিক আলি মর্দান (১২১০-১৩ খ্র.)-এঁর ঘটনাবহুল জীবন। বিদ্রোহ, নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, দুঃসাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা, উন্মত্ততা, উচ্চাভিলাষ প্রভৃতির সমবায়ে ইনি বিচিত্র ও ভয়ঙ্কর মানুষ।

হিন্দু-মুসলমান সবাই তার হাতে সমভাবে উৎপীড়িত হয়েছে। (He) was a man of undoubted ability as a soldier, but impolitical, blood-thirsty and of a murderous disposition …. Partly out of policy but mainly actuated by a feeling of Vengeance against his Khilji Kinsmen who had cast him out, he made the Khilji nobles suffer terribly at his hands. (P. 19)

৫। মালিক হুসামুদ্দিন গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ (পুন. ১২১৩-২৭)– অত্যন্ত জনপ্রিয় সুশাসক। ইনি নৌবহর সৃষ্টি করেন। সম্ভবত তাঁর নৌসৈন্যেরা হিন্দু ছিল।

(Iwaz) Proved one of the most popular Sultans that ever sat on the throne of Gour (P. 21) … Iwaz built more than one Juma Mosque, other Mosques and Madrasas also arose on all sides (P. 25) …. the kingdom of Lakhnawati and Bihar enjoyed uninterrupted peace for about twelve years under the vigorous and beneficient rule of Sultan Ghyasuddin Khilji till the first expedition of Sultan Shamsuddin Iltutmish against Bengal 1225 A. D. (P. 25)-Sultan Ghyasuddins reign of about fourteen years was a prosperity for his kingdom (P.17). Sultan Ghyasuddin in his exterior and interior graces was every inch a Padishah, just, benevolent and wise (P. 28), বৃহৎত্বঙ্গেও (পৃ. ৬১২) এর উচ্ছ্বসিত তারিফ আছে। এখানেই খালজী আমীরদের শাসনের অবসান ঘটে। তারপরে শুরু হয় দিল্লী সুলতানের মামলুক (ক্রীতদাস) শাসন।

 (খ) মামলুক (গোলাম) শাসনে (১২২৭-৮২)।

৬। শাহ্জাদা নাসিরুদ্দীন মাহমুদ (১২২৭-২৯) সম্রাট ইলতুতমিসের পুত্র নাসিরুদ্দীন গিয়াসুদ্দীন ইওয়াজকে পরাজিত ও হত্যা করে গৌড়ের শাসক নিযুক্ত হন। তিনি দেড় বছর মাত্র অতি দক্ষতার সহিত রাজদণ্ড চালনা করিয়াছেন। (বৃহবঙ্গ পৃ. ৬১৩)।

৭। মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন বখ খালজী (১২২৯-৩০) ওরফে দৌলতশাহ্ বিন মওদুদ নাসিরুদ্দীনের মৃত্যুর পর ইনি স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। কিন্তু সম্রাট ইলতুতমিসের সেনানীর হাতে পরাজিত ও নিহত হন।

৮। মালিক আলাউদ্দীন জানি (১২৩১-৩২)–সম্রাট ইলতুতমিস এঁকেই গৌড়ের শাসক নিযুক্ত করেন। কিন্তু অল্পকাল পরে সম্রাট স্বয়ং গৌড়ে আসেন এবং অজ্ঞাত কারণে তাঁকে পদচ্যুত করে মালিক সাইফুদ্দীন আইবককে সুবাদারী দেন।

৯। মালিক সাইফুদ্দীন আইবক (১২৩২-৩৫)He possessed all the noble qualities of his race and rose to the front rank of the maliks of his age. (P. 45)

১০। মালিক ইজুদিন তুঘরল তুঘান খান (১২৩৬-৪০)- ইনি রাঢ় অঞ্চলও দখলে এনেছিলেন। ফলে বিহার, বরেন্দ্র ও রাঢ়ের অধীশ্বর হয়ে ইনি যোগ্যতার সঙ্গে শাসনদণ্ড চালনা P659 1 He was adorned with all sorts of humanity and sagacity and graced with virtues and noble qualities and in liberality, generosity and power of winning mens heart he had no equal. (P. 46)

১১। মালিক তৈমুর খান-ই-কিরান (১২৪৫-৪৭) ইনি তুঘরল তুঘান খান থেকে গৌড় জবরদখল করেন। এঁর আমলে উড়িষ্যার গঙ্গাবংশীয় রাজা নরসিংহদেব রাঢ় ও বরেন্দ্রের অনেকখানি দখল করে নেন। কিন্তু তিনি তা পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।

১২। মালিক জালালউদ্দীন মাসুদ জানি (১২৪৭-৫১)–ইনি আলাউদ্দীন জানির পুত্র। এর উপাধি ছিল মালিক-উ-শর। উল্লেখ্য কৃতিহীন রাজত্ব।

১৩। মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন মুঘিসুদ্দীন উজবেক (১২৫২-৫৭)–ইনি তিনবার দিল্লীর অধীনতা অস্বীকার করেন। এই দিগ্বিজয়ী, সাহসী ও নিপুণযোদ্ধা গৌড়, বিহার ও অযোধ্যা জয় করেন এবং কামরূপ অভিযানে পরাজয় ও মৃত্যুবরণ করেন।

Rushness and imperiousness were implanted in his nature and constitution; but he was a man of undoubted ability as soldier and proved a successful ruler too (P.51)

১৪। মালিক ইজুদিন বলবন-উজবেকী (১২৫৭-৫৯)–জবরদখলকার। তাঁর উল্লেখ্য কোনো কৃতি নেই।

১৫। মালিক তাজুদ্দিন আরসালান খান (১২৫৯-৬৫)–যুদ্ধবাজ ও রক্তপিপাসু। ইজুদিন যখন বঙ্গ অভিযানে ব্যস্ত তখন লখনৌতে প্রবেশ করে হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

He was an impetuous and warlike men and had attained the acsue of capacity and intrepidity (P. 55)

১৬। তাতার খান (১২৬৫-৬৮)–আরসালানের পুত্র।

Tatarkhan was a very capable ruler, renowned for his bravery, liberality, heroism and honesty. (P. 57)

১৭। শেরখান (১২৬৮-৭২) উল্লেখ্য কৃতিহীন।

১৮। আমীন খান–উল্লেখ্য কৃতিহীন। সহকারী সুবাদার তুঘরল খান (১২৭২-৮১)।

১৯। মুঘিসুদ্দিন তুঘরল তুঘান খান (১২৭২-৮১)– অল্পদিন সুবাদার আমীন খানের সহকারী রূপে থেকে গৌড়ের শাসন-ক্ষমতা লাভ করেন। তুঘরলের হিন্দু পাইক (পদাতিক) সৈন্যবাহিনী ছিল, (P. 61)। সম্রাট গিয়াসুদ্দীন বলবন অসংখ্য পরিকর সহ তুঘরলকে হত্যা করেন। গৌড়ে সে এক বীভৎস হত্যাকাণ্ড।

Tughral possessed all the characteristic virtues of Turk, indomitable will, reckless bravery, resourcefulness and boundless ambition. (P. 58)-His court at Lakhnawati rivalled that of Delhi in power and magnificence and he was more popular with his people and much better served by them than Sultan Balban who was more feared than loved by his subjects–He was profuse in liberality so the people of the city (of Delhi) who had been there, and also the inhabitants of that place (Lakhnawati) became very friendly to him. The troops and citizens having shaken off all of the Balbani chastisement, joined Tughral heart and soul. (P. 60–61)

এবার ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে মামলুক শাসনকালের স্বরূপ বিশ্লেষণ করা যাক: The History of this period is sickening record of internal dissensions usurpations and murders- Here in Bengal the political maxim gained ground that who-soever could kill or oust the reigning ruler should be acknowledged without demur as its legitimate master and Bengalees, whether Turks or Hindus remained generally indifferent to the fate of their rulers and enunciated a constitutional principle of their own that the loyality of a subject was due to the masnad (throne) and not to the person who happened to occupy it (P. 42) Another notable feature of the history of this period was the beginning of a sort of rapprochment between the conquerors and their Hindu subjects. The exodus of upper class Hindus on a wide scale from the Muslim Territory gradually stopped and now for the first time we come across references to Hindus as a class of inhabitants in the Muslim Capital. The Muslim rulers had no internal trouble with regard to their Hindu subjects or Varendra even when the Hindus of Orissa threatened the capital with a siege. (P. 43).

(গ) বলবন বংশের শাসনে (১২৮২-১৩০১)

২০। নাসিরুদ্দীন বঘরা খান (১২৮২-৯১)- কর্মকুণ্ঠ, বিলাসপ্রিয়, কিন্তু হৃদয়বান সজ্জন। He was wise in counsel, weak in action and unaggressive by temperament. Though there was nothing to admire in him, he was a lovable and genial personality strong in human virtues. He reigned rather than ruled the kingdom of Bengal, but he enjoyed throughout the esteem of his nobles and popularity with his subjects in the land of his adoption (P. 47)

২১। রুকুনউদ্দীন কায়কোয়াস (১২৯১-১৩০১)–নারুিদ্দীনের পুত্র। উল্লেখ্য কৃতিহীন রাজত্ব।

এবার বলবনী শাসনের ফলশ্রুতি যাচাই করা যাক : The Balbani regime in Bengal was not only a period of expansion but one of consolidation as well. It was during this time that the saints of Islam who excelled the Hindu priesthood and monks in active peity, energy and foresight began prosetlylising on a wide scale not so much by force as by the fervour of their faith and their exemplary character. They lived and preached among the low class of Hindus then as ever in the grip of superistition and social repression.: –About of a century after the military and political conquest of Bengal, there began the process of the moral and spiritual conquest of the land through the efforts of the muslim religious fraternities that now arose in every corner. By destroying temples and monasteries the muslim warriors of earlier times had only appropriated their gold and silver-the saints of Islam completed the process of conqueset-moral and spiritual by establishing Dargahs and Khankhas deliberately on the sites of these ruined places of Hindu and Buddhist worship (P.69)

(ঘ) অজ্ঞাত মামলুক শাসনে (১৩০১-২৮)

২২। শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৩০১-২২)Shamsuddin Firoz was a ruler of exceptional ability. (P. 81) He died full of years of glory and a fame (P. 82)

২৩। (ক) গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ Rebellious son of Firoz Shah.

(খ) নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম শাহ্

(গ) বহরম খান ও তাতার খান (১৩২২-২৮)।

এখন থেকে কয়েক বছরের জন্য গৌড় রাজ্যকে তিন-অঞ্চলে ভাগ করে তিনজন শাসকের অধীনে দেয়া হয় এবং শাসকদের নিজেদের মধ্যে দখল-বেদখলের কোন্দলও চলতে থাকে।

২৪। (ক) কদর খান-লখনৌতি–১৩২৮

(গ) মালিক ইজুদ্দিন এহিয়া–সাতগাঁও-১৩২৮

(গ) বহরম খান–সোনারগাঁও-১৩২৮–(মৃত্যু : ১৩৩৮)

২৫। (ক) ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮-৫০)–সোনারগাও। The lot of Hindu population in Fakhruddins time was not very enviable for They are muleted says Ibn Batuta of half of their crops and have to pay taxes over and above that (P. 102)

(খ) আলী শাহ (১৩২৮-৪২) লখনৌতি

(গ) শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ-লখনৌতি-সাতগাঁও (১৩৪২-৫৭)–সোনারগাঁও (১৩৫৩-৫৭)

(ঘ) ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহ (১৩৫০-৫৩)–সোনারগাঁও। ইনি ফখরুদ্দীন মুবারক শাহর পুত্র।

(ঙ) ইলিয়াস শাহী আমলে (১৩৪২-১৪১৩)

২৬। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ-ই শেষ অবধি গোটা গৌড়রাজ্যের অধিপতি হয়ে উঠেন এবং তিনি ১৩৫৩ সন থেকেই গৌড়রাজ্যের স্বাধীন সুলতান।

২৭। সিকান্দর শাহ (১৩৫৭-৮৯)-ইলিয়াস শাহর পুত্র। During the long period of peace that followed Sultan Sikandar adorned his capital with many noble monuments of architecture (P. 112)

২৮। গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪০৯)–এর ন্যায়পরায়ণতা, বিদ্যানুরাগ ও সাহিত্যপ্রীতি প্রাবাদিক ও প্রাবনিক হয়ে আছে। ইনি সিকান্দর শাহর পুত্র। বিদ্যাপতি এঁরই গুণকীর্তন করেছেন।

২৯। সাইফুদ্দীন হামজা শাহ (১৪০৯-১০)। উল্লেখ্য কৃতিহীন।

৩০। শামসুদ্দীন (১৪১০-১৩) ইনি হামজা শাহের পুত্র। এর আমল রাজা গণেশের প্রভাবের যুগ। এ সময় সম্ভবত রাজপরিবারে গৃহযুদ্ধ ঘটে।

(চ) গণেশ ও তার বংশধরদের আমল (১৪১৪-৪২)

৩১। রাজা গণেশ (১৪১৪-১৮)–জবরদখলকার। এঁর নিন্দা-প্রশংসা দু-ই আছে। তবে সুদক্ষ শাসক।

৩২। মহেন্দ্র দেব (১৪১৮) রাজত্বকাল কয়েক মাস মাত্র। ইনি হিন্দু দলের দ্বারা মসনদে প্রতিষ্ঠিত হন।

৩৩। যদু বা জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৮-৩১)–যেসব ব্রাহ্মণ তাঁর প্রায়শ্চিত্তে অংশগ্রহণ করেও তাকে সমাজে গ্রহণ করতে নারাজ ছিল, তাদের তিনি লাঞ্ছিত করেন। মোটামুটিভাবে সুশাসক। We can well believe that the province grew in wealth and population during his peaceful reign. (P. 129)

৩৪। শামসুদ্দীন আহমদ শাহ (১৪৩২-৩৩)- ইনি জালালউদ্দীনের পুত্র। His reign was darkened by his crimes and follies, till the nobles finding it intolerable1 got him murdered through his slaves Shadi khan and Nasir khan in 1333 A. D. (P. 129)

 (ছ) পরবর্তী ইলিয়াস শাহ আমলে (১৪৩৩-৮৬)

৩৫। নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৩-৫৯)।

Chosen by the people the new sovereign, who styled himself Nasiruddin Abul Muzaffar Mahmud, was able to enjoy an undisturbed and prosperous reign. He is described as a just and liberal king by whose good administration the people, both young and old, were contended and the wounds of oppressions inflicted by Ahmad Shah were healed …. his main interests probably lay in the arts of palace. A large number of inscriptions found all over his kingdom recording the erection of Mosques, khankas, gates, bridges and tombs, testify not only to the prevailing prosperity but also to the enthusiasm for pulic works and interest in the building art, which he inspired. (P. 130) -২১

৩৬। রুকনউদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-৭৬)–Histories praise him as a sagacious and law-abiding sovereign in whose kingdom the soldiers and citizens alike had contentment and security. (P. 132) prosto প্রতিপোষকতা পেয়েছিলেন।

৩৭। শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-৮১)– মালাধর বসু এরই প্রতিপোষকতায় শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন। Both Firishta and Nizamuddin described him as vastly learned, virtuous and an able administrator. He evidenced a special interest in the administration of justice and interested on the strict and impartial application of the law-like Alauddin, he totally prohibited the drinking of wine and frequently assisted the judges in difficult cases. (P. 136)

৩৮। জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ (১৩৮১-৮৭)–Fath is stated to have been an intelligent and liberal ruler who maintained the usages of the past and in whose time the people enjoyed happiness and comfort. (P. 137)

এবার এখানে ইলিয়াস শাহী রাজত্বের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন উদ্ধৃত করছি :

The dynesty deserved well of Bengal, for with remarkable consistency it produced a succession of able rulers. They were tolerant, enlightened administrator and great builders. In shaping the economic and intellectual life of the Bengali people for nearly a century and a half; the Ilyas Shahi kings played the leading part. Tolerance was their greatest asset. To have ruled over a people of an alien faith for eight generations was in itself a great achievement; to be instated on the throne after twenty five years exclusion by a local dynesty was an even greater one. It was a singular proof of their popularity-a popularity which rested on their past services. (P. 137)

(জ) হাবসী গোলাম আমলে (১৪৮৭-৯৩)

৩৯। সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-৯২)–প্রভু হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে প্রভুপত্নীর অনুরোধে বিশ্বস্ত হাবসী-গোলাম–আমীর আন্দিল সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ নামে গৌড়ের সিংহাসনে বসলেন।

He is credited with having ruled justly and efficiently. His reputation as a soldier inspired respect and awe and his attachment to the Ilyas Shahi house made the people forget his race. His kindness and benevolence evoked warm praise from the historians. (P. 139)

৪০। নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (২য়)–(১৪৯০-৯১)– এক বছর কাল রাজত্ব করার পর সিবিদরের হাতে নিহত হন।

৪১। শামসুদ্দীন মুজাফফর ওর্ফে সিদিবদর ওফেঁ দিওয়ানা (১৪৯১-৯৩)-রক্তপিপাসু নরদানব।

He was perfect reign of Terror …. Commenced a ruthless destruction of the noble and learned men of the capital. His sword fell equally heavily on the Hindu nobility and princes suspected on opposition to his sovereignty. (P. 140)

(ঝ) হোসেন শাহী আমল (১৪৯৩-১৫৩৮)

হোসেন শাহী শাসন সম্বন্ধে কোনো অভিযোগ নেই, বরং তারিফ আছে প্রচুর। কাজেই আমরা ইতিহাস আর ঘটতে চাইনে।

৪২। সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)। আমরা বাঙলার ৩১৫ বছরের ইতিহাসের খসড়া চিত্র দিলাম। এ ধরনের শাসনেই ডক্টর সুকুমার সেন অত্যাচার ও হত্যার তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করেছেন, গোপাল হালদার দেখেছেন কেবল রক্ত আর আগুন, আর ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মনীন্দ্রমোহন বসু, ডা. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাঙলা সাহিত্যের প্রায় সব ইতিহাসরচয়িতাই পড়েছেন দুঃশাসন, নিপীড়ন, বিধর্মী হত্যা কিংবা বলপ্রয়োগে ইসলামে দীক্ষার ত্ৰাসকর কাহিনী।

.

ইখতিয়ার উদ্দীন খালজী (১২০৪) থেকে সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৫১৯) অবধি মোট বিয়াল্লিশ জন শাসক গড়ে সাত বছর করে গৌড়রাজ্য শাসন করেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ স্বাধীন, কেউ বা দিল্লীর সম্রাটের সুবাদার। সুবাদারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ও বিধিবদ্ধ শাসনতান্ত্রিক কানুনের অনুপস্থিতি, সিংহাসনের উত্তরাধিকারে দাবী ও যোগ্যতা বিষয়ে ধর্মীয় কিংবা শাসনতান্ত্রিক বিধানের অভাব এবং অঞ্চল হিসাবে গৌড়ের প্রান্তিকতা গৌড় শাসকদের উচ্চাভিলাষী ও উচ্ছখল হতে সহায়তা করেছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিপুলতার কারণও এ-ই। তাই সুবাদার বদল হয়েছে ঘন ঘন। এতেই শাসকসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা-যুগে সুলতানেরা সাধারণত আমৃত্যু রাজত্ব করেছেন।

এঁদের মধ্যে হিন্দু-পীড়ক ও অত্যাচারী শাসক হচ্ছেন : ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খালজী (১২০৪-৭), আলী মর্দান (১২১০-১৩), মালিক তাজুদ্দিন আরসালান খান (১২৫৯-৬৫), সোনার গাঁয়ের ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৫৩-৫৭), শামসুদ্দীন মুজাফফর ওর্ফে সিদিবদর (১৪৯১-৯৩)। এদের মোট রাজত্বকাল বিশ বছর। ৩১৫ বছর কালের পরিসরে কুশাসন বা হিন্দু নিপীড়নের বিভিন্ন কালের যোগে পাচ্ছি মাত্র বিশ বছর। এই বিশ বছরই দুধে চনা কিংবা দুধে গরলের মতো গোটা মুসলিম আমলকে রক্ত ঝরানো ও আগুন জ্বালানো শাসনরূপে পরিচিত করেছে। সে-যুগে বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি না হওয়ার কারণ নাকি এ-ই।

আমরা জানি, মুসলমান শাসকেরা কেবল নিজেদের মধ্যে মারামারিই জিইয়ে রাখেননি, রাজ্যবিস্তারেও উদ্যোগী ছিলেন। রাজ্যের সংখ্যাগুরু হিন্দুকে শক্ত করে রেখে, অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু সৈন্য-ও নিয়ে (যেমন তুঘান খান, ১২৭২-৮১) যুদ্ধাভিযান করা কিছুতেই সম্ভব হত না। কাজেই রাজ্যের স্থায়িত্বের গরজেই হিন্দু-নির্যাতন সম্ভব ছিল না। আর সুবাদারেরা ঘন ঘন মসনদ নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন বটে, তাতে রাজধানীতে ও যুদ্ধক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা ও প্রজার দুর্ভোগ হওয়া সম্ভব, অন্যত্র নয়। বিশেষ করে দুইজনের কাড়াকাড়ির অবসরে প্রজারা প্রশ্রয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আর প্রতিদ্বন্দ্বীরা যখন মুসলমান, তখন এরূপ ক্ষেত্রে কেবল হিন্দুর উপরই পীড়ন হওয়ার কারণ নেই। সে যুগে রাজধানীর যুদ্ধ ও রাজা বদলের সংবাদ রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয় মাসে নয় মাসেই পৌঁছত। প্রজাসাধারণের তাতে ক্ষতি-বৃদ্ধির তেমন কিছু ছিল না। এ সম্পর্কে মামলুক শাসন সম্বন্ধে ঐতিহাসিকের পূর্বোদ্ধৃত মন্তব্য স্মরণীয়। যুগান্তকর পলাশী যুদ্ধের খবরই বা কাকে বিচলিত করেছিল? শহুরে রাজনীতি, আন্দোলন কিংবা হাঙ্গামা এ দেশে আজো গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে না। এ প্রসঙ্গে ১৯৪২, ৪৬ ও ৫০-এর রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার কথা স্মর্তব্য। আরো আগের ইতিহাসের দৃষ্টান্তও নেয়া যায়। আকবরের সময়ে (১৫৭৫ খ্রী:) বাঙলা বিজিত হল বটে; কিন্তু আকবর-জাহাগীরের আমলে নিরঙ্কুশ মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেননা মুঘলে-পাঠানে তথা রাজশক্তি ও সামন্ত শক্তিতে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই ছিল। শাহজাহানের আমলে বাঙলায় মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল সত্য; কিন্তু হার্মাদদের উপদ্রবে মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ছিল না; আবার আওরঙ্গজীবের আমলে বাণিজ্য-ক্ষেত্রে য়ুরোপীয় বণিকদের দৌরাত্ম্য নতুন উপসর্গরূপে দেখা দিল। তা সত্ত্বেও বাঙলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ ছিল না। আর ভারতে ইসলাম প্রচারে কোনো কোনো রাজশক্তির সহানুভূতি ছিল হয়তো, কিন্তু সহযোগিতা যে ছিল না তা ঐতিহাসিকেরাও স্বীকার করেন। জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করার কাহিনীও অমূলক। এ ব্যাপারে বলবনী শাসন সম্বন্ধে ঐতিহাসিকের পূর্বোদ্ধৃত মন্তব্য স্মরণীয়।

এবার বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসাগুলো পেশ করছিঃ

ক. তুর্কী আক্রমণ ও বিজয় কি কেবল বাঙলা দেশেই ঘটেছিল, ভারতের অন্যত্র ঘটেনি? সেখানকার অবস্থা কিরূপ দাঁড়িয়েছিল?

খ. যুদ্ধকালে জীবন ও সম্পদ নষ্ট অনিবার্য। কিন্তু তাই বলে যারা রাজত্ব করতে আসে, তারা বিজিতদের ওপর নির্বোধের মতো চিরকাল বেপরওয়া অত্যাচার চালায় না এবং চালালে সে-রাজ্য ও রাজত্ব টেকে না। রাজনীতি ও শাসননীতিতে এমন নির্বোধ policy থাকতে পারে না। যারা কথায় কথায় বাঙলা দেশে দেড়শ, দুশ বা আড়াই শ বছরব্যাপী হিন্দু-পীড়নের কথা বলেন, তাঁরা ভেবে দেখেছেন কি, যে এটা ছয় থেকে দশ পুরুষের (generations) ব্যাপার? ইতিমধ্যে শাসক বদল হয়েছে কয়বার; generation ঘুরেছে কয়বার? দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে পুরুষানুক্রমে একই মতাদর্শে আস্থা রাখা, একই পীড়ননীতি চালু রাখা কিংবা একই কর্মে সক্রিয় থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব কি?

গ, জনাব গোপাল হালদার (বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা, ১ম খণ্ড) বলেছেন, বৌদ্ধদেরও উপর অত্যাচার হয়েছিল। দুর্গভ্রমে মগধের বৌদ্ধবিহার আক্রমণ ও সৈন্যভ্রমে ভিক্ষু হত্যার ব্যাপারটি যে একান্তই অজ্ঞানকৃত তা ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেছেন। বৌদ্ধদের সংখ্যা তখন বাঙলায় নেহাত নগণ্য এবং দণ্ডশক্তি তাদের কারো হাতে ছিল না। তারা তখন ব্রাহ্মণ্য সমাজের নিগ্রহপিষ্ট ও অনুকম্পাজীবী। কাজেই তাদেরকে নিপীড়িত করবার কারণ ও সুযোগে দু-ই ছিল অনুপস্থিত। মুসলমান বিজয়ে ব্রাহ্মণ্য পীড়ন-মুক্তির উল্লাসই কি নিরঞ্জনের রুমায় ব্যক্ত হয়নি?

ঘ. ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন, উচ্চ বর্ণ ও বিত্তের লোকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। তারপরেও বাঙলা দেশে–বিশেষ করে গৌড়ে-নদীয়ায় উচ্চবর্ণের এত হিন্দু রইল কী করে? বাঙলা দেশে উচ্চবর্ণের লোকের আনুপাতিক সংখ্যা যত, ভারতের অন্য কোনো প্রদেশে তত আছে কি? বাঙলার যে অংশ সুলতানদের পদতলে ও পদপ্রান্তে ছিল সেখানে হিন্দুর সংখ্যা বেশি কেন? রক্তে ও আগুনে এতকিছু ধ্বংস করার পরেও সব রইল কী করে? মন্দির ধ্বংস কিংবা হিন্দু নাগরিক হত্যা না করেই পূর্ববঙ্গ একশত বছর পরে (১৩০১ খ্রী.) জয় করা হয়। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করতে আসলে ১৫০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল।] রাঢ় অঞ্চলও তেরো শতকের তৃতীয়পাদ অবধি গঙ্গারাজদের দখলে ছিল। সেখানকার বাঙলা ও সংস্কৃত অবদানের নিদর্শন কী এবং কোথায়?

ঙ. সে যুগে কি নির্দিষ্ট প্রান্তরে নির্দিষ্ট সময়ে যুদ্ধ হত না? এবং সেনাপতির নিধনে, দুর্গ দখলে কিংবা তখৃত অধিকারে গোটা দেশ জিত হত না? গরিলা যুদ্ধ তথা গণসগ্রাম ছিল কি? রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখড়ের প্রাণ যায়–কথাটা কি আক্ষরিক অর্থে সত্য ছিল না? আমাদের মধ্যযুগীয় শেষ লড়াই পলাশীর যুদ্ধও এরূপ যুদ্ধ নয় কি? জয়ের পরে দুই একদিন নিশ্চয়ই যুদ্ধক্ষেত্রের চারপাশে, রাজধানী প্রবেশের পথে ও রাজধানীতে লুটতরাজ চলত (এ-ই নিয়ম)। তাই বলে তা বছরের পর বছর ধরে চলেছে বলে ভাববার কারণ কি? বর্গীর হামলার মতো রাজশক্তির ও রাজার সুপরিকল্পিত cold-blooded বর্বরতা, লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ডের নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর আছে কি? তবু বর্গী উপদ্রুত অঞ্চলে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, পালা-পার্বণ ও বিবাহ-উৎসবাদি কি বন্ধ ছিল? দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে নিপীড়ন চললে তা কি গা-সহা বা অভ্যস্ত হয়ে উঠে না? সে অবস্থায় জীবনযাত্রা কি বিকৃতভাবেও স্বাভাবিকতা লাভ করে না? তখন সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় খুব বাধা থাকে কি? ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষকালে যখন বাঙলা দেশের প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ হারাল তখনো কি কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখিত এবং বাঙলার দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রে কি ছাপা হয় নি? পলাশীর যুদ্ধের পরে, সিপাহী বিপ্লবকালে, ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের সময়ে কিংবা ১৮৪৬-৫০-এর পাক-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বেপরওয়া হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের সময়ে (সংবাদপত্রাদির মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও এবং অনেকের আত্মীয়-স্বজনের প্রাণ ও সম্পদহানি হওয়ার পরেও) বাঙলা দেশের অধিকাংশ লোকের প্রাত্যহিক জীবনে ও মননে বিপর্যয় ঘটার প্রমাণ আছে কি? তখন কি স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত, পার্বণ ও বিবাহাদি উৎসব বন্ধ ছিল?

চ. মুসলমান আক্রমণকারীরা নাহয় গৌড়-লখনোতিতে চলার পথে, যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা রাজধানী দখলের সময়ে মন্দির ভেঙেছে, প্রধান ব্যক্তিদের হত্যা করেছে, গ্রাম লুট করেছে; কিন্তু তাদের সংখ্যা কয়টি ও কয়জন? দেশব্যাপী হিন্দু যারা বেঁচে রইল তাদের বাড়ির এবং দেশের অন্যান্য মন্দিরের পুথিপত্র নষ্ট হবার কারণ কি? এ তো গৌড়ের কথা। রাঢ়ে-বঙ্গে তো মুসলমানের পা বহুকাল পড়েনি, যখন পড়েছে তখন যুদ্ধক্ষেত্রেই জয়-পরাজয় নিশ্চিতভাবে নির্ণিত হয়েছে, মন্দির ভাঙার কিংবা নির্বিচারে লোকহত্যার প্রয়োজন হয়নি। সেখানকার হিন্দুর বাঙলা-সংস্কৃতে কী অবদান আছে? গৌড়-লখনেতিতে কাফেররা কি কেবল নিগৃহীতই হচ্ছিল; রাজনীতি ও কূটনীতির নিয়মানুসারে কেউ কেউ কি অনুগৃহীত হয়নি? তাদের দান কী?

ছ. ভারতে সর্বত্র ইংরেজের শাসনকাল সমান নয়। বাঙলাতেই তো ১৮২ বছর মাত্র। তবু আমরা কী দেখলাম? এর মধ্যেই আমাদের সর্বাত্মক বিবর্তন ও রূপান্তর জন্মান্তরেরই নামান্তর নয় কি? তা হলে মুসলমান রাজত্বের প্রথম আড়াইশ বছরেও (বিজ্ঞানযুগ নয় বলে হয়তো খুব মন্থরগতিতে) দেশের সমাজ সংস্কৃতি ক্ষেত্রে রূপান্তর ও বিবর্তন নিশ্চয়ই ঘটেছে, যার ক্রমিক ও পূর্ণ বিকশিত রূপ পাচ্ছি ভাস্কর রামানুজ-নিম্বার্ক-বল্লভ-কলন্দর-রামানন্দ-কবীর-নানক-একলব্য রামদাস-দাদু-রজ্জব-চৈতন্যের মতবাদে। ক্ষিতি মোহনসেনের ভারতের মধ্যযুগে সাধনার ধারা, হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা, তারাঠাদের, Influence of Islam on Indian culture সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের The Hindu view of life, বিনয় ঘোষের বাঙলার নবজাগৃতি, উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের ভারত দর্শন সার প্রভৃতি গ্রন্থে আমাদের উক্তির সমর্থন রয়েছে।

এ ব্যাপারে সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, নবদেবী-বনবিবি, কালুরায়-কালুগাজী, ওলাদেবী-ওলাবিবি প্রভৃতি উপ ও অপদেবতার উদ্ভব ও পূজা-শিনীর কথাও স্মরণীয়।

বৃহৎ বঙ্গে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, বাঙলা দেশে পাঠান প্রাবল্যের যুগ এক বিষয়ে বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রধান যুগ। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গদেশের সভ্যতার যে শ্রী ফুটিয়াছিল, এই পরাধীনতার যুগে সেই শ্ৰী শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল। এই পাঠান প্রাধান্য যুগে চিন্তাজগতে সর্বত্র অভূতপূর্ব স্বাধীনতার খেলা দৃষ্ট হইল। অরবিন্দ পোদ্দারের মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য ও মানবধর্ম গ্রন্থেও তুর্কী বিজয়ের সুফলের কথা আছে এবং বৈষ্ণব মত যে সুফী মতের প্রভাবপ্রসূত তা সুকুমার সেনও কিছুটা স্বীকার করেন। (বাঙ্গাল সাহিত্যের ইতিহাস-পূর্বার্ধ পৃ. ২৪৫)।

জ, বাঙলা দেশ উজাড় হল বলে বাঙলা সাহিত্য, দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে সৃষ্টি হয় নি, এ-ই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু সিদ্ধাদের চর্যাপদ ছাড়া বাঙলায় আর কিছুই সৃষ্টি হয়েছিল কি? উচ্চবর্ণের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মুসলিম বিজয়ের পূর্বেকার কোনো বাঙলা রচনার সন্ধান বা উল্লেখ পাওয়া যায় কি? লক্ষণ সেনের সভায় বাঙলায় লিখিয়ে কবি ছিলেন কি? শৌরসেনী ছাড়া অন্য কোনো অবহট্টেই কি লিখিত বিশেষ কোনো রচনা আছে [ODBL-P. 113]? গৌড়ী অবহট্টে রচনার রেওয়াজ না থাকলে প্রাচীন বাঙলাতেই বা থাকবে কেন? ধ্বংসের মধ্যেও মূর্ধাহত বাঙালি প্রাকৃত পৈঙ্গল ও সদুক্তিকর্ণামৃত সংকলন করবার প্রেরণা ও সংকলনের জন্য কবিতা পেলেন কোথায়? আর প্রাকৃত-অবহট্টের মতো বাঙলা কবিতা থাকলেও কি এরূপ সংকলন হত না? এ সময়ে রচনার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে এ সময়কার কিছু কিছু সংস্কৃত রচনার (পুরাণাদির) সন্ধান মিলল কিরূপে? বাঙলা কি তখন শিক্ষিত লোকের সাহিত্য রচনার বাহন হবার যোগ্য হয়েছিল? সে-যুগের ধর্মসম্পৃক্ত সাহিত্য ভাষায় সৃষ্টির বা অনুবাদের পক্ষে বাধা ছিল না কি? চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস ছাড়া কোনো বামুন আদিস্তরে বাঙলায় কিছু লিখতে সাহস বা আগ্রহ দেখিয়েছেন কি?

অষ্টাদশ পুরাণানি চ রামস্য চরিতানি চ।
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।

কিংবা কৃত্তিবেসে, কাশীদেসে আর বামুনঘেঁষে এ তিন সর্বনেশে বুলিটা আঠারো শতক অবধি কথায় ও কাজে অন্তত কিছুটা কি চালু ছিল না?

ঝ. হিন্দুর বেদ-পুরাণাদি রইল, লক্ষ্মণ সেনের সভাকবিদের গ্রন্থও রইল, মুসলমানেরা কি শুধু বেছে বেছে বাঙলা বই নষ্ট করেছিল যে চর্যাপদ নেপাল দরবারের আশ্রয়ে টিকে রইল আর শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন) বাঁকুড়ার গোয়ালঘরে আশ্রয় পেল? শ্রীকৃষ্ণ-সন্দর্ভের আর কোনো কপি পাওয়া গেল না কেন? শেখ শুভোদয়া কী বলে? বাঙলা দেশে কি আগুন-পানি-উই-কীট সে যুগে ছিল না? জনপ্রিয় না হলে এ-যুগের ছাপা বইও কি দুর্লভ ও ক্রমে লুপ্ত হয় না? ভাষার পরিবর্তনে ও জনপ্রিয়তার অভাবে (যদি বাঙলায় কিছু রচিত হয়েও থাকে) আলোচ্য যুগের বাঙলা বই কি লুপ্ত হতে পারে না? শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ কী লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় গ্রন্থ নয়?

নেপালেই বা চর্যাপদের একাধিক পুথি পাওয়া গেল না কেন? ষোলো-সতেরো শতকে রচিত বহু পুথি কি লুপ্ত হয়নি? শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের তারিখটি এবং কৃত্তিবাসের আত্মকথা প্রচুর পাওয়া যায় না কেন?

আমাদের ধারণায় তুর্কীবিজয় ও তার পরেরকার গৌড়রাজ্যের চিত্র এরূপঃ

তুর্কীরা যুদ্ধ করে যখন দেশ জয় করেছে (আসলে বখতিয়ার খলজী অনায়াসেই দেশ দখল করেন, হত্যাকাণ্ডের বিশেষ প্রয়োজন হয়নি, কারণ রাজা পালিয়ে গিয়েছিলেন]; তখন সাময়িকভাবে হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজ চলেছিল (যেমনটি চলে থাকে)। তারপর দেশ শাসনে তারা মনোযোগী হয়। গোড়ার দিকে উদ্ধত অসহযোগীদের শায়েস্তা করতে হয়, ফলে বিশেষ বিশেষ লোকের উপর অত্যাচার চলে। কিছু কিছু লোকের ধন-জন-প্রাণ হরণ করা হয় (যেমনটি নিয়ম ও প্রয়োজন)। তারপর রাজত্ব স্থায়ী করার গরজেই শাসিতদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা দানে শাসকবর্গ বাধ্য হয় এবং যেহেতু দেড়শ বছর ধরে গৌড় সিংহাসনের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা ছিল না, মসনদ নিয়ে নিত্য কাড়াকাড়ির আশঙ্কা থাকত, সেহেতু সিংহাসনাভিলাষীরা সামন্ত, সর্দার ও ভূঁইয়াদের স্বপক্ষে টানবার জন্যে সুশাসন চালাবার চেষ্টা করতেন এবং সে সূত্রে সুশাসনের নামে বেশকিছুটা অতিরিক্ত উদারতা ও সদাশয়তা দেখাতেন এবং জনপ্রিয়তার জন্যে জনগণকে প্রশ্রয় দিতেন। এও অনুমান করা যায় যে, তাঁরা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হবার গরজে প্রজাদের গোড়ার দিকে করভারে পীড়া দিয়েছেন। ইংরেজদের যেমন দেখেছি, তেমনি মুসলমানেরাও উত্তম্মন্যতা (Superiority complex) নিয়ে চলত, আর শাসিতদের অবজ্ঞা ও অনুকম্পা দেখাত; নির্বোধ ও সাধারণ মুসলমানেরা সে-অবজ্ঞা কথায় ও আচরণে প্রকাশ করত। কীর্তিলতা ও চৈতন্যমঙ্গলে যেমন দেখা যায় এজন্যে হিন্দু। মনেও ক্ষোভ ছিল (যেমন মধ্যযুগের হিন্দুরচিত নানা গ্রন্থে মুসলমানদের প্রতি বিরূপতা দেখা যায়; বৃটিশ আমলের দেশীয় সাহিত্যে যেমন ইংরেজ-বিদ্বেষ প্রকট)। এজন্যে সময় ও সুযোগমতো তারা তিলকে তাল করে রটিয়ে দিত। (কিছুকাল আগে যেমন পাকিস্তানে হিন্দু-নারী হরণের ও হিন্দুর উপর নানা লঘুগুরু অত্যাচারের অলীক সংবাদ কলকাতায় শোনা যেত)। শাসক-শাসিতের সম্পর্ক বিজাতির ও বিদেশীর হলে এমনটিই হয়, না হয়ে পারে না। শাসকের দোষ খোঁজার ও দেখার জন্যে এবং ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগের জন্যে এমনি অবস্থায় মনটি তৈরি হয়েই থাকে। (গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধীদলের ভূমিকা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।) ঐতিহাসিকের কর্তব্য সব কথা আক্ষরিকভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস না করে সত্য ও সারটুকু হেঁকে নেয়া। আর অদ্ভুত ও অসম্ভব কথা এ যুগেও রটে– সুতরাং সে-যুগে নানা কারণে এর বাহুল্য যে ছিল এবং অজ্ঞতার সুযোগ এবং যাচাই করবার উপায়ের অভাবে সেগুলো যে সহজে বিশ্বাস হত তা না বললেও চলে। আজকের মতোই ভালয় মন্দয় শাসনকার্য চলত, মাঝে মাঝে অমানুষ শাসকের হাতে পড়লে তার ব্যতিক্রম ঘটত–আজও যেমন ঘটে। এজন্যে মানুষের ভাব-চিন্তা কিংবা আনন্দ-উৎসব বন্ধ থাকেনি–থাকে না। তবে অনুকূল-প্রতিকূল পরিবেশে তার উৎকর্ষ-অপকর্ষ ঘটে। তাও এসব বাধার যা-কিছু গুরুত্ব সাধারণের কাছেই–প্রতিভাধরের কাছে কখনোই নয়। তার প্রমাণ বিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য।

এবার বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের কথায় আসা যাক। চর্যাগীতি যে বাঙলা এ বিশ্বাস থেকেই বাঙলা সাহিত্যের তামস-যুগ তত্ত্বের উদ্ভব। অথচ চর্যাগীতি যে প্রাচীন বাঙলা তা আজো সর্বজন স্বীকৃত সত্য নয়। হিন্দি, মৈথিল, উড়িয়া, অসমীয়াও এর দাবীদার। ডক্টর সুকুমার সেন, অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন প্রমুখ বাঙালি বিদ্বানেরাও ওদের দাবীর আংশিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। সব সিদ্ধার বাড়ি বাঙলায় নয়, বাঙলা তখনো শালীন ও লেখ্য সাহিত্যের ভাষা নয়, আঞ্চলিক বুলি মাত্র। কাজেই উড়িষ্যা, মিথিলা কিংবা আসামের লোকের বাঙলা পদ রচনা করার তখনো সাধ-সাধ্য থাকার কথা নয়। অতএব সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, চর্যাপদ অর্বাচীন প্রাচ্য (গৌড়ী?) অবহট্টে রচিত। সে সময় আঞ্চলিক বিকৃতিজাত সামান্য প্রভেদ থাকলেও উড়িয়া-বিহারী-বাঙলা ও আসামী অবহট্ট মোটামুটি অভিন্ন ছিল। নাথ সহজিয়া পন্থের অন্যতম প্রসারক্ষেত্র চন্দ্ররাজদের রাজ্য পূর্ববঙ্গ। কাজেই মানিকচাঁদ-ময়নামতী-গোপীচাঁদের দেশে (আধুনিক কুমিল্লাদি জেলায়) বহুল চর্চার ফলে নেপালেও চর্যাগীতি সম্ভবত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশাদি পূর্ববাঙলার লোকেরাই নিয়ে যান চর্যাগীতিতে বঙ্গ-গৌড়ীয় বিকৃতি এসেছে। এতেই বাঙলার দাবী জোরালো হয়েছে। মুনিদত্তের টীকাযুক্ত চর্যাগীতি নেপালে নেওয়ারী হরফে লিখিত পুথিতেই পাওয়া গেছে। বিদেশে বিভাষীর পক্ষে ভিন্ন ভাষার অলিখিত শাস্ত্রচর্চা সম্ভব নয়। কাজেই চর্যাগীতি নেপালে স্বাভাবিকভাবেই লিখিত ও টীকা সম্বলিত হয়েছে। কিন্তু আসাম-বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যাতেও তার লেখ্যরূপ ছিল বলে মনে করবার সঙ্গত কারণ নেই। নাথ সহজিয়া-শন্থ যোগ-তান্ত্রিক বজ্রযান বৌদ্ধদের বিকৃত উপশাখা। কাজেই উপসম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বেশি ছিল না এবং তারা স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপন। করেনি। অতএব সেকালের বাঙালি-বিহারী-আসামী-উড়িয়া সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বের দাবী বা যোগ্যতা এদের ছিল না। সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পাল আমলের। মধ্যকাল থেকেই সংস্কৃত চর্চা করত। কারণ শাস্ত্রচর্চার ও শাসন পরিচালনের বাহন ছিল সংস্কৃত। তাই প্রাচ্য অবহট্টেরও লেখ্যরূপ মিলে না। গৌড়ী-মাগধী অবহট্টেই যদি লেখার রেওয়াজ না থাকে, তা হলে তখনো নিতান্ত অবজ্ঞেয় আঞ্চলিক মুখের বুলি আসামী-বাঙলা-উড়িয়া-বিহারীতেই বা লেখ্য রচনার সম্ভাব্যতা কোথায়? কাজেই এদেশে চর্যাগীতির কোনো লেখ্যরূপ ছিল না এবং এগুলো মুখে মুখে রচিত ও গীত লোকসাহিত্য বা লোকায়ত শাস্ত্ররূপেই চালু ছিল বলে আমাদের ধারণা। অতএব, আমাদের অনুমান এই যে চর্যাগীতি লিখিত রচনাও নয়, বাঙলাও নয়– অর্বাচীন গৌড়ী-মাগধী অবহট্ট এবং মৌখিক রচনা। ডক্টর সুকুমার সেনও বলেছেন–অসমীয়া ভাষীদের দাবী অযৌক্তিক নয়, কেননা যোড়শ শতাব্দী অবধি (বাঙলা ও অসমীয়া) দুই ভাষায় বিশেষ তফাৎ ছিল না  এবং উড়িয়া-আসামীদের সঙ্গে বাঙলার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আদিতে এই তিনটি একই ভাষা ছিল। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর হইতে মূল ধারা হইতে উড়িয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে।4- ৫ কাজেই ভাষার এক সাধারণ স্তর থেকে বাঙলা, উড়িয়া, মৈথিল অসমীয়ার উদ্ভব। ডক্টর সুকুমার সেন এর নাম দিয়েছেন, প্রত্ন-বাঙ্গালা-অসমীয়া-উড়িয়া।৬ এই সাধারণ স্তর আমাদের ধারণায় অর্বাচীন অবহট্ট বা আধুনিক ভাষাগুলোর লক্ষণ স্ফুটনকালীন অবহট্ট। অতএব চর্যাগীতি কেবল বাঙলার নয়, উক্ত অপর ভাষাগুলোও সাধারণ ঐতিহ্য এবং এর ভাষা আলোচ্য সবকয়টি ভাষার জননী।

ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন না হলে আগের যুগে কোনো বুলিই লেখ্য সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হত না। আদিযুগে সংস্কৃতই ছিল পাক-ভারতের ধর্মের, শিক্ষার, দরবারের, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও বিভিন্ন অঞ্চলের লোকের ভাব-বিনিময়ের বাহন। তাই কোনো আর্য ভারতিক আঞ্চলিক বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা কিংবা শালীন সাহিত্যের বাহন হবার সুযোগ পায়নি। বৌদ্ধ ও জৈন মত প্রচারের বাহনরূপেই প্রথম দুটো বুলি–পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যিক ভাষার স্তরে উন্নীত হয়। তারপর অনেক কাল রাষ্ট্র শাসনের কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগেনি বলে পরে কোনো বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি। পরে সাহিত্যের প্রয়োজনে নাটকে শৌরসেনী, মারাঠি ও মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতে থাকে। আরো পরে রাজপুত রাজাদের প্রতিপোষকতায় শৌরসেনী অপভ্রষ্ট বা অবহট্ট সাহিত্যের ভাষার রূপ পায়।

এরপরে মুসলমান আমলে ফারসি হল দরকারী ভাষা। মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এদেশী জনজীবনে যে ভাববিপ্লব এল, বিশেষ করে তারই ফলে আধুনিক পাক-ভারতিক আর্য ভাষাগুলোর দ্রুত সাহিত্যিক বিকাশ সম্ভব হল। এক্ষেত্রে ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই সব কয়টি আঞ্চলিক বুলি লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এ ব্যাপারে রামানন্দ, কলন্দর, নানক, কবীর, দাদু, একলব্য, রামদাস, চৈতন্য, রজ্জব প্রভৃতি সন্তগণের দান মুখ্য ও অপরিমেয়।

এদিক দিয়ে পূর্বী বুলিগুলোর ভাগ্যই সবচেয়ে ভাল। এসব বুলি যখন সৃজ্যমান তখন এদের জননী অর্বাচীন অবহট্ট বৌদ্ধ ব্ৰজযান সম্প্রদায়ের যোগ-তন্ত্র ও শৈবমত প্রভাবিত এক উপশাখার সাধন-ভজনের মাধ্যম হবার সুযোগ পায়– যার ফলে আধুনিক আর্য ভাষার (অবহট্ট থেকে ভাষাগুলোর সৃষ্টিকালের বা দুইস্তরের অন্তর্বর্তীকালের বা সন্ধিকালের) প্রাচীনতম নিদর্শনস্বরূপ চর্যাগীতিগুলো পেয়েছি।

তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হল। আর এর দ্রুত বিকাশের সহায়ক হল বৈষ্ণবমত ও দেব পাঁচালী। পরবর্তীকালে খ্রীস্ট ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের, হিন্দুসমাজে সংস্কারের এবং কোম্পানীর শাসন পরিচালনের প্রয়োজনে বাঙলা গদ্যের সৃষ্টি ও দ্রুত পুষ্টি হয়। এসব আকস্মিক সুযোগসুবিধা পেয়েও বাঙলা ভাষা স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেনি; কারণ পরপর সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজির চাপে পড়ে বাঙলা কোনো দিন জাতীয় ভাষা বা সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ভাষার মর্যাদা পায়নি। আজ অবধি বাঙলা একরকম অযত্নে লালিত ও আকস্মিক যোগাযোগে পুষ্ট।

শিক্ষার, সাহিত্যের ও দরবারের ভাষা শিক্ষিত লোকের ভাষা। সেকালে শিক্ষিতের সংখ্যা। ছিল নগণ্য। কাজেই প্রাকৃতজন তাদের ভাব-ভাবনা ও অনুভূতি-উপলব্ধি প্রকাশ করত নিজেদের মুখের বুলিতেই। এভাবে তারা গান, গাথা, ছড়া, বচন ও রূপকথা-রসবার্তা তৈরি করে মুখে মুখে প্রচার করতে থাকে। বহু মুখের স্পর্শে ওগুলো রূপ ও রস বদলায়, ফলে ও-গুলোকে ব্যক্তিক রচনা বলে চিহ্নিত করা যায় না। তাই আজকাল এ সাহিত্যকে গণরচনা বলে নির্দেশ করা হয়। আমাদের আধুনিক সংজ্ঞায় এগুলোই লোক-সাহিত্য বা পল্লী-সাহিত্য। আঞ্চলিক বুলিতে রচিত বলে লোক সাহিত্য সাধারণত অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে দেশময় ব্যাপ্ত হতে পারত না। পল্লী-সাহিত্য সাহিত্য-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস-প্রসূত নয়। তবু মানবমনের কোমল অনুভূতির আন্তরিক প্রকাশ বলেই এগুলো সুন্দর এবং স্থানে স্থানে শিল্পগুণে মণ্ডিত। মুখের বুলির পুষ্টি ও বিকাশ হয়েছে প্রাকৃত . রচনা লোক-সাহিত্যের মাধ্যমেই। বাঙলা লোক-সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে–ডাক ও খনার বচন, ছড়া, প্রবাদ, রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা, যোগীপাল-ভোগীপাল, মহীপাল গীত (অপ্রাপ্য), ময়নামতী-গোপীচাঁদ-মানিকচাঁদ গীত, মীননাথ-গোখনাথ-হাড়িপা কাহিনী; শিবের-ছড়া, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, রাম পাঁচালী, ভারত কথা প্রভৃতি। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে ব্রাহ্মণ্য সমাজের কাহিনীগুলো রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ও মঙ্গল কাব্যাদিতে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ কাহিনী ময়নামতী-গোপীচাঁদকথা গাথা রূপেই রয়ে গেছে এবং পাল গীতি লোপ পেয়েছে।

অন্যান্য দেশের বুলি যেমন ধর্মমত প্রচারের বাহন বা রাজ্য শাসনের মাধ্যম কিংবা প্রাকৃতজনের রচনার অবলম্বন হয়ে ক্রমে সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে বাঙলার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে বলে রাখা ভাল, মুসলমান সুলতান-সুবেদারেরাও শাসিতদের জানবার ও শাসন পরিচালনার গরজেই বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির পোষকতা করেন। লেখ্য ভাষা বইপত্র ছাড়া লেখা যায় না, কাজেই গ্রন্থ লিখিয়ে নিতে হল–ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যেমনটি হয়ে ছিল। আর ভাষার বুনিয়াদ দ্রুত গড়ে উঠে এবং ভাষা পুষ্টি লাভ করে অনুবাদের মাধ্যমে। বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি।

অতএব আলোচ্য দুশ বছরের মধ্যেকার বাঙলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন না মেলার আমাদের অনুমিত কারণ এই :

ক. ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্য শাসনের বাহন হয়নি বলে বাঙলা তুর্কী বিজয়ের পূর্বে লেখ্য ভাষার মর্যাদা পায়নি।

খ. ফলে, তেরো-চৌদ্দ শতক অবধি বাঙলা ভাষা উচ্চবিত্তের লোকের সাহিত্য রচনার যোগ্য হয়ে উঠেনি। এ সময় প্রাকৃতজনের মুখে মুখে গান, গাথা ও ছড়া-পঁচালীই চলত।৭

গ. সংস্কৃতের কোনো ভাষাতেই রস-সাহিত্য চৌদ্দ শতকের পূর্বে রচিত হয়নি। ভাষাকে লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহন রূপেই প্রাকৃতজনেরা গ্রহণ করে। সাহিত্যের ভাষা। তখনো সংস্কৃত প্রাকৃত বা শৌরসনী অবহট্টই ছিল। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র ভাষায় রচন, পঠন ও শ্রবণ নিষিদ্ধ ছিল। সংস্কৃতের মাধ্যমে বৌদ্ধ শাস্ত্রেরও চর্চা প্রথায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর অপরিণত বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির কল্পনা ও সম্ভাব্যতা কোনো উচ্চশিক্ষিত লোকের মনে জাগে নি। পাল ও সেন আমলে সংস্কৃত চর্চা হয়েছে এবং মুসলমান বিজয়ের পর প্রাকৃতজনেরা প্রশ্রয় পেয়ে বাঙলা রচনা করেছে মুখে মুখে। তাই লিখিত সাহিত্য অনেককাল গড়ে উঠেনি। কিন্তু এতে ভাষা বিকশিত হয়েছে; তার প্রমাণ মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে (তথা শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে)। এ গ্রন্থেই দেখা যায়, ইতিমধ্যে এক ডজন ফারসি-তুর্কী শব্দ বাঙলা সাহিত্যের ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে।

ঘ, তেরো-চৌদ্দ শতকে সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র ছিল হিন্দু শাসিত মিথিলায়। তাই এ সময় বাঙলা দেশে সংস্কৃতচর্চা বিশেষ হয়নি, কেবল কিছু কিছু শাস্ত্রগ্রন্থের অনুশীলন হয়েছিল। মিথিলার পণ্ডিত চক্ৰায়ুধের মৃত্যুর পর নবদ্বীপ সংস্কৃতচর্চার তথা শাস্ত্রচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠে।

ঙ. তর্কের খাতিরে যদি স্বীকারও করা যায় যে আলোচ্য যুগে বাঙলায় কিছু কিছু পুথিপত্র রচিত হয়েছিল, তা হলেও জনপ্রিয়তার অভাবে, ভাষার বিবর্তনে এবং অনুলিপি করণের গরজ ও আগ্রহের অভাবে তা নষ্ট হয়েছে। যত্ন করে রক্ষা না করলে অপ্রিয় বা বাজে ছাপা বইও লোপ পায়। আগুন পানি-উই-কীট তো রয়েইছে। কিন্তু এ যুগে যে ভাষায় কিছু লিখবার রীতি ছিল না, তার বড় প্রমাণ পনেরো শতকের শেষাবধি নানা মঙ্গল গীতি, রামায়ণ গান, ভারত পাচালী এবং বিশ শতকেও পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়নামতী গানের লিখিতরূপ পাওয়া যায়নি। অথচ এগুলো সুপ্রাচীন।

চ. আবার লিখিত হলেও কালে লুপ্ত হওয়ার বড় প্রমাণ চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ, (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন), শেখ শুভোদয়া প্রভৃতির একাধিক পাণ্ডুলিপির অভাব।

ছ. চর্যাগীতি রচনার শেষ সীমা যদি বারো শতক হয়, তা হলে তেরো-চৌদ্দ শতক বাঙলা ভাষার গঠন যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। কাজেই এ সময়কার কোনো লিখিত রচনা না-থাকারই কথা। চর্যাগীতি ছাড়াও বারো শতকের বাঙলা-ঘেঁষা রচনার নমুনা মেলে শেখ শুভোদয়ার আর্যায় ও প্রাকৃত পৈঙ্গলের কোনো কোনো পদে। বাঙলা তখন সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, লক্ষ্মণ সেনের সভায় আমরা বাঙলা-কবিও দেখতে পেতাম এবং পূর্ববঙ্গ ও রাঢ়ের মতো হিন্দুশাসিত অঞ্চলে তেরো শতকে লিখিত বাঙলা রচনার নিদর্শন পাওয়া যেত।

জ. দেশজ মুসলমানের ভাষা চিরকালই বাঙলা। বাঙলায় লেখ্য রচনার রেওয়াজ থাকলে তুর্কী-বিজয়ের পূর্বের বা পরের মুসলমানের রচনা নষ্ট হবার কারণ ছিল না এবং মুসলিম বিজয়ে তাদের রচনার ধারাবাহিকতা ছিন্ন হওয়ার কারণ ঘটেনি। কেবল তাই নয়, বাঙলা লেখ্য ভাষা হলে গৌড়-সুলতানের দরবারে রাজ্যশাসনের প্রয়োজনে গোড়া থেকেই অন্তত বাঙলা ফরমান লিখিয়ে মুসলমান পাওয়া যেত। হিন্দুরা যে অশ্রদ্ধাবশত বাঙলায় কখনো সাহিত্য সৃষ্টি করতে চায়নি, লৌকিক দেবতার পূজাপ্রচার প্রয়াসীই ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে আঠারো শতক অবধি লিখিত হিন্দুর রচনায়।

পরাধীনতার গ্লানি হিন্দু-মনে অবশ্যই ছিল। তেমন অবস্থায়ও যে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হতে পারে তার সাক্ষ্য রয়েছে উনিশ-বিশ শতকের বাঙলা সাহিত্যে। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যে চারশ বছরেও আশানুরূপ উন্নতি ও বিকাশ হয়নি বাঙলা দরবারী কিংবা জাতীয় ভাষার মর্যাদা পায়নি বলেই।

অতএব, আমাদের অনুমান এই যে বাঙলা বারো, তেরো ও চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ অবধি লেখ্যভাষার স্তরে উন্নীত হয়নি। এটি হচ্ছে বাঙলার প্রাপ্তির কাল ও মৌখিক রচনার যুগ।

 বিদ্যাপতির কাল নিরূপণ

বিদ্যাপতির আবির্ভাব কাল তথা জীবকাল নিঃসংশয়ে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি আজো। মুখ্যত লক্ষণ সংবই এরজন্যে দায়ী। মিথিলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই সংবৎ গণনার চারটি ভিন্ন রীতি ছিল ষোলো সতেরো শতক অবধি। মোটামুটিভাবে কোনোটির সঙ্গে ১০৮০, কোনোটির সঙ্গে ১১০৮, কোনোটির সঙ্গে ১১১৯-২০ এবং কোনোটির সঙ্গে ১১২৯ বছর যোগ করলে খ্রীস্টাব্দ মেলে।

আমরা বিদ্যাপতি-রচিত গ্রন্থে ও পদাবলীতে মিথিলার ও প্রতিবেশী রাজ্যের রাজপুরুষ, রানী ও রাজাদের নাম পাই। ভোগীশ্বর, গণেশ্বর, কীর্তিসিংহ, বীরসিংহ, ভবসিংহ, দেবসিংহ, হরসিংহ, শিবসিংহ, পদ্মসিংহ, নরসিংহ, রাঘবসিংহ, ভূপতি সিংহ, রাজবল্লভ, রুদ্র সিংহ, ধীরসিংহ, মিথিলারাজ ভোগীশ্বর-পত্নী পদ্মাদেবী, দেবসিংহ-পত্নী হাসিনী দেবী, শিবসিংহ-পত্নী লক্ষ্মীদেবী, পদ্মসিংহ-পত্নী বিশ্বাসদেবী, নারায়ণ-পত্নী মেনকা দেবী, রেণুকা দেবী, রাজা অর্জুন, চন্দ্ৰসিংহ, রূপিণী দেবী, ভূপতিনাথ, কংসনারায়ণ ও তৎপত্নী সুরমা দেবী, রাঘব সিংহ-পত্নী স্বর্ণমতী দেবী, পুরাদিত্য লক্ষ্মীনারায়ণ-পত্নী চন্দল দেবী প্রভৃতি এবং আরসালান, মালিক বাহারুদ্দিন, গিয়াসুদ্দিন, আলম শাহ, নসরত শাহ, ইব্রাহিম শাহ, হোসেন শাহ, ফিরোজ শাহ প্রভৃতি প্রতিবেশী রাজ্যের সুলতান ও রাজপুরুষদের নাম রয়েছে কবির গ্রন্থে ও পদাবলীতে।

ঐনবার বংশের কামেশ্বর-পুত্র রাজা ভোগীশ্বরই বিদ্যাপতির রচনায় প্রথমোল্লিখিত ব্যক্তি। ভোগীশ্বর দিল্লীর তুঘলক সুলতান ফিরোজ শাহর (১৩৫১-৮৮) সমসাময়িক ও প্রিয় বন্ধু ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন বিদ্যাপতি :

ভোগী সরাঅ বর ভোগ পুরন্দর। …
পিঅ সখা ভণি পিঅরোজ সাহ সুরতান-সমানল।

এই ভোগীশ্বরের রাজত্বকালেই যে বিদ্যাপতি গান রচনা শুরু করেন, তার প্রমাণ–এর পূর্বেকার মিথিলার কোনো রাজা বা রাজপুরুষের নাম মেলে না বিদ্যাপতির পদে। ভোগীশ্বরের পত্নীর নাম ছিল পদ্মাদেবী। বিদ্যাপতি বলেন: বিদ্যাপতি কবি গাবিআরে

তোকে অছ গুণক নিধান
রাউ ভোগিসর গুণ নাগরা রে
পদমা দেবী রমাণ।

ভোগীশ্বরের পুত্র গণেশ্বরের সঙ্গে ২৫২ লক্ষণ সংবতে আরসালান (আসলান) নামের এক রাজ্যলোভী তুর্কীর যুদ্ধ হয়, এই যুদ্ধে আরসালান পরাজিত হয়। কিন্তু পরে একসময় উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এবং সে-সুযোগে আরসালান গণেশ্বরকে হত্যা করে মিথিলার শাসক হয়। কীর্তিলতা সূত্রেই আমরা এ সত্য জানতে পাই :

লখখন সেন নরেশ লিহিঅ জবে পখখ পঞ্চদ্বে
তনুহমাসহি পঢ়ম পখখ পঞ্চমী কহি অজে।
রজ্জলুব্ধ আসলান বুদ্ধি বিক্কম বলে হারল।
পাস বইসি বিসবাসি রাএ গএনেসর মারল।

এর থেকে আমরা দুটো বিষয়ে ইঙ্গিত পাই, ক. ২৫২ সংবতের তথা ১৩৮১ (২৫২– ১১২৯) খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই ভোগীশ্বরের মৃত্যু হয় আর ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের পরে কোনো সময়ে গণেশ্বর আরসালানের হাতে প্রাণ হারান। এবং খ. ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই গান লেখার মতো বয়স হয়েছিল বিদ্যাপতির। অতএব বিদ্যাপতির জন্ম হয় ১৩৬০-৬৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে।

কীর্তিলতা থেকেই জানা যায়, গণেশ-পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ জৌনপুরের রাজা ইব্রাহিম শাহ শর্কীর (১৪০১-৪০ খ্রীস্টাব্দে) আশ্রয় ও সহায়তা পেয়েছিলেন। অতএব অন্তত ১৪০১ খ্রস্টাব্দ অবধি মিথিলা আরসালানের অধিকারে ছিল।

ইব্রাহিম শর্কী গণেশ-পুত্র কীর্তিসিংহকে মিথিলার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। কীর্তিসিংহের আগ্রহে তার বীরত্ব-কথা বর্ণিত বলেই গ্রন্থের নাম কীর্তিলতা। কীর্তিসিংহের পরে মিথিলার রাজা হন কামেশ্বরের অপর পুত্র ভবসিংহ। তার পরে রাজত্ব করেন তাঁর পুত্র দেবসিংহ। পিতৃদ্রোহী শিবসিংহ পিতা দেবসিংহকে তাড়িয়ে নিজেই রাজা হলেন। শিবসিংহের পিতা দেবসিংহ আবার সিংহাসন পেয়েছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অপর পুত্র পদ্মসিংহ রাজা হন। অবশ্য এঁদের কেউ বেশিদিন রাজত্ব করেননি। তবে শিবসিংহ প্রতাপশালী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে গৌড়ের রাজা গণেশের মিত্রতা ছিল এবং তিনি সম্ভবত মিথিলাকে জৌনপুরের প্রভাবমুক্ত করেন। শিবসিংহের আমলেই বিদ্যাপতি তার অধিকাংশ পদ এবং গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কাজেই শিবসিংহ ও বিদ্যাপতির যশ ও খ্যাতি পারস্পরিক প্রীতি ও গুণগ্রাহিতার ফল। গণেশের বিরুদ্ধে ইব্রাহিম শর্কীর গৌড় অভিযানকালে (১৪১৫ খ্রীস্টাব্দে) শিবসিংহ ইব্রাহিম শর্কীর হাতে নিহত অথবা বন্দী হন। এবং শর্কী দেবসিংহকে আবার রাজা করেন। কাজেই ১৪১৫ খ্রীস্টাব্দে শিবসিংহের রাজস্ব শেষ হয়। শ্রীধরের কাব্য প্রকাশ গ্রন্থের পুষ্পিকা সূত্রে বলা যায় (২৯১ ল. সং + ১১১৯) শিবসিংহ ১৪১০ সনের দিকে পিতৃসিংহাসন দখল করেছিলেন। দেবসিংহের পরে তাঁর অপর পুত্র পদ্মসিংহ রাজা হন। পদ্মসিংহের পরে হয়তো দেবসিংহের ভাই ত্ৰিপুর সিংহের (নৃপনারায়ণ) পুত্র অর্জুন ও অমর সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। এই সুযোগে নেপালের সপ্তরী জনপদের পুরাদিত্য অর্জুন ও অমরকে পরাজিত ও হত্যা করে দ্রোণবারে স্বাধীন রাজা হন। তাঁর সভাতেই বিদ্যাপতি এই বিপর্যয়ের সময় আশ্রয় পান। হয়তো শিবসিংহের পরিবারও রাজবনৌলি গ্রামে বিদ্যাপতির তত্ত্বাবধানে ছিলেন। পদ্মসিংহের পর দেবসিংহের ভাই হর বা হরিসিংহের পুত্র নরসিংহ বা নৃসিংহ রাজত্ব পেয়েছিলেন। এই নৃসিংহ বা নরসিংহের একটি শিলালিপি মিলেছে মাধিপুরা মহকুমার কানাদাহা গাঁয়ে। এতে শক শাশ্ব মদন: তথা ১৩৭৫ শক বা ১৪৫৩-৫৪ খ্রীস্টাব্দ পাওয়া যায়। অতএব নরসিংহ অন্তত ১৪৫৩-৫৪ খ্রীস্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন। নরসিংহের আদেশে বিদ্যাপতি বিভাগসার, তাঁর স্ত্রী ধীরমতির আগ্রহে দানবাক্যাবলী, পুত্র ভৈরব সিংহের আজ্ঞায় দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী রচনা করেন। দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণীতে কবি নরসিংহ ও তাঁর পুত্র ধীর সিংহকে রাজা বলে বর্ণনা করেছেন। অতএব পিতার জীবিত কালেই পুত্র রাজা বা যুবরাজ হয়েছিলেন। নরসিংহেরই বিরুদ ছিল দর্পনারায়ণ। এই দর্পনারায়ণের আদেশেই কবি ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণী রচনা করেন। শিবসিংহের দুই জ্ঞাতি ভাতার নাম ছিল রাঘবসিংহ ও রুদ্ৰসিংহ এবং ধীরসিংহের পুত্র ও পৌত্রেরও যথাক্রমে এ দুটো নাম ছিল। বিদ্যাপতির তিনটে পদে রাঘব সিংহের ও দুটো পদে রুদ্র সিংহের নাম আছে। ধীর সিংহের সময়েই তাঁর পুত্র-পৌত্রকে পাওয়া যায়, কাজেই রাঘব ও রুদ্র শিবসিংহের জ্ঞাতিভ্রাতা না হয়ে যদি ধীরসিংহের পুত্র এবং পৌত্রও হয়, তাতে বিদ্যাপতির জীবৎকালের পরিসরে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। অতএব, বিদ্যাপতি আনুমানিক ১৪৫৫ খ্রীস্টাব্দ অবধি গ্রন্থ ও পদ রচনা করেছেন। আমরা উপরে যা আলোচনা করেছি, ছকে তা এরূপ দাঁড়ায়।

কামেশ্বর [ ঐনবার বংশ ]

ভোগীশ্বর (আ. ১৩৫৩–৫৫- ৮০ খ্রী.)

পত্নী পদ্মাদেবী।

ভবসিংহ

১৪০৪– ০৫}

হরসিংহ

ত্রিপুরাসিংহ

গণেশ্বর

গরুড়নারায়ণ

দেবসিংহ।

(পত্নী হাসিনীদেবী। কীর্তিসিংহ বীরসিংহ রাওসিংহ ( ১৪০৬-৯ এবং ১৪১৬-১৭ [ ১৪০২-০৪ খ্রী.]

অর্জুন. অমর [ অরাজকতা ১৪২৫-২৯ খ্রী:]

রূপনারায়ণ শিবসিংহ

পদ্মসিংহ পিত্নী লক্ষ্মীদেবী ] পত্নী বিশ্বাসদেবী। ( ১৪১০– ১৫ খ্র.]

১৪১৮-২৫ খ্রী. 1 [ এঁর জ্ঞাতিভ্রাতা : রাঘব ও রুদ্ৰসিংহ

দর্পনারায়ণ নরসিংহ পিত্নী ধীরমতি ] [ ১৪৩০– ৫৩ খ্রী. ]

যুবরাজ ভৈরবসিংহ

চন্দ্ৰসিংহ

কংসনারায়ণ ধীরসিংহ পিত্নী সুরমাদেবী ] [ ১৪৫০– ৫৫ খ্র.)

জগন্নারায়ণ

রাঘবসিংহ। [ পত্নী স্বর্ণমতীদেবী

রুদ্ৰসিংহ

গদাধর

ভোগীশ্বর থেকে রুদ্ৰসিংহ অবধি কামেশ্বর বংশীয় সব রাজা, রাজকুমার ও রানীর প্রশংসাসূচক ভণিতা দিয়েছেন বিদ্যাপতি তাঁর রচিত পদে। গ্রন্থগুলোও রচিত হয়েছে তাঁদের কারো-না-কারো নির্দেশে। বংশ তালিকাটি দীর্ঘ হলেও কাল-পরিসর দীর্ঘ নয়। খুব দীর্ঘায়ু না হয়েও এমনি স্বল্পজীবী অনেক সুলতানের (গিয়াসুদ্দীন বলবন থেকে গিয়াসুদ্দীন তুঘলক অবধি প্রতিপোষণ পেয়েছিলেন কবি জামীর খুসরুও (১২৫৩-১৩২৫ খ্রী.]। ভোগীশ্বর থেকে রুদ্ৰসিংহ অবধি কালের বিস্তৃতি হবে মোটামুটি ৭৫ বৎসর (আনু ১৩৮০-১৪৫৫ খ্রীস্টাব্দ]। বিদ্যাপতি দীর্ঘজীবী ছিলেন বলে লোকশ্রুতি আছে। অতএব, বিদ্যাপতির আয়ু [ ১৩৬৪– ১৪৫৪ খ্রী.] নব্বই বছর হলেই ভোগীশ্বর থেকে রুদ্ৰসিংহ অবধি সবাই তার জ্যেষ্ঠ, সমবয়স্ক কিংবা কনিষ্ঠ সমসাময়িক হতে পারেন।

আমাদের ধারণা দর্পনারায়ণ নরসিংহের রাজত্বকালেই যুবরাজ ছিলেন। ধীরসিংহ এবং ভৈরবসিংহ রাজত্ব করেছেন পনেরো শতকের শেষদশকে (মুদ্রার প্রমাণে)। ধীরসিংহের পুত্র রাঘব কিংবা পৌত্র রুদ্ৰসিংহ দর্পনারায়ণ নরসিংহের আমলেই যথাক্রমে প্রৌঢ় ও যুবক ছিলেন। আর সৌজন্যের ভাষায় রাজপরিবারের লোকমাত্রই রায় বা রাজা। এইজন্যে তাঁরা যথার্থ রাজা ছিলেন। বলে মনে করা অসঙ্গত। এ প্রসঙ্গে দীর্ঘজীবী আওরঙজীবের বংশধারা–বাহাদুর শাহ– আজিমুশোন–ফররুখশিয়র প্রভৃতি স্মর্তব্য। আওরঙজীবের মৃত্যুকালে প্রপৌত্র ফররুখশিয়রই প্রায়-প্রৌঢ়।

বিদ্যাপতি যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলোর আদেষ্টানুক্রমিক তালিকা এরূপ :

গ্রন্থ        ———  আদেষ্টা
১.   কীর্তিলতা   ——–   কীর্তিসিংহ।
[১৪০২-০৪]।
২.    কীর্তিপতাকা ——–   রূপনারায়ণ
৩.    পুরুষ পরীক্ষা ——–  শিবসিংহ
৪.    গোরক্ষ বিজয় [নাটক] —- [১৪১০-১৫ খ্রী.]
৫.    ভূপরিক্রমা  ———   গরুড়নারায়ণ দেবসিংহ।
[১৪১৬-১৭ খ্রী.]
৬.    শৈবসর্বস্বসার ——–   পদ্মসিংহ ও তৎপত্নী বিশ্বাসদেবী
৭.   গঙ্গাবাক্যাবলী। ——-     [১৪১৮-২৫ খ্রী.]
৮.   লিখনাবলী  ———     দ্রোণবারের রাজা পুরাদিত্য
[ল, সং ২৯৯+১১২৯=১৪২৮ খ্রী.]
দ্রষ্টব্য : JASB, 1915, p.422 ]
৯. বিভাগসার  ———–    দর্পনারায়ণ নরসিংহ।
১০. দানবাক্যাবলী  ——–   নরসিংহ পত্নী ধীরমতি
১১. দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী  ——   কংসনারায়ণ ধীরসিংহ আঃ ভৈরবসিংহ [রূপনারায়ণ ও হরিনারায়ণ]।
১২. ব্যাড়ীভক্তিতরঙ্গণী  ——-   দর্পনারায়ণ নরসিংহ
[৯-১২ —- ১৪৩০-৫৫ খ্রী]
১৩. বর্ষকৃত্য বা ক্রিয়া-অপ্রাপ্ত।
১৪. গয়াবাক্যাবলী বা গয়াপত্তন–অপ্রাপ্ত।

বিদ্যাপতি ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণীতে প্রসঙ্গক্রমে দুর্গা ভক্তিতরঙ্গিনীর উল্লেখ করেছেন–অনুত্তং যদন্যম দুর্গাভক্তিতরঙ্গিন্যাম অনুসন্ধেয়ং গ্রন্থ কলেবর শঙ্কয়াএ পুণর্লিখিতমিতি–গণেশচরণ বসুর মতে স্মৃতিকারেরা নিজের রচনা উল্লেখ প্রসঙ্গেই সাধারণত অনুসন্ধেয়ং শব্দটি প্রয়োগ করতেন।

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণী দুর্গাভক্তি তরঙ্গিণীর পরে রচিত। বিদ্বানদের মতে দুর্গাভক্তি তরঙ্গিণী ভৈরব সিংহের আদেশে প্রণীত। ভৈরব সিংহের পিতা নরসিংহ দর্পনারায়ণ যে ১৪৫৩ খ্রীস্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন, তার প্রমাণ তার তাম্রশাসন। কাজেই এ সময়ে বা কিছু আগে কিংবা পরে যে ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণী রচিত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সম্ভবত এটিই বিদ্যাপতির শেষ গ্রন্থ।

সম্ভবত গিয়াসুদ্দীন তুঘলকই (১৩২৪-২৫ খ্রীস্টাব্দে) মিথিলার কর্ণাট-বংশের উচ্ছেদ সাধন করে রাজপণ্ডিত কামেশ্বরকে মিথিলার সিংহাসন দান করেন। মুহম্মদ তুঘলকের রাজত্বকালে হাজী ইলিয়াস ওর্ষে গৌড় সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ১৩৪৫-৪৬ খ্রীস্টাব্দে বিহার জয় করে হাজীপুর শহরের পত্তন করেন। পরে ফিরোজ তুঘলক ইলিয়াস শাহকে বিতাড়িত করে মিথিলার রাজা করলেন কামেশ্বর-পুত্র ভোগীশ্বরকে। হয়তো তাঁর ভাই ভবসিংহও বিহারের এক অংশ শাসনের অধিকার পান, এবং কীর্তিসিংহের পর ভবসিংহের পুত্র শিবসিংহ বাহুবলে বিহারের একচ্ছত্র অধিপতি হন।

এক বিদ্বানের অনুমান, আরসালান কর্তৃক গণেশ্বর নিহত হওয়ার পরে হয়তো গণেশ্বরের পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ দিল্লী ও গৌড় সুলতানের দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করে ব্যর্থ হয়ে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীর সাহায্য গ্রহণ করেন এবং পরেও নানা রাজনৈতিক বিপর্যয়ে মিথিলারাজকে হয়তো বিভিন্ন দরবারে ধরনা দিতে হয়েছে। এ সূত্রেই মিথিলার দরবারী কবি বিদ্যাপতি–গৌড় সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ, গৌড়ের সুফী-পীর আলম শাহ (হযরত নূর কুতুব-ই-আলম) অথবা দিল্লীর সৈয়দ বংশীয় সুলতান আলম শাহ (১৪৪৪-৪৮ খ্রী.) দিল্লীর তুঘলক সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ (১৩৯৪-৯৯ খ্রী.), গৌড় সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৩৩-৫৯ খ্রীস্টাব্দ) শকী হোসেন শাহ বা মখদুম সুলতান হোসেন শাহ, মালিক বাহারুদ্দীন প্রভৃতির প্রশস্তি যোগ করেছেন তাঁর রচিত পদাবলীতে। যথা:

১. নাসিরুদ্দীন নসরত শাহ (তুঘলক)

কবি শেখর ভণ অপরূপ রূপ দেখি
রাত্র নসরদ সাহ ভজলি কমল মুখি। (গুপ্ত ৩৪৯, মিত্র-মজুমদার ৯৩২)

অথবা

বিদ্যাপতি ভানি অশেষ অনুমানি।
সুলতান শাহ নাসির মধুপ ভুলে কমলবাণী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুথি সং ২৩৫৩)

২. নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ (গৌড়)

নাসির শাহ ভাণে
মুঝে হানল ময়ন বাণে
চিরঞ্জীব রহু পঞ্চ গৌড়েশ্বর
কবি বিদ্যাপতির ভাণে। (গুপ্ত : ৪৪, মিত্র-মজুমদার ৯৩১)

পাঠান্তর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুথি সং ২৬৪৮

সাহা হুসেন ভাণে
জাকে হানল মদন বাণে
চিরঞ্জীব রহু পঞ্চ গৌড়েশ্বর
কবি বিদ্যাপতি ভাণে।

৩. গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (গৌড়)
বিদ্যাপতি কবি ভাণ
মহলম যুগপতি চিরেজীব জীবথু
গ্যাসদেব সুরতান। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ৭৪, পদ সং ২৯)

৪. হুসেন শাহ শর্কী বা দ্বারবঙ্গের মখদুম শাহ সুলতান হোসেন:

ভণই বিদ্যাপতি নব কবিশেখর
পৃথিবী পুহবী] দোহর কঁহা
সাহ হুসেন ভৃঙ্গসম নাগর
মালতী সেনিক জহা। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ১৩১, পদ নং ১৫১)

৫. মালিক বাহারুদ্দীন :

বিদ্যাপতি কবি রভবে গাব
মালিক বহারদিন বুবই ভাব। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ১২০, পদ সং ১১০)

৬. আলম শাহ:

দশ অবধান ভন পুরুষ প্রেম গুনি
প্রথম সমাগম ভেলা।
আলম শাহ পহু ভাবিনি ভজি রহু।
কমলিনি ভমর ভুললা।
(রাগতরঙ্গিণী, পৃ. ৮৬, গুপ্ত সাহিত্য পরিষদ, সং পদ সং ৬, পৃ. ৫২৯, মিত্র মজুমদার ভূমিকা পৃ.)

অবশ্য উক্ত সুলতানগণকে গৌড়ের আলাউদ্দীন হোসেন শাহ আর তাঁর পুত্র নুসরতশাহ ও গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহ বলে অনুমান করে এগুলোকে সহজেই শ্রীখণ্ডবাসী বাঙালি কবি বিদ্যাপতির (কবিশেখর, কবিরঞ্জন) পদ বলেও প্রমাণ করা যায়, এবং অনেকেই তা করেছেন। কিন্তু তা করবার প্রয়োজন নাই। কেননা, এগুলোকে মৈলিথিল কবির রচনা বলে গ্রহণ করতে বাধা দেখিনে।

আমাদের ধারণায় বিদ্যাপতি, ১৩৬০-৬৫ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এং ১৪৫৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে পরলোক গমন করেন। আমরা এ-ও বিশ্বাস করি যে মৈথিল কবি বিদ্যাপতি অভিনব জয়দেব, নব কবিশেখর (কবিশেখর), কবিরঞ্জন, কবিকণ্ঠহার, পণ্ডিত ঠকুর, সদুপাধ্যায়, রাজপণ্ডিত প্রভৃতি উপাধি ছিল।

আর আমাদের ধারণায় বিদ্যাপতি শৈবই ছিলেন। আমাদের বৈষ্ণব বিদ্বানেরাই বিশেষ করে একে বৈষ্ণব বলে ভাবতে চান। তার কারণও রয়েছে।

চৈতন্যদেব স্বয়ং বিদ্যাপতির পদ আস্বাদন করতেন, সেই থেকে বিদ্যাপতি হয়েছেন মহাজন গোস্বামী। পাঁচশ বছর পরে আজ যদি বিদ্যপতি শৈব ছিলেন বলে কেউ দাবী করেন, তাহলে বৈষ্ণবের ভক্তি-বিশ্বাসের ভিতেই যেন ফাটল ধরে পায়ের নিচে চোরাবালি যেন সরে যায়! কেননা সাধন-ভজনের পবিত্র বাহন আকস্মিকভাবে যেন আদিরসের পঙ্কমণ্ডিত হয়ে উঠে। তাই বিদ্যাপতিকে বৈষ্ণব রাখতেই হয়, অথচ বিদ্যাপতি ছিলেন রাজপণ্ডিত ও স্মার্ত। সমাজকে স্মৃতির শাসনে রাখা তাঁর পবিত্র দায়িত্ব বলেই তিনি জানতেন। তাই কীর্তিলতা, কীর্তিপতাকা, পুরুষ পরীক্ষা ও গোরক্ষবিজয় নাটক ছাড়া তাঁর সব রচনাই স্মৃতিগ্রন্থ। আর রাধাকৃষ্ণ পদ তাঁর মানবিক প্রণয় সঙ্গীত। তার প্রমাণ তাঁর বিবিধ বিষয়ক গান ও আদিরসাত্মক পদ। যেমন :

অপনা মন্দির বৈসলি অছলহু
ঘর নহি দোসর কেবা
তহিখনে পহিয়া পাহুন আয়ল
বরিষয় লাগল দেবা।
কে জান কি বোলতি পিসুন পরৌসিনী
বচনক ভেল অবকাশে।
ঘর অন্ধার নিরন্তর ধারা।
দিবসহি রজনী ভাণে
কোনক কহব হমে কে পতিয়ায়ত
জগত বিদিত পচবাণে।
[নিগেন্দ্র গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ২৩৮, পদ সং ১৫]

অথবা—

বালম নিঠুর বয়স পরবাস
চেতন পড়োসিয়া নাহি মোর পাশ।
ননদী বালক বোলউ ন বুঝ।
পহিলহি সঁঝ শাও নহি সুঝ।
হসে ভরে যৌবতী রজনী অন্ধার
স্বপেনেহুঁ নহি পুর ভম কোটবার। ইত্যাদি
(গুপ্ত পৃ. ২৩৯-৪০ পদ সং ২১)

এসব পদও বৈষ্ণবপদের মতোই। কেবল রাধা-কৃষ্ণের নাম নেই। তাছাড়া বিদ্যাপতির হরগৌরী বিষয়ক পদ, প্রহেলিকা পদ, গঙ্গা ও রাম-সীতা বিষয়ক পদ আর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদে পার্থক্য দুর্লক্ষ্য। রসিক কবি সব দেবতাকে সমভাবেই ভক্তি করেন, বিদ্রূপও করেন অকাতরে। কাজেই পদাবলীতে বিদ্যাপতির ধর্মীয় আবেগ নয়–রসবোধই অভিব্যক্তি পেয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। অতএব রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ তাঁর বৈষ্ণব মতের পরিচায়ক নয়। প্রেম-সঙ্গীতের জন্যে বিষয় হিসেবে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলাই আর্কষণীয় বলে কবি রাধাকৃষ্ণলীলার পদই অধিক রচনা করেছেন। কবি, রসিক, পণ্ডিত ও ভাষার যাদুকর বিদ্যাপতি সংস্কৃত, অবহট্ট ও মৈথিল বুলিতে তাঁর জ্ঞান, চিন্তা, রসবোধ ও কাব্যকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন অবলীলায়।

.

পরিশিষ্ট

শতেক বছর ধরে বিদ্যাপতি সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছে বাঙলা ও বিহারে। কিন্তু করদ রাজ্য মিথিলার রাজবংশের রাজপঞ্জী, কুলপঞ্জী, লোকশ্রুতি নির্ভর আলোচনা কোনো স্থির সিদ্ধান্তের পথে এগিয়ে দেয়নি। লক্ষ্মণ সংবতের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারই এজন্যে অনেকটা দায়ী। এজন্যে বিদ্যাপতির জীবকাল সম্বন্ধে নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আজো সম্ভব হয়নি। বিদ্বানেরা আজ অবধি যে-সব মত চালু করেছেন, সেগুলো এখানে উদ্ধৃত হচ্ছে। তার আগে বিদ্যাপতি ও তাঁর রচনা সম্বন্ধে যারা আলোচনা করেছেন কিংবা তার পদাবলী সংকলন করেছেন অথবা তাঁর রচিত গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন, তাঁদের নাম উল্লেখ করছি।

রাজেন্দ্রলাল মিত্রই প্রথম (১৮৫৮-৫৯ সনে) বিবিধার্থ সংগ্রহে বঙ্গ ভাষার উৎপত্তি নামক প্রবন্ধে বিদ্যাপতির পরিচয় দেন। এর পর আলোচনা করেন রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাবে (১৮৭২ সনে)। এসব ছাড়াও হরিমোহন মুখোপাধ্যায় কবি চরিতে (১৮৬৯ সন), মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বঙ্গ ভাষার ইতিহাসে (১৮৭২ সনে) এবং মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বাঙ্গালা সাহিত্য সংগ্রহে (১৮৭২) বিদ্যাপতির লোকশ্রুতিমূলক পরিচয় দান করেন।

কিন্তু বিদ্যাপতি সম্বন্ধে যথার্থ ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসা শুরু হয় জন বীমসের প্রবন্ধ দিয়ে। এ প্রবন্ধের সমালোচনা স্বরূপ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বঙ্গ দর্শন পত্রিকায় বিদ্যাপতি নামে তথ্যবহুল একটি প্রবন্ধ লেখেন। জন বীমস রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বিদ্যাপতি সম্বন্ধে আর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত করেন Indian Antiquary-তে। এরপর G. A. Grierson ১৮৮১ সনে তাঁর An introduction to the Maithili language of North Bihar, containing a grammar, Chrestomathy and vocabulary ( vol II) acts গ্রন্থে এবং পরবর্তী দুটো প্রবন্ধে বিদ্যাপতির বিশেষ পরিচয় দেন। তারপর জগদ্বন্ধুভদ্র ১৮৭৪ সনে মহাজন পদাবলী (১ম খণ্ড) নামে বিদ্যাপতির পদাবলী সংকলন করেন। আর ১৮৭৮ সনে। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ (২য় খণ্ড) গ্রন্থে বিদ্যাপতির পদ সংকলিত হয়। ১৮৯২ সনে (১২৮৫ বঙ্গাব্দে) প্রকাশিত হয় সারদাচরণ মিত্রের বিদ্যাপতির পদাবলী নামক সংকলন গ্রন্থ। এরপর ১৯০৯ সনে (১৩১৬ বঙ্গাব্দে) নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সংগৃহীত ও সম্পাদিত প্রখ্যাত বিদ্যাপতি ঠাকুরের পদাবলী প্রকাশিত করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। পরে বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে নগেন্দ্র গুপ্ত সংকলিত বৈষ্ণব মহাজন পদাবলী (২য় খণ্ড) : মহাকবি বিদ্যাপতির পদাবলী প্রকাশিত হয় ১৩৪২ বঙ্গাব্দে (১৯৩৫ সনে)। এর এক বছর আগে খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ বের করেন (১৩৪১ বাং ১৯৩৪ সন) বিদ্যাপতি পদাবলী। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে তথা ১৯৫২ সনে প্রকাশিত হয় খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও ডক্টর বিমানবিহারী মজুমদারের বিদ্যাপতি পদাবলী, ডক্টর শহীদুল্লাহর সংকলিত বিদ্যাপতি শতক বের হয় ১৩৬১ বঙ্গাব্দে বা ১৯৫৪ সনে। এগুলো ছাড়াও কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের বিদ্যাপতির বঙ্গীয় পদাবলী (১৮৯৪ সন), পঞ্চানন তর্করত্নের বিদ্যাপতি পদাবলী (১৮৯৫) হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নবাবিষ্কৃত বিদ্যাপতি পদাবলী (১৯০০-০৬), কীর্তিলতা (১৯২৫) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ছাড়াও রয়েছে ব্রজানন্দ সহায়-এর মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতি (১৯১০), নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিদ্যাপতি ঠাকুর (১৯১০), রামকৃষ্ণ শর্মার বিদ্যাপতি কি পদাবলী (১৯৩১), বসন্ত কুমার ময়ূরের বিদ্যাপতি কি পদাবলী (১৯৫২), শম্ভু প্রসাদের মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতির সংক্ষিপ্ত পদাবলী (১৯৪৭), লালা দেবেন্দ্র সিংহ ও সূর্যাবলী সিংহের বিদ্যাপতি (১৯৫০), সুভদ্র ঝা-র বিদ্যাপতি Songs of Vidyapati (১৯৫৪), অরবিন্দ ঘোষের Songs of Vidyapati (১৯৫৬) প্রভৃতি। এগুলো ছাড়াও যে-কোনো পদাবলী সংকলন গ্রন্থে বিদ্যাপতির পদ রয়েছে, এবং সবাই বিদ্যাপতির অল্প বিস্তর পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছেন। বিদ্যাপতির কীর্তিলতা পুরুষ পরীক্ষা ও তাঁর স্মৃতিগ্রন্থগুলোর সম্পাদনা কিংবা আলোচনা প্রসঙ্গেও বিদ্যাপতি সম্বন্ধে নানা তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা হয়েছে। তাছাড়া বাঙলা ও মিথিলার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ইতিহাসেও রয়েছে বিদ্যাপতি সম্পর্কে নানা তথ্য।

এবার বিদ্যাপতির জন্ম-মৃত্যুর কাল সম্বন্ধে বিভিন্ন বিদ্বানের মতগুলো এখানে তুলে ধরছি।

১. সারদাচরণ মিত্র : খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই তাঁহার পদাবলী প্রকাশিত হইয়াছিল। (বিদ্যাপতির পদাবলী ১৮৭৮ খ্র.)

২. জি. এ. গ্রিয়ার্সন : Vidyapati flourished and was a celebrated author during at least the first half of the 15th century (Introduction, p 11, Puruhsa Pariksa).

৩. নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত : ক)] বিদ্যাপতি ১৩৫৮ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যু হয় ১৪৪৮ খ্রীস্টাব্দে (বিদ্যাপতি ঠাকুরের পদাবলী)।  [–বা, সা. প. সং ভূমিকা পৃ.]।

খ) বিদ্যাপতি সাতাশী-অষ্টাশী বৎসর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। মহাকবি বিদ্যাপতির পদাবলী, বসুমতী সাহিত্য মন্দির পৃ. ১]

৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : জীবনকাল ১৩৪৭-১৪৫৬ খ্রীস্টাব্দ (কীর্তিলতা, ভূমিকা পৃ. ]

৫. কুমার গঙ্গানন্দ সিংহ : জন্মসন ১৩৫০ খ্রীস্টাব্দে। (বিদ্যাপতি কি পদাবলী পৃ. ১১, ৩১)

৬. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় : End of 14th, begining of 15th century. (Original and Development of Bengali language vol. 1)

৭. দীনেশ চন্দ্র সেন : জন্মসন ১৩৫৮ কিংবা তদ্রূপ কোনো সময় (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য)।

৮. বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় : জন্ম ১৩৭২, মৃত্যু ১৪৪৮ খ্রীস্টাব্দ, [Journal of Development of Letters, Calcutta. vol. XVI, p 36]

৯. অমূল্য চরণ বিদ্যাভূষণ : জন্ম : ১৩৫০ খ্রীস্টাব্দের পর নিকটবর্তী কোনো সময়। [বিদ্যাপতির পদাবলী : ভূমিকা]।

১০, খগেন্দ্রনাথ মিত্র : (ক) জন্ম চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ পাদে, [পদামৃত মাধুরী পৃ. ৪৮]

(খ) জন্ম : ১৩৯০ খ্রীস্টাব্দে (বৈষ্ণব রস সাহিত্য)।

১১. সতীশচন্দ্র রায় : জন্ম ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ এবং শতাধিক বৎসর সুস্থ শরীরে জীবিত থাকিয়া নানা গ্রন্থ রচনা করেন [পদকল্পতরু ৫ম খণ্ড পৃ. ১৬৬-১৬৭]

১২. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : জন্ম ১৩৫৪ এবং ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দেও বিদ্যাপতি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে বিদ্যমান ছিলেন। রুদ্ৰসিংহের রাজত্বকালে (১৪৭৫ থেকে শুরু) বিদ্যাপতির মৃত্যু হয়।

(ক) বাংলা সাহিত্যের কথা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭২-৭৬। বিদ্যাপতি শতক, ভূমিকা পৃ.–১০)

১৩. সুকুমার সেন (ক) ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দের পর বিদ্যাপতি বেশিদিন জীবিত ছিলেন বলিয়া মনে হয় না (বিদ্যাপতি গোষ্ঠী, পৃ. ২২-২৩) (খ) বিদ্যাপতি ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত, সমর্থ ও অধ্যাপনরত ছিলেন (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৩য় সং ১ম খণ্ড, পূর্বার্ধ, পৃ. ৩৮৩)।

১৪. বিমান বিহারী মজুমদার : ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকছি সময়ে বিদ্যাপতির জন্ম এবং ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দে বিদ্যাপতি জীবিত ছিলেন প্রমাণিত হইতেছে। (বিদ্যাপতির পদাবলী, ভূমিকা পৃ.)।

১৫. উমেশ মিশ্র : কবির জীবকাল ১৩৬০ থেকে ১৫০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে। বিদ্যাপতি ঠাকুর (হিন্দুস্থানী একাডেমী, এলাহাবাদ ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দ পৃ ৩৬-৩৭)

১৬. শিবনন্দন ঠাকুর : জন্ম ১৩৫১ ও মৃত্যু ১৪৪৮ খ্রীস্টাব্দ। (মহাকবি বিদ্যাপতি পৃ. ৩৭-৩৯)

১৭. জয়কান্ত মিশ্র : জন্ম ১৩৬০ ও মৃত্যু ১৪৩৭ খ্রীস্টাব্দ ( History of Maithili literature )।

১৮. সুখময় মুখোপাধ্যায় : জন্ম ১৩৭০ ও মৃত্যু ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দের মতো সময়ে। (বাংলা সাহিত্যের কালক্রম পৃ. ৪৭-৪৮)

১৯. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : জন্ম আ. ১৩৮০ ও মৃত্যু আ. ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ, (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৮-৭৯)।

২০. সুভদ্র ঝা : মৃত্যু ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দের পরে। ( Songs of Vidyapati, Introduction)

লক্ষণীয়, এর মধ্যে অনেকেই বিদ্যাপতির মৃত্যু সন ১৪৪৮ অথবা ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ ধরেছেন। যারা ১৪৪৮ সন বলে মনে করেন তাদের সিদ্ধান্তের ভিত্তি হচ্ছে বিদ্যাপতির রচনা বলে অনুমিত একটি পদ :

সপন দেখল হম শিবসিংহ ভূপ
বতিস বরস পর সামর রূপ।
বহুত দেখল হম গুরুজন প্রাচীন।
অব ভেলহু হম আয়ুবিহীন। [ নগেন্দ্র গুপ্ত : বসুমতী সং পৃ. ২৩৮ পদ সংখ্যা–১১ মিত্র ও মজুমদার পদসংখ্যা ৯১৪]

এঁরা শিবসিংহের মৃত্যু সন ধরেছেন ১৪১৫-১৬ খ্রীস্টাব্দ এবং বিশ্বাস করেছেন পদোক্ত স্বপ্নফল অবশ্যম্ভাবী। কাজেই ১৪১৬+৩২=১৪৪৮ খ্রীস্টাব্দেই বিদ্যাপতির মৃত্যু হয়েছিল। কেননা ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণ-মতে স্বপ্ন মিথ্যে হবার নয়।

আর যারা বিদ্যাপতির মৃত্যু সন ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ বলে নিরূপণ করেছেন তাঁদের দলিল হচ্ছে একটি পুথির লিপিকাল। হলায়ুধ মিশ্রের ব্রাহ্মণ সর্বস্ব গ্রন্থের একটি প্রতিলিপি তৈরি করেছিলেন বিদ্যাপতির ছাত্র রূপধর। পুষ্পিকায় লিপিকাল ও জীবিত বিদ্যাপতির উল্লেখ আছে। যথা :

লসং ৩৪১ মুড়িয়ার গ্রামে সক্রিয় সদুপাধ্যায় নিজকুল কুমুদিনী চন্দ্রবাদি মওভ সিংহ পরম সচ্চরিত্র পবিত্র শ্রীবিদ্যাপতি মহাশয়েভ্য পঠিতা ছাত্র শ্রীরূপ ধরেণ। লিখিত মদঃ পুস্তকম।

৩৪১ লক্ষ্মণ সংবেতের সঙ্গে ১১১৯ যোগ করেই তারা ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ পেয়েছেন। কিন্তু ৩৪১ এর সঙ্গে ১০৮০, ১১০৮ কিংবা ১১২৯ যোগ করিলে যথাক্রমে ১৪২১ ১৪৪৯ এবং ১৪৭০ খ্রস্টাব্দও পাওয়া যায়। তবে পুস্পিকা সূত্রে মনে হয় বিদ্যাপতি তখন যশ ও মনে অনন্য, কাজেই লিপিকাল ১৪৪১ খ্রীস্টাব্দ ধরাই সঙ্গত। বিশেষ করে যিনি নেপালের দ্রৌণবাররাজ পুবাদিত্যের আশ্রয়ে (রাজাবনৌলি গাঁয়ে) থেকেও জীবকার্জনের জন্যে লিখনাবলী রচনা করেছেন ২৯৯ লং সংবতে তথা (২৯৯+১১২৯) ১৪২৮ খ্রীস্টাব্দে বা তৎপরে, তার তখনো খ্যাতি-প্রতিপত্তি উক্ত সব বিশেষণের আনুপাতিক হয়ে না-উঠারই সম্ভাবনা।

বিদ্যাপতি নাকি তালপাতায় একখানি ভাগবতের প্রতিলিপি তাৈন করেছিলেন। তার পুষ্পিকায় বিদ্যাপতির নাম ও অস্পষ্ট লিপিকাল রয়েছে : শুভমস্ত সৰ্ব্বর্থগতা সংখ্যা লং ৩০৯ শ্রাবণ শুদি ১৫ কুজে রাজাবনৌলি গ্রামে শ্রী বিদ্যাপতের্লিপিরিয়মিতি। দ্বিারবঙ্গের রাজগ্রন্থাগারে রক্ষিত]।

বিস্ফী গাঁয়ের কবি বিদ্যাপতি কিংবা রাজসভার কবি ও রাজপণ্ডিত বিদ্যাপতি ১৪৩৮ সনেও রাজাবনৌলি গায়ে বসে ভাগবত নকল করেছেন, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। পদ্মসিংহের মৃত্যু ও নরসিংহের সিংহাসন প্রাপ্তির সন্ধিকালে হয়তো রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে কবি নেপালে দ্রৌনবারের রাজার আশ্রয় নিয়েছিলেন। লিখনাবলী সূত্রে বোঝা যায় তিনি ১৪২৮ খ্রীস্টাব্দেও সেখানে ছিলেন। কিন্তু তাই বলে আরো দশ বছর সেখানে বাস করার কথা নয়। কেননা, তিনি নরসিংহ পরিবারের প্রতি অর্জন করেছিলেন। কাজেই উক্ত প্রতিলিপি হয়তো অন্য কোননা বিদ্যপতির কৃতি। নাম-সাদৃশ্যে গুরুত্ব আরোপ না-করাই সঙ্গত। আর (৩০৯+১১২৯=) ১৪৩৮ খ্রীস্টাব্দেই এ পুথি লিপীকৃত। কেননা ঐ বছরের শ্রাবণ মাসের শুদি ১৫ বা পূর্ণিমা তিথি মঙ্গলবারে পড়েছিল এবং ঐদিন তারিখ ছিল ৫ই আগস্ট।

এ ছাড়া বিদ্যাপতি রচিত দানবাক্যাবলীর একটি প্রতিলিপি রয়েছে নেপাল রাজ গ্রন্থাগারে। ওটি নাকি বিদ্যাপতির স্বহস্তে সংশোধিত। নকলের তারিখও রয়েছে লং সং ৩৫১। এর সঙ্গে ১০৮০, ১১০৮, ১১১৯ ও ১১২৯ যোগ করলে যথাক্রমে ১৪৩১, ১৪৫৯, ১৪৭০ ও ১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ হয়। তবে ১৪৩১ খ্রীস্টাব্দ ধরাই সমীচীন।

১৩০৭ সালের সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ বিদ্যাপতির ভনিতাযুক্ত একটি অবহটঠপদ উদ্ধৃত করেছিলেন। পদটি নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিদ্যাপতি পদাবলীর বসুমতী সংস্করণে বিধৃত রয়েছে (পৃ. ২৩৬-৩৭ পদ সং ৯ ও পরিষৎ সং; পদ সং ৫৩১)। পদটির শুরু এভাবে :

অনল রন্ধ্রকর লকখন নরবই সক সমুদ্দকর অগিনি সসী
চৈতকারি ছঠি জেঠা মিলিও বার বেহপ এ জাউলসী।
দেবসিংহে জং পুহবী ছড়িঅ অদ্ধাসন সুররাএ সরূ
দুহু সুরতনি নীলে অবে শোয়উ তপন হীন জগতিমিরে ভরু।

শেষ—

আরন্তিয় অন্তেষ্টি মহামখ রাজসুয় অসমেধ যঁহা।
পণ্ডিতঘর আচার বখানিয় যাচক কা ঘর দান কঁহা।
বিদ্যাপতি কবিবর এহু গাবয় মানব মন আনন্দ ভয়ও
সিংহাসন শিবসিহ বইঠঠো উচ্ছব বৈরস বিসরি গয়েও।

এখানে প্রদত্ত সন (অনল-৩, রন্ধ্র-৯, কর-২) = ল সং ২৯৩ এবং শক (সমুদ্র– ৪, কর– ২, অগ্নি– ৩, শশী-১) = ১৩২৪ শক।

ল, সংবত থেকে ১৩৭৩, ১৪০১, ১৪১২ বা ১৪২২ খ্রীস্টাব্দ মেলে আর শকাব্দ থেকে পাই ১৪০১-০২ খ্রীস্টাব্দ। কাজেই ১৪০১-০২ খ্রীস্টাব্দই নির্দেশিত হয়েছে বলে মানতে হয়। কেউ কেউ শকাব্দের কর স্থলে পুর ধরে একে ১৩৪৩ শক বা ১৪১২ খ্রীস্টাব্দ পেতে চান। এই সন শিবসিংহের (কাব্য প্রকাশবিবেক সূত্রে সিংহাসন আরোহণ ১৪১০ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে রাজত্বকালে পড়ে। কিন্তু এ পদটি অনেকের মতেই জাল। কেননা প্রথমত দেবসিংহের মৃত্যুর আগেই পিতৃদ্রোহী শিবসিংহ পিতাকে তাড়িয়ে রাজ্য দখল করেন, এ সংবাদ আমরা মোল্লা তাকিয়ার বয়ায সূত্রে জানতে পাই। দ্বিতীয়ত, পুরুষ পরীক্ষা সূত্রে বোঝা যায়, এই গ্রন্থ রচনাকালে দেবসিংহ জীবিত ছিলেন, ভাতি যস্য জনকোরণজেতা দেবসিংহ গুণরাশি:। তৃতীয়ত নৈমিষারণ্যে আশ্রিত। দেবসিংহের আদেশেই যে বিদ্যাপতি ভূপরিক্রমা রচনা করেছিলেন, তা ভূপরিক্রমা থেকেই জানা যাচ্ছে। অতএব শিবসিংহের রাজত্বকালে দেবসিংহ মৃত নয়, নির্বাসিত অথবা পলাতক ছিলেন।

কেউ কেউ কীর্তিলতার দুটো শ্লোকের তাৎপর্য অনুসরণে বিদ্যাপতির জন্ম সন ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ নিরূপণে প্রয়াসী। শ্লোক দুটো এরূপ :

১, বালচন্দ্র বিজ্জাবই ভাসা
দুহু নহি লগগেই দুজ্জন হাসা।
ও পরমেসর হরশির সোহই
ঈ নিশ্চই নাঅর-মন মোহই।

বালচন্দ্র ও বিদ্যাপতির ভাষা–এ দুইয়ের কোনোটিতেই দুর্জনের উপহাস লাগিবে না। যেহেতু চন্দ্র পরমেশ্বর মহাদেবের মস্তকে লাগিয়া থাকে, আর বিদ্যাপতির ভাষা নাগর জনের মনোমমাহন করে। [ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

২ মাধুর্য প্রসবস্থলী গুরু যশো শিক্ষাসখী।
যাবদ্বিশ্বমিদঞ্চ খেলনকবের্বিদ্যাপতের্ভারতী।

মাধুর্যের প্রসব স্থলী স্বরূপ যশোবিস্তারের শিক্ষাসখী সদৃশ খেলন কবি বিদ্যাপতির কবিতা সমস্ত বিশ্বে ব্যাপ্ত হইতে থাকুক। [ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

প্রথমটাতে বালচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাপতির ভাষা তুলিত হয়েছে। বিদ্বানরা মনে করেছেন, বিদ্যাপতি তখনো তরুণ। আর দ্বিতীয় শ্লোকে খেলনা কবি অর্থে (খেলুড়ে-বাল্যক্রীড়ার বয়স অতিক্রান্ত হয়নি যার) বালক কিংবা কিশোর কবি নির্দেশ করা হয়েছে বলেই তাদের ধারণা। কীর্তিলতা ১৪০১-০৪ সনের মধ্যে রচিত। কাজেই এঁদের মতে এটি কৃবির বিশ-বাইশ বছর। বয়সের রচনা। এজন্যে তাঁরা কবির জন্ম সন ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ বলে অনুমান করেন।

আগে কয়েকটি গীত রচনা করলেও পূর্ণাঙ্গ কাব্য হিসেবে কীর্তিলতাই বিদ্যাপতির প্রথম কৃতি। এজন্যেই কবি এই নব প্রয়াসকে নবচন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন : নবচন্দ্র যেমন নতুন ও ক্ষীণকায় বলে নিন্দনীয় নয়, তেমনি নতুন কবির প্রথম কাব্য বলে কীর্তিলতাও অবহেলার বস্তু নয়। এমনি তাৎপর্যেও উক্ত শ্লোকটি গ্রহণ করা সম্ভব।

সম্প্রতি খেলনকবের্বিদ্যাপিতর্ভারতী পাঠ কেউ কেউ অশুদ্ধ ও অর্থহীন বলে মনে করেন। তাঁদের মতে শুদ্ধ পাঠ হবে খেলতু কবের্বিদ্যাপতের্ভারতী। অতএব যা ছিল বিনয়বচন, তা গর্বিত আহবানে হল পরিণত। কাজেই উক্ত দুই শ্লোক অপরিণত অল্প বয়সের সাক্ষ্য নয়। বিশেষ করে বিদ্যাপতির পদে রাজা ভোগীশ্বরের উল্লেখ রয়েছে। জীবিত রাজা ভোগীশ্বরের প্রশস্তিই গেয়েছেন কবি তাঁর ভণিতায়। ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের আগে ভোগীশ্বরের মৃত্যু হয়। কাজেই এ সময়ে বিদ্যাপতির বয়স ১৫-২০ না হলে পাঠযোগ্য পদ রচনা সম্ভব না।

বিশ্ব-সমস্যা

উই, পিঁপড়ে, মৌমাছি, ভিমরুল প্রভৃতিও সমাজবদ্ধ জীব। কর্মে ও জীবিকায় এদেরও রয়েছে যৌথ জীবন। জলে-ডাঙায় এমনি আরো অনেক প্রাণী রয়েছে যারা সামাজিক ও যৌথ জীবনযাপন করে। এগুলো প্রাকৃত প্রাণী–স্বভাব বা সহজাত বৃত্তি-প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত। এদের জীবনে রীতি-নীতি কিংবা পদ্ধতির পরিবর্তন নেই– ডারুইনকে মেনেও বলা চলে কয়েক হাজার বছরের মধ্যে অন্তত দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কিন্তু মানুষের জীবনেতিহাস অন্যরূপ। তার দৈহিক গঠন ও মানস সম্পদ তাকে প্রেরণা দিয়েছে প্রকৃতির আনুগত্য অস্বীকার করতে ও প্রকৃতির উপর স্বাধিকার বিস্তার করতে। তাই মানুষের প্রয়াস কৃত্রিম জীবন রচনার সাধনায় নিযুক্ত। প্রকৃতিকে জয় করার, প্রাকৃত সম্পদের উপযোগ সৃষ্টি করার সংগ্রামই মানুষের জীবন প্রচেষ্টার ইতিহাস। কাজেই মানুষের ইতিহাস–ক্রম পরিবর্তন, ক্রম আত্মবিস্তার ও ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার ইতিকথা। অতএব মানুষের জীবনযাত্রায় ও চিন্তায় চিরস্থায়ী কিছু অসম্ভব, অনভিপ্রেত, এমনকি দুর্লক্ষণ। মানুষের এই অগ্রগতির আঞ্চলিক ও গোত্রীয় ধারায় দৈশিক-কালিক প্রতিবেশের প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র প্রভৃতি যৌথ জীবনে আবশ্যক রীতি-নীতি-পদ্ধতি কিংবা আইন ও আদর্শ। পুরোনো যখন উপযোগ হারিয়েছে, জীর্ণপত্রের মতোই তা হয়েছে জীবন ধারণের পক্ষে অকেজো। তখন প্রয়োজনবুদ্ধি আবার সৃষ্টি করেছে নতুনতর রীতি-নীতি ও আদর্শ। এমনি করে লোকপ্রবাহ এগিয়ে এসেছে আজকের দিনে। এ তত্ত্ব বোঝে না কিংবা বুঝতে চায় না বলেই পাঁচ-সাত হাজার বছর আগের জীবন-চেতনা ও জীবন-রীতি যেমন সুলভ, আবার এই তত্ত্ব-সচেতন বলেই আজকের দিনে গ্রহলোক জয়কামী মানুষও দুর্লভ নয়। তাই মানুষের ইতিহাস পুরোনো চেতনা আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ইতিবৃত্তেরই নামান্তর। যেখানে পুরোনো চেতনা প্রবল, সেখানে অগ্রগতি ব্যাহত; যেখানে নতুন চিন্তা তীব্র ও আগ্রহ অমোঘ, সেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অতিক্রম করেই এগিয়েছে মানুষ। ঋতুবদল যেমন কালের পরিচায়ক ও পরিমাপক, তেমনি পাথেয় পরিবর্তনও চলমানতার লক্ষণ। শীত-বৃষ্টি রৌদ্রে যেমন পরিচ্ছদ ও আশ্রয় অভিন্ন নয়, তেমনি দেশ-কালভিত্তিক জীবনে দেশান্তর ও কালান্তর নতুন প্রয়োজন বোধের জন্ম দেয়। এ প্রয়োজনে সাড়া না দিলে জীবনে নেমে আসে বদ্ধতার বিকৃতি, অচলতার গ্লানি। প্রয়োজন-চেতনার অভাব কিংবা প্রয়োজন-অস্বীকৃতি জীবনের গতিশীলতা অস্বীকারের অপর নাম। মানুষের জীবন যে স্বরচিত এবং মানুষকে যে স্বশিক্ষিত হতেই হবে– এ বোধের অভাবেই অধিকাংশ মানুষ অচলতায় স্বস্তি খোঁজে–চিরন্তনতায় চায় আশ্বস্ত হতে। কিন্তু মানুষ যে সচল প্রাণী–জড়তা যে তার ধর্ম নয়–চলমানতাতেই যে তার জীবন-সত্য নিহিত, তা সে বুঝতে না চাইলেও প্রকৃতি আঘাত হেনে তাকে জানিয়ে দেয়। প্রকৃতির আঘাত আসে দুর্ভিক্ষ, মড়ক, দারিদ্র্য, অসততা, পীড়ন ও অপ্রেমরূপে। তখনই দেখা দেয় দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিদ্রোহ, পীড়ন, বিপ্লব ও সগ্রাম–আনে নতুন মতবাদ, নীতিবোধ, আদর্শ কিংবা ধৰ্মৰ্মত। এ জন্যেই যে স্থানিক প্রয়োজনে জরথুস্ত্রর কিংবা হযরত মুসা-ঈসা-বুদ্ধ-বর্ধমানের ধর্মমতের উদ্ভব, ও পরিবর্তিত পরিবেশে সে-প্রয়োজনের অবসানে স্বস্থানেই সেসব ধর্মমত হয়েছে বিলুপ্ত। আবার সে-সব ধর্ম দেশান্তরে গৃহীত হয়েছে বটে কিন্তু নতুন শক্তি হিসেবে সমাজে কিংবা মনে স্বদেশের মতো বিপ্লব ঘটায় নি। হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি সবাই পুরোনো-দ্রোহী ও নতুনের প্রতিষ্ঠাতা।

মনের দিক দিয়ে মানুষ তিন শ্রেণীর এক শ্রেণীর লোক পথ চলে পথের দিশা খোঁজে, আর এক শ্রেণীর মানুষ গড়া-পথে বাহনে চলতে উৎসুক, আর তৃতীয় শ্রেণীর লোক চলতেই চায় না– তারা দোলনায় দুলে চলার আনন্দ পায়। প্রথম শ্রেণীর লোক দুর্লভ। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকও স্বল্প। তৃতীয় শ্রেণী দলে ভারী। তাই দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম করে তাদের তাড়িয়ে নিতে হয় নতুন মঞ্জিলে। এ কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রসর সমাজও অতিক্রান্তকালের তুলনায় বেশি এগুতে পারেনি।

আত্মরক্ষা ও জীবিকা আহরণের প্রয়োজনে আদি যুগের মানুষ অনুভব করে সহযোগিতা ও সহ-অবস্থানের গরজ। তারই ফলে যে-সংহতিবোধ জাগে তার বহি:রূপ গোত্রীয় ঐক্য। এই গোত্রীয় সংহতি-চেতনা কালে ধর্মীয় ঐক্যবোধে রূপান্তর লাভ করে অভিন্ন মতবাদীর সাম্প্রদায়িক সংহতি গড়ে তোলে,–তারপরে তা রূপ নিয়েছে দৈশিক কিংবা রাষ্ট্রিক জাতীয়তায়। ইদানীং এ চেতনা রাজনৈতিক আদর্শ বা মত ভিত্তিক সম্প্রদায়ও গড়ে তুলছে। এ চেতনা কোনো কোন যুগে দেশ-কালের প্রয়োজন মিটিয়েছে, মানুষের সাময়িক কল্যাণ এনেছে। কিন্তু এ চেতনা মানুষকে চিরকাল অনুদার, অসহিষ্ণু, স্বার্থপর, হিংসুটে, অমানবিক ও দ্বপরায়ণ রেখেছে। এ হয়তো প্রাণীকে প্রাণ-ধর্মে নিষ্ঠ রাখে–জীবন-সংগ্রামে হয়তো হিংস্র বলিষ্ঠতাও দান করে, কিন্তু মানবিক গুণের বিকাশ সাধনে–উদার মানবতাবোধে দীক্ষা গ্রহণে সহায়তা করে না।

আঠারো শতক থেকে য়ুরোপীয় বিজ্ঞানবুদ্ধি ও জীবনচেতনা পৃথিবীকে দ্রুত এগিয়ে দিয়েছে– এ জন্যে আগে যে-মতাদর্শের উপযোগ থাকত হাজার বছর ব্যাপী–এ যুগে তা পঞ্চাশ বছরেই হয়ে পড়ে অকেজো। তাই যে-ধর্মমত মধ্যযুগ অবধি আঞ্চলিক মানুষের কল্যাণ এনেছে, তা আজ হয়ে উঠেছে মানব ও মানবতার দুশমন। যে-জাতীয়তাবোধ উনিশ-বিশ শতকে য়ুরোপীয় জীবনে আবে হায়াত রূপে প্রতিভাত-তা আজকের মানুষ ও মানবতার বড়ো শত্রু। যে-গণতন্ত্র ব্যক্তি মানুষের মুক্তি ও স্বাতন্ত্র স্বীকৃতির আদর্শ সংস্থা বলে অভিনন্দিত, সেখানেও মানুষ ধনবল ও বাহুবলের দাস; যে-সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্র চরম মানবতাবোধের পরম দান বলে পরিকীর্তিত, তাতেও মানুষের জীবন যতটা যান্ত্রিক ততটা মানবিক নয়। ব্যক্তি মাত্রই রাষ্ট্রকলের যন্ত্রাংশ কিংবা মজুর–সে যন্ত্র যারা ধনবলে বা বুদ্ধিবলে চালানোর অধিকার পায়, তারাই উপভোগ করে সাময়িক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র-আগের যুগে এ স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র যেমনটি ছিল সম্রাট, শাসক ও সামন্তের। কাজেই পরিবর্তিত ব্যবস্থায়ও ব্যক্তি মানুষের মুক্তি আসেনি। কেউ পড়েছে ধনগত পীড়নের চাপে, কেউ রয়েছে দলগত নির্যাতনের তাপে। তাই বঞ্চিতজনের বিক্ষুব্ধ আত্মার চিৎকার ও দ্রোহ সর্বত্র বিরাজমান–আর্তনাদ আর সংগ্রামও কোথাও কোথাও দৃশ্যমান। বলতে গেলে সারা পৃথিবীর শাসিত মানুষ আজ Time Bomb-এর মতো–সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো, অনুকূল পরিবেশে যোগ্য নেতৃত্বে সামান্য উত্তেজনায় জ্বলে উঠবে–নিজেরা পুড়বে আর পোড়াবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত সমাজ, ধর্ম, নীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। ধর্মীয় ঐক্য-চেতনার, মতবাদের অভিন্নতার কিংবা রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে গড়া সরকারি ব্যবস্থা এখন আর মানুষের অভাব মোচন করতে কিংবা চাহিদা মেটাতে পারছে না। গোটা পৃথিবীর সমস্যা সমাধানের সামগ্রিক প্রয়াস-প্রসূত কোনো উপায় বের না হলে এর ইতি হবে না। সাধারণ মানুষ সমস্যাই কেবল অনুভব করে, সমাধানের উপায় জানে না। তাই এ দায়িত্ব চিন্তানায়ক, কর্মীপুরুষ ও শাসকগোষ্ঠীর। পৃথিবীর বহুদেশ আজ শিল্পায়িত ও শিল্পদ্রব্যে সমৃদ্ধ, অন্যগুলোও একই লক্ষ্যে অগ্রসরমান। তাই বাজার মন্দা। কাজেই অর্থনৈতিক সমস্যা আজ জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় সমস্যা নয়- বিশ্ব-সমস্যা। ফলে এ সমস্যার সমাধান কোনো এক রাষ্ট্রের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। তাই ধর্ম, জাতীয়তা ও রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্রের বন্ধন-মুক্ত হয়ে একই মিলন-ময়দানে সব মানুষকে এসে দাঁড়াতে হবে। অসমানে একত্রিত হতে পারে বটে–কিন্তু মিলতে পারে না। কাজেই সাম্য ও সমদর্শিতার নীতিতে আস্থা রেখে লিলামুক্ত চিত্তে সদিচ্ছা নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে মানবিক সমস্যার সমাধানে।

নইলে বাড়বে মানুষের অন্তর্দাহ-সংঘাত হবে তীব্র ও গভীর, সংগ্রাম হবে ব্যাপক ও আত্মধ্বংসী-ভাঙ্গার গানই শুনতে হবে সর্বত্র। তার লক্ষণও পষ্ট হয়ে উঠেছে নানা দেশে। বীট হিপ্পী আন্দোলন থেকে বর্ণাঙ্গা অবধি সব কিছুতে সেই বিষেরই বিস্ফোট দৃশ্যমান।

আধুনিক পরিভাষায় এই বিক্ষোভ-বিদ্রোহকে বলে শ্রেণী-সংগ্রাম কিংবা দলগত সংগ্রাম। যারা স্বার্থবাজ ধূর্ত আর যারা নির্বোধ তারা ক্রান্তিকালের যে কোনো বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও বিপর্যকে অবক্ষয় বলে আখ্যাত করে বিজ্ঞোচিত বিশ্লেষণ-সামর্থ্যে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সমাজে যেখানে একশ্রেণীর বিপর্যয়ে অন্যশ্রেণীর সুদিনের সূচনা করে, যেখানে দুই প্রতিপক্ষের সংগ্রামে এক পক্ষ কাহিল হয়, সেখানে দেশ বা জাতির জীবনে সামগ্রিক অবক্ষয় কোথায়? অতএব অবক্ষয় বলে কিছু যদি থাকেও তা শ্রেণীগতজাতিগত নয়।

জনসংখ্যা ও যন্ত্রশক্তির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে মানুষের অভাব, প্রসারিত হবে প্রয়োজনবোধ, বিস্তৃত ও বিচিত্র হবে জীবনচেতনা, দেখা দেবে নতুন নতুন সমস্যা, জটিল হবে জীবনপদ্ধতি। সময়মতো সমাধান খুঁজে না পেলে জাগবে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ, আসবে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা, দেখা দেবে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, শুরু হবে সগ্রাম– একে অবক্ষয় বলা চলে না–এ তো চলমানতার অবশ্যম্ভাবী প্রসূন। জীবন থাকবে সচল আর প্রয়োজন থাকবে স্থির–একি কখনো হয়।

উপায় বের করতেই হবে–পুরোনো কখনো নতুন মানুষের প্রয়োজন মিটাতে পারে না। অতীত কখনো বর্তমানের চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ নয়, তা-ই যদি হতো তাহলে তো নিত্য বর্তমানই থাকত কাল–তার না থাকতো অতীত, না থাকতো ভবিষ্যৎ–এমনকি এ কালভাগ থাকতো অকল্পনীয়।

তাই পরিহার করতে হবে অতীতের ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রবোধ, পুরোনো ন্যায়-নীতি ও আদর্শ চেতনা। বাঁচার উপায় বের করতেই হবে–এমনকি তা যদি Flamingo-দের মতো আত্মহত্যার মাধ্যমেও করতে হয়, তাহলেও। বাঁচার তাগিদে আগেও কোনো প্রাণী মারতে বা মরতে দ্বিধা করেনি। আজো করবে না, বাঁচার জন্যেই আজো মানুষ মরতে ও মারতে প্রস্তুত। অন্ন ও আনন্দের ভারসাম্য চাই আজ। বাস্তব পন্থা অবলম্বন না করে হৃদয়বেদ্য মহৎ ও বৃহৎ বুলির চাতুরী দিয়ে ভোলানো যাবে না আজকের মানুষকে। এমনি বুলি শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস। আমাদের ভুললে চলবে না, যে বিজ্ঞান দর্শন, শিল্পকলা প্রভৃতির স্রষ্টা হলেও মানুষ প্রাণী–আর সব কিছুর স্থান জীবের জৈব চাহিদার পরে। Old order must change yeilding place to new.

বৈষ্ণব মতবাদ ও বাঙলা সাহিত্য

আর্যপূর্ব যুগে ভারতে দ্রাবিড়গণই বিশেষ প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিল। তারা সংখ্যায় যেমন অধিক ছিল, দণ্ডশক্তি এবং সংস্কৃতিতেও তেমনি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। কাজেই মনে করা যেতে পারে আর্যপূর্ব যুগে ভারতে যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিরাজ করত তা বাহ্যত এবং প্রধানত দ্রাবিড় সভ্যতা।

দ্রাবিড়গণ সেমিটিক গোত্রীয় হলেও, ভারতের আবহাওয়ায় তাদের মন ও মননের পরিবর্তন হয়েছিল। কায়ার চেয়ে ছায়ার মায়ায় ক্রমশ অভিভূত হয়ে পড়েছিল তারা। জীবনবাদের চেয়ে জীবনুক্তিই সাধ্য-সাধনার মুখ্য লক্ষ্য হয়ে উঠল। ভোগবাদ যেখানে বৈরাগ্যের নিকট পরাজিত হয়, সেখানে অলস-নিষ্ক্রিয়তা তথা ভাবপ্রবণতা ছাড়া আর কী আশা করা যায়! বাহ্যজগতের প্রতি বিরাগ ও মনোজগতের প্রতি অনুরাগই তাই তাদের বড় দার্শনিক করে তুলল বটে, কিন্তু নির্বোধ বিষয়ী করে রাখল। দৃশ্যজগৎকে তুচ্ছ করে, অদৃশ্যজগৎকে উচ্চ করে তার সাধনায় যখন দ্রাবিড়গণ বিভোর, তখন ভারতে এল আত্মপ্রত্যয়শীল, সগ্রামী, জীবনবাদী যাযাবর আর্য। বাধা দেবার মতো দণ্ডশক্তি দ্রাবিড়দের ছিল না। উৎপীড়ন যখন অসহ্য হয়, তখন নিতান্ত নিরীহ এবং দুর্বলও মরণ কামড় দিতে চেষ্টা করে। দ্রাবিড়গণ সেরূপ বাধা দিয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা দাক্ষিণাত্যে ও পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে বাঁচল। অভিজাত অনার্যেরা আর্যসমাজে মিশে গেল। তবু বহু অনার্য আর্য-খপ্পরে পড়ে গেল এবং আর্যসমাজে তারা নিগ্রহ ভোগ করতে থাকল।

আর্যগণ দ্রাবিড়দের মাথার অধিকার পেল বটে, কিন্তু মনের কাছে হার মানল। দ্রাবিড়দের যুগান্তরের ভাবচিন্তা কি ব্যর্থ হবে? তাই এদের মানস-সংস্কৃতির কাছে বাহুবলে বলীয়ান আর্যগণ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। যেমন পরবর্তীকালে রোমকগণ করেছিল গ্রীকদের কাছে, আরবগণ করেছিল ইরানীদের নিকট। বাহুবল বাক্যবলের কাছে হার মানল। মাংসপিণ্ড থেকে মন যে অনেক বড়, তা স্বীকৃতি পেল। ক্রিয়াকাণ্ড ও. যাগ-যজ্ঞপ্রধান আর্যধর্মের উপর পড়ল দ্রাবিড় প্রভাব। আচারসর্বস্ব আর্যধর্মে প্রবিষ্ট হল ভাববাদ। জীবনবাদী,জীবনধর্মী আর্যদের তৃতীয়নেত্র উন্মীলিত হল, মায়াবাদ প্রাণধর্মী আমানসের সরস সতেজ ক্ষেত্রে বইয়ে দিল উদাস হাওয়া।

দিন যায়। দ্রাবিড় প্রভাবে আর্য ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি রূপান্তরিত ও পুষ্ট হতে থাকে। আর্য দ্রাবিড়ে নতুন শক্তি গড়ে উঠে। কিন্তু বিষয়বুদ্ধি-নিপুণ দণ্ডশক্তি মায়াবাদকে আত্মস্বার্থ সিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বর্ণাশ্রম নিপীড়নের ঘূপকাষ্ঠরূপে দেখা দিল। সদুদ্দেশ্য নিয়ে যা প্রতিষ্ঠিত, অসদুদ্দেশ্য সিদ্ধির তাই বাহন হয়ে দাঁড়াল।

অত্যাচার, উৎপীড়ন যখন চরম আকার ধারণ করল, তখন ধীরে ধীরে সমাজমনে দেখা দিল অসন্তোষ। এই অসন্তোষই পুষ্ট হয়ে একসময় প্রবল বিদ্রোহ ও সর্বাত্মক বিপ্লবে পরিণত হল। এর সার্থকনাম নেতা হচ্ছেন বর্ধমান মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধ। এঁদের আগে তেইশজন তীর্থঙ্কর ও বহু বৌধিসত্ত্ব এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই মায়াবাদ এদেরও মূলধন। এই বিপ্লবের বন্যায় যুগসঞ্চিত কলুষ-জীর্ণ প্রাচীন যত সব-কিছুই ভেসে গেল–বেদ গেল, ব্রাহ্মণ গেল, দেবভাষাও মর্যাদাচ্যুত হল, বর্ণাশ্রম গেল। স্বর্গ-নরক-দেবতা কারুর অস্তিত্ব স্বীকৃতি পেল না। সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা, জীবে-দয়া, জাতিভেদের অসারতা প্রভৃতি প্রচারিত হল। সর্ব বন্ধনকে দলিত করে বিঘোষিত হল মনুষ্যত্বের জয়। আর্য-অনার্যের বিভেদ ঘুচে গেল। গণতন্ত্র হল না সত্য, কিন্তু গণমানস স্বীকৃতি পেল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম জনসাধারণের আচরণসাধ্য ছিল না, শাস্ত্রে ছিল না অধিকার, নিজের মনের কথা স্বমুখের বুলিতে দেবতার কাছে নিবেদন করবার উপায় ছিল না। পুরোহিতের মাধ্যমে দেবতার সঙ্গে যে কৃত্রিম সম্পর্ক ছিল, তাতে সংস্কারের দৃঢ় বন্ধন ছিল না। তাই বুদ্ধ ও মহাবীরের ডাকে বিপুল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল সহজেই।

ধর্মদর্শন হিসেবে মায়াবাদই ছিল বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের পুঁজি। মায়াবাদ যতই শ্রোত্ররসায়ন হোক না কেন, (একে অবসর সময়ে ভাবপ্রবণ দুর্বলচিত্তে প্রশ্রয় দিতে বেশ লাগে সত্য) কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। কারণ, জৈবসাধনা হচ্ছে ধন-জন-মানের সাধনা। এটা প্রাকৃতিক বা প্ৰাবৃত্তিক। সুতরাং প্রারম্ভিক উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনা যখন চলে গেল, তখন বোঝা গেল জৈবধর্মের প্রতিকূল এ বৈরাগ্যবাদ– এ জীবন-মুক্তির সাধনা প্রাত্যহিক জীবনে আচরণ-সাধ্য নয়। তাই বৌদ্ধ-জৈন ধর্মে বিকৃতি ও সমাজ-জীবনে বিকার অবশ্যম্ভাবীরূপে দেখা দিল। শঙ্কর প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এ বিকৃতি ও শৈথিল্যের সুযোগ গ্রহণ করলেন।

ব্রাহ্মণ্যবাদীদেরও এ ব্যাপারে প্রধান পুঁজি মায়াবাদ। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হল বলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই প্রথম বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসবাদকে স্বীকৃতি দিল অর্থাৎ মায়াবাদকে ভাঁওতা হিসেবে নয়, জীবনে সাধ্য ধর্ম-দর্শনরূপেই গ্রহণ করল তারা। এর ফলে জীবনে চতুরাশ্রম গ্রহণ একরূপ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল। এইরূপে হয়তো এই প্রথম দ্রাবিড়-আর্যের ধর্মসমন্বয় পূর্ণতা পেল। এমনি করে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিমার্গের সমান আদর ও কদর প্রতিষ্ঠিত হল। আর্যের ব্ৰহ্মবাদ, দ্রাবিড়ের মায়াবাদ এবং উভয়ের সমন্বয় ও সংমিশ্রণজাত ভক্তিবাদ সচ্চিদানন্দ শক্তি পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রসার লাভ করল। এতেও মূলত দ্রাবিড় সংস্কৃতি প্রাধান্য পেল। ভারতে মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিবর্তন ও রূপান্তরের ধারা ছিল এরূপই।

মুসলমানদের কোরআনের মধ্যেই সূফীতত্ত্ব নিহিত ছিল বলে অনেকের বিশ্বাস। ভাবপ্রবণ হৃদয়বান ইরাকীদেরকে প্রথমে তা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মূলত কোরআন থেকেই সূফীমতের সমর্থন পাওয়া গেলেও এর পুষ্টি ও প্রসার ঘটে ভারতীয় বেদান্তের পরোক্ষ এবং নিউল্ল্যাটনিক দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। দেখতে দেখতে ইরাকে-ইরানে মরমীয়াদের সংখ্যা আশাতীতরূপে বেড়ে গেল। হাফেজ, রুমী, জামী, নিযামী, ওমর খৈয়াম প্রমুখ কবির সৃষ্টির মাধ্যমে তা ইরানের সীমা অতিক্রম করে গোটা মুসলিম জগতে ছড়িয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, সূফীদের আল্লাহ আর সচ্চিদানন্দে দৃশ্যত পার্থক্য কিছুই নেই।

মুসলমান অধিকারের পূর্বে ও পরে ভারতে যারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন তাঁরা সবাই সূফী দরবেশ ছিলেন। এই মরমীদের অনেকেরই সঙ্গে শরীয়তের বাহ্যানুষ্ঠানের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। অথচ ধর্ম আচারিক ও আনুষ্ঠানিক না হলে সাধারণ লোকের পক্ষে ধর্মাচরণ দু:সাধ্য। সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক ও পারমার্থিক সাধনা বাহ্যানুষ্ঠান ও আচরণের মাধ্যমেই চলে। ফলত, পীর দরবেশ-আউলিয়া প্রচারিত ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ভারতের প্রথম যুগের মুসলমানগণ মুসলিম সংস্কৃতি পুরোপরি গ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পীর-পূজা প্রচলিত হয়। এইভাবে। এতে কোনো হিন্দুপ্রভাব নেই। তবে এই পীরবাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ও হিন্দুর গুরুবাদের পূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে।

সূফীদের মূলবক্তব্য হচ্ছে : সৃষ্টিটা স্রষ্টার আনন্দজাত। আনন্দিত স্রষ্টা বললেন: কুফায়াকুন (Be it so, and it is so) অর্থাৎ সৃষ্টিটা কারো অনুরোধে বা গরজে হয়নি। স্রষ্টা তার খেয়াল খুশির খাতিরে আনন্দ-সহচর হিসাবেই তা করেছেন। এ তাঁর লীলা। অসমানে প্রণয় হয় না। নিদ্বন্দ্ব, নির্বিঘ্ন ও অকৃত্রিম আনন্দ পেতে হলে বন্ধুর সাহচর্যই কাম্য। কারণ, হৃদয়ের অসংকোচ প্রকাশ একমাত্র প্রণয়ের সম্পর্কেই সম্ভব। সুতরাং স্রষ্টা যেখানে আত্মোপভোগের জন্যেই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেখানে সৃষ্টি-সেরা মানুষের সঙ্গে তাঁর বান্দা-মনিব-সম্পর্ক হতে পারে না। তাহলে যে সৃষ্টির সার্থকতা থাকে না–স্রষ্টার উদ্দেশ্যই যে ব্যর্থ হয়। যেখানে প্রণয় আছে, সেখানে গতিবিধি অবাধ হওয়াই স্বাভাবিক,–কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলের বাধা সেখানে অবাঞ্ছিত নয় শুধু, অসম্ভবও। কাজেই আল্লাহর সঙ্গে যেখানে মানুষের প্রণয়ের সম্পর্ক সেখানে বান্দা-মনিবের, পিতা-পুত্রের বা ভক্ত-ভগবানের সম্পর্ক কল্পনা করাও বাতুলতা। কাজেই নামাজ, রোজা বা ইত্যাকার আনুগত্যের প্রশ্নই অবান্তর। ফলে শরীয়ৎ সেখানে নিরর্থক। অনুরাগে প্রণয়ের উন্মেষ, বিরহ বোধে উপলব্ধি এবং মিলনে এর সার্থকতা। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে–প্রেমিক প্রেমাস্পদ পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ করতে আকুল হবে, পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। এ প্রেম জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম। জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার খণ্ডিতাংশ। বিন্দু বিন্দু বারি নিয়ে সমুদ্র। কিন্তু বিন্দুর একক শক্তি কতটুকু! তাই তার অস্তিত্ব রক্ষার গরজেই সমুদ্রের জন্যে তার আকুলতা। নইলে যে তার অপমৃত্যু সুনিশ্চিত! বিন্দুস্বরূপ জীবাত্মার তাই পরমাত্মার জন্যে এত আকুলতা। গরজ জীবাত্মার, তাই সে প্রেমিক–তাই সে রাধা। পরমাত্মারও গরজ আছে–যেমন সমুদ্রও বারিবিন্দুর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোনো বিশেষ বিন্দুর জন্যে তার বিশেষ আকুলতা নেই। এজন্যেই জীবাত্মা সদা উদ্বিগ্ন পাছে সে বাদ পড়ে। তাই রাধা বলে–এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে; না-জানি কানুর প্রেম তিলে জনি টুটে। প্রেমের পরিণতি একাত্মতায়, যখন বলা চলে আনলহক বা সোহম। এই অবস্থাটা সূফীর ভাষায় ফানাফিল্লাহ বা বাকাবিল্লাহ, বৈষ্ণবের কথায় যুগল রূপ বা অভেদ রূপ। (তু. চৈতন্যদেব মুই সেই, মুই সেই)–এ দুটো কথায় সূক্ষ্ম-দার্শনিক অর্থে মারপ্যাঁচ আছে। তবে অবস্থা ও অভিপ্রায়টা মূলত একই।

কুনফায়াকুন দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। পক্ষান্তরে, একোহম বহুস্যাম অদ্বৈতবাদনির্দেশক। সূফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী কিন্তু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে, পরিণামে অদ্বৈত সত্তার প্রয়াসে। সুফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের প্রেমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্ত বিরহবোধের উদ্বোধনই সুফী বৈষ্ণবের প্রধান কাজ। কেননা, রুমীর কথায়–

দানা চু অন্দর জমিন পেন্হা শওয়াদ।
বাদ আঁজা সারে সবজি বস্তা শওয়াদ।

জীবাত্মা তখন বংশীর ন্যায়–বশোনা আজয়ে ফুঁ হেকায়েত মি কুনদ…..এজন্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন :

বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো
রয়েছে দীপ না আছে শিখা, এই কি ভালে ছিল রে লিখা
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।

তাই সূফী গজলে ও বৈষ্ণবপদে আমরা মিলন-পিপাসু বিরহী-আত্মার করুণ ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাই। সূফী-গজল ও বৈষ্ণবপদসাহিত্য মানবাত্মার চিরন্তন Tragedy-র সুর ও বাণী বহন করছে। না-পাওয়ার বেদনা আর পেয়ে হারানোর শঙ্কা–কোটার চেয়ে কোন্‌টা কম! তাই চিরকাল হিয়ার পরশ লাগি হিয়া যেমন কাঁদে এবং লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়া রাখলেও হিয়া, জুড়ায় না, তেমনি দুহু ক্রোড়ে দুহঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া। এর শেষ নেই–সমাধান নেই। এ সাধনাও বড় কঠিন সাধনা। ঘৃণা-লজ্জা-ভয়–এ তিন থাকতে কিছু হয় না। ধন-জন-মানের আকাঙ ক্ষা ত্যাগ করলে, তবে ঘৃণা-লজ্জা-ভয় ঘুচে যায়। এজন্যেই এতে সবার অধিকার নেই। সূফী বৈষ্ণবেরা তাই পণ্ডিত ও ধর্মধ্বজীদের উপহাস করেন। হাফেজ বলেন :

ঢালো সুরা সখি, সাজাও পেয়ালা শরম আছে কি তায়।
প্রেমের মরম তারা কি জানে লো ধরম যাহারা চায়

চণ্ডীদাস বলেন,

মরম না জানে ধরম বাখানে এমন আছ যারা,
কাজ নাই সখি, তাদের কথায় বাহিরে রহুন তারা।

মুসলমানদের ভারত অধিকার ভারতবর্ষের সামাজিক ও কৃষ্টির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইতিপূর্বে শক-হুঁনদল এসেছিল; ভারতবাসীরা অনায়াসে তাদের গ্রহণ করতে পেরেছিল। কিন্তু বহিরাগত তুর্কী মুসলিমকে এদেশীয় সমাজ আত্মস্থ করতে পারে নি। তার কারণ, মুসলমানেরা শুধু বিশেষ আকৃতি, প্রকৃতি ও বাহুবল সম্বল করে আসে নি, এনেছিল যুক্তি নির্ভর এবং প্রত্যয়-দৃঢ় ধর্ম, সমাজ, আচার আর রাষ্ট্রাদর্শ যার সামাজিক ও পারমার্থিক প্রভাব ছিল অসাধারণ। এত অসাধারণ যে, তা আজকের দিনের বলশেভিকবাদের চেয়েও সর্বগ্রাসী এবং আণবিক বোমার চেয়েও বিস্ময়কর। ফলে, মুসলমানদের একদেহে লীন করা কোনো মতেই সম্ভব হয় নি। কিন্তু আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ্য-ধর্মও পর্যদস্ত হবার নয়। এর অন্তর্নিহিত শক্তিও এই নবশক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার যোগ্য ছিল। ফলত, ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম না হল ইসলামে বিলীন, না পারল মুসলমানদের বিলীন করতে। বিজেতা ও বিজিতের তথা শাসক ও শাসিতদের মধ্যেকার এ স্নায়বিক দ্বন্দ্ব বড় তীব্র হয়ে দেখা দিল। কেউ কাকেও না পারে গ্রহণ করতে, না পারে গ্রহণ করাতে। অবস্থাটা যেন কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান। উভয় পক্ষই বুঝল এ অবস্থা অসহ্য, এর আশু সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু এসব অভিজাত হিন্দুর কথা।

এদিকে বর্ণাশ্রম কণ্টকিত অনুদার রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে নিপীড়িত শূদ্রগণ ইসলামের সাম্য ভ্রাতৃত্বের চুম্বকার্ষণে এতই বিচলিত হয়েছিল যে, স্বধর্মে সুস্থির থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। আগ্রহ প্রবল হলেও মন যা চায় তা পাওয়া অধিকাংশের পক্ষেই সহজ ছিল না। নবধর্ম গ্রহণে বাধা ছিল ত্রিবিধ : প্রথমত, প্রাচীন সংস্কারের মোহ ও ভয় : দ্বিতীয়, হিন্দু-সমাজপতির কোপ-দৃষ্টি, তৃতীয়, ইসলাম সম্বন্ধে অনিশ্চিত জ্ঞান। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার-বঞ্চিত নিপীড়িত নিম্নবর্ণের হিন্দুগণ ইসলামের উদার সমাজ-ব্যবস্থা ও সাম্য দর্শনেই প্রলুব্ধ হয়েছিল এবং আজন্ম পোষিত মায়াবাদের সঙ্গে বহুশ্রুত সূফীতত্ত্বের অপূর্ব সামঞ্জস্য দর্শনে কিছুটা আশ্চর্যও হয়েছিল। এভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুগণের ঘরের বাঁধন আলগা হয়ে গেল, পথে নামল, কিন্তু ইসলামের আশ্রয় নিতে পূর্বোক্ত কারণে ছিল প্রচুর শঙ্কা। দাদুর ভাষায়–হিংদু তুরুক ন হোইবা সাহিব সেতী কাজ। অতএব নির্ভে নিৰ্পৰ্থ হোই। তাই ঘরেও নয়, গন্তব্যেও নয়, পথ চলে পথের দিশা পাওয়ার প্রয়াস দেখা দিল। হিন্দুর মায়াবাদ ও মুসলমানদের সূফীতত্ত্বের সমন্বয়ে নবদর্শন আবিষ্কৃত হল, অর্থাৎ নতুন ধর্ম সৃষ্টি হল। সক্রেটিসের Knoweth thyself, উপনিষদের আত্মানাং বিদ্ধি, ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু। বা উপনিষদের তং বেদ্যং পুরুষৎ বেদ মা বো মৃত্যু পরিব্যথা। এই হল নবধর্মের মূল দর্শন বা মন্ত্র। ধর্ম সাধনার উদ্দেশ্য যখন মনের মানুষকে পাওয়া, তাহলে হিন্দুয়ানী বা মুসলমানীর বেড়াজালে আটকে পড়ার দরকার কী? শঙ্করাচার্যের দর্শন তখনও আলোচিত তত্ত্ব এবং ফারসি-সাহিত্যের মারফত হাফেজ, জামী, রুমী, আত্তার, খৈয়ামের বাণী মুখে মুখে উচ্চারিত সত্য। কাজেই এ আন্দোলনের ইন্ধন ছিল হাতের কাছেই।

এরূপে ভারতের দিকে দিকে ধর্ম সমন্বয় ও ঐক্যের বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ভাস্কর, মাধব, রামানন্দ, নানক, কবীর, একলব্য, দাদু, চৈতন্য, রামদাস, নিস্বার্ক, বল্লভ প্রমুখ বহু সাধক-প্রচারকের আবির্ভাব ঘটল। শাস্ত্রাধিকার, সামাজিক সত্তা ও জীবনে নিরাপত্তাবোধের অবচেতন প্রেরণা থেকেই হয়তো এসব ধর্মান্দোলন শুরু হয়, কিন্তু অনতিকাল মধ্যে এগুলো ইসলাম ও দণ্ডধর মুসলিম শক্তিকে বাধা দেবার বা বিতাড়িত করবার সচেতন প্রয়াস হিসেবে প্রকট হয়ে উঠে। শিখ ও বৈষ্ণবান্দোলনে এ উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল– তার বহু প্রমাণ রয়েছে। রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে বাদশাহ আকবর থেকে গান্ধীর কাল পর্যন্তও সমন্বয়-সাধনা অব্যাহত ছিল। এ পথে গান্ধীর রামধুন সংগীত ও নজরুলের কয়েকটি কবিতাকে শেষ প্রয়াস বলে ধরে নেয়া চলে। এসব সংগীত সূফী কবির দিওয়ান, গজল ও রুবাইর অনুকরণে রচিত হয়েছে। চর্যাগীতিও দোহার আমল থেকেই গণভাষায় রচিত পদ ও দোহা ধর্মমত ও তত্ত্ব প্রচারের বাহনরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এদের উদ্দেশ্য ও সাধনা সার্থক হয়েছিল। ইসলাম সত্য সত্যই বড় বাধা পেল। এর গতি চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ইসলাম আর প্রচার বা প্রসার লাভ করল না। এর আগে মদিনা থেকে পশ্চিম পাঞ্জাব অবধি ইসলামে দীক্ষা অপ্রতিহত ছিল। শুধু তাই নয়, বহু মুসলমান তাঁদের মতে দীক্ষিতও হল– বিশেষত শিখ ও বৈষ্ণব ধর্মে। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের আওতায়ও এরা রইল না। এগুলো হিন্দু-মুসলিম ধর্মদর্শনের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম। কিন্তু প্রচারকগণ নামত হিন্দু বিধায় এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, রাধা, কৃষ্ণ, রাম, সীতা, দেরতা প্রভৃতি নামসার হিন্দুয়ানীর রেশ থাকাতে, এরা জাতি অর্থে হিন্দুই রয়ে গেল। তাতে উত্তরকালে রাজনীতিক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা হয়। সুতরাং এরা নামগত জাতিতে হিন্দু এবং ধর্মগত জাতিতে আলাহিদা। যেমন রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্মে হিন্দুয়ানীর চেয়ে খ্রীস্টানী ও মুসলমানী কম নয়, তবু ব্রাহ্মবাদের ঐতিহ্যবোধে এবং রামমোহন নামের মাহাত্মে ব্রাহ্মগণ নিজেদের ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের শাখানুসারী বলে মনে করে। ফলত এরা জাতি হিসেবে হিন্দুই রয়ে গেল। বস্তুত, রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম সচেতনভাবে খ্রীস্টধর্মের প্রসার রোধকল্পে প্রবর্তিত হয়েছিল ও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল।

উক্ত সব সাধকের মধ্যে জোলা শ্রেণীর কবীর ও ধূনকর সম্প্রদায়ের দাদু ও রজ্জব মুসলমান ছিলেন। মুসলমান হয়েও তারা ধর্মান্দোলন শুরু করেছিলেন তার কারণ, এরা নিম্নশ্রেণীর উৎপীড়িত হিন্দু-সমাজ থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সূফীদের হাতে। শরিয়তী ইসলামের সঙ্গে পরিচয়ের অভাব, পূর্ব-সংস্কারগত মায়াবাদের প্রভাব এবং সূফীতত্ত্বের উদার আবহাওয়া এদেরকে ভাবরসে বা প্রেমসাধনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। বৈচিত্র্য ও বিভেদের মধ্যেও যে আত্মার স্বরূপ এক ও অবিকৃত, এই সমন্বয়পন্থিগণ তা-ই প্রচার করেছেন। এসব ধর্মান্দোলনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল বর্ণভেদ প্রথা ও শাস্ত্রে অনধিকার রহিতকরণ এবং মনুষ্যসত্তার মর্যাদা দান। তা পুরোপুরি সফল হল। তাই ইসলাম আর প্রসার লাভ করেনি। ইসলামের প্রভাবই সমাজ সংস্কারে প্রয়োজনীয় ফল দান করল। যেমন, য়ুরোপে ইসলামের অনুকরণে Protestant মত প্রচারই নবযুগ সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

বাঙলাদেশে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে চণ্ডীদাসও এরূপ একজন সাধক ছিলেন। সূফীপ্রভাবে তিনিও প্রেমধর্ম প্রচার করেন এবং বর্ণভেদের বিরুদ্ধে তিনিও বলে উঠেন: শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। এর পরে মাধবেন্দ্রপুরী এবং তার পরে শ্রীচৈতন্য।

ভাগবতে ভক্তিবাদের উল্লেখ ছিল। কিন্তু তা মুসলিম বিজয়ের পূর্বে প্রসার লাভ করে নি। গীতগোবিন্দে আধ্যাত্মিকতা নেই, বিদ্যাপতিতেও না। গীতগোবিন্দ, বিদ্যাপতির পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণবিজয়, কৃষ্ণধামালী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। (শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ), শিবশিবানীর ছড়া বা গাথা প্রভৃতি আদিরসাত্মক রচনা সমাজ-জীবনের বিকৃতির এবং রাজনৈতিক নিবর্ষিতার যুগে নৈতিকতা শিথিল গণমনের রস-পিপাসা মিটাবার জন্যে রচিত হয়েছিল। ইত্যাকার আদিরসাত্মক রচনা সম্বন্ধে হুমায়ুন কবীর যথার্থই বলেছেন: সমাজ জীবনে যখন মন্দা পড়েছে, বিলাসের আড়ম্বরে জাতির চরিত্রতেজ ও শৌর্য যখন ম্লান, তখনই বিদ্যাসুন্দরের এবং এ ধরনের কাহিনীর প্রাদুর্ভাব। পাঠান রাজত্বের অবসানের যুগে শ্রীধরের বিদ্যাসুন্দর, মোগলশক্তির আসন্ন ভাঙনের দিনে কৃষ্ণরামের বিদ্যাসুন্দর এবং নবাবী আমলের অবসানে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের আবির্ভাবে এ-কথার সাক্ষ্য মেলে। রাজশক্তির পতনের দিনে ঐশ্বর্য ও বিলাসের আড়ম্বর সমস্ত দেশেই দেখা দেয়, বাঙলা দেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি; তাই অবনতিপ্রবণ সমাজের বিকৃত রুচির প্রতিচ্ছায়া হিসাবে বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়ও বারে বারে অশুচিরূপে ফুটে উঠেছে।… রাজসভার কৃত্রিমতায় সে কাহিনী যত পঙ্কিল হয়ে উঠেছে ধর্মপ্রেরণার অবান্তর আগ্রহে তাকে সজীব করবার চেষ্টাও হয়েছে তত বেশি। ভারতচন্দ্র তাই ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতীক–জীবনের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মন্দার দিকে তার আবির্ভাব স্বাভাবিক ও সঙ্গত।

বিপরীতধর্মী দুই সংস্কৃতির মোকাবিলায় নিপীড়িত নিম্নবর্ণের হিন্দুসমাজ-মনে, তার ধর্মবিশ্বাস ও জীবনদর্শনে যে সাড়া জাগল, তারই ফলে বাঙলায় বৈষ্ণব ও বাউল মতবাদের উদ্ভব ও পরিণতি। অবশ্য দক্ষিণ ভারতেই এর প্রথম বিকাশ। এখানে ভক্তিবাদে যে মনোবৃত্তির প্রকাশ তাতে দ্রাবিড়সুলভ ভাবাবেগের প্রাচুর্য ছিল, আর ছিল তীব্র প্রাণময়তা। দ্রাবিড়রক্তের উত্তরাধিকারী বাঙলায়ও বৈষ্ণব ভক্তিবাদ একইরূপ উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনার সৃষ্টি করল। এমনিতে বাঙালি চিরকাল ভাবপ্রবণ ও স্পর্শকাতর। সামান্য কারণেই উচ্ছ্বসিত, উত্তেজিত, উন্মত্ত বা অভিভূত হয়ে পড়ে। এজন্যেই এরা যখন সাহিত্য সৃষ্টি করে তখন তা গীতিকবিতা হয়ে উঠে, সামাজিক আন্দোলনে সাময়িক ঝড় উঠে। রাজনীতিতে ভয়ংকর বিপ্লব ঘটায়, এজন্যেই এরা তর্ক করে যুক্তি মানে, কিন্তু হৃদয়ানুভূতিগোচর না হলে আচরণ করে না।

বৈষ্ণব মত ও সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছিল পশ্চিম বাঙলায়। এদের প্রভাবও বিশেষভাবে পড়েছিল পশ্চিম বাঙলায়। তার কারণ, হুমায়ুন কবীরের ভাষায় : পশ্চিম বাঙলায় শালবন আর কাঁকরের পথ–দিগন্ত-প্রান্তর দৃষ্টিসীমার বাইরে মিলিয়ে আসে। শীর্ণ জলধারার গভীর রেখা কাটে দীর্ঘ সংখ্যাহীন স্রোতস্বিনী। বাতাসে তীব্রতার আভাস, তপ্তরৌদ্রে কাঠিন্য, দিনের তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট দীপ্তির পর অকস্মাৎ সন্ধ্যার মায়াবী অন্ধকারে সমস্ত মিলিয়ে যায়। রাত্রিদিনের অনন্ত অন্তরালে মনের দিগন্তে নতুন জগতের ইঙ্গিত নিয়ে আসে, তপ্ত রৌদ্রোলোকে মূর্ধাহত ধরণী অন্তরকে উদাস করে তোলে। পশ্চিম বাঙলার প্রকৃতি তাই বাঙালির কবিমানসকে যে রূপ দিয়েছে, তার মধ্যে। রয়েছে লোেকাতীত রহস্যের আভাস, অনির্বচনীয়ের আস্বাদে অন্তর সেখানে উন্মুখ ও প্রত্যাশী জীবনের প্রতিদিনের সগ্রাম ও প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণে। কিন্তু পূর্ব বাঙলায় এতবড় ধর্ম ও সাহিত্য আন্দোলনের প্রভাব যে পড়েনি তা নয়, তবে তা যেন কতকটা প্রথা রক্ষার তাগিদে কৃত্রিম চর্চা। পূর্ববঙ্গে মানুষ ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাই ছিল বেশি, তাই লক্ষ্য তার প্রায়ই ভূমির দিখে। কৃচিৎ ভূমার দিকে তা ধাবিত হয়েছে। ফলে এখানে প্রাত্যহিক জীবনের সুখ দুখ-দ্বন্দ্ব ও প্রেম-স্নেহ-বিরহ-মিলনের গান-গাথা এবং দেবদ্রোহী, বীর্যমান, মর্যাদাবান, মানবতার প্রতীক চাঁদ সদাগর চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। কারণ পূর্ববঙ্গের নিসর্গ হৃদয়কে ভাবুক করেছে বটে, কিন্তু উদাসী করে নি। দিগন্ত প্রসারিত প্রান্তরে রয়েছে অহোরাত্র জীবনের চঞ্চললীলা। পদ্মা-যমুনা মেঘনার অবিরাম স্রোতোধারায় নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস। প্রকৃতির বিপুল শক্তি নিয়তই উদ্যত হয়ে রয়েছে, কখন আঘাত করবে তার ঠিকানা নেই।… সেই জীবন ও মরণের অনন্ত দোলার মধ্যে সংগ্রামশীল মানুষ প্রকৃতির সে ঔদার্য, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের সেই ভয়ঙ্কর শক্তি ভোলবার অবসর কই? চরের মানুষ নদীর সাথে লড়াই করে, জলের ঐশ্বর্যকে লুটে জীবনের উপাদান আনে। তাই লোকাতীতের মহত্ত্ব হৃদয়কে সেখানেও স্পর্শ করে, কিন্তু মনের দিগন্তকে প্রসারিত করেই তার সমাপ্তি, প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণের সেখানে অবকাশ কই?… পূর্ববাঙলার প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও মহিমা সত্ত্বেও নিসর্গের সঙ্গে সগ্রামশীল মানুষ মুহূর্তের জন্যও নিজের সত্তা ভুলে থাকতে পারেনি। বৌদ্ধ বিপ্লবে যে সাম্যবাদ পূর্ব বাঙলার মজ্জাগত, মুসলিম বিজয়ে তা আরো প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করল এবং সেই সঙ্গে জেগে উঠল নতুন আত্মপ্রত্যয়, নতুন ব্যক্তিত্ববোধ এবং স্বাধিকারের জ্ঞান। এভাবে পূর্ব বাঙলার ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিদ্রোহ-ধর্মী মন সহজেই ইসলামের সংসারমুখী সন্ন্যাস-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে নিল। (বাঙলার কাব্য)।

স্মার্ত রঘুনন্দন ও রঘুনাথ শিরোমণির ব্রাহ্মণ্য আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিয়ে বৈষ্ণব বিপ্লবের যে প্লাবন এল তাতে পশ্চিমবঙ্গেও কিন্তু সবাই চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত হয়নি বা রাধাকৃষ্ণের রূপকে ভক্তি বা বৈরাগ্য সাধনা করে নি। হয়তো চৈতন্যদেবের উপর অভিমান, অথবা রাধা-কৃষ্ণ রূপক থেকে প্রেরণার অভাব। তাই একদল লোক ভিন্ন পথে একই সাধনা করে চলল, এরা বাঙলার বাউল। বাউল আর বৈষ্ণবে সাধনাগত মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। পরিণামে তারা। একই গন্তব্যে পৌঁছে। একদল মুসলমান হিন্দুয়ানীর প্রতি অবজ্ঞাবশত পীর-মুর্শিদের রূপকে সাধনা করেছে। আর একদল হিন্দুর যোগ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতির সমন্বয়ে এক তত্ত্ব-দর্শন খাড়া করেছে। ফলত, বাঙলায় চতুর্বিধ শাখার সাহিত্য আমরা পাচ্ছি: ১. বৈষ্ণবপদ সাহিত্য ২. বাউল সাহিত্য, ৩. মুরশিদা ও ৪. মারফৎ সাহিত্য। এ সবকটির মূল উৎস মায়াবাদ আর মুসলমানের সূফীতত্ত্ব। মায়াবাদও সূফীমতের সংমিশ্রণে ও সমন্বয়ে উদ্ভূত। শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও নানাভাবে নানাদিকে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা সেদিন নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল প্রচুর। সাহিত্যে, শিল্পে, স্থাপত্যে, সংগীতে সর্বত্র এর সাক্ষ্য মিলে। এ ধারায় চললে আজ বাঙলার সংস্কৃতি কিরূপ নিত তা হয়তো কল্পনা করা সম্ভব–কিন্তু নিরর্থক। কারণ, মধ্যপথে অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চেষ্টায় রামায়ণ-মহাভারতের বহুল চর্চা হিন্দু-মানসকে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যমুখী করে দিল। অপরপক্ষে ফরাজেয়ী-ওহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে শরীয়তের প্রতি অত্যধিক অনুরাগ মুসলমানগণকেও রক্ষণশীল এবং আরব-ইরানী তমদুনের পূজারী করে তুলল। ফলে, বাঙলার সংস্কৃতি সম্ভাব্য পরিণতি লাভ করতে পারল না।

বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অনেক কবি বৈষ্ণবপদ-সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। তাদের কেউ করেছেন নেশার ঝেকে আর কেউ করেছেন পেশা হিসেবে। নেশার ঝেকে করার দারণ দুটো :১. সূফী মতবাদের সাথে বৈষ্ণবাদর্শের আত্যন্তিক সাদৃশ্য ও আচারিক মিল, ২. জগৎ ও জীবনের চিরাবৃত রহস্য, জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের কৌতূহল প্রভৃতি মানুষের মনে যে জিজ্ঞাসা জাগায়, তার সদুত্তর সন্ধান-প্ৰয়াসজাত যে অভিব্যক্তি তাতে দেশী বহুল প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ রূপকের ব্যবহার। বৈষ্ণবদের নামকীর্তন, জীবে দয়া, বর্ণভেদ প্রথার বিলোপ সাধন, বিনয়, নামে রুচি, দশা, সখীভাব, ঐশ্বর্য প্রদর্শন, রাগানুগ্লাভক্তি, তালাক প্রথা, পুনর্বিবাহ প্রভৃতি সূফীদের যিকর, খিদমত, সামা, হাল, সদাসোহাগ, কেরামতি, তরিকত, হকিকত, মারফত প্রভৃতির অনুকরণ মাত্র। ফানাফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহও রাধাকৃষ্ণের অভেদতত্ত্ব বা যুগল রূপ পরিকল্পনার উৎস স্বরূপ। এমনকি অদ্বৈতবাদী হিন্দুর দ্বৈতাদ্বৈতবাদও সূফীর দ্বৈতবাদ থেকে উদ্ভূত। অবশ্য বেদান্ত প্রভাবে পরে সূফীদের কেউ কেউ দ্বৈতাদ্বৈতবাদী হয়েছিলেন। সুতরাং সুফী মতাসক্ত বাঙালি মুসলমানদেরকে বৈষ্ণব সাধনা অনুপ্রাণিত করবে তাতে আশ্চর্য কী? এজন্যেই সাধক নূর কুতুবে আলম এবং সৈয়দ মর্তুজা ফারসি গজল যেমন লিখেছেন, বাঙলা রাধাকৃষ্ণপদও তেমনি রচনা করেছেন। তারা দুই তত্ত্ব অভিন্নরূপে দেখেছেন। রাধাকৃষ্ণ যে জীবাত্মা ও পরমাত্মা, দেহ ও প্রাণ এবং ভক্ত ও ভগবানের পরিভাষারূপে পাক-ভারতের সর্বত্র গৃহীত হয়েছিল, এঁদের এবং পাক-ভারতের বিভিন্ন ভাষায় মুসলিম রচিত পদ ও দোহাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তা ছাড়া মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে চিরজিজ্ঞাসু–সেই অনাদিকাল থেকে মানুষ নানাভাবে এ প্রশ্নের সদুত্তর সন্ধান করেছে। আজও তার অবসান হয়নি। কারণ, আজো সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সমাধান মেলেনি। এই চিরন্তন জিজ্ঞাসার রূপ মানুষ অবিশেষে একই, কাজেই চিন্তাধারাও কমবেশি একই রূপ। কেননা, সবারই যে চিত্তকাড়া কালার বাঁশী লাগিছে অন্তরে। ইরানী ভাষা ও সাহিত্যে অপটু বাঙালি মুসলমান তাই রাধাকৃষ্ণের দেশী রূপকে জগৎ, জীবন আত্মপরমাত্মায় রহস্য উদঘাটনে প্রয়াসী হয়েছে। শুধু বাঙালি মুসলমানই বা বলি কেন; দাদু, কবীর, রজব, তাজ প্রভৃতি অবাঙালি মুসলমানও রাম সীতা ও রাধা-কৃষ্ণকে বাদ দিতে পারেননি। রাধাকৃষ্ণ রূপক তাঁদের মনন-প্রকাশের বাহনরূপে কাজ করেছে। সতেরো শতকের দরিয়া সাহেব বলেন:

আদি অংত মেরা হৈ রাম।
উন বিন ঔর সকল বেকাম ॥
কহা করা যে মান বড়াই।
রাম বিনা সরহী দুখ দাঈ ॥

কবি শেখ বলেন :

চরণ কমল হী কী।
লোচনর্মে লোচ ধরী
রোচন হরৈ রাচ্যো
সোচধাম ধনকৌ।
সোক নেস নেক হু।
কলেস কৌ ন লেস রহ্যো।
সুমরি শ্রীগোকলেস
গো কলেস মনকৌ।

মইজুদ্দিন বলেন :

বৃংদাবনকী কুংজ গলিন মে
টুংটত টুংটত হারী
দৈহৌ দরস মোহি আপনি।
মৌজ সে এহো কৃষ্ণ মুরারী
পিয়া মোহি আস তিহারী।

আফসোস বলেন :

নিশিদিন কৃষ্ণ মিলন কো সখিয়া
আস লগায়ে ঠাড়ি রহত হৈ।
আফসোস পিয়াকী নেহ-সুরতিয়া।
নিরখত নর ঔনারী রহত হৈঁ।

কবি কাইম বলেন :

হরি হেরত মৈ কিরতা বাবরী
নৈননি সেঁ কব আবৈ
হরি কো লখি কাইম সখিয়া সে
কাহে ন ধূম মচাবৈ।

সাধক এয়ারী বলেন :

হৌ তো খেলৌ পিয়া সংগ হোরী,
জবতে দৃষ্টি পরৌ অবিনাসী
লাগী রূপ ঠগৌরী।
কহ য়ারী যদি কর হরিকী
কোই কহৈ কো কহৌরি

দরিয়াও বলেন :

মুরলী কৌন বজ রৈ হো।
গগন মংডল কে বীচ?
যা মুরলীকে ধুন সে
সহজ রচা বৈরাট।
যা মুরলী কী টেরহি সুন সুন
রহী গোপিকা মোহী।
সব্দ ধুন মিরদংগ বজত হৈ
বারহ মাস বসংত।
অমহদ ধ্যান অখংড আতুর রে
ধ্যায়ত সব হী সংত।
কানুহ গোপী করত নৃত্যহি
চরণ বপু হি বিনা।
নৈন বিন দরিয়ার দেখে
আনংদ রূপ ঘনা।

একেতো সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানগণ ধর্মান্তরিত ভারতীয়দের বংশধর; তাদের রক্ত-সংস্কারে ভারতীয় প্রভাব বিদ্যমান, তার উপর ইসলামের একটি বিশিষ্ট শাখা-সুফী মতবাদ ভারতে প্রাধান্য লাভ করে, সুতরাং মুসলমানদের মন, ইন্দ্রিয়, আত্মা ও ধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভারতীয় ভক্তিবাদ তাদেরকে সহজেই প্রভাবিত করতে পেরেছিল। তাই বাঙালি কবি শাহনূরের কথায় মুসলমানদের রাধাকৃষ্ণ রূপক গ্রহণের সংগত কারণ খুঁজে পাই :

সৈয়দ শাহনূরে কয় রাধা কানু চিন হয়
রাধাকানু আপনার তনেরে।

আরো স্পষ্ট হয় যখন শুনিঃ তন রাধা মন কানু শাহনূরে বলে।

অথবা :

সৈয়দ শাহনূরে কয়, ভব কূলে আসি
রাধার মন্দিরে কানু আছিলা পরবাসী?

অথবা, ওসমানের কথায় :

রাধাকানু একঘরে কেহ নহে ভিন
রাধার নামে বাদাম দিয়ে চালায় রাত্রিদিন,
কানুরাধা একঘরে সদায় করে বাস
চলিয়া যাইবা নিঠুর রাধা কানু হইবা নাশ।

সৈয়দ মর্তুজাও বলেন :

আনন্দমোহন মওলা খেলএ ধামালী।
আপে মন আপে তন আপে মন হরি
আপে কানু আপে রাধা আপে সে মুরারী।
সৈয়দ মর্তুজা কহে সখি, মওলা গোপতের চিন।
পুরান পিরীত খানি ভাবিলে নবীন।

এর সঙ্গে তুলনীয় :

রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি
অন্যোন্যে বিলাসয় রসাস্বাদন করি। (চৈতন্যচরিতামৃত)।

বিকৃত বৈষ্ণব সাধক–বাঙলার বাউল ও অন্যান্য উপ-সম্প্রদায়ের অনেকগুলোই রাধাকৃষ্ণের রূপকে দেহতত্ত্ব তথা জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদপ্রয়াসী। শুধু তাই নয়, আধুনিক উর্দু কবি হাফিজ জলন্ধরী থেকে বাঙলা কবি নজরুল, জসীমউদ্দীন প্রভৃতি অনেককেই এ রাধাকৃষ্ণ কাব্য-প্রেরণা দান করেছেন।

ফলত, বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মননের ক্ষেত্রে বৈষ্ণব-মতের প্রভাব ও প্রেরণা ছিল গভীর ও ব্যাপক। এজন্যে ষোলো শতককে বাঙলার রেনেসাঁর যুগ বলা হয়। বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ ও বাঙালির মানবতাবোধ বৈষ্ণবান্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল। বাঙলা গীতিকবিতায় প্রেমের অনন্য অনুভূতির অনুপম বিকাশ, চরিত সাহিত্য সৃষ্টি, তত্ত্বালোচনার সূত্রপাত, কীর্তনের বিভিন্ন সুরের আবিষ্কার, সর্বোপরি মানুষের মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি–জীবে ব্ৰহ্ম ও নরে নারায়ণ দর্শন এবং প্রীতিতত্ত্বে দীক্ষা বাঙলাভাষা ও বাঙালির প্রতি চৈতন্য মতবাদের অমূল্য অবদান।

মতবাদীর বিচারে রবীন্দ্রনাথ

০১.

ইংরেজ-শাসন ও ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে অকালে, অতর্কিতে ও অভাবিতভাবে ঘটল আমাদের মধ্যযুগের অবসান। এ যেন অমাবস্যার নিশীথে হঠাৎ সূর্যোদয়, এ যেন কাঁচা ঘুমে জেগে উঠা। আধুনিক যুগের এই ঊষালগ্নে চকিত-চমকিত জনের মানস স্বাস্থ্যানুসারে কেউ বিমূঢ়, কেউ বিরক্ত আবার কেউ বা কৌতূহলী। নবযুগের সূচনায় যাকে সপ্রতিভ কৌতূহলী হিসেবে পাই তিনি রামমোহন। পশ্চিমী চেতনার বাতায়নিক বায়ু সেবনে তাঁর চিত্তলোক প্রসারিত–প্রতীচ্য জ্ঞানরশ্মিতে তার প্রজ্ঞালোক উদ্ভাসিত, তার উদ্যম উদ্দীপ্ত–তাই তিনি চঞ্চল, মুখর ও অক্লান্ত। তার মধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করি বুদ্ধির মুক্তি–পশ্চিমী জীবন-চেতনার প্রথম ফল।

পাশ্চাত্য হাওয়া অনেককাল কোলকাতার চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারেনি, কেননা, ইংরেজি শিক্ষা তখনো পরিব্যাপ্ত হয়নি মফস্বল অঞ্চলে। এখানেই আমরা বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত থেকে ইয়ং বেঙ্গল অবধি সবাইকে চেতনা-চঞ্চল দেখি। তখন পাশ্চাত্য নাস্তিক্য দর্শন, যন্ত্রবিজ্ঞান এবং ফরাসী বিপ্লবের মহিমাই ছিল মুক্তবুদ্ধি তরুণদের অনুধ্যেয়। অন্যেরা গ্রহণ-বর্জনের টানাপড়েনে দ্বিধান্বিত, কেউ কেউ বিপর্যস্ত। বস্তুত রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, রামকমল, কৃষ্ণকমল প্রভৃতি কয়েকজন ছাড়া তারুণ্যের অবসানে আর সবাই অর্থাৎ ইয়ং বেঙ্গলেরা হিন্দুয়ানীতেই স্বস্তি খুঁজেছেন ১৮৬০-এর আগে ও পরে। অবশ্য লালবিহারী, কৃষ্ণমোহন, মধুসূদন প্রমুখ খ্রীস্টানই রয়ে গেলেন। তখন ব্রাহ্ম হওয়া আর ব্রাহ্ম থাকাই ছিল চরম আধুনিকতা তথা প্রগতিশীলতা।

এভাবে নাস্তিক্য দর্শন তাঁদের জীবনে হল ব্যর্থ, যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসাদ ছিল অনায়ত্ত আর ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব রইল অনাগত।

আগে ছিল ভূমি-নির্ভর কড়ির জীবন। এখন নগরে দেখা দিল বেনে সমাজের কাঁচা টাকার লেনদেন। নগুরে বাঙালি ব্রিটিশ বেনের বেনিয়া-ফরিয়া-কেরানী হয়েই সে-কাঁচা টাকার প্রসাদে ধনী ও মানী। বুর্জোয়া-জীবনের পরোক্ষ স্বাদ পেয়েই তারা ধন্য ও কৃতার্থ।

তারপর ক্রমে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হল। প্রতীচ্য চেতনারশ্মি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু সে-চেতনা ছিল গোড়া থেকেই বিকৃত, বিসদৃশ, অস্পষ্ট ও অজাতমূল। বৈশ্য বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যের মধ্যযুগীয় ভূমি-নির্ভর সামন্তিক সমাজে হঠাৎ করে চালু হল পশ্চিমের শিল্পায়ত সমাজের বুর্জোয়া অর্থনীতি। অকালে ও অস্থানে এই অতর্কিত ব্যবস্থা নিয়ে এল এদেশের নিস্তরঙ্গ আর্থিক জীবনে চরম বিপর্যয়। সাম্রাজিক শোষণ, ঔপনিবেশিকতা, যন্ত্ৰজাত পণ্যপ্রাধান্য, অটল সামন্তব্যবস্থা, জনগণের অশিক্ষা, বুর্জোয়া জীবনানুরাগ আর মনোজগতে শিক্ষালব্ধ মানবিক ও আত্মিক জীবন-চেতনার প্রসার প্রভৃতি এক অদ্ভুত পরিস্থিতির জন্ম দিল, যার সমাধানবুদ্ধি ছিল না। বিমুগ্ধ, বিমূঢ়, বিভ্রান্ত ও বিপর্যপ্ত জনগণের।

সামন্ততন্ত্রের বিলোপ, শিল্পবিপ্লব, বেনেবুদ্ধি, সাম্রাজ্যলি প্রভৃতি ছিল ইংরেজের জীবন চেতনাজাত ও সমাজ-প্রতিবেশ-পরিস্থিতি প্রসূত স্বাভাবিক জীবনচর্যার প্রসূন। সে-পরগাছা লালনের প্রস্তুতি ছিল না আমাদের দেশে। যে আবহাওয়ায় ও-সবের উন্মেষ ও বৃদ্ধি, সে-আবহাওয়া ছিল অনুপস্থিত ও অজ্ঞাত। তাই এদেশের মাটি ও-সবের কোনোটাই গ্রহণ করেনি বটে, কিন্তু সবগুলোর পীড়ন সইতে হয়েছে তাকে। অতএব, ইংরেজি শিক্ষার সূচনায় যে অকাল বসন্তের আভাস দেখা দিয়েছিল, রঙধনুর মতোই মিলিয়ে গেল সে-ক্ষণবসন্ত। বাসন্তী হাওয়া গায়ে লাগার আগেই যেন দেখা দিল হিমেল হাওয়ার দৌরাত্ম্য। কৃত্রিম আশ্বাস এভাবে বিদায় নিল অকৃত্রিম যন্ত্রণার জন্ম দিয়ে।

অজ্ঞ, মূক ও দৈব নির্ভর মানুষের দারিদ্র্য দুঃখ বেড়ে চলল বটে, কিন্তু এটি নিয়তির লীলা ও আল্লাহর মার বলেই জেনে আত্মপ্রবোধ পাওয়া কঠিন হল না। কাজেই কিসে কী হয়, সে তত্ত্ব রইল অজ্ঞাত।

যারা নগুরে তারা ইংরেজ বেনের উচ্ছিষ্ট পেয়েই ধনী ও ধন্য। ব্যবহারিক জীবনের ঐশ্বর্যে, চাকচিক্যে ও ভোগের নতুনতর রীতির আস্বাদনে তারা বিমুগ্ধ। যাদের বদৌলতে এ প্রাপ্তি, সেই ইংরেজ এখন তাদের প্রমূর্ত ভগবান। ছায়াকে কায়া বলে অনুভব করার বিড়ম্বনা তখনই টের– পাওয়ার কথাও নয়।

এঁদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ও মননশীল, তারা জীবনের অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গতির ঈষৎ অনুভূত পীড়া ও বেদনা থেকে মুক্তি কামনায় য়ুরোপীয় জীবন প্রতিবেশের আর এক দান বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও শিল্প চর্চায় আত্মনিমগ্ন থেকে চিত্তলোক প্রসারে আনন্দিত হতে চেয়েছেন।

য়ুরোপে যন্ত্র-শিল্পের প্রসার, মানসোৎকর্ষ ও বৈশ্য সভ্যতার বিকাশ তথা বুর্জোয়া সমাজের প্রাধান্য ছিল ঐতিহাসিক বিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী অভিব্যক্তি এবং সে কারণেই স্বতঃস্ফূর্ত। এর কোনোটাই অনুকূল ছিল না আমাদের দেশে। এজন্যে আমাদের জ্ঞানী-মনীষীরা য়ুরোপীয় জীবনের ও যুগের মর্মবাণী স্বরূপে উপলব্ধি করতে হয়েছেন অসমর্থ। তবু অবচেতন প্রেরণায় নতুন যুগ ও পরিবেশকে তারা গ্রহণে ছিলেন উনুখ, যদিও সামর্থ্য ও সুযোগ ছিল সামান্যই। ব্যবহারিক জীবনে বুর্জোয়ার ঐশ্বর্য অর্জনের উপায় ছিল না বলে তাদের সাধনা হয় অন্তর্মুখী। এভাবে আর্থিক জীবনে প্রতিহত হয়ে তারা মানবিক ও আত্মিক চেতনা প্রসারে হন প্রয়াসী। ব্যবসায় দ্বারকানাথের অসাফল্য দেশের স্বাদেশিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক চেতনা বৃদ্ধির নিমিত্ত হয়েছে, দেখতে পাই।

য়ুরোপীয় বুর্জোয়া সমাজের ব্যবহারিক ও মানস ঐশ্বর্যে মুগ্ধ লুব্ধচিত্ত বাঙালির ঘরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। এই ঘরে সামন্ত জীবনের দাপট ও বুর্জোয়া জীবনের ঐশ্বর্যের আশ্চর্য মিলন। হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বেই য়ুরোপে বুর্জোয়া জীবন বিকাশের পূর্ণতা লাভ করে। তার জন্মোত্তরকালে বুর্জোয়া সমাজের গ্লানি, ত্রুটি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হতে থাকে। কিন্তু সে খবর উনিশ শতকেও এদেশে পৌঁছেনি। কাজেই বুর্জোয়া সমাজ; বেনে বুদ্ধি ও বৈশ্য সভ্যতাই ছিল শিক্ষিত বাঙালির অনুধ্যেয় জীবন স্বপ্ন। তাতে আবার ঠাকুর পরিবারের সন্তানেরা তখনো বুর্জোয়া জীবনের কোনো প্রসাদ থেকেই ছিলেন না বঞ্চিত। ধন-মান-যশ-প্রতিপত্তি যা-কিছু মানব কাম্য, যা-কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন তা ছিল জন্মসূত্রেই আয়ত্ত। এ জীবন দেশগত তথা প্রতিবেশ প্রসূত নয়-এ হচ্ছে দেখে শেখা ও পড়ে পাওয়া কৃত্রিম ও অনুকৃত জীবন– এ দেশে অজাতমূল। কাজেই গোটা দেশের প্রয়োজন ও সমস্যার সঙ্গে এ জীবনের যোগ ছিল না–তাই দায়িত্ব ও কর্তব্য চেতনাও ছিল অনুস্থিত। কিন্তু নেতৃত্বের সহজ অধিকার বশে তারা সভাপতিত্ব করতেন বটে, কিন্তু তাতে সেবার প্রেরণা ছিল না, ছিল সৌজন্যের আড়ম্বর।

এ হেন পরিবেশের সন্তান রবীন্দ্রনাথের অসামান্যতা এখানে যে তিনি মানুষ অবিশেষের প্রতি। প্রীতির অনুশীলনে সাফল্য লাভ করেছিলেন। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ মানুষের মানবিক গুণে ও আত্মিক উৎকর্ষে আস্থা রাখতেন, অনুকূল আবহাওয়ায় মানুষের সদ্বুদ্ধি ও সৌজন্যেই পীড়ন ও পাপমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠবে–এ ধারণা বশেই তিনি জাগতিক সব অন্যায়-অনাচারের ব্যাপারে মানুষের বিবেক ও বোধের কাছেই আবেদন জানিয়েছেন। কোনো বাস্তব পন্থায় সমাধান প্রয়াস তার কাছে হয়তো মনে হয়েছে কৃত্রিম ও জবরদস্তিমূলক–যা স্বতঃস্ফূর্ত নয় বলেই টেকসই নয়।

দৈশিক পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক অমোঘতায় যে চেতনার জন্ম, সে-চেতনা সমস্যার প্রকৃতি ও সমাধানের উপায় নির্ধারণে সহজেই সমর্থ। কিন্তু যে-চেতনা পড়ে পাওয়া এবং পরিসুতি ও অনুশীলন প্রসূত তা তত্ত্বপ্রবণই করে–সক্রিয়তা দেয় না। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধও তাই। সংবেদশীলের মহাপ্রাণতাজাত সমস্যা-বিব্রত দেশকর্মীর নয়।

এজন্যেই তিনি চাষী-মজুরের হিতকামনা করেছেন, তাদের স্বাবলম্বী হবার প্রেরণা দিতেও চেয়েছেন। সমবায় সমিতি গড়েছেন কিন্তু প্রজাস্বত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন নি। জমিদার যে পরোপজীবী ও পরস্বাপহারী তা উপলব্ধি করেও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদে সক্রিয় হন নি।

পীড়নমুক্ত মনুষ্য সমাজ দেখবার জন্যে তাঁর আবেগ ও আকুলতার অন্ত ছিল না। এ ব্যাপারে তাঁর উদ্বেগও ছিল অশেষ। কিন্তু কৃত্রিম বুর্জোয়া পরিবেশে মানুষ হয়েছিলেন বলে সমাধানের বাস্তবপন্থা গ্রহণে ছিলেন অসমর্থ। এজন্যে রবীন্দ্রনাথ হিতকামী দার্শনিক–কর্মী পুরুষ নন।

কৌতূহল থাকলে তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ কার্লমার্কসকে (১৮১৮-৮৩) চাক্ষুষও করতে পারতেন। তাঁর প্রৌঢ় বয়সে রাশিয়ায় মার্কসের আদর্শ সমাজ মূর্তিলাভ করতেও দেখলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সে-প্রভাব অনুপস্থিত। এমনকি রাশিয়া স্বচক্ষে দেখেও তিনি দ্বিধামুক্ত হননি। মার্কসবাদের প্রয়োগক্ষেত্র হওয়া উচিত ছিল ভারতবর্ষ। কেননা বর্ণে বিন্যস্ত ও দারিদ্রক্লিষ্ট ভারতেই ছিল সাম্যবাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। যেহেতু জনমনে ছিল মধ্যযুগের ঘোর, সামন্ত ও পেটি বুর্জোয়া জীবন ছিল প্রসারমুখী, এর জ্ঞানী-মনীষীরা ছিলেন বুর্জোয়া-জীবনের মানস-ঐশ্বর্যে বিমুগ্ধ এবং তার উপর ছিল পরাধীনের অসামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাসের অভাব; সেহেতু সাম্যবাদ এখানে শিকড় গাড়তে পারেনি। এ আবহাওয়ার সন্তান মানবতাবাদী মানবদরদী রবীন্দ্রনাথও তাই চিন্তানায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেননি। মার্কস পেলেন তার অবহেলা।

প্রসঙ্গত নজরুল ইসলামের নামও এ সূত্রে মনে পড়ে। স্বাধীনতা ও সাম্যকামী হয়েও তিনি মার্কসবাদ গ্রহণ করেননি। উভয়ের ক্ষেত্রেই কারণ সম্ভবত অভিন্ন। বুদ্ধিগ্রাহ্য তত্ত্ব বা তথ্য কিংবা উপায় বা আদর্শ আবেগগত না হলে তা জীবনে আচরণীয় হয়ে উঠে না। বিশেষ করে আস্তিক ও আত্মবাদীরা নাস্তিক্য ভিত্তিক ধনসাম্যবাদ মানতে চায় না। কেননা তাদের চেতনায় Man does not live by bread alone তত্ত্বের গুরুত্ব অশেষ। এ শ্রেণীর লোকই Animal Farm জাতীয় গ্রন্থে নিজেদের বোধ ও বিজ্ঞতার সমর্থন পেয়ে আশ্বস্ত ও আনন্দিত হয়। কিন্তু ধনসাম্য যে মানুষের দেহ-মন-আত্মার পার্থক্য মুছে দেয় না কিংবা সত্তার স্বাতন্ত্র ও স্বাধীন বিকাশ যে ব্যাহত করে না, ধনসাম্য যে শক্তিসাম্য ঘটায় না এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, প্রজ্ঞা, দর্শন প্রভৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র ও প্রতিষ্ঠা বুর্জোয়া কিংবা পুঁজিবাদী সমাজের মতোই যে সম্ভব, কেবল তা নয়; ব্যবহারিক, সামাজিক জীবনেও সামর্থ্যানুসারে প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি তা মান-যশ-প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে অক্ষুণ্ণ–বরং বাড়ে। কেননা ধনে লভ্য কৃত্রিম শক্তির প্রয়োগ এখানে অচল বলেই যোগ্যের প্রতিষ্ঠা লাভ যে সহজ–তা তারা বুঝতে চায় না।

ধন্যসাম্যবাদীরা খাদ্যবস্তুর অভাব, তার উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটিই মানুষের যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা, পীড়ন-শোষণ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উৎস বলে বিশ্বাস করে। জীবিকা তথা খাদ্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন-আহরণ যারা করে তারা শ্রমজীবী শ্ৰেণী আর যারা কৃত্রিম উপায়ে পরোপজীবী তারা শোষক শ্ৰেণী। এদের সম্পর্ক হয়েছে উৎপাদক ও নিষ্ক্রিয় উপভোগীর, শোষক ও শোষিতের, পীড়ক ও পীড়িতের, বুর্জোয়া ও প্রলিতারিয়েতের, পুঁজিবাদী ও দরিদ্রের, সামন্ত ও ভূমিদাসের, মালিকের ও মজুরের, ধনী ও নির্ধনের, বেনের ও ক্রেতার, মহাজন ও খাতকের, মেহনতি জনতা ও পরশ্রমজীবী সবলের। কাজেই এদের মধ্যে সচেতন কিংবা অচেতন একটা দ্বন্দ্ব; বৈর কিংবা প্রতিপক্ষতা রয়েছে। এর নাম শ্রেণীসংগ্রাম। জীবন-চেতনার বিশেষ বিকাশের সঙ্গেই। এর শুরু। এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি; জীবিকার দুর্লভতা, জীবনবোধের প্রসার ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে এ সগ্রাম স্পষ্ট ও তীব্রতর হচ্ছে। অতএব মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে উৎপাদনে ও বণ্টনে সমতা বিধান করে প্রত্যেক মানুষের জীবিকার সুব্যবস্থা করার মধ্যেই। তাই মানবিক ভাব-চিন্তা কর্ম এই শ্রেণী- সংগ্রামের অবসান কল্পে উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যে নিয়োজিত হওয়া আবশ্যক। এজন্যেই বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত প্রভৃতিরও এ সমস্যা সমাধানে হাতিয়ার রূপে ব্যবহারের উপযোগী হতে হবে। এসবের আলাদা কোন উদ্দেশ্য বা সার্থকতা থাকতে পারে না– অন্তত থাকা উচিত নয়। এগুলো আগে পরশ্রমজীবী শোষকদের চিত্তবিনোদনে নিয়োজিত হয়েছে,এখন হবে শোষিতের মুক্তি সংগ্রামের সহায়ক। কাজেই রাষ্ট্রসংস্থার নিয়ন্ত্রণে জনগণের কর্ম ও চিন্তাগত যৌথ প্রয়াসে মানবিক সমস্যার সমাধান ও জীবিকার সুব্যবস্থাই হচ্ছে দৃষ্টিগ্রাহ্য একমাত্র উপায়।

রবীন্দ্রনাথ মার্কসবাদী ছিলেন না, তাঁর রচনা এই সংগ্রামী প্রেরণা প্রসূত নয়। তার মানবতাবোধ ও মানবপ্রীতি বুর্জোয়া উদারতার প্রসূন মাত্র। কাজেই রবীন্দ্রসাহিত্য কালপ্রবাহে দেশের মৃত ঐতিহ্য মাত্র। এর মূল্য ইতিহাসের উপাদান হিসেবেজীবনের উপকরণ রূপে নয়। অতএব বামপন্থীদের চোখে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্যের কোনো উপযোগ মূল্য নেই। এক্ষেত্রে মুসলিম তমদুনবাদীদের মতও স্মরণীয়। তাদের কাছেও রবীন্দ্রসাহিত্য তাদের সংস্কৃতিবিধ্বংসী। একদলের পক্ষে পরিত্যাজ্য বুর্জোয়া সাহিত্য বলে, অপর দলের কাছে অশ্রদ্ধেয় হিন্দুয়ানী বলে। তাদের ধারণায় রবীন্দ্রনাথ যুগের সৃষ্টি ও যুগধর–যুগোত্তর কিংবা যুগ প্রবর্তক নন।

.

০২.

অতএব রবীন্দ্রসাহিত্যের অপমৃত্যু আসন্ন! অবশ্য কাল সবকিছুকেই গ্রাস করে। রবীন্দ্রনাথও একসময় প্রাচীন কবি হবেন, তার অধিকাংশ রচনা মূল্য হারাবে–রবীন্দ্র-মহিমাও হবে ম্লান। ইতিমধ্যেই আধুনিক কবিতা ও গান রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। কিন্তু এত শিগগির যে রবীন্দ্রনাথ অশ্রদ্ধেয় হয়ে উঠবেন, তা ছিল অভাবিত।

অবশ্য এর মধ্যে ভরসার কথা এই যে এ বিরূপতা বিচারের ফল নয়– আদর্শিক প্রতিপক্ষতার স্বাক্ষর মাত্র। আদর্শে অনুগত মানুষের বিচারশক্তি থাকে না–থাকে আচ্ছন্ন মনে advocacy-র প্রবণতা। আদর্শিক প্রয়াসের সিদ্ধিবাঞ্ছায় তারা চালিত হয় আবেগে–বিবেক-বুদ্ধি হয় অবহেলিত।

উৎপাদন ও বণ্টন বৈষম্যেই-যে সমাজে ধনবৈষম্য ও তজ্জাত অন্যান্য সর্বপ্রকার উপসর্গের সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু সচেতন বা অচেতন শ্রেণীসংগ্রাম আধুনিক কালের চেতনাপ্রসূত–পুরাকালে এর উপস্থিতির সাক্ষ্য মেলে না। পৃথিবীর বিভিন্ন যুগের চিন্তানায়ক ও বিপ্লবীদের চেতনায় এর কোনো নজির পাইনে। মুসাতে দেখি পাপ-ভীতি, ঈসার মধ্যে পাই ধনভীতি ও প্রীতির কথা, হযরত মুহম্মদের বাণীতে দেখি দাস ও দরিদ্রের প্রতি দাক্ষিণ্যের কথা এবং সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব কিন্তু ধন সাম্যের নয়। বুদ্ধে রয়েছে জন্ম-জরার ত্রাস আর করুণা ও মৈত্রীর কাক্ষা ও ধন-বিরাগ, ব্রাহ্মণ্য ধর্মে পাই লোভের পরিণামভীতি ও ভোগে অনাসক্তির গুরুত্ব। চৈতন্য প্রচার করেছেন বৈরাগ্য ও ও প্রীতির মহিমা, কনফুসিয়াস কিংবা লাও সে (Lao tse) ধনসাম্যের কথা বলেননি। এঁদের সবারই আবেদন ছিল মানুষের আত্মার কাছে, সদ্বুদ্ধির প্রতি। এরা সবাই যুগানুগত ও মানবতাবাদী।

সুশৃঙ্খল সমাজ লক্ষ্যে সবাই চেয়েছেন নীতিনিষ্ঠা ও ন্যায়-সত্যের প্রতিষ্ঠা, উৎসাহ দিয়েছেন দয়া-দাক্ষিণ্যে–কিন্তু ধন বৈষম্যের অভিশাপের কথা কারো মুখে শোনা যায়নি। বস্তুত মার্কস-পূর্ব যুগে উৎপাদন ও বণ্টন বৈষম্যই যে মানবিক যন্ত্রণার গোড়ার কথা এবং সামাজিক মানুষের ব্যবহারিক জীবনের ইতিহাস যে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিকথা, তা কখনো উচ্চারিত হয়নি। অবশ্য এসব মনীষীর চিন্তা ও কর্মের মধ্যে যদি কেউ শ্রেণীসংগ্রাম এড়ানোরই অবচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করেন, তা হলে আমরা নাচার।

কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের চিন্তানায়ক রুশো-মন্টেগ-ভলট্যায়ার কিংবা মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন থেকে আজকের দিনের যে কোনো দেশের অধিকাংশ কম্যুনিস্ট নেতা, কর্মী কিংবা চিন্তাবিদ বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া এমনকি পুঁজিপতির সন্তান। Zeno থেকে Nicolite খ্রীস্টান বা জোসেফ প্রোচোন, বাকুনীন বা Hippie অবধি কোনো anarchist-ই গরিব ঘরের নন। কাজেই Suffering থেকেই সংগ্রামের শুরু অর্থাৎ শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম চিরন্তন–এই তত্ত্বে সত্য নেই। অতএব চিরকাল মানবিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা বা সংগ্রাম করেছেন মানবতাবাদীরাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শোষিত দরিদ্ররা এত প্রচারণার পরেও আত্মস্বার্থে ধনসাম্যতন্ত্রে তথা সমাজতন্ত্রে আজো উৎসাহবোধ করছে–না এটিই কি শ্ৰেণীচেতনা ও শ্রেণীসংগ্রামের অনুপস্থিতির বড় প্রমাণ নয়। এতে বোঝা যায় মানবতাবোধ, মানবপ্রীতি, সংবেদনশীল মন, সংগ্রামী প্রেরণা প্রভৃতি আবেগযুক্ত হলেই ব্যক্তিবিশেষ শোষণ-পীড়ন ও দারিদ্র্যমুক্ত মনুষ্য-সমাজ বাঞ্ছা করে কিংবা গঠনে উদ্যোগী হয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন কালের মানবতাবাদী মানবদরদীরা সহানুভূতির আবেগেই সুশৃঙ্খল ও সুখী সমাজ গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। প্রত্যেকেই দেশকালের প্রেক্ষিতে জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষের সামাজিক তথা আত্মিক কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করেছেন। ক্রমে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে, জীবিকা হয়েছে অপ্রতুল, পৃথিবী হয়েছে সংহত, কাজেই সমস্যাও হয়েছে জটিল–সমাধানের উপায়ও হয়েছে বহু ও বিচিত্র। মার্কসোত্তর যুগে মার্কসপন্থীর সমাজতন্ত্র তাই মানব-সমস্যা সমাধানের নতুনতম পন্থা। গরিবদেশের সমস্যা সমাধানে সমাজতন্ত্র তথা ধনসাম্যবাদ প্রবর্তন অবশ্যম্ভাবী–তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এটিও স্থায়ী সমাধান নয়, ঐতিহাসিক ধারার আধুনিক রূপ মাত্র।

অতএব হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি সবাই একই লক্ষ্যে কাজ করে এসেছেন, পার্থক্য কেবল পথ ও পদ্ধতির। সবাই মানবদরদী ও মানবতাবাদী। সবার জ্ঞান-বুদ্ধি অভিজ্ঞতা অভিন্ন ছিল না, কাজেই উপায়ও এক থাকেনি। মানুষের সমস্যাও পরিবেশগত। তাই সমাধান পদ্ধতিও হয়েছে স্থানিক ও কালিক। তাই কারো কল্যাণ প্রচেষ্টাই স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করে সর্বকালিক ও সর্বমানবিক হয়নি।

রবীন্দ্রনাথও মানবতাবাদী। তিনি মুখ্যত কবি-মনীষী–কর্মী নন। তাঁর কর্তব্য ছিল মানুষকে আত্মিক চেতনায় প্রবুদ্ধ করা–বাস্তবে রূপায়ণ নয়। আবহমান কালের ধারায় তিনি যুগ-প্রতিনিধি। তার আবেদন মানুষের সদ্বুদ্ধি ও বিবেকের কাছে। ক্যুনিস্টদের আবেদনের লক্ষ্যও তাই। কম্যুনিস্ট বল প্রয়োগে বিশ্বাসী। মানবতাবাদী কবি স্বতঃস্ফূর্ত কল্যাণ-বুদ্ধির বিকাশে আস্থাবান। সামন্তবাদী, ঔপনিবেশিকতাবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, অধ্যাত্মবাদী প্রভৃতি সংজ্ঞায় চিহ্নিত করে কোনো মানবতাবাদীকে বিচার করা অবিচারের নামান্তর। নিজের মত-পথকেই কেবল একমাত্র ও অভ্রান্ত ভাবা অসহিষ্ণুতা ও মানব-মনীষার প্রতি অশ্রদ্ধা তথা ব্যক্তিক সত্তার অবমাননার নামান্তর।

রবীন্দ্রনাথ নিজের সুদীর্ঘ জীবনে সমান্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তিনটেই স্বচক্ষে দেখেছেন– বুঝবার শক্তিও তার নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন আত্মিকবোধ না জন্মালে বাহুবলে আর্থিকসাম্য স্থাপন স্থায়ী হতে পারে না। বুদ্ধির সঙ্গে আবেগের যোগ না ঘটলে তা স্বভাবে পরিণতি পায় না। স্বেচ্ছা সম্মতি আর জবরদস্তির সায় এক বস্তু নয়।

কবি-মনীষী রবীন্দ্রনাথ মানুষের প্রতি মানুষকে শ্রদ্ধাবান করে তুলবার সাধনাই করেছেন, কল্যাণ ও সদ্বুদ্ধি প্রসূত স্বেচ্ছাসম্মতি দানে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছেন। মানবকল্যাণকামী স্বেচ্ছা-সৈনিক। তাঁর এই জীবন-দৃষ্টিকে বুর্জোয়া উদারতা ও দাক্ষিণ্য বলে উপহাস করা অসৌজন্য।

গল্পে-প্রবন্ধে-নাটকে-কাব্যে কত ভাবে তিনি দ্বেষ-দ্বন্দ্ব, বিভেদ-বিরোধ, শোষণ-পীড়ন ও অপ্রেম-অশ্রদ্ধামুক্ত সমাজ-চিন্তা জাগানোর চেষ্টা করেছেন! ন্যায়যুদ্ধে কত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি!

তবু, তা কারো ism-সম্মত হল না বলে তাদের কাছে তা অকেজো ও অশ্রদ্ধেয়। কাজেই রবীন্দ্রসাহিত্য আজ তাদের কাছে না ঘরকা না ঘাটকা! মানুষকে ভালবাসার এ এক অভিনব বিড়ম্বনা!

 মসি-সংগ্রামীর সমস্যা

এ যুগে লেখকেরা বঞ্চিত শোষিত মানুষের ত্রাণের জন্যে লেখনী ধারণ করেছেন। মসি যুদ্ধে মানুষের মতি ফেরানোর এই অভিনব ও সুপরিকল্পিত প্রয়াসে চরিত্রবান সাহিত্যিকদের আন্তরিকতার অভাব নেই। এঁদের লক্ষ্য দ্বিবিধ : প্রত্যক্ষভাবে শোষিতদের ও সহানুভূতিশীলদের সচেতন ও সগ্রামী করে তোলা আর পরোক্ষে শোষকদের অন্যায়বিমুখ ও সুবিবেচক করা।

কিন্তু মুখ্য কিংবা গৌণ লক্ষ্য–কোনোটাই আশু ফলপ্রসূ নয়। কেননা যারা লেখেন তারা এমনকি বিত্তহীন হলেও-মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত। যাদের জন্য তাঁদের সংগ্রাম তারা অশিক্ষিত, অজ্ঞ, মূক এবং মধ্যবিত্তদের সঙ্গে তাদের মানস-সূত্র অসংযুক্ত। আর যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তারাও এ সাহিত্যে অবহেলাপরায়ণ। কাজেই এ সাহিত্যের দ্বারা অশিক্ষিত শোষিতজন বিক্ষুব্ধ ও সংগ্রামী হয় না। আর শোষক বুর্জোয়ারাও ন্যায়নিষ্ঠ ও দায়িত্বসচেতন হওয়ার গরজ বোধ করে না।

সুতরাং আপাতত, দেখা যাচ্ছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ লক্ষ্য যারা, তাদের কাছে এ সাহিত্য পৌঁছেই না।

তাহলে, এ সাহিত্য কাদের জন্যে, কাদের কাছে এ সব লেখার আবেদন? ..

না বললেও চলে যারা বঞ্চিত কিংবা শোষিত, তাদের চেতনা সূক্ষ্ম নয়; তারা কেবলই মার খায়, আর তাকে নিয়তি কিংবা বিধিলিপি বলে মেনে নেয়। আন্দোলন করবার, বিদ্রোহী হবার, কিংবা নেতৃত্ব দেবার স্বপ্ন অথবা সামর্থ্য তাদের কোনো কালেই ছিল না। তাদের জাগাবার, সংগ্রামী প্রেরণা দেবার কিংবা নেতৃত্ব দানের গরজ বোধ করেছেন চিরকালই মধ্য অথবা উচ্চবিত্তের সংবেদনশীল মানবতাবাদী শিক্ষিত মানুষ। মার্কস-এঙ্গেলস্ থেকে মাও-সে-তু অবধি সব নেতাই মধ্য ও উচ্চবিত্তের লোক। অতএব মানবতাবাদী সমাজতন্ত্রী লেখকের উদ্দিষ্ট পাঠক মধ্য ও উচ্চ বিত্তের শিক্ষিত জনগণই। তাদের কিছু সংখ্যক লোককে লেখার মাধ্যমে সংবেদনশীল ও সংগ্রামী করে গড়ে তুলতে পারলেই তাদের মাধ্যমেই গণসংযোগ ও গণ-আন্দোলন সম্ভবপর হয়। দুনিয়া জুড়ে সৈন্যরা ছড়িয়ে রয়েছে, কেবল সেনাপতিরই অভাব। দুর্যোগ-দুর্দিনে শিক্ষিত সংবেদনশীল দৃঢ়চিত্ত সাহসী ও ত্যাগপ্রবণ কর্মীর নেতৃত্বই সংগ্রামে সাফল্য দান করে।

সংবেদনশীলতা ও মনুষ্যত্ব সব হৃদয়ে সুলভ নয়। পরিশীলন ও পরিচর্যায় এর বিকাশও হয়তো সামান্যই হয়। সহানুভূতি ও মনুষ্যত্ব মন-মেজাজের বিশেষ গড়ন-প্রসূত। নীতিকথায় এক্ষেত্রে মন ফেরানো অসম্ভব। এ অবস্থাকে স্বাভাবিক ও অপ্রতিরোধ্য বলেই মেনে নিতে হবে। তাছাড়া উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বিত্তশালী হবার নানা সুযোগ ঘটে। শিক্ষিত, কুশলী ও নীতিভ্রষ্ট নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে প্রলোভন সংবরণ করা সহজ নয়। কাজেই যে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর উপর জনকল্যাণ ও গণমুক্তি নির্ভরশীল, তাদেরও রয়েছে চোরাবালির মতো প্রতারক মন।

একেবারে নিঃস্ব না হলে সাধারণত মানুষ নিশ্চিত বর্তমান ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা বাড়ায় না। ব্যতিক্রম কেবল অসামান্যতারই পরিচায়ক। তাই দেখা যায় Boss ও বিবেকের দ্বন্দে প্রায়ই Boss-এর জয় হয়। কেননা চাকুরে-কুকুরে সমান–হুকুম করিলেই দৌড়িতে হয়।

এজন্যে মধ্যবিত্তে দীর্ঘস্থায়ী চারিত্রিক দার্ট সুদুর্লভ। আবার টাকার এমন কুহক যে লোকে লাথিও খাচ্ছে এবং নিকটে গিয়া যে-আজ্ঞাও করছে। এমনো দেখা যায় মধ্য বয়সে মানুষ ন্যায় নীতি-আদর্শের বন্ধন মুখোশের মতোই হঠাৎ পরিহার করে। বাইরের লোক তার খোলস পালটানো দেখে নিন্দে করে। কিন্তু কোন্ বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে মানস ও বৈষয়িক সংগ্রামে সে পর্যদস্ত ও পরাজিত, তা তারা ভাবতে-বুঝতে চায় না। তেমন অবস্থায় একজন সংগ্রামপ্রবণ, আদর্শবাদী মানুষও একান্তভাবে বিষয়ী স্বার্থপর হয়ে উঠে। তখন আল্লাহর দয়া, মনিবের দক্ষিণ্য ও বিবির দিদার ছাড়া কিছুই তার কাম্য থাকে না। তখন আদর্শের রূপায়ণ-ব্ৰতী কোনো বুদ্ধিজীবী একাকী দায়িত্ব পালনে কিংবা কর্তব্য সাধনে ভয় পায়। তার রাত্রি-নিশীথের সংকল্প দিন-দুপুরে আত্মপ্রকাশের সাহস হারায়। তেমন লোক বক্তব্য প্রকাশের জন্যে কেবলি আকুলিবিকুলি করে সহায়-সমর্থনের জন্যে নিজের চারদিকে তাকায়, কাকেও না পেয়ে গুমরে মরে, ব্যথায় জর্জরিত হয়, ক্ষোভের যন্ত্রণায় ছটফট করে,–কিন্তু একা মৃত্যুর কিংবা পীড়ন বরণের ঝুঁকি নিতে জৈব কারণেই অসমর্থ।

শিক্ষিত লোকের সংখ্যাল্পতার জন্যে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে এ সমস্যা আরো প্রকট ও তীব্র। কেননা, সেখানে সহানুভূতিশীল পাঠকও কম। এজন্যেই প্রাচ্যদেশে যদিও ধনবৈষম্য তীব্র, জীবিকা অর্জনের সুযোগ সীমিত, পীড়ন ভয়াবহ ও প্রবলের স্বৈরাচার নির্বিঘ্ন, তবু এখানে গণদরদী লেখক স্বল্প, পাঠক নগণ্য, সরকারও অসহিষ্ণু। তাই তারুণ্যের অবসানে অধিকাংশকেই দেখি ব্রতভ্রষ্ট ও খন্ত্রত।

তাছাড়া মধ্যবিত্ত সংজ্ঞাটিও আপেক্ষিক। প্রাচ্যদেশে যারা মধ্যবিত্ত, যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা য়ুরোপের কোনো কোন দেশের নিম্নবিত্তের লোকের চেয়েও তারা হীনাবস্থ। জীবনযাত্রার মান নিম্ন এবং রুচি অবিকশিত বলে এ দেশে যারা প্রাচুর্যের মধ্যে আছে বলে মনে করি, তারাও জীবনের নানা ভোগ্য-সামগ্রী থেকে বঞ্চিত। ফলে তারাও অভাব মুক্ত নয়–তারাও মনে কাঙাল। কাজেই প্রলুব্ধ হওয়া তাদের পক্ষেও সম্ভব ও সহজ। এবং কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের নানা প্ররোচনায় ও প্রলোভনে বিভ্রান্ত ও আদর্শচ্যুত করবার প্রয়াসী। সাহিত্য পুরস্কারের শিকার হয়ে প্রাণের কথা বিকৃত করে প্রকাশ করা বা বক্তব্য চেপে যাওয়া গরিব লেখকের পক্ষে সম্ভব। আবার প্রত্যয় দৃঢ়মূল নয়, অথচ বয়োধর্মের বশে ফ্যাশানের আনুগত্যে কেউ কেউ আদর্শবাদের বুলি কপচায়, একটু বয়স হলেই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে–দালালও হয়ে উঠে। যেমন গতশতকে ইয়াংবেঙ্গলদের প্রায় সবাই চল্লিশোত্তর জীবনে নিষ্ঠাবান গোঁড়া হিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। এসব নানা কারণে তারুণ্যের অবসানে আদর্শবাদী গণদরদী ন্যায়নিষ্ঠ সগ্রামপ্রবণ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকরা বদলে যায়, ভোল পাল্টায়।

নির্যাতিত মানবতার কথা ছেড়ে দিলেও দুনিয়াব্যাপী গণমানবের দুঃখের অন্ত নেই। যেখানে একনায়কত্ব, সেখানে পেটের ক্ষুধা যদি বা মেটে, মনের কথা প্রকাশের পথ নেই। তাতে মনের ঝাল মিটিয়ে প্রাণের জ্বালা জুড়োবার উপায় খুঁজে পায় না মানুষ। জীবনে সে আর এক যন্ত্রণা। যেখানে ডেমোক্রেসির মার্কা আঁটা সরকার পরমত অসহিষ্ণু সেখানেও সেই জ্বালা। ক্ষোভে-দুঃখে, জ্বালায়-যন্ত্রণায় বাকস্বাধীনতা মানুষের বেদনা উপশমের অন্যতম উপায়। কেননা, মানুষ প্রাণ নিয়ে বাঁচে না, বাঁচে মন নিয়ে। সে মনের উপর পীড়ন একসময় সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। তাই দৈহিক পীড়ন ঘটায় মৃত্যু, আর মানস নির্যাতন দেয় বিকৃতি। তখন গুপ্ত পথে বিষাক্তক্ষতের মতো তা পরিণামে প্রাণঘাতী বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও জিঘাংসা জাগায়। সমাজে-রাষ্ট্রে নেমে আসে বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা ও ব্যভিচার। ক্ষমতাপ্রিয় স্বার্থলোলুপ শাসকের দৌরাত্মও বেড়ে যায়। তখন রাষ্ট্র যেন লুটের মাল, শেষ মুহূর্ত অবধি যা পাওয়া যায় তাই লাভ–এই মনোভাবের বশে শাসক গোষ্ঠীও হয়ে ওঠে বেপরওয়া। ধন-জন সব ছারখার হয়ে যায় রক্তে আর আগুনে।

এসব পরিণাম যে শাসক গোষ্ঠীর অজানা, তা নয়, কিন্তু আপাত সুখের মোহে তাদের শ্রেয়োবোধ হয় অবলুপ্ত। অন্যদিকে সগ্রাম ও জীবনধ্বংসী দুর্ভোগ ছাড়া যে মুক্তি আসতে পারে না, তা যদিও সংগ্রামীদের বোধ বহির্ভূত নয়, কিন্তু যন্ত্রণা-বঞ্চনা সইবার ধৈর্যের অভাবে তারা সংকল্পচ্যুত ও পলাতক।

কাজেই আজকের দুনিয়ায় নিপীড়িত মানুষের জন্যে সংগ্রামের প্রস্তুতি পর্বে চাই বাক স্বাধীনতার আন্দোলন, আর এজন্যে চাই শিক্ষিত বয়স্ক মধ্যবিত্তের সহানুভূতি এবং তরুণ মধ্যবিত্তের সমর্থন, বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্তের সহায়তা এবং লিখিয়েদের উচ্চ ও নির্ভীক কণ্ঠ এবং অবিচলিত কলম। এ ব্যাপারে সমর্থন ও সহযোগিতাই শক্তির উৎস। এককভাবে মানুষ কেবল দুর্বল নয়-ভীরুও। জনবলই বল। আর মনোবলই সামর্থ্য। সঙ্শক্তির মতো শক্তি নেই, যৌথ কর্মে নেই অসাফল্য।

এদেশের প্রাচীন কবির এক আপ্তবাক্য বদংশত মা লিখ–আজ মিথ্যে বলে প্রমাণিত। কেননা সরকারের চোখে বক্তৃতা মারাত্মক, গদ্য লেখা দূষণীয় ও কবিতা নিষ্ফল। তাই দেখছি কবিতায় যে-কিছু বলা যায়, কিন্তু গদ্যে লিখলে হয় আপত্তিকর, আর বক্তৃতায় বললে হয় অপরাধ।

কবিতার আবেদন যদিও গভীর ও স্থায়ী, তবু তা স্বল্পসংখ্যক পাঠকে সীমিত। প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প এবং নাটকের আবেদনও সর্বজনীন নয়। বক্তৃতা গণমুখী,–তাই সরকার বক্তৃতাভীরু। দুনিয়ার প্রায় সব সরকারেরই এক চেহারা এক রূপ। তাই বলে কি কাফেলা স্থির হয়ে থাকবে, চিন্তার স্রোত কি শুকিয়ে যাবে! বাধা প্রবল ও বেপরওয়া হলে কালমাত্রা বেড়ে যায় এবং ক্ষয়-ক্ষতিও বেশি হয় বটে কিন্তু পরিণামে গণসগ্রামে সাফল্য সুনিশ্চিত।

 মানবিক সমস্যার সমাধানে সংবাদপত্র

বিজ্ঞানীরা বলেন, চল্লিশ লাখ বছর আগে সচল প্রাণীরূপে প্রথম দেখা দেয় মাছ। আর ক্রমবিবর্তনে বা ক্রমোন্নয়নে মানুষ অবয়ব পায় দশ লাখ বছর পূর্বে। বিজ্ঞানীর বিবর্তনবাদে ও উদ্বর্তন তত্ত্বে আস্থা রেখে বলা চলে, মানুষের আরো কয়েক লক্ষ বছর কেটে গেছে দেহে-মনে উৎকর্ষ লাভের অবচেতন প্রচেষ্টায়। কিছুটা আভাসে, কিছুটা অনুমানে এবং কিছুটা নিদর্শনে আমরা মানুষের ইতিকথা পাচ্ছি মাত্র আট-দশ হাজার বছরের।

মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন ও বিশিষ্ট করেছে তার দৈহিক উৎকর্ষ ও আঙ্গিক সামর্থ্য। তার দুটো হাতের উপযোগই তাকে দিয়েছে প্রাণিজগতে শ্রেষ্ঠত্ব,–দিয়েছে জৈব-সম্পদে ও মানস-ঐশ্বর্যে অধিকার।

আত্মসচেতন প্রাণী হিসাবে মানুষের মননের প্রথম লক্ষণীয় প্রকাশ ঘটে সর্বপ্রাণবাদ (Animism) তত্ত্বচিন্তায়। তারপরে তার আরো এগিয়ে আসার স্বাক্ষর মেলে তার যাদুতত্ত্বের (Magic Power)উদ্ভাবনায়। তার আরো অগ্রগতির সাক্ষ্য রয়েছে টোটেম-টেবু ভিত্তিক জীবন চেতনায় ও সমাজ বিন্যাসে।

Pagan জীবন-চেতনায় ও ধর্মীয় জীবনে মৌলিক কোনো পার্থক্য দুর্লক্ষ্য। বাহ্য পার্থক্য হচ্ছে একটি অবচেতন অভিব্যক্তি, অপরটি সচেতন জীবন ধারণা। একটিতে রয়েছে অবিন্যস্ত অস্পষ্টতা, অপরটিতে আছে যুক্তির শৃঙ্খলা ও তাত্ত্বিক তাৎপর্য। মূলত ভয়-ভরসা, বিস্ময়-বিশ্বাস ও কল্পনা সংস্কারই উভয়বিধ জীবন-তত্ত্বের ভিত্তি। আর জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ও প্রসারই লক্ষ্য। এ জন্যে যুক্তি, বিশ্বাস ও তত্ত্ব সমন্বিত হলেও ধর্ম Animism, Magic, Totem, Taboo তত্ত্বেরই বিকশিত শোভন রূপ। আচারে-অনুষ্ঠানে আজো তার শাস সর্বত্র দৃশ্যমান। কেবল লক্ষ্যে মহত্তাব ও উদ্দেশ্য আরোপিত হয়েছে মাত্র। কেননা, মানুষের কোনো বিশ্বাস-সংস্কারেরই মৃত্যু নেই। পরিবর্তিত পরিবেশে তার রূপান্তরই হয় শুধু।

জীবনের বিকাশ কিংবা বিলয় জীবন-জীবিকার পরিবেশ নির্ভর। তাই মানুষে মানুষে পরিবেষ্টনী-গত পার্থক্যও দেখা দিয়েছে গোড়া থেকেই। সে পার্থক্য বর্ণে, জীবিকায় ও জীবনদৃষ্টিতে সুপ্রকট। পরিবেষ্টনীগত প্রয়োজন স্বীকার না করে উপায় ছিল না বলেই বিচিত্র ধারায় গড়ে উঠেছে মানুষের জীবন ও মনন। এভাবে প্রতিবেশের আনুকূল্যে মানুষের অগ্রগতি কোথাও হয়েছে অবাধ, আবার এর প্রতিকূলতায় কোথাও হয়েছে ব্যাহত।

পরিবেশ ও প্রয়োজনের অনুগত মনুষ্য জীবনে এজন্যেই বিকাশ সর্বত্র সমান হতে পারেনি। তাই আজো স্থিতিশীল আরণ্য গোত্র যেমন রয়েছে, তেমনি দেখা যায় পাঁচ-সাত হাজার বছরের পুরোনো সভ্য জাতিও।

সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ-মানসে তথা জীবন-জীবিকায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বিধান লক্ষ্যে উন্নততর সমাজে ধর্মের উদ্ভব। ধর্মও তাই স্বীকার করেছে পরিবেষ্টনীগত জীবন-জীবিকার প্রভাব ও প্রয়োজন। এ জন্যেই কোনো ধর্মই দেশকাল নিরপেক্ষ সর্বমানবিক হতে পারেনি। প্রতিবেশের কারণেই কোনো ধর্মে প্রাধান্য পেয়েছে পাপ, কোনো ধর্মে ক্ষমা, কোনো ধর্মে কর্ম, কোনো ধর্মে আচার, কোনো ধর্মে বৈরাগ্য, কোনো ধর্মে জরামৃত্যুভীতি, কোনো ধর্মে নৈতিক জীবন, কোনো ধর্মে জ্ঞান, কোনো ধর্মে ভক্তি এবং কোনো ধর্মে মুখ্য হয়েছে সংগ্রাম।

দেশকালের চাহিদা পূরণের জন্যে এভাবে কত ধর্মের জন্ম-মৃত্যু হয়েছে, আবার একই ধর্মের হয়েছে কত কত শাখা উপশাখা। তবু নিত্য পরিবর্তনশীল পরিবেশে চলমান মানুষের নব-উদ্ভূত প্রয়োজন মেটেনি। নিত্য নতুন সমস্যায় বিব্রত মানুষ উপায় খুঁজে খুঁজে এগিয়েছে একটার সমাধান পেল তো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অন্য সমস্যা। কোনো চলমান জীবনেই প্রয়োজন ও উপকরণ অপরিবর্তিত ও স্থিতিশীল থাকে না। তাই মানুষ কোনদিন নিশ্চিত জীবনের আশ্বাস পায়নি।

ফলে, ধর্ম অভাব মিটিয়ে ভরে তুলতে পারেনি বলে, ধরেও রাখতে পারেনি। দিশেহারা মানুষ ধর্মের নামে কেবল খুনোখুনিই করেছে–কিন্তু শ্রেয়সের সন্ধান পায়নি। এ অভিজ্ঞতা থেকে উন্নততর সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ জীবনচেতনা তথা সমাজ-চেতনা দেখা দেয়। তারই ফলে জীবন, সমাজ ও জীবিকা-তত্ত্বে হয়েছে নানা মতের ও পথের উদ্ভব। এ সব মতবাদই এখন সভ্যজগতে জীবন নিয়ন্ত্রণের ও চালনার ভার নিয়েছে।

ধর্মে ছিল অপৌরুষের অঙ্গীকার। তার ভিত্তি ছিল ভয়-ভরসা ও বিশ্বাস-সংস্কার। এজন্যে ধর্মে আনুগত্য ছিল প্রায় অবিচল।

মতবাদ হচ্ছে যুক্তি ও ফল নির্ভর। মতবাদ গ্রহণে-বর্জনে মানুষ অকুতোভয় এবং স্বাধীন। এ জন্যে সমাজে ও রাষ্ট্রে আরো জটিল হয়েছে সমস্যা।

ধর্মে আনুগত্য ভয়-বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে উঠে বলে সে-আনুগত্য হয় অন্ধ ও অবিচল। তাই ধার্মিক মাত্রেই গোঁড়া ও কর্তব্যনিষ্ঠ। আনুগত্য, সংযম ও নিষ্ঠাই ধার্মিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ভয় ভরসা ও বিশ্বাসের অঙ্গীকারে সংযত ও বিধাননিষ্ঠ ধার্মিক তাই পোষমানা প্রাণী। তার মধ্যে প্রশ্ন নেই, দ্রোহ নেই, নেই কোনো উদ্বেগ। নিয়ম ও নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত তার জীবনের সুখে-দুঃখে, সাফল্যে-ব্যর্থতায়, রোগে-শোকে কিংবা আনন্দে-বেদনায় সে সহজেই প্রবোধ ও স্বস্তি পায়। অপৌরুষের বিধি-নিষেধের আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত থাকে তার ইহলোকে-পরলোকে প্রসারিত জীবনের ঐহিক ও পারত্রিক অভীষ্ট। এজন্যেই ধার্মিক মানুষে খাঁটি মানবতা সুদুর্লভ। মনুষ্যত্বের সহজ ও স্বাভাবিক বিকাশ তাতে অসম্ভব। তার হচ্ছে যান্ত্রিক জীবন। যেমন দুটোই সৎকর্ম হওয়া সত্ত্বেও ধার্মিক মুসলমান মন্দির নির্মাণে এবং ধার্মিক অমুসলমান মসজিদ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে না। এবং বিধর্মী ভিক্ষুক দিয়ে কাঙ্গাল ভোজনের কিংবা ফিত্রা দানের পুণ্য মেলে না। তার ধর্মপ্রেরণা-প্রসূত দয়া যেমন অশেষ তার ঘৃণাও তেমনি তীব্র ও মারাত্মক। এজন্যে তার মনুষ্যত্ব, তার মানবতা ও তার উদারতা তার ধর্মবুদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারে না কখনো। তাই ধার্মিক মানুষের সংযম ও নীতিনিষ্ঠা সমাজ-শৃঙ্খলার সহায়ক হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষের অগ্রগতির অবলম্বন হয় নি। আর মতবাদ যেহেতু যুক্তি ভিত্তিক ও কল্যাণমুখী সেজন্যেই মতবাদই মতধারীর মনুষ্যত্ব ও মানবতার পরিমাপক। এটি তার বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে অর্জিত বলেই এখানে সে স্বয়ম্ভ।

সেকালের ধর্মমত আর একালের মতবাদ দুটোই মূলত সামান্য অর্থে ধর্ম,–জীবনযাত্রীর নিয়ামক। একটা ঐশ্বরিক, অপরটা নিরীশ্বর তথা মানবিক–পার্থক্য এটুকুই। কিন্তু কোনোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। মানবিক সমস্যার সমাধানে কোনোটাই নয় পুরো সমর্থ। তবু গণহিতৈষণা-কামীর গণবাদ শ্রেয় এবং গণতন্ত্র উন্নততর ব্যবস্থা।

সেকালে ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন, প্রচারক ছিলেন, ছিল ধর্মগ্রন্থ। একালেও মতবাদের প্রবর্তক আছেন, সংবাদপত্রই এর গ্রন্থ এবং সাংবাদিকরাই এর প্রচারক। এজন্যে আজ সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরাই মানব ভাগ্যের নিয়ামক।

সেকালে পৃথিবী ছিল খণ্ডে বিভক্ত, আর সে-কারণে সমাজগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন। একালে পৃথিবী হয়েছে অখণ্ড ও সংহত। মানুষের প্রয়োজন ও সমস্যা হয়েছে একই সূত্রে গ্রথিত। যৌথ প্রয়াস ছাড়া কোনো প্রয়োজনই মেটে না; সহযোগিতা ছাড়া মেলে না কোনো সমস্যার সমাধানও। এমনি। অবস্থায় ধর্মীয় ও জাতীয় স্বাতন্ত্র-প্রবণতা কেবল অকল্যাণই আনবে। স্বাতন্ত্র ও সৌজন্য; স্বার্থ ও সহযোগিতা; ধর্মবোধ ও মানবতা এবং জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধনেই কেবল আজকের মানবিক সমস্যার সমাধান হতে পারে।

আগের যুগের মানবতাবোধ ছিল ব্যক্তি-মানসের উৎকর্ষের ফল। এ যুগে মানবতাবোধ সমাজ-মানসে সংক্রমিত না হলে মানুষের নিস্তার নেই। সংবাদপত্র হচ্ছে গণসংযোগের মাধ্যম। কাজেই মানবতা-প্রচারকের ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে সাংবাদিককেই। স্বার্থ বজায় রেখেও সৌজন্য দেখানো সম্ভব অথবা সৌজন্য বজায় রেখেও স্বার্থসচেতন থাকা যায়–লি মুক্ত স্বার্থে ও সৌজন্যে যে বিরোধ নেই–এ কথা আজ মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ব্যষ্টি নিয়েই সমষ্টি। ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র্য যেমন প্রয়োজন, সামষ্টিক দায়িত্ব এবং কর্তব্যবুদ্ধিও তেমনি আবশ্যিক। আগের মতো ক্ষণিকের উত্তেজনায় কিংবা লিল্লায় আপাত স্বার্থে ধর্ম, জাতি ও রাষ্ট্রের নামে বিরোধের ব্যবধান সৃষ্টি না করে মিলনের মহাময়দান তৈরির ব্রত গ্রহণ করতে হবে সাংবাদিককে। দেশ-ধর্ম বর্ণ নিরপেক্ষ নির্ভেজাল মানবতার বিকাশের সাধনার আজ বড়ো প্রয়োজন। ধর্মীয়, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থচেকে করতে হবে বিশ্বমৈত্রী ও করুণার অনুগত এবং এগুলো রক্ষার ও বৃদ্ধির অনুকূল। আজ সহ-অবস্থান ও সহযোগিতার নীতিই মানবিক সমস্যা সমাধানের দৃষ্টিগ্রাহ্য একমাত্র উপায়।

এ নীতি প্রচারের গুরুদায়িত্ব, এ কঠিন কর্তব্য ও নেতৃত্বের এ অধিকার আজ সংবাদপত্রের। সংবাদপত্রের কাছে বিশ্বের কল্যাণকামী মানুষ মাত্রেরই তাই আজ অনেক প্রত্যাশা।

মুক্তির অন্বেষায়

প্রায় দশলাখ বছর আগে প্রাণিজগতে যখন মনুষ্য শ্রেণীর উদ্ভব, তখন থেকেই হয়তো শুরু হয় মানুষের মুক্তির অন্বেষা। জন্মমুহূর্ত থেকেই শিশু যেমন বুঝবার চেষ্টা করে তার পরিবেশকে, এও ছিল হয়তো তেমনি অবচেতন প্রয়াস। দিন যায়, বর্ষ যায়, এমনি করে বয়ে যায় লক্ষ লক্ষ অব্দ। এক সময়ে তার অবোধ মনে সৃষ্টি হয় বোধের, যেমন শিশু অর্জন করে তার বোধশক্তি।

তার বোধ-বুদ্ধির বিকাশ ছিল মন্থর, কিন্তু বিরামহীন ও প্রবহমান। তার আত্ম-শক্তি-চেতনাও ছিল তার বোধ-বুদ্ধির আনুপাতিক। এবং অজ্ঞতার দরুন সে-শক্তির প্রয়োগ-সামর্থ্য ছিল তার আরো কম। প্রয়োগ-বাঞ্ছাই যোগায় প্রয়াসের প্রেরণা। আবার প্রত্যয়হীন বাঞ্ছও বন্ধ্যা। কাজেই প্রয়োগ-বাঞ্ছার সঙ্গে প্রত্যয় ও প্রয়াসের মেল-বন্ধন না হলে সাফল্য থাকে অনায়ত্ত। আর তেমনি অবস্থায় আসে নিষ্ক্রিয়তা। তখন বুদ্ধি ও শক্তি দুটোই আচ্ছন্ন হয় জড়তায়। শীতকালীন ঔষধির মতো দুটোই আত্মগোপন করে সুপ্তির গহ্বরে।

এমন মানুষ হয় প্রয়াস-বিহীন প্রাপ্তিকামী। তারা পরোপজীবী ও পরনির্ভর। এ রকম মানুষের সংখ্যাই অধিক। তাই মানুষের সংখ্যার অনুপাতে মানুষের কৃতি ও সাফল্য নিতান্ত নগণ্য। চেতনার ও চিন্তার, বুদ্ধির ও কর্মের, প্রয়োগ-বাঞ্ছ ও প্রয়াসের যোগ হয়েছে তেমন মানুষের সংখ্যা যে গোত্রে বেশি, সে-গোত্রের অগ্রগতিও হয়েছে সে অনুপাতে। আর অন্য গোত্রগুলো প্রকৃতির কৃপা জীবী হয়েই রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে।

এ কারণেই মানুষের যা কিছু সাফল্য ও কৃতিত্ব তা গুটিকয় মানুষেরই দান। এই গুটিকয় মানুষের উদ্ভাবনের ও আবিষ্কারের, চিন্তার ও চেতনার ফসলই সাধারণ মানুষের সম্বল ও সম্পদ। এই স্বাচ্ছন্দ্য-সুখেই, এই গৌরব-গর্বেই মানুষ প্রাণিশ্রেষ্ঠ।

সেকালে মানুষের জগৎ ছিল অঞ্চলের দিগন্তে সীমিত। সেজন্যে মানুষের কোনো কৃতিই হতে পারে নি সর্বমানবিক সম্পদ। তাই আজো কেউ রয়েছে আদি অরণ্যচারী, আর কেউ হয়েছে নভোচর।

পরমুখাপেক্ষী মানুষের এই নিষ্ক্রিয়তা কেবল বেদনাদায়কই নয়, সমস্যাপ্রসূও। কেননা এদের চেতনার বিকাশ নেই, নেই সৃষ্টির প্রয়াস। এদের এগুবার আগ্রহ নেই, আছে সুস্থির থাকার বাসনা। তাই নিশ্চিত পুরোনো-প্রীতি আর অনিশ্চিত নতুন-ভীতিতে তাদের মন-মানসের পরিক্রমা অবসিত। আচার-সংস্কারের পরিসরে স্বস্তি খোঁজে তাদের জীবন। স্বাচ্ছন্দ্য-বৃদ্ধির কাক্ষা নিয়ে নতুন সৃষ্টির আগ্রহে অজানার ঝুঁকি নিতে তারা নারাজ। তাই জীবন-সচেতন কর্মী-মনীষীর নব চেতনালব্ধ চিন্তা কিংবা প্রয়াসার্জিত কৃতি গ্রহণেও তারা বিমুখ। তারা কেবলই রুখে দাঁড়ায়, কেবলই পিছু টানে। চেতনায়, চিন্তায় ও কর্মে অগ্রসর মানুষের জীবন তাই দ্বন্দ্ববহুল ও বিঘ্নসঙ্কুল। আজ অবধি মানুষের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের মর্মকথা এ-ই।

এভাবে আশীর্বাদকে অভিশাপ ভেবে তারা যে কেবল নিজেরা ঠকেছে তা নয়, ভাবী মানুষের অগ্রগতিও করেছে ব্যাহত। অতএব, আদিম স্তরে আবদ্ধ আরণ্য-মানুষের কথা তো উঠেই না, এমনকি দুনিয়ার অগ্রসর মানুষের সংস্কৃতি-সভ্যতাও সময় আর সংখ্যার পরিমাপে শোচনীয় ভাবে সামান্য।

যতই মন্থর ও বাধাগ্রস্ত হোক, তবু প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির দাস মানুষের মুক্তি অন্বেষার ও প্রয়াসের একটি প্রবহমান ইতিহাস আছে। সে-ইতিহাস অবশ্যই গুটিকয় চিন্তাশীল ও কর্মীমানুষের চিন্তা ও কর্মের ইতিকথা। এ ভাবে একজনের চিন্তা অন্য সবার সংস্কারে এবং একজনের কর্ম অন্যদের আচারে হয় রূপায়িত ও পরিণত। অতএব, একের চিন্তা ও কর্মের ফসল সমাজবদ্ধ অঞ্চলবাসী গোত্রের মানস ও ব্যবহারিক সংস্কার এবং আচার তথা চেতনা ও জীবিকা-পদ্ধতিরূপে পরিচিত।

প্রমাণে ও অনুমানে জানা যায়, Animism, Magic belief, Totem, Taboo gyfo Pagan ও প্রতীকতার স্তর পার হয়েই ধর্ম-দর্শনের স্তরে উন্নীত হয়েছে মানুষ। এখনো অবশ্য সর্বস্তরের মানুষই মেলে অল্পবিস্তর। এ সব মতবাদ বিশ্বাস-ভিত্তিক। এ বিশ্বাসপ্রসূত ভয়-ভরসা নির্ভর জীবনধারা চলেছে আজো। প্রকৃতির পোষণ ও পীড়ন থেকে মুক্তি-কামনায় মানুষ স্বাধীন ও স্বস্থ জীবনোপায় সন্ধানে বেরিয়ে, ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন স্তর উত্তীর্ণ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আজকে অবস্থায়।

অঞ্চল ও গোত্রে সীমিত জীবনে আচার-সংস্কারের এরূপ ঐক্যমত ছিল সমাজ-বন্ধনের ও সমাজ-শৃঙ্খলা রক্ষার সহায়ক। অভিন্ন মত ও স্বার্থভিত্তিক ঐক্য অন্য অঞ্চলের ভিন্ন গোত্রীয় লোকের আক্রমণ প্রতিরোধের হয়েছিল সহায়ক আর সহজ করেছিল যৌথ প্রচেষ্টায় জীবিকার্জন।

কাজেই একস্তরে গোত্ৰ-চেতনা ও পরবর্তী স্তরে ধর্মীয়-ঐক্য চেতনা ছিল মানুষের আত্মরক্ষার ও আত্মোন্নয়নের সহায়ক। Pagan মত ও ধর্মমতের পার্থক্য এখানে, যে Pagan মতের ভিত্তি হচ্ছে ভয়-বিস্ময়-ভরসা ও কল্পনা। আর ধর্মমত হচ্ছে বিশ্বাসের অঙ্গীকারে যুক্তি ও তাৎপর্যের সমন্বিত রূপ। যে-যুক্তির ভিত্তি জ্ঞানও নয়, প্রজ্ঞাও নয়, কেবলই বিশ্বাস, তা ফুটো পাত্রে জল ধরে রাখার মতো অলীক। সে-যুক্তি প্রমাণ নয়,অনুমান। বিশ্বাস ও যুক্তি এমনিতেই পরস্পর বিপরীত ভাব। বিশ্বাস অন্ধ ও বন্ধ্যা, আর যুক্তি জ্ঞান ও জ্ঞানপ্রসূ। বিশ্বাসের উৎস মানসপ্রবণতাজাত ভাব, আর যুক্তির ভিত্তি বাস্তব প্রমাণ। তাই বিশ্বাসে যুক্তি আরোপ করা পুতুলে চক্ষু বসানোরই নামান্তর।

দুধ শিশুর খাদ্য। শৈশবোত্তর কালে মানুষ সে-খাদ্যে বাঁচে না। তখন অন্য খাদ্য প্রয়োজন। তেমনি Animism থেকে Religion অবধি বিশ্বাস ও ব্যবস্থা সমাজবদ্ধ মানুষের শৈশব-বাল্যের সংস্কৃতি, সভ্যতা কিংবা জীবন-জীবিকার প্রয়োজন মিটিয়েছে। এক বয়সের অবলম্বন অন্য বয়সের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। তাই পুরোনো সবকিছু জীর্ণপত্র ও ছিন্ন বস্ত্রের মতো পরিহার করে নতুনের প্রতিষ্ঠা করেছে মানুষ। কাজেই পুরোনো জীবনবোধ ও রীতিনীতি নতুন মানুষের জীবন যাত্রার অনুকূল নয়। কিন্তু বিশ্বাস-সংস্কারের ব্যাপারে সে পুরোনোকেই শ্রেয় ও সত্য মনে করে। এজন্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে পরিবর্তনকে স্বীকার করে,-পরিবর্তন যে পরিবর্ধনও তা সহজেই মেনে নেয়। কিন্তু তার বিশ্বাস ও আচার সংস্কারের ক্ষেত্রে সে সত্য ও শ্রেয়সের চিরন্তনত্বে আস্থাবান। ব্যবহারিক জীবনের ক্ষেত্রে মানুষ চিরকালই বিনাদ্বিধায় নতুনকে গ্রহণ করেছে, পরম আগ্রহে বরণ করেছে শ্রেয়ঃ-কে। কিন্তু মনোজীবনে তার রয়েছে অচলায়তনের বাধা। সেখানে সে পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কারের অনুবর্তনে আশ্বস্ত থাকে–আয়ত্তগত সংকীর্ণ চেতনার পরিসরে সে যেন খুঁজে পায় নিজেকে–এতেই তার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য। তাই নিষ্ক্রমণের সিংহদ্বার খুলে দিয়ে বাইরের উদার আকাশের আলো-হাওয়ায় কেউ আহ্বান জানালেও বের হতে সাহস পায় না সে। পাছে অনিশ্চিত অজানায় বেঘোরে মরতে হয়–এই তার ভয়। চিন্তনে ও সৃজনে সে নিষ্ক্রিয় বলেই সে বিবেচনা শক্তিহীন, সে গোঁড়া; সে রক্ষণশীল। তার নতুন-ভীতি ও পুরোনো-প্রীতির এই কারণ।

বলেছি গুটিকয় লোক ছাড়া আর সব পরচিন্তা ও পরসৃষ্টিজীবী। বিরূপ সংখ্যাগরিষ্ঠের বিমুখতার ফলে মনুষ্য-সমাজের অগ্রগতি ছিল নিতান্ত মন্থর এবং সময় সময় হয়েছে ব্যাহত।

যেহেতু পুরোনোর অপর নাম জরা ও জীর্ণতা, আর নতুন-মাত্রই জীবন ও শক্তির প্রতীক; সেহেতু নতুনকে শেষ অবধি ঠেকিয়ে রাখা যায় না যায়নি। কেননা বন্যা বাঁধ মানে না। তাই সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করেই এগিয়েছে সংস্কৃতি ও সভ্যতা,–ভাব-চিন্তার হয়েছে বিকাশ ও বিস্তার। কিন্তু তবু তার উত্তরণ ঘটেনি যুগের তোরণে। কেননা, কোনো বিকাশই হতে পায়নি সর্বাত্মক ও সর্বমানবিক। আজকের মানুষের বারো আনা দুঃখই এ পিছিয়ে-পড়া মানুষের মানস মুক্তির অভাব প্রসূত। সব মানুষের মনে যতদিন জ্ঞান-প্রজ্ঞাজ যুক্তির জন্ম না হবে, ততদিন সমাধান নেই মানবিক সমস্যার।

আদিম মানুষের জীবনবোধ ছিল অবিকশিত। তার জৈবিক চাহিদা ছিল সীমিত। জীবন ছিল আঞ্চলিক। জীবিকা ছিল পরিবেষ্টনীগত। তাই গোত্রীয় ঐক্যই ছিল নিদ্বন্দ্ব-নির্বিঘ্ন জীবন ও জীবিকার দৃষ্টিগ্রাহ্য উপায়। প্রকৃতি ও পরিবেষ্টনীর অনুগত জীবনে তাই বিবেচিত হয়েছিল শ্রেয়। বলে। কথায় বলে, Necessity is the mother of invention, এই প্রয়োজন-বুদ্ধিই উপযোগ সৃষ্টির যুগিয়েছে প্রেরণা। পূজ্যের অভিন্নতা পূজারীকে করেছে ঐক্যবদ্ধ। Fatherhood of deity, brotherhood of men-তত্ত্বে দিয়েছে প্রেরণা ও প্রবর্তনা। সেদিন সে-অবস্থায় এর থেকে কল্যাণকর আর কিছুই হতে পারত না হয়তো। উপযোগবুদ্ধিজাত এই ঐক্য জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে দিয়েছে যৌথ প্রয়াসের সুযোগ দিয়েছে নিরাপত্তার আশ্বাস ও আত্মপ্রসারের প্রেরণা।

তারপর ক্রমে জীবনবোধ হয়েছে প্রসারিত। প্রয়োজনবোধ হয়েছে বিচিত্র। জনসংখ্যা গেছে বেড়ে। জীবিকা হয়েছে দুর্লভ। তখন সীমিত অঞ্চল ও গোত্রগত জীবন আর অনুকূল থাকেনি জীবিকার। সে-সময় প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক গোত্রের সংহতি ও সহযোগিতা, কিন্তু সে কল্যাণবুদ্ধি জাগেনি জনমনে। তাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হল গোত্রে গোত্রে ও অঞ্চলে অঞ্চলে। তখন আত্মসংকোচন ও স্বাতন্ত্র-বুদ্ধিই আত্মরক্ষার উপায় রূপে হল বিবেচিত। বাহুবলই হল টিকে থাকার সম্বল। তখন জোর যার মুলুক তার। তখন বসুন্ধরা বীরভোগ্যা। তখন শক্তিমানের উদ্বর্তনই প্রমাণিত তত্ত্ব ও তথ্য। তখন আত্মরতি আর পরপীড়নই মনুষ্যধর্ম। তখন অসূয়া ও বিদ্বেষেই নিহিত ছিল বাঁচার প্রেরণা। স্বমতের ও স্বগোত্রের না হলেই শত্রু। এবং শত্রুর বিনাশ সাধনই ছিল নিজের বাঁচার উপায়। সহ-অবস্থান তত্ত্ব ছিল অজ্ঞাত।

জ্ঞানী-মনীষীরা নব-উদ্ভূত সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন নানাভাবে। কিন্তু জনগণের অবোধ্য উপায় কাজে লাগেনি বিশেষ। তাই আজো জটিলতর হয়েই চলেছে সমস্যা। কেননা জীবনবোধ প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের চাহিদা বেড়েই চলেছে, অথচ প্রয়োজন মিটানোর সদুপায়-চিন্তা আজো ঠাই পাচ্ছে না জনমনে। আজকের সংহত পৃথিবীতে সংহতি, সহ-অবস্থান ও সহযোগিতা যে দরকার, তা তারা যেন কোনো রকমেই চিন্তাগ্রাহ্য করে উঠতে পারছে না। কেননা, তারা চিন্তা করে না। তাই তাদের পিতৃ-পুরুষদের মতোই প্রতাপকেই তারা সত্য বলে জানে। প্রভাবের গুরুত্ব আজো অস্বীকৃত। অথচ প্রতাপে নয়, মানুষ বেঁচে থাকে প্রভাবের মধ্যেই। প্রতাপ দূরে সরায়, আর প্রভাব টানে কাছে। নিজের প্রভাব যে যতটুকু অন্যমনে সঞ্চারিত ও বিস্তৃত করতে পারে–তার অস্তিত্ব ততটুকুই। প্রতাপ নেতিবাচক, প্রভাব ইতিসূচক। কেননা, প্রতাপের প্রকাশ পীড়নে, আর প্রভাবের ফল প্রীতি।

আজকের দিনেও মানুষ আঁকড়ে ধরে রয়েছে তার পূর্বপুরুষ-শিশুমানবের বিশ্বাস সংস্কার ভিত্তিক আচারিক ধর্ম ও ধর্মবোধকে। এবং গোত্রীয় চেতনারই আর এক রূপ–স্বাধার্মিক ও স্বাদেশিক জাতীয়তা মানুষের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। আদিকালের এই জীর্ণ ও জড় আচারিক ধর্মের নিগড় ও স্বাগোত্রিক মোহ থেকে অন্তত অধিকাংশ মানুষ মুক্ত না হলে, কল্যাণ নেই আজকের মানুষের। স্বাধর্ম ও স্বাজাত্য-চেতনা স্বাতন্ত্রের দেয়াল তুলে রোজই যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে বিরোধের ব্যবধান। দেশ-জাত-ধর্ম অস্বীকারের ভিত্তিতে, নিবর্ণ মনুষ্য–সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকারে সংহতি, সহযোগিতা ও সহ-অবস্থান নীতির প্রয়োগে একালের মানবিক সমস্যার সমাধান সম্ভব।

ব্যষ্টি ও সমষ্টি, পরিবার ও সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রসঙ্, জাতি ও জাতিসঙ্, স্বাতন্ত্র ও সদ্ভাব, সহিষ্ণুতা ও সহানুভূতি, প্রতাপ ও প্রভাব, বিদ্বেষ ও প্রীতি, অসূয়া ও অনুরাগ, স্বার্থ ও সৌজন্য প্রভৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে বিশ্বমানবের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজকের কল্যাণকামী মানুষের প্রয়াস হবে To convert hostility into negotiation, bloody violence into politics and hate into reconciliation.S

আশ্চর্য এই যে মানুষ প্রকৃতি-বশ্যতা থেকে মুক্তি-বাঞ্ছায় সংগ্রাম শুরু করে মনের জোরে। মনই ছিল তার শক্তির উৎস,–তার ভরসার আশ্রয়,–প্রাণিজগতে তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। যে মনের সৈনাপত্যে তার এই মুক্তি-অন্বেষা, সেই মনই কোন্ সময়ে বিশ্বাস-সংস্কারের দাসত্ব স্বীকার করে তাকে করেছে প্রতারিত! এভাবে মন নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে বিশ্বাস-সংস্কারের কাছে, আর মানুষ নিজেকে বন্ধক রেখেছে মনের কাছে। এজন্যে মানুষের মুক্তি-অন্বেষা সফল হয়নি–সার্থক হয়নি তার প্রয়াস।

তাই মুক্তি আজো দৃষ্টিসীমার বাইরে। যদিও মানুষ তার প্রাথমিক ব্রতে সফল হয়েছে– কেননা প্রকৃতি আজ তার প্রভু নয়, দাস– কিন্তু অভাবিত রূপে সে যার দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ হয়েছে, তাকে সে শত্রু বলেও জানে না। এবং শত্রু না চিনলে সংগ্রাম চলে না,–সতর্কতাও হয় ব্যর্থ। তেমন অবস্থায় আত্মরক্ষা করা অসম্ভব। আজ মানুষ তেমন এক মিত্ৰকল্প শত্রুর কবলে আত্মসমর্পণ করে আশ্বস্ত। জ্ঞান-বুদ্ধি-যুক্তিকে সে এই মিত্রকল্প শত্রু–বিশ্বাস-সংস্কারের অনুগত করে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। খাঁচায় পোষা পাখির মতো সে মিথ্যা সুখে প্রবঞ্চিত। তার আত্মা যে অবরুদ্ধ, তার আত্মবিকাশের অসীম সম্ভাবনা যে বিনষ্ট, তা সে অনুভবও করে না। তার রক্ষক বিশ্বাস-সংস্কার যে তাকে গ্রাস করছে, তা সে মানে না। অজগরের দৃষ্টিমুগ্ধ শিকারের মতো তার অভিভূত চেতনা তাকে প্রতারিত করছে। তার বিমুগ্ধ আত্মা ফাঁদের চুম্বক আকর্ষণে ব্যাকুল। তাই তার মনে চেতনা-সঞ্চার করা কঠিন।

মানুষ মাত্রেই শান্তি ও কল্যাণকামী। কিন্তু শান্তি ও কল্যাণের পথ চেনা নেই বলেই তারা শান্তির নামে ঘটায় অশান্তি, কল্যাণ কামনায় ডেকে আনে অকল্যাণ; প্রীতির নামে জাগায় গোষ্ঠী চেতনা। তাই আচারিক ধর্মানুগত্য ও উগ্রজাতীয়তাবোধই মানবপ্রীতি ও মানবতাবোধ বিকাশের বড়ো বাধা,–আজকের মানব-সমস্যার মূল কারণ। প্রীতি বিনিময়ে কারো অনীহা নেই–এ বিশ্বাসে আমরা মানুষ অবিশেষকে আহ্বান জানাই,–সংস্কারমুক্ত চেতনা, চিন্তা ও বুদ্ধি দিয়ে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে। কামনা করি, বিবেক ও যুক্তি তাদের দিশারী হোক। কৃত্রিম আচারিক ধর্ম ও উগ্রজাতীয়তা পরিহার করে তারা বিবেকের ধর্মে ও মানুষের অভিন্ন জাতীয়তায় আস্থা রাখুক। তাদের চিত্তলোকে প্রীতি ও সহিষ্ণুতার চাষ হোক, সেই ফসলে তাদের চিত্তলোক ভরে উঠুক। মানবতাই মানব ধর্ম–এ বোধের অনুগত হোক তাদের চিন্তা ও কর্ম। মুক্তি অন্বেষ্টা মানুষের মুক্তির অন্বেষা সফল ও সার্থক হোক।

মোহিতলালের কাব্যের মূল সুর

বাঙলা দেশে রবীন্দ্রযুগে যত কবি আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের উপর রবীন্দ্রনাথের কিছু-না কিছু প্রভাব রয়েছে, তবে তাঁদের স্বকীয় বিশেষত্বও কিছু যে না আছে তেমন নয়। বস্তুত অল্পবিস্তর প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাব-চিন্তা ও প্রকাশের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রকট, তারা হচ্ছেন–অক্ষয়কুমার বড়াল, দেবেন্দ্রনাথ সেন, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন।

এঁদের মধ্যে আবার মোহিত মজুমদার ক্লাসিকধর্মী বলে, যতীন্দ্রনাথ নতুন জীবন-দৃষ্টির জন্যে, কাজী নজরুল নতুন ভাব-চিন্তা-আদর্শ ও আঙ্গিকের প্রবর্তক হিসেবে এবং জসীমউদ্দীন প্রাচীন পল্লী-সাহিত্য ধারার অনুসারীরূপে বিশেষভাবে খ্যাতিমান।

মোহিত মজুমদার ক্লাসিকধর্মী হলেও তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাষা এবং য়ুরোপীয় ভাবাদর্শের প্রভাব কম নয়, তবু তাঁর একটা নিজস্ব ভাবলোক, মতপথ এবং গতি ও ভঙ্গি রয়েছে, যা অন্যত্র সুদুর্লভ। তাই তিনি অনন্য ও তাঁর কবিতা বিশিষ্ট। তাঁর কাব্যে সবচেয়ে যে বস্তুটা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে কাব্যের আঙ্গিক বা কবিতার Diction. শব্দ চয়নে আভিজাত্য, ছন্দে গাম্ভীর্য ও লালিত্য, ভাবাদর্শের অনন্যতা, প্রকাশ-ভঙ্গির-বৈশিষ্ট্য ও সংযম তাঁর কাব্যকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এককথায় মোহিতলালের কাব্য Classical in form আর Romantic in Spirit.

কবি আদর্শবাদী ও শিল্পী। তাঁর কাব্যে ব্যবহারিক জীবনের রোগ-শোক, জরা-মৃত্যু-ব্যথা, অথবা নিজের বা মনুষ্য-সাধারণের দৈনন্দিন জীবনের আনন্দ-বেদনা, অভাব-অনটন, অত্যাচার নিপীড়নের কাহিনী স্থান পায়নি–কারণ তাঁর মতে:

জীবন যাহার অতি দুর্বহ, দীন দুর্বল সবি,
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ সেই জন বটে কবি।

অতএব তাঁর কাব্য-প্রেরণার উৎস–ব্যবহারিক জীবন কিংবা মনুষ্য-সাধারণ নয়। তাঁর কাব্যে কোথাও বৈষয়িক জীবন-চেতনার অভিব্যক্তি নেই। কবি রসাদর্শের (art for arts sake) অনুসারী। তাঁর ভাব-চিন্তার ধারা তন্ময় নয়–মন্ময়। ব্যবহারিক জীবনে সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা ও কলকোলাহলের ঊর্ধ্বে মনোময় কল্পজগৎ সৃষ্টি করে তাতে তিনি বিহার করেন। বাস্তব জীবনকে আড়াল করে স্বপ্নের স্বর্গলোকে কামনার কামিনী-সাধনায় তার শিল্পীমন পরিতৃপ্তি খোঁজে। তাঁর নিজের কথায়:

১. এ হৃদয়ে আজো তাই রহিয়াছে অমৃতের তৃষ্ণা।…
… সকল কল্লোল মাঝে নীরব নিকুঞ্জ গড়ি করিতেছে নিভৃত কূজন।
—(উৎসর্গ–স্বপন পসারী)

২.  যে স্বপন তুমি দেখিয়াছ রাতে–
মনে নাই যাহা জাগিয়া প্রাতে,
তবু আঁকা আছে হৃদয়ের পাতে
জল-রেখা রঙ্গিলা–
সেই জলছবি ফুটাইবে কবি।
–অপরূপ সেই লীলা।
আনন্দ ধন-রস-সরসিত,
দিবসের জ্বালাহরা
ঘুচে যাবে খেদ, যত ভেদ-ভয়,
কায়া আর ছায়াবৃথা সংশয়,
স্বর্গ হইবে ধরা। (স্বপন পসারী)

৩. ভুলের ফুলের মোহন মালিকা
গাঁথিয়াছে হের স্বপ্ন বালিকা।
যে বীণা বাজাতে আলো-নীহারিকা
ছায়া পথে যায় থামি–
তারি সুরে হেঁকে পথ চলি ডেকে।
স্বপন-পসারী আমি। (স্বপন পসারী)

৪। যত ব্যথা পাই, তত গান গাই–গাঁথি যে সুরের মালা!
ওগো সুন্দর! নয়নে আমার নীল কাজলের জ্বালা!
আঁখি অনিমিখ, মেটে না পিপসা, এ দেহ দহিতে চাই!
সুখ-দুঃখ ভুলে যাই। (ব্যথার আরতি)

৫. দেহী আমি, মন্দিরে মন্দিরে তাই পরশ ভিখারী,
…. পরশ-রসিক আমি, অন্ধ আঁখি তারা
আমার আকাশ তাই শশী সূর্য হারা।
পদতলে পৃথ্বি আছে আলিঙ্গনে চৌদিকে বিথারি–
আলো নাই, আছে শুধু প্রাণের আরাম। (স্পর্শ রসিক)

৬. ঘোমটা-পরা মিথ্যাময়ী সেই যে আমার সর্বজয়ী!
জনমকালে কখন সে যে জড়িয়েছিল কণ্ঠহারে–
একটি চুমায় বন্ধ করে রাখল প্রাণের নিশানটারে! (অ-মানুষ)

৭. সুখ-দুঃখের বিলাস-বাঁশরী তানে,
সুর দিব আমি হাস্য-অশ্রু-গানে,
ফুটাব ঝরাব ফুল-পল্লব বারোমাস। (মৃত্যু)

৮. রূপ-মধু সৌরভের স্বপন সাধনা
করিনু মাধবী মাসে; ইন্দ্রিয় গীতায়
রচিনু তনুর স্মৃতি। (ফুল ও পাখী)।

তাঁর এই কল্পলোকে তিনি যে রস পান করেন–তা এ জগতে দুর্লভ। এই ভাব-সর্বস্ব কল্পলোকাশ্রয়ীদের সুবিধে এই যে, এখানে জীবন সংঘাতমুখী নয়–একেবারে নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন।

মোহিতলালের অনুভূতির সে-জগৎ প্রশস্ত নয়। তাই সেখানে তাঁর জীবন-লীলায় বৈচিত্র্য বিরল। নানা ভাবে, নানা ধারায় জীবনকে উপলব্ধি করবার প্রয়াস তাতে অনুপস্থিত। তাঁর প্রাণও উচ্ছল নয়–এ জন্যে তাঁর ভাবাবেগে উদ্দামতা নেই, তবে তাঁর অনুভূতি তীক্ষ্ণ ও গভীর। এ কারণে কবি সর্বত্র সংযতবাক ও গম্ভীর। আঙ্গিকের আভিজাত্য, বাভঙ্গির গাম্ভীর্য, অনুভূতির অনুচ্ছলতা, মননশীলতা প্রভৃতি তাঁর কাব্যমাধুর্যকে ফল্গুধারার মতো গুপ্ত ও মন্দ-প্রবাহিণী করে রেখেছে। ঊর্মিমুখর স্রোতস্বিনী করে তোলেনি। ফলে তাঁর কাব্যে শুধু বিশেষের অধিকার আছে, তার দুর্গম কাব্যবীথি সাধারণের জন্যে দুরতিক্ৰমণীয়। এসব কারণে উঁচুদরের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাঁর কবিখ্যাতি সাধারণ্যে বিস্তৃত হয়নি। কবিও এ ব্যাপারে সচেতন : তিনিও বলেছেন,-I shall dine late but the dining room will be well lighted, the guests few and select.

কবি কল্পলোকে যে পিপাসা নিয়ে বিচরণ করেন, সে পিপাসা হচ্ছে–রূপ ও প্রণয় পিয়াস। কবি উপলব্ধি করেছেন–দেহে রূপ, রূপে প্রণয় এবং প্রণয়ে সম্ভোগ লিপ্সা জাগে। অতএব, রূপ। প্রণয় ক্ষুধা চরিতার্থতা লাভ করতে পারে একমাত্র দেহকে অবলম্বন করেই। এই দেহ-কেন্দ্রী রূপ ও প্রণয় সাধনাই হচ্ছে তার প্রথম দিককার কাব্যের মূল সুর।

যে রূপের পিপাসায় প্রেম হল জীবন অধিক (প্রেম ও জীবন)

এ ব্যাপারে মোহিতলাল কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের ভাবশিষ্য। দেবেন্দ্রনাথের সাধনাও ছিল রূপ সাধনা। তবে তিনি প্রধানত নিসর্গ রূপপিয়াসী।

চিরদিন চিরদিন।
রূপের পূজারী আমিরূপের পূজারী।

মোহিতলালও বলেছেন–আমি কবি অন্তহীন রূপের পূজারী।

কবি-চিত্তে রূপের পিপাসা–রূপ আগে পরে ভালবাসা (রতি ও আরতি)। Taso বলেছেন, That thou art beautiful and I am not blind; মানে, তোমার রূপ আছে আমারও আছে পিপাসা। রবীন্দ্রনাথের কথায় : ও রূপের কাছে এ ক্ষুধা তাই চিরদিন জাগিয়া রবে। Keats-8 657676901-A thing of beauty is a joy forever. মোহিতলাল মননশীল, তাই তিনি মানস রূপের পূজারী :

যেই আমি আমা হতে মুক্তি চাই কল্পনার নিশীথ স্বপনে,
সেই আমি বাঁধি পুন আপনারে চেতনার জাগ্রত ভুবনে।
আমারি ঐশ্বর্য তাই হেরি আমি তার দেহ মাঝে,
তাই সে সুন্দর হেন, সাজিয়াছে মোর দেওয়া ফুল্লফুল সাজে। (রতি ও আরতি)

মোহিতলালের সাধনায় তিনটি স্পষ্ট স্তর রয়েছে। স্বপন পসারী-বিস্মরণী স্তর, স্মরগরলের স্তর এবং হেমন্ত গোধূলির স্তর। স্বপন পসারীতে উন্মেষ, স্মরগরলে পূর্ণ বিকাশ এবং হেমন্ত গোধূলিতে অবসান। প্রথম স্তরকে রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমলের যুগের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরকে মানসীর সঙ্গে মিলানো যায় না। কারণ মানসীর নিষ্ফল কামনা ও সুরদাসের প্রার্থনায় কবির দেহ-সম্ভোগ লিপ্সার ইতি ঘটেছে এবং অনন্ত প্রেম কবিতায় প্রেমের বিকাশ, বিস্তার ও চরম পরিণতি সম্বন্ধে অপরূপ উপলব্ধি রয়েছে।

কবি বুঝে নিয়েছেন–

ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব
কেহ নহে তোমার আমার।

এবং

আকাক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের। (নিষ্ফল কামনা)

আরো উপলব্ধি করেছেন :

বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার চিরকাল রবে সে কি
ক্রমে ধীরে ধরে নিবিড় তিমিরে ফুটিয়া উঠিবে নাকি
পবিত্র মুখ, মধুর মূর্তি স্নিগ্ধ আনত আঁখি?
হৃদয় আকাশে থাক না জাগিয়া দেহহীন তব জ্যোতি।
তোমাতে হেরিব আমার দেবতা হেরিব আমার হরি
তোমার আলোকে জাগিয়া রহিক অনন্ত বিভাবরী। (সুরদাসের প্রার্থনা)

এ উপলব্ধির চরম বিকাশ অনন্ত প্রেম কবিতায় :

তোমারেই আমি বাসিয়াছি ভাল শতযুগে শতবার
যুগে জনমে জনমে অনিবার।
আমরা দুজন করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
আজ সেই চির দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে।
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।

এর পরে রবীন্দ্রনাথ এক অশরীরী রূপ-সৌন্দর্যকে ভালবেসে প্রণয়-ক্ষুধায় চরিতার্থতা লাভ করেছেন। মোহিতলাল কিন্তু এই মার্গে পৌঁছতে পারেননি। তিনি স্বপনপসারী ও বিস্মরণীতে দেহ সম্ভোগে রূপ-সৌন্দর্য-প্রণয় পিপাসা মেটাতে চেয়েছেন। অবশ্য ভাবের ঘোরে ধ্যানের চোখে কায়া কখনো কখনো ছায়াতে এবং মায়াতে মিলিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের রাহুর প্রেম-এ যে প্রবৃত্তি বেগ প্রকাশ পেয়েছে, এ স্তরে মোহিতলালও প্রায় সেই আবেগে চঞ্চল এবং লিপ্সায় মুখর। তার কয়েকটি অভিব্যক্তি :

১. কনক-কমল রূপে প্রেম যদি ফুটি উঠে
তবেই আমার মানস-মরাল অলস পক্ষপুটে
চকিতে জাগিয়া উঠে। (রূপতান্ত্রিক)

২. আমার দেবতা–সুন্দর সে যে!
পূজা নয়, ভালোবাসি!
সুন্দর লাগি ভালোবাসা মোর,
অন্তর আঁখি ফুটে!–(রূপতান্ত্রিক)

৩. থাক্ তোলা আলবোলা পেয়ালায় মুখ ধর!
চেয়ে দেখ মন-ভোলা দুনিয়া কি সুন্দর! (দিলদার)

৪. দিকে দিকে প্রিয়ারি পিরীতি।
উথলিছে লাবণ্যের মত! সে মিলন
অহরহ কোথা নাই বিরহ কল্পনা!…
আলোক আঁধারে দ্বন্দ্ব।
ঘুচে গেল মানবেরি পিপাসার সাথে। (পুরূরবা)

৫. রানীর মুকুটখানির কথা প্রেমির মনে জাগে
নারীর পূজার তরেই সে যে রাজার বিভব মাগে। (নারী)

৬. রস–সে যে রূপে পড়িয়াছে ধরা, কোথা নহে নিরাকার,
অরূপ রূপের উপাসনা–সে যে অন্ধের অনাচার! (একখানি চিত্র দেখিয়া)

৭. পাপের লাগিয়া ফুটিয়াছে হেন অতুল অবনী ফুল (প্রেম)?
রসে রূপে আর সৌরভে যার চরাচর সমাকুল!
পরতে পরতে দলে দলে যার অমৃত পরাগ ভরা–
মধুহীন যারে করিবারে নারে শোক তাপ ব্যাধি জরা। (পাপ)

৮. নীল ফুলে ভরা কুঞ্জ বিতানে।
চেয়ে আছি আমি কার মুখপানে
হয়ে গেছি ভোর রূপ সুধা পানে,
চেয়ে আছি অনিমেষ…
রূপের প্রভায় ঝলসে নয়ন
সীমা নাই, সীমা নাই।…
সেতো নহে শুধু দেহ বিভঙ্গ
কালো আঁখি আর কেশ তরঙ্গ,
বিষ অধরে মুকুতা সঙ্গ,
সে যে সবই রূপ! সে যে অনঙ্গ
দিব্য আলোক বিভা। (পূর্ণিমা স্বপ্ন)

৯. সৃষ্টি হতে এতকাল এই যে পীড়ন–
এত কালি, এত ধূলা এত পাপ তাপে,
তবু কি মরেছি আমি? নবীন জীবন।
জন্মে জন্মে লভিয়াছি প্রেমের প্রতাপে। (ভ্রান্তি বিলাস)

১০. মধু সৌরভ-সৌরভ মধু। মধু আর শুধু মধু,
আপনারি প্রাণ দুইখানি হয়ে হল বর হল বধূ!
পাপড়ি কি পাখা চেনা নাহি যায়, কার মধু
নাহি গুঞ্জন, শুধু সুধা পান শুধু সুখ! (আঁধারের লেখা)

১১. আকাশের তারা যেমন জ্বলিছে জ্বলুক
অসীম রাতি,
ওর পানে চেয়ে ভয়ে মরে যাই, চাহি না
অমৃত ভাতি।
ধরার কুসুম বার বার হাসে, বার বার কেঁদে
আঁধারে আলোকে শিশিরে কিরণে আমি
হব তার সাথী। (কামনা)

এখানে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। তিনিও ভালবাসি নারী নরে, ভালবাসি চরাচরে সুখ পেতে চেয়েছেন এই হাসি-অশ্রুময় ধরণীতে। তিনিও স্বর্গের অনন্ত সুখ ভীরু!স্বরগে অন্ অনন্ত সুখ! ওহো, এ কি যাতনা!

১২. আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী অপ্সরী সঙ্গোপনে!
সেথা সুখ নাই, দুঃখ নাই সেথা
–দিবা কি নিশা।
গানেরি আড়ালে সাড়া দেয় শুধু সে অমরা
বাহির ভুবনে এই বাহু পাশে দিবে না ধরা। (বিস্মরণী)

১৩. আমারে করেছে অন্ধ গন্ধ ধূমে দেহ-ধূপধার,
মাদক সৌরভে তার চেতনা হারায়।
বিষরস পান করি স্বাদ পাই স্বরগ সুধার,
চির বন্দী আছি তাই স্বপ্ন কারায়। (স্পর্শ রসিক)

১৪. দেহ ভরি কর পান কবোষ্ণ এ প্রাণের মদিরা
ধূলা মাখি খুঁড়ি লও কামনার কাঁচমণি হীরা।
অন্ন খুঁটি লব মোরা কাঙালের মত
ধরণীর স্তন যুগ করে দিব ক্ষত।
নিঃশেষ শোষণে, ক্ষুধাতুর দশন-আঘাতের করিব
জর্জর–আমরা বর্বর।
ওরে মূঢ়! জ্বেলে নে রে দেহ-দীপে স্নেহ
ভালোবাসা নব জন্ম আশা (মোহমুদার)

১৫. দেহে মোর আকণ্ঠ পিপাসা। ……. নিষ্ফল কামনা
মোরে করিয়াছে কল্প সহচর
সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি
মিথ্যা সনাতনী।
সত্যেরে চাহি না তব, সুন্দরের করি আরাধনা।
জানিতে চাহি না আমি কামনার শেষ কোথা আছে।
ব্যথায় বিবশ, তবু হোম করি জ্বালি কামানল!
এ দেহ ইন্ধন তায়–সেই সুখ।
চিনি বটে যৌবনের প্রেম দেবতারে,
নারীরূপা প্রকৃতিরে ভালবেসে বক্ষে লই টানি,
রহস্যময়ী স্বপ্ন সখী চির অচেনারে
মনে হয় চিনি যেন–এ বিশ্বের সেই ঠাকুরানী। (পান্থ)

১৬. সেই রূপ ধ্যান করি অঙ্গে মোর জাগিল
যে স্কুরৎ কদম্ব শিহরণ।
দেহ হতে দেহান্তরে বাধিলাম কি সহজে প্রীতি
প্রেম সেতুর বন্ধন।
পাপ-মোহ-লালসার লাল নীল রশ্মিমালা বরতনু
ঘেরিয়া তোমারি
লাবণ্যের ইন্দ্র ধনু শোভা ধরে–নাই জ্বালা,
মুগ্ধ হনু আনন্দে নেহারি। [অকাল সন্ধ্যা

১৭. ভালো যারা বাসে তারাই চিনেছে,
তুমি আঁকিয়াছ তারে–
সে দিনের সেই তরুণীরে নয়–নিখিলের
বনিতারে।
যার তনু ঘেরি, আরতি করিল শরতের
আলোছায়া–
মানস বনের মাধবী সে হল? ফাগুনের ফুল
কায়া! (মাধবী)।

১৮. বধূও জননী পিপাসা মিটায় দ্বিধাহারা–
রাধা ও ম্যাডোনা একাকারা!
অধরে মদিরা, নয়নে নবনী,
একি অপরূপ রূপের লাবণী।
সুন্দর! তব একি ভোগবতী
মরম পরশী রসধারা। (বাধন)

১৯. (হে দেহ) হাসি ক্রন্দন তব উৎসব!
পিরীতির পারাবার
অধরে, উরসে, চরণ সরোজে
আরতি যে অনিবার। (মৃত্যুশোক)

২০. রূপের আরতি করিনু আঁধারে।
আবেশে নয়ন মুছি–
হেরি দেহে মনে বাধা নাই আর,
–উদ্বেল অম্বুধি! (বিস্মরণী)

স্মরগরলে কবি বুঝেছেন : শুধু দেহে ও রূপে এ ক্ষুধা মিটবার নয়, যেন দেহাতীত এমন কিছু আছে যা সত্যিকার তৃপ্তি–নিবৃত্তি দিতে পারে, কিন্তু তা কি তিনি স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন নি!

বুঝি না, দোহার মাঝে কেবা নিদ্রা যায়,
কেবা জাগে কার চেতনা হরিয়া। (রূপ মোহ)

দেহ ও দেহস্থিত আত্মাকেও তিনি এক বলে উপলব্ধি করেছেন :

দেহের মাঝে আত্মা রাজে–
ভুল সে কথা, হয় প্রমাণ,
আত্মা-দেহ ভিন্ন কেহ
নয় যে কভু এক সমান। (পরমক্ষণ)

তিনি এই জীবনকে এবং যৌবন-ধর্মের স্বাভাবিক চাহিদা রূপ-দেহ-প্রণয়-সম্ভোগকে অস্বীকার করেননি। তিনি একান্তভাবে, জীবনধর্মী বলেই মৃত্যুর পরপারে আর জীবনের–চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। মৃত্যু তাঁর নিকট অন্ধকার ও ধ্বংসের প্রতীক। তাই বলে তাঁর এই রূপ-প্রণয়ের সাধনাকে কামজ মনে করবার হেতু নেই। একে তো তিনি দেহাতীত ও রূপাতীত সৌন্দর্য এবং সম্ভোগ বাসনাকে স্বীকার করেছেন, অধিকন্তু তাঁর রূপ ও প্রণয় পিপাসার মধ্যে এমন এক তীব্র ও গভীর অনুভূতি, এমন এক অনন্য সৌন্দর্য দৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে, যা ভূমির হয়েও ভূম্যেতর। এই প্রকার রূপ-সৌন্দর্য পিপাসা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–যারা সৌন্দর্যের মধ্যে সত্যি সত্যি নিমগ্ন হতে অক্ষম, তারাই সৌন্দর্যকে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের ধন বলে অবজ্ঞা করে–কিন্তু এর মধ্যে সে অনির্বচনীয় গভীরতা আছে, তার আস্বাদ যারা পেয়েছে, তারা জানে সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ান্ত শক্তিরও অতীত–কেবল চক্ষু কর্ণ দূরে থাক, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না।–(ছিন্নপত্র)

এই উক্তি মোহিতলাল সম্বন্ধে সর্বৈব প্রযোজ্য। এমনিতর ব্যাকুলতাই তার কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে। এ স্তরে তিনি জেনেছেন দেহে রূপ, রূপে রতি ও কামে প্রেম জন্মায়। সে প্রেম। সম্ভোগলিন্দু নয়, একপ্রকার মানসোপভোগই কাম্য। তখন দৈহিক রূপ সৌন্দর্যানুধ্যানের সোপান কিংবা অবলম্বন মাত্র।

এ বোধে উত্তরণের পর মোহিতলাল যথার্থই শিল্পী–নিষ্কাম সৌন্দর্যের সাধক। কিন্তু তাতেও যেন কোথায় অতৃপ্তির বেদনা জেগে থাকে। যেন কামে-প্রেমে একটা দ্বন্দ্ব, রূপে-অপরূপে যেন টানাটানি–একটা আলো-আঁধারি কিংবা কায়া-ছায়ার মায়াপ্রপঞ্চ তাঁকে অস্থির ও উদ্বিগ্ন রাখছে। তবু স্বীকার করতে হয় Byron-এর মতো উচ্ছলতা, Shelley-র মতো উদ্দামতা এবং Keats-এর মতো আকুলতা তার নেই। তবে Keats যেমন বুঝেছেন–

Heard melodies are sweet
But those unheard are sweeter

তেমনি মোহিতলালও উপলব্ধি করেছেন–এই যৌবন এই রূপ এই দেহ সত্য হলেও স্বপ্ন এবং রূপের আরতি সুন্দরতর।

বল দেখি, কমলের বঁধূ অলি, না সে ওই আকাশের রবি?
রূপ যে স্বপ্ন তারকামনার ধন নয় বাসনার ছবি।
রূপসীরে করে পূজা, প্রেয়সীরে ভালবাসে কবি।
রূপ নহে সেই রস, রতি নয় সে শুধু আরতি,
মনের নিশীথে সে যে চিত্তাকাশে অপরূপ জ্যোতি।
সে তো নহে ভোগ প্রয়োজন,
সে নয়, প্রাণের ক্ষুধা প্রেম নয়, সে তো দেহ পদ্মে মধু আস্বাদন।
উঁহু দোঁহা ভুঞ্জে শুধু, দুই আমি এক আমি হয়,
আত্মরস রসাতলে স্বর্গ-মর্ত নিখিলের লয়! (রতি ও আরতি)

এইরূপে মোহিতলালের সকাম রূপপিপাসা ও প্রণয়ক্ষুধা নিষ্কাম বিদেহ রূপ সাধনার আভাস দিয়ে থেকে গেছে; তা রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে জগতের গিরি নদী সকলের শেষে কামনার মোক্ষধাম অলকার তীরে পৌঁছতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ যেমন রূপসাগরে ডুব দিয়েছেন অরূপরতন আশা করি, তেমনি আশ্বাস মোহিতলাল কোথাও পাননি। তাই তাঁর ক্রন্দন

মোর কামকলা কেলি উল্লাস
নহে মিলনের মিথুন বিলাস–
আমি যে বধূরে কোলে করে কাঁদি, যত
হেরি তার মুখ…
আমার পিরীতি দেহরীতি বটে, তবু সে যে বিপরীত
ভক্ষ্ম-ভূষণ কামের কুহকে ধরা দিল স্মরজিত!
ভোগের ভবনে কাঁদিছে কামনা
লাখ লাখ যুগে আঁখি জুড়াল না।
দেহের মাঝারে দেহাতীত কার ক্রন্দন সঙ্গীত (স্মরগরল)

[কবি শেখরের সখি, কি পুছসি অনুভব মোয় পদ স্মরণীয়।

২. একে দুই কাজ নাই, দুয়ে এক ভালো
তুমি আমি বাঁধা রব নিত্য আলিঙ্গনে।
নিভে যাক রাধিকার নয়নের আলো
রাধার মরণ হোক তোমার জীবনে।
আমি প্রেম, তুমি প্রাণ-বারি ও পিয়াস
এক পাত্রে রহে যেন দ্বন্দ্ব যাক থামি। (ভ্রান্তি বিলাস)

৩. একদিন আছিল যা সফেন তরল।
আজ সে যে নিরুজ্জাস! (উৎসর্গ)

৪. আমি মদনের রচিনু দেউল দেহের দেহেলী পরে
পঞ্চশরের প্রিয় পাঁচফুল সাজাইনু থরে থরে।
দুয়ারে প্রাণের পূর্ণ কুম্ভ
পল্লবে তার অধীর চুম্ব,
রূপের আধারে স্বস্তিক তার আঁকিনু যতন ভরে। (স্মরগরল)

৫. আমার অন্তর লক্ষ্মী দেহ-আত্মা-মানসের
শেষ তীর্থে শুচি স্নান করি দাঁড়াইল।
মুক্ত লজ্জা,
সর্বরাগহারা এবে, তাই তার রূপরেখা
অনিন্দ্য সুন্দর।
প্রাণের সঙ্গীত রসে একপাতে ধরেছিনু
ইন্দ্রিয়ের পঞ্চ উপাচার
বুঝি না দোহার মাঝে কেবা নিদ্রা যায়,
কেবা জাগে কার চেতনা হরিয়া

৬. দেবী সে প্রেয়সী নয়। এ যে তাই
আরো রূপ।
একি মোহ স্নেহ অবসানে– (রূপ মোহ)

৭ সৃষ্টির ভরা ভারি হয়ে এল, ভেঙ্গে যায় রূপের চাপে
তবু রূপ চাই স্নায়ু চিরে চিরে, আয়ু যে ফুরায় তাহারি দাপে!
রূপ নয় আর প্রিয়েরি লাগিয়া প্রেমের ছলা
সে যে নিজ তরে কামনা নটীর নৃত্যকলা। (রুদ্রবোধন)

৮. সুখের স্বপনে সুমধুর ব্যথা কেন জেগে রয়! (বসন্তবিদায়)

৯. কোথা সেই রূপ চোখ দিয়ে যারে যায় না ধরা,
যে রূপ রাতের স্বপন-সভায় স্বয়ম্বরা।
কোথা সেই তুমি দেখেছিনু যারে দেখারও আগে। (নিশিভোর)

১০. শত যুগ ধরি রূপসী বসুধা
মিটাইতে নারে অসীম যে ক্ষুধা
এক যৌবনে ফুরাবে সে সুধা?
তারি পরে যমকূপ।
হায় সখি, হায়! তবু এ ধরায় এত রঙ এত রূপ।
অসীম ক্ষুধার একটু সে সুধা যে করে পুলকে পান,
সে যে জীবনের বনে বনে পায় সুমধুর সন্ধান! (দিনশেষ)

এবার কবি জেনেছেন :

১১. জেনেছি কোন্ সাগর-কূলে।
আলোক লতা উঠছে দুলে
পেয়েছি সেই জ্যোতির আভাস
আর কিছু না চাই। (নতুন আলো)

১২. নয়নে লেগেছে আজ অবনীর বৃন্দাবনী মায়া,
যে জীবন যৌবনের ক্ষয় নাই, খেদ নাহি যায়–
হাসি অশ্রু দুই-ই-এক, একই শোভা গোলাপে শিশির!
জীবন বসন্ত শেষ–শেষ নাই পূর্ণিমা নিশির।… …
জীবনের মতো প্রেম উবে যায় যাদুমন্ত্র বলে,
ভাসে শুধু এক সুর–সুখহীন একান্ত উদাস।

১৩. সেই প্রেম! জন্ম জন্ম তারি লাগি ফিরিছে সবাই!
এই দেহ পাত্র ভরি যেই দিন উঠিবে উছলি–
যুচিবে দুরূহ দুখ মৃত্যুভয় রবে না যে আর। (বুদ্ধ)

১৪. মৌনবতী সে রাজকন্যারে আর কেহ চিনিল না–
শুধু মোর লাগি সে মূক অধরে মনোহর মন্ত্রণা!
তনুর প্রভায় অতনুরে নাশি
মোরে চিরতরে করিল উদাসী।…
অয়ি সুন্দরী ভুবনেশ্বরী!
আমার জগতে তবু হায় বাণীরাগ রঙ্গিণী,
হেরিনু তোমারে মনোমন্দিরে রূপ রেখা বন্দিনী।
আমারে লইয়া একি লীলা তব? (শেষ আরতি)

কবি ভুবেনশ্বরীর লীলা বুঝেও শান্তি পেলেন না–

১৫. এ যে মৌন অট্টহাস মরণের জ্যোৎস্না জাগরণ।
যৌবন দেহের ব্যাধি, রূপে যেন তাহারি বিকার!
মনে হয়, খুলে গেছে প্রকৃতির মুখ-আবরণ—
দিবসের লীলা শেষে নিশাকালে একি হাহাকার। (নিযুতি)।

সুতরাং এই স্তরে কবির তৃপ্তি–অতৃপ্তির, জানা-অজানার দ্বন্দ্বের নিরসন আর হল না, তাই আমরা বলেছি, কবি সাধন-মার্গের শেষপ্রান্তে অলকার তীরে পৌঁছতে পারেননি। কবি বুঝেছেন দেহাতীত রূপ–কামাতীত সৌন্দর্যই যথার্থ চাওয়ার ও পাওয়ার বস্তু। উপভোগ, তৃপ্তি কিংবা প্রশান্তি মেলে তখনই যখন রূপ নিরূপে পায় সূক্ষ্মতা, সৌন্দর্যানুভূতি নিরবয়বে পায় স্থিতি। কিন্তু তা তাঁর বোধে স্থায়ীভাবে ধরা দেয়নি। কায়ার প্রতিভাস ছায়ারূপে মাঝে মাঝে জেগেছে বটে, কিন্তু সে ছায়াও মায়া বিস্তার করে পালিয়েছে–জ্যোতিষ্মন হয়ে তার অন্তর্লোকে স্থিতি লাভ করেনি। আকূতি ও বেদনাতেই তাই কবির সাধনা অবসিত প্রশান্তিতে পরিসমাপ্ত নয়। মোহিতলাল ভোগের কবি– ত্যাগের নন-বেদনারও নন, তিনি জীবনধর্মী। প্রাণ-ধর্মের প্রাচুর্যে তাঁর বেদনাও মাধুরী হয়ে ফুঠে উঠেছে। তার কাছে জীবনের বড়ো প্রেম:

হায় প্রেম ক্ষণপ্রভা! এ জীবন আঁধার বিধুর!
জীবনের চেয়ে ভালো সে প্রেমের ক্ষণিক পুলক। (প্রেম ও জীবন)

তিনি একান্তভাবে জীবনধর্মী বলেই মৃত্যুর পরপারে আর জীবনের চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। মৃত্যু তাঁর নিকট অন্ধকার ও ধ্বংসের প্রতীক। এমনকি স্বর্গের নিত্য অনন্ত সুখও তাকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে তিনি বিহারীলালের ভাবশিষ্য। এ হাসি-অশ্রুময় জগতের আকাশ জল বাতাস আলোতে যে আরাম, যে সুখ, যে মাধুরী তা স্বর্গে নেই। তাই স্বর্গসুখ অনভিপ্রেত। এ সূত্রে রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপও স্মরণীয়। কবি বলেন

১. অজর অমর হয়ে নিত্যের নন্দনে।
থেকো না অরূপ রূপে।…
নব নব জন বিবর্তনে আঁখি যুগ
চিনি লবে আঁখি যুগে, চির পিপপাসায়।
বার বার হারায়ে হারায়ে ফিরে পাব
দ্বিগুণ সুন্দর।…
নিত্যেরে কে বাসে ভালো? চিরস্থির ধ্রুব
অন্তর রজনী কিম্বা অনন্ত দিবস?
নহি তাই অনুরাগী। আমি চাই আলো
ছায়ারি পশ্চাতে; চাই ছন্দ, চাই গতি
রূপ চাই ক্ষুব্ধ সিন্ধু তরঙ্গ শিয়রে—
ধরিতে না ধরা যায়, পুলকে লুটায়। (পুরূরবা)

২. আমি চাই এই জীবনেরে জুড়ে বুকে করি লব সব,
জীবনের হাসি জীবনের কলরব।
জীবনের হাসি জীবনের দুখ
জীবনের আশা, জীবনের সুখ
পরাণ আমার চির উৎসুক
লইতে পাত্র ভরি
অধরে তুলিব ধরি
ধরণীর রস জীবনের রস যত।…
তারপর–আমার আমিটা একেবারে শেষ হোক
করিব না কোনো শোক,
মৃত্যুর পরে চাহিব না কোনো সুন্দর পরলোক। (মৃত্যু)

৩. জীবন মধুর! মরণ নিঠুর তাহারে দলিব পায়,
যত দিন আছে মোহের মদিরা ধরণীর পেয়ালায়!
দেবতার মতো কর সুধা পান।
দূর হয়ে যাক হিতাহিত জ্ঞান।…
অপরূপ নেশা অপরূপ নিশা
রূপের কোথাও নাহি পাই দিশা। (অঘোর পন্থী)

৪. ত্যাগ নহে, ভোগ–ভোগ তারি লাগি যেই জন বলীয়ান,
নিঃশেষে ভরি লইবারে পারে, এত বড় যার প্রাণ। (পাপ)

৫. জানি শুধু–যাব বহুদূর, আসিয়াছি বহদূর হতে!
জানি না কোথায় কবে।
পথ চলা শেষ হবে
লুকাইবে লোক-লোকান্তর অন্তহীন অন্ধকার স্রোতে। (পথিক)

৬. (দেহ) তোমারি সীমায় চেতনার শেষ,
তুমি আছ তাই আছে কাল দেশ,
দুঃখ-সুখের মহা পরিবেশ!
দেহলীলা অবসানে
যা থাকে তাহার বৃথা ভাগাভাগি
দর্শনে-বিজ্ঞানে।…
আর তুমি প্রেম!–দেহের কাঙ্গাল!
হারাইলে আর পাবে না নাগাল।
…. পড়িবে না চোখে সেই রূপ-রেখা–

স্বপনের সঙ্গিনী। (মৃত্যুশোক) শুধু এখানেই শেষ নয়, কবি মনে করেন, হৃদয়ের রূপ প্রণয় স্নেহ ভালবাসার ক্ষুধা ভবতৃষ্ণা জাগিয়ে রাখে। তাতেই জন্মান্তর হয় এবং স্বর্গের নিত্য আনন্দ-ভোগের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি মেলে। গৌতম বুদ্দের ভব তনহার শাস্তিস্বরূপ জীবজন্ম বা হিন্দুমতের পাপজনিত জন্মান্তর এ নয়, এ হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে জীবনের আনন্দ উপভোগ করবার জন্যে ধূলার ধরায় ফিরে ফিরে আসা।

১. শিয়রে মৃত্যুর ছায়া, চক্ষে ভাসে তবু
নন্দনের চিরন্তন আনন্দ স্বপন!…
প্রেম যে আত্মার আয়ু! ক্ষয় নাহি তার
জন্মে জন্মে তাই মোরা একই বধূ বর। (জন্মান্তরে)

২. এ ধরার মর্মে বিধে রেখে যাব স্নেহ ব্যথা, সন্তান পিপাসা,
তাই রবে ফিরিবার আশা।
তারি তরে, ওরে মূঢ়। জ্বেলে নেরে দেহ-দীপে
স্নেহ ভালবাসার নবজন্ম আশা। (মোহমুঘর)

স্বর্গও মিথ্যা–

৩ সত্য শুধু কামনাই মিথ্যা চিরমরণ পিপাসা।
দেহহীন, স্নেহহীন, অর্থহীন বৈকুণ্ঠ স্বপন।
যমদ্বারে বৈতরণী, সেথা নাই অমৃতের আশা
ফিরে ফিরে আসি তাই, ধরা করে নিত্য নিমন্ত্রণ (পান্থ)।

৪. নবীন জীবন জন্মে জন্মে লভিয়াছি প্রেমের প্রতাপে। (ভ্রান্তি বিলাস)

শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ হেমন্ত গোধূলির আমলে কবি তার আত্মভাব সাধনার মূল সুরটি হারিয়ে ফেলেছেন; লীলা চঞ্চল, দৃপ্ত-দুরন্ত সে যৌবন আর নেই। যৌবনের পুরোহিত প্রেমদেবতার আধিপত্য লুপ্ত হয়ে গেছে। যৌবন মদমত্তায় যে রূপ-প্রণয়কে জীবনে চরম ও পরম কাম্য বলে মনে করেছিলেন, যৌবনাবসানে কবির মোহ যখন গেল ছুটে, স্বপ্ন গেল ভেঙে, কঠোর বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে কল্পলোকবিহারী কবি তখন উপলব্ধি করলেন, রূপ প্রণয় সম্ভোগ প্রেম প্রভৃতি সব অনিত্য এবং নিঃসার। ফলে তার হৃদয়-মনে এল হাহাকার, ক্লান্তি, অবসাদ। যৌবনের সেই মিথ্যা ভোগেচ্ছাকে জীবনধর্ম বা দেহের নিয়তি বলে স্বীকার করে নিলেন। বিগত জীবনে ফেলে আসা দিনগুলোর জন্যে কোথায় যেন একটু ব্যথা বাজে, কেন যেন অনুশোচনা হয়। স্বপ্ন ভঙ্গে, আহত কবির চিত্ত বিক্ষুব্ধ অশান্ত ও ব্যথিত। তাই তিনি আকুলভাবে অকূল শান্তি ও বিপুল বিরতি আশায় গঙ্গাতীরে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছেন।

৩ যৌবন নিশার সেই স্বপন সঙ্গিনী,
সহসা উষার সাথে মিলাইল ত্বরা,
অন্তরীক্ষে, পূরূরবা মায়া বসুন্ধরা
কাঁদিয়া খুঁজিছে তারে দিবস যামিনী।
হায় নর! বৃথা আশা, বৃথা এ ক্রন্দন!
উর্বশী চাহে না প্রেম প্রেমের অধিক
চায় সে দৃপ্ত আয়ু, দুরন্ত যৌবন!
ফাগুনের শেষে তাই সে বসন্ত পিক
পলায়েছে; মরু পথে, হে মৃত্যু
কে রচিবে পুনঃ সেই প্রফুল্ল নন্দন? (স্বপন সঙ্গিনী)

৪. অসময়ে ডাক দিল হায় বন্ধু একি পরিহাস।
ফাগুন হয়েছে গত, জানো নাকি এ যে চৈত্র মাস?
বাতাসে শিশির কোথা ফুলেদের মুখে হাসি নাই,
কোকিল পলায়ে গেছে, গোলাপ যে বলে–যাই।
একদিন এ জীবনে পূর্ণিমার ছিল না পঞ্জিকা!
নিত্য জ্যোত্সা ছিল নিশা হেমন্ত ও শারদ চন্দ্রিকা!
শ্রাবণে ফাগুন রাতি উদিয়াছে বহু বহু বার
শীতে রৌদ্রে গাঁথিয়াছি চম্পা আর চামেলীর হার।
জীবনের সে যৌবন মরু পথে সেই মরুদ্যান
পার হয়ে আসিয়াছি আজ শুধু করি তার ধ্যান।
দুদিনের এই সুখ, দুদিনের এই সুন্দর ভুল
এরি লাগি সৃষ্টিপথ অহরহ মেলিছে মুকুল। (অকাল বসন্ত)

৫. রূপ মধু সৌরভের স্বপন সাধনা।
করিনু মাধবী মাসে, ইন্দ্রিয় গীতায়।
রচিনু তনুর স্তুতি। প্রাণ সবিতায়।
অঞ্জলিয়া দিনু অর্ঘ্য-প্রীতি নির্ভাবনা,
নিষ্ফল ফুলের মতো অচির শোভনা
সুন্দরের কামনারে গাঁথি কবিতায়। (ফুল ও পাখি)

৬. তুমি নাই, প্রাণে মোর পিপাসাও নাহি
প্রিয়া নাই–প্রেম সেও গেছে তারি সাথে।
সংসার শর্বরী।
তব রূপ স্বপ্নে আমি করেছিনু ভোর।
গৃহ পরিহরি চলেছিনু কল্পবাসে। (নির্বেদ)

৭. ঘুচিল সংশয় মোহ–সত্য আর সুন্দরের ছল
বুঝিলাম দুই-ই মিথ্যা। সৎ শুধু প্রকাশ মহিমা ।
প্রাণস্পর্শী বিরাটের; তারি ধ্যানে সঁপিনু সকল। (প্রকাশ)

৮.। পরশ হরষে মজি নাই তাই গেয়েছি দেহের গান,
জেগে রব বলে করি নাই তার অধরের মধু পান।
রুদ্রের সাথে রতির সাধনা করিয়াছি একাসনে,
প্রাণের পিপাসা আঁখিতে ভরেছি রূপের অন্বেষণে।

সব যখন মিথ্যে হল, তখন :

অকূল শান্তি, বিপুল বিরতি আজিকে
মাগিছে প্রাণ।

৯. এমন প্রহর ভ্রমিবে না আর, ঠাই তার লবে চিনি
আর রবে না রূপের পিপাসা
আজি অ-ধরার অধর লাগি সারা প্রাণ উৎসুক
সে রসে বিবশ ঘুমাইবে মোর বাণী হারা
সুখ দুখ। (বাণী হারা)

প্রতিভাবান কবিদের রচনাবলীতে ভাবধারার একটা ঐক্য থাকে, একটি ভাব-সূত্রে গ্রথিত হয়ে রূপ রস ও ভাবের একটি অপূর্ব রসময় মানসমূর্তি অঙ্কিত হয়। অন্যকথায় সব রচনায় কবির আত্মভাব সাধনার বা কাব্যের মূল সুরের ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। মোহিতলালের কবিতায়ও এরূপ একটি যোগসূত্রের সন্ধান মিলে। এইজন্যই আমরা কবির কাব্য-প্রেরণার উৎস-রূপ ও প্রণয় পিপাসা আদিম বর্বর প্রবৃত্তির প্রতীক নাদির শাহ এবং বেদুইনের মধ্যেও দেখতে পাই। নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর এবং মৃত্যুশয্যায় নূরজাহান কবিতাদ্বয়েও রূপ ও প্রণয় পিপাসাই শেষ কথা :

১. তাহমিনা। তাহমিনা!
চাও, কথা কও! কোথা সুখ নাই
নাদিরের তোমা বিনা।
আজ নওরোজ রাতে
অশোক এসেছে, যৌতুক দিতে দিল তার ওই হাতে।
লুটাইনু পায়, বলিনু বাঁচাও! তুমি জানো সেই পাতা
যার রসে এই যাতনা জুড়ায়, আর কেহ জানে না তা। (নাদির শাহের শেষ)

২. এ বিশ বছর ধ্যান করি, কালি তার দেখা পেয়েছি ভাই।
মাফ পেয়েছি যে–ছুটি আজ থেকে,
হুকুম মিলেছে খোদাতালার,
সকল যাতনা জুড়াইয়া গেছে,
অবসান আজ সব জ্বালার। …
আমার কাহিনী তুই বুঝিবি না, বুঝেছে
সে কথা আর একজন।
দুনিয়ার মাঝে দরদী যেথায় করিবে।
অশ্রু বিসর্জন।
যেদিন চেয়েছি কবরে তাহার ব্যথায়
গুমারি গভীর রাতে,
অমনি আলো যে জ্বেলেছে দ্বিগুণ আগুনের ঝঞ্ঝাবাতে।  (শেষ শয্যায় নূরজাহান)

৩. সেই মুখ, আর সেই চোখ, আর ছাউনি যে–
বাচ্চার পানে হরিণীর মত ফিরে চাওয়া পথের মাঝে।…
তারি মুখখানি মনে করে আমি গান বেঁধেছিনু
দিওয়ানা হয়ে
তেমন ব্যথা যে পাইনি কোথাও –ছুরি–ছোরা?
সে তো গেছেই সয়ে।
দারাত জ্বলের নামে গাঁথা সেই সুরটি পরাণ ছাইয়া আষে। (বেদুঈন)

৪. ভালো করে কাঁদো! ঢাকিওনা মুখ–
এত শোভা, মরি মরি
হাহাকার প্রাণ, তবু মনে হয় দেখে লই আঁখি ভরি!
ওই মুখ যবে জলে ভেসে যাবে আল্লার দরবারে,
রোজ কেয়ামত ভেরীর আওয়াজ থেমে যাবে একেবারে। (নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর)

মোহিতলাল ফারসি সাহিত্যের সূফীধারার অনুরাগী। জীবনকে সূফীদের ন্যায় প্রত্যক্ষ করতে তিনিও প্রয়াসী :

১. থাক তোলা আলবোলা পেয়ালায় মুখ ধর
চেয়ে দেখ মন ভোলা, দুনিয়া কি সুন্দর! (দিলদার)

২. যত নেশা হৌক রাতটি ফুরালে রয় তা কি?
তোমার সুর-সুরায় যে জন মস্তানা,
হুঁশ হবে তার আখেরি জামানা শেষ-দিনে।
বড় মিঠা মদ! ফের পেয়ালা ভর সাকী।
হরদম্ দাও! আজ বাদে কাল ভরসা কি? (গজল গান)

৩. য়ুসুফের রূপ দিনদিন যে গো ফুটে ওঠে,
কুমারী ধরম-শরম যে তার পায়ে লোটে।
জুলায়খার ঐ আবরু এবার গেল টুটে,
ইজ্জত রাখা ভার হল সেই লজ্জিতার। (হাফিজের অনুসরণে)

শব্দ, ভাষা ও ছন্দযোগে বিষয়ানুরূপ পরিবেশ সৃষ্টিতে মোহিতলালের কৃতিত্ব অসাধারণ। ফারসি সাহিত্যানুগ কবিতা রচনায় বা মুসলিম জীবনালেখ্য চিত্রণে তাঁর কৃতিত্ব লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে মোহিতলাল সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুসারী এবং এঁদের এ ধরনের কবিতাই নজরুল ইসলামকে উৎসাহিত করেছিল আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগে।

মোহিতলালের আর একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে তার মধ্যে ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতি প্রীতি যেমন প্রবল, তেমনি নতুন ভাব-চিন্তার অগ্রনায়ক বাঙালির মননও প্রচুর। এইজন্যে একদিকে অগ্নিবৈশ্বানর, পুরূরবা, মৃত্যু ও নচিকেতা, আবির্ভাব, রুদ্রবোধন, কন্যা প্রশান্তি প্রভৃতি কবিতায় যেমন তিনি হিন্দু তত্ত্ব-চিন্তার অনুসারী; তেমনি নারী স্তোত্র, বুদ্ধ, প্রেম ও সতীধর্ম অঘোর পন্থী, দেবদাসী, প্রেম ও জীবন প্রভৃতি কবিতায় বাঙালি সুলভ নতুন মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। এখানে কবির নিজস্ব মনন ও চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে। আমরা জানি মোহিতলাল মনেপ্রাণে স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বধর্মনিষ্ঠ। দেশাত্মবোধ ও ভারতীয় দর্শন-সংস্কৃতি প্রীতি তাঁর অস্থিমজ্জায়। তাঁর গদ্য রচনাবলীর মূল ব্যঞ্জনাই এসব। ফলে তাঁর মননশীল মন গ্রহণ বর্জনের একটি সুনির্দিষ্ট ধারা মেনে চলেছে। অন্য কথায় তিনি তার মনীষা ও রুচি অনুসারে হিন্দু তত্ত্ব-চিন্তা ও দর্শনের কিছু গ্রহণ কিছু বর্জন করে নিজস্ব একটা আদর্শ বা মতপথ খাড়া করেছেন। এজন্যে তাঁর কবিতার দু-এক জায়গায় সনাতন আদর্শ বিরোধিতা ও মতদ্রোহিতা প্রকাশ পেয়েছে :

১. মাটির প্রতিমা বটে, মাটি বিনা সবই যে নশ্বর
দেহই অমৃত ঘট, আত্মা তার ফেন অভিমান।
সেই দেহ তুচ্ছ করে, আত্মা ভয়-বন্ধন জর্জর
এসেছে প্রলয় পথে, অভিশপ্ত প্রেতের সমান
আত্মার নির্বাণ তীর্থ নারীদেহে চায় তবু আত্মার সন্ধান। (নারীস্তোত্র)

২. করাইলে আত্মবলিদান।
শূন্য সুখ তবে শুধু ঘুচাইয়া প্রাণের পিরীতি
সেকি নহে দুর্বলেরে লয়ে সেই সবলের খেলা! …
রুদ্ধ করি আঁখি জল স্নান করি অধরের হাসি।
প্রাণ হত্যা করিবারে কেবা তোমা দিল অধিকার?
তার চেয়ে ক্রুর সেকি তৈমুরের লক্ষ জীব নাশ? …
দেহ মিথ্যা, প্রাণ মিথ্যা, একমাত্র দুঃখ সত্য হবে?
… সেই প্রেম। জন্ম জন্ম তারি লাগি, ফিরিছে সবাই।
এই দেহ পাত্র-ভরি সেই দিন উঠিবে উছলি–
ঘুচিবে দুরূহ দুঃখ, মৃত্যু ভয় রবে না যে আর। (বুদ্ধ)

মোহিতলালের কবিতায় নিসর্গ বা প্রকৃতির অনাবিল শোভা সৌন্দর্য উপলব্ধির প্রয়াস চিহ্ন নেই। কারণ কবি মননশীল, তিনি প্রকৃতির রূপ শোভার অন্তরালের রহস্য উদঘাটন প্রয়াসী এবং তৎসঙ্গে মানবজীবনের সামঞ্জস্য ও যোগসূত্র আবিষ্কারে আগ্রহশীল। ফলে তাঁর শ্রাবণ রজনী, বসন্ত আগমনী, ভাদরের বেলা, পূর্ণিমা স্বপ্ন, বিভাবরী, বসন্ত বিদায় প্রভৃতি কবিতায় নাম-মাহাত্ম্য রয়েছে শুধু, নিসর্গ শোভা তার মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তাই তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হিসাবে নিসর্গের স্থান নগণ্য। পূর্বেই বলেছি তিনি বস্তুতান্ত্রিক নন, মর্মরস রসিক বা গ্রাহী। তাই প্রকৃতি-প্রেরণার অভাব তাঁর কবিমনের মাধুর্য নষ্ট করতে পারেনি এবং কবিমন বিকাশেও বাধা জন্মায়নি। দেহ ও রূপ কবির কাব্যশিল্পের উপকরণ, তাঁর কাব্যসৌধের উপাদান।

কবি ও মনীষী-প্রশস্তিমূলক কবিতাবলীতে কবির গুণগ্রাহিতা, ঐতিহ্যানুরাগ, স্বদেশ, স্বজাতি ও সংস্কৃতি প্রীতি মূর্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্র জয়ন্তী, মধু উদ্বোধন, বঙ্কিম চন্দ্র, বিবেকানন্দ প্রভৃতি কবিতা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

আঙ্গিক (Form) ও বক্তব্য বিষয়ের প্রাঞ্জলতায় মোহিতলালের সনেট পরম্পরায় রচিত দীর্ঘ কবিতাও তাঁর কৃতিত্বের পরিচায়ক। যথা–শরৎচন্দ্র, কবিধাত্রী ও এক আশা।

সাধারণভাবে বলতে গেলে মোহিতলাল কবিতার Form (আঙ্গিক) ও diction (ভঙ্গি) সম্বন্ধে বিশেষভাবে যত্নশীল। স্মরগরলের ভূমিকায় তিনি এ-কথা সগর্বে বলেওছেন। আমরা লক্ষ্য করেছি, তাঁর কবিতায় বিষয় ও ভাব-গাম্ভীর্যানুযায়ী শব্দ ও ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ভাবের দীনতা, ছন্দে শৈথিল্য, শব্দে ব্যঞ্জনার অভাব কোথাও তেমন দেখা যায় না। মননশীলতায় তাঁর দীনতাও বিরল। এইজন্যে ভাবের উচ্চতায়, শব্দের ব্যঞ্জনায়, ভাষার আভিজাত্যে, ছন্দের ললিত মন্থরতায় ও গাম্ভীর্ষে, মননশীলতার চমঙ্কারিত্বে তার এক-একটি কবিতা অনবদ্য শিল্পকর্মে রসমূর্তি লাভ করেছে।

আমরা কবি মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যের মূলসুর বা আবেদন কী তাই শুধু জানতে চেয়েছি। এই ব্যাপারে আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে বহু উদ্ধৃতি দিয়েছি, তা পাঠকের কাছে বিরক্তিকর; তৎসত্ত্বেও আমরা দিয়েছি–এই আশঙ্কায় পাছে আমাদের বক্তব্য অস্পষ্ট থেকে যায়। সুতরাং তার বিশিষ্ট কবিতাগুলোর ভাব ও রূপ প্রতাঁকের সৌন্দর্যের আলাদা আলোচনা সম্ভব হল না। তাঁর কবিতার ভাষা ও ছন্দ-সৌন্দর্য বিশ্লেষণও এখানে অপ্রাসঙ্গিক হত।

জানি, এই গণ-সংগ্রামের যুগে মোহিতলালের কবিতার কদর হবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন দিনও হয়তো আসবে, যখন মানববাদীর গণ-সাহিত্য কেবল ঐতিহাসিক মর্যাদায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে, আর মোহিতলালের কাব্য-সুধা মানস-রস-রসিকদের দেবে তৃপ্তি।

যদিও মোহিতলালের জীবন-দৃষ্টি কোনো শ্রেয়সের সন্ধান দেয় না, তবু তার নির্মিত এই বাসনা-জগৎও যে মানব-কাম্য তা অস্বীকার করা যাবে না। তাঁর সৃষ্ট রস-সরোবরের সার্থকতা এখানেই। তাঁর কাব্যের স্থায়ী আবেদন-তত্ত্বও এতেই নিহিত।

রবীন্দ্র প্রসঙ্গে

রবীন্দ্রসাহিত্য আমাদের সংস্কৃতি-বিধ্বংসী বলে যে কথা উঠেছে, যে আশঙ্কা আমাদের জাতি-প্রাণ বুদ্ধিজীবীদের মনে জেগেছে, তা নিরসনের জন্যে রবীন্দ্রসাহিত্যানুরাগী আর একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। তাঁদের সদিচ্ছা নিশ্চয় শ্রদ্ধেয়। তাদের কল্যাণকামী হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা সহানুভূতিও জাগায়। কিন্তু তাদের সদিচ্ছা সৎসাহসপুষ্ট নয়–এবং সদিচ্ছার সঙ্গে সৎসাহসের যোগ না হলে সাফল্য থাকে অসম্পূর্ণ; এমনকি স্থান-কাল বিশেষে সাফল্য অর্জন হয় অসম্ভব।

রবীন্দ্রসাহিত্য যে আমাদের অকল্যাণের নয় বরং আমাদের মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধ বিকাশের সহায়ক–এই কথা বুঝিয়ে বলবার জন্যে তারা যে-সব যুক্তির অবতারণা করেন আর যে-সব তথ্য ও তত্ত্ব উপস্থিত করেন, তাতে তাঁরা তাঁদের অজ্ঞাতেই রবীন্দ্রনাথকে করেন অপমানিত আর নিজেরা বরণ করেন কৃপাজীবীর লজ্জা।

তারা প্রতিবাদের দ্বারা প্রতিরোধ করতে চান না, তারা অনুগ্রহকামীর মন-বুদ্ধি নিয়ে হুজুরের দরবারে তদবিরে নিরত। বিরোধীদের ক্ষমা ও প্রশ্রয়বাঞ্ছায় তারা পেশ করেন আবেদন-নিবেদন, যাঞা করেন কৃপাদৃষ্টি। তাই তারা সভায় ও লেখায় বলে চলেছেন; রবীন্দ্রনাথের পিতা ছিলেন হাফিজের কাব্যের অনুরাগী, রবীন্দ্রনাথে বর্তেছে সে-প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম, আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সূফীকবি, মুসলিম বিদ্বেষ তাঁর ছিল না, নিন্দাও করেননি কোথাও। তিনি টুপি ইজার আলখাল্লা পরতেন, আর সযত্নে লালন করতেন দাড়ি। মোঘলাই পরিবেশ ছিল ঠাকুর পরিবারে। অতএব রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রায় তৌহিদবাদী ও আধা মুসলমান। কাজেই হুজরান দয়া করে আমাদের শুনতে দিন রবীন্দ্রসঙ্গীত, পড়তে দিন রবীন্দ্রসাহিত্য। এখন মহামহিমদের সুমর্জি, ক্ষমাসুন্দর হুকুম ও সদয়প্রশ্রয়ের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা আসামীর দুরু দুরু বুকের কাপুনি ও আশা নিয়ে। নির্দোষ বলে প্রমাণ করার জন্যে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভীরুহৃদয়ের এই সদিচ্ছা রবীন্দ্রনাথকে অপমানিত করতে বাকি রাখল কি? বরং রবীন্দ্র-বিরোধীরাই তাঁকে যথার্থ সম্মান দেন। কেননা, তাঁর অমিত শক্তি ও সর্বগ্রাসী প্রভাব স্বীকার করেন বলেই তারা ভীত। তারা সূর্যের প্রচণ্ড তাপ স্বীকার করেন বলেই অন্ধকারের প্রাণীর মতো তারা আত্মরক্ষার ভাবনায় বিচলিত।

মহত্মনের স্পর্শকামী এইসব মানবতাবাদী যদি রবীন্দ্রসাহিত্য বিরোধিতা প্রতিরোধ প্রয়াসে সৎসাহসের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসতেন, তাহলে তাদের মুখে শোনা যেত অন্য যুক্তি। তারা বলতে পারতেন–আমাদের কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান থেকে ইসলামী শাস্ত্র অবধি সব বিদ্যাই দান করা হয় বিদেশী, বিজাতি ও বিধর্মী য়ুরোপীয় বিদ্বানদের গ্রন্থ পড়িয়ে। চীন-রাশিয়ার নাস্তিক্য সাহিত্যই আজ পাকিস্তানে জনপ্রিয় পাঠ্য। আমেরিকার যৌন-গোয়েন্দা সাহিত্যে আজ বাজার ভর্তি। বিদেশীর, বিজাতির ও বিধর্মীর সাহিত্য অনুবাদের জন্যে দেশে গড়ে উঠেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। খ্রীস্টান য়ুরোপের আদর্শে জীবন রচনার সাধনায় আজ সারাদেশ উন্মুখ। য়ুরোপীয় আদলে জীবনযাপন করে অসংখ্য লোক কৃতাৰ্থমন্য। য়ুরোপ আজ কামনার স্বর্গলোক। তাছাড়া ইমরুল কএস থেকে হাতেমতাই, এবং দারান-ওশেরোয়া থেকে রুস্তম অবধি সব আরব-ইরানী কাফেরই আমাদের শ্রদ্ধেয়। এতসব উপসর্গ বেষ্টিত হয়েও আমাদের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি বিলোপের আশঙ্কা করিনে। কেবল দেশী কাফের রাম থেকে রবীন্দ্রনাথকেই আমাদের ভয়। অথচ এই রাম রবীন্দ্রনাথের দেশেই তাঁদের জ্ঞাতিরাই বরণ করেছে ইসলাম। এঁদের দেখে-শুনে-জেনেও বিচলিত হয়নি মুমিনের ইমান। পাশে থেকেও প্রভাবে যে পড়েনি তার প্রমাণ আজকের মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। তাহলে হাজার বছরের পুরোনো মুসলমান সন্তানদের ধর্ম-সংস্কৃতি হারানোর এই ভয় কেন?

অতএব, রবীন্দ্রবিরোধিতার মূলে সংস্কৃতিধ্বংসের আশঙ্কা নয়, রয়েছে অন্য কিছু। তা যদি রাজনৈতিক স্বার্থ কিংবা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক হয়, তা হলে আমাদের বুঝিয়ে বলেন না কেন তারা? আমাদের স্বাজাত্যবোধ দেশপ্রেম কিংবা রাষ্ট্রানুগত্য কি কারো চেয়ে কম যে তাঁরা আমাদের প্রতি সন্দিহান হয়ে আমাদের অপমানিত করবার অধিকার নেবেন! আমরা যদি উপলব্ধি করতে পারি কিংবা তারা যদি আমাদের বুঝিয়ে দেন যে রবীন্দ্রসাহিত্য আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকর, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই বর্জন করব রবীন্দ্রসাহিত্য। দেশের স্বার্থে এমনকি প্রয়োজন হলে নিজের সন্তানকেও বর্জন করতে রাজি। কিন্তু এ তো হুকুমে হবার কাজ নয়–জানা-বুঝার ব্যাপার। তারা এগিয়ে আসুন, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিন। আমরা কি এতই পাপাত্মা যে দেশের স্বার্থ বুঝব না! –এমনি সব তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তির অবতারণা করতে পারতেন তারা। আর যদি শ্রেণীস্বার্থের কারণেই ঘটে রবীন্দ্রবিরোধিতার উদ্ভব, তাহলে আমাদের স্বার্থেই প্রতিকার প্রয়োজন। সে-প্রতিকারের পথে যদি আঘাত নেমেই আসে, তবে ধৈর্য, দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে সইতে হবে সে আঘাত। কেননা, ছলনা দিয়ে ছলনার প্রতিকার হয় না। পরস্বাপহারীর হৃদয় গলে না অনুনয়ে। কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখলেই শুকায় না দুষ্টক্ষত কিংবা বন্ধ হয় না। মিথ্যার প্রলেপে ঢাকা যায় না মিথ্যাকে। বেদনা সয়েই ব্যবস্থা করতে হয় বেদনা উপশমের। সমস্যা এড়িয়ে চললে সমস্যা বাড়েই–সমাধান হয় না। অস্ত্রোপচারে যন্ত্রণা বাড়িয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে হয় কোনো কোনো রোগে। এরূপ ক্ষেত্রে কল্যাণবুদ্ধি ও মমতাই যোগায় নির্মম হবার প্রেরণা। আপাত নিষ্ঠুরতা অনেকক্ষেত্রেই গভীর করুণার পরিচায়ক।

রবীন্দ্রনাথ মানবতার প্রমূর্ত প্রতিনিধি। মানবকল্যাণের দিশারী। আমাদের গরজেই আমরা রবীন্দ্রসাহিত্যের পাঠক। সে-গরজ যদি হয় গুরুতর, তা হলে আমাদের প্রতিকার-প্রয়াসও হবে তীব্র। এভাবে সখের প্রেরণায় সৌখিন ক্ষোভ ও বেদনা প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথকে অপমানিত করবার অধিকার নেই আমাদের।

Exit mobile version