কেউ কেউ মনে করেন, মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বিরূপতা ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবপ্রসূত। কিন্তু ওহাবী আন্দোলনের কেন্দ্র বিহার ও উত্তর প্রদেশে তৎসত্ত্বেও ইংরেজিশিক্ষা প্রসার লাভ করেছিল। আমরা জানি কোনো আন্দোলনের প্রভাবই সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী হয় না। মুসলিম সমাজে ওহাবী প্রভাবও সর্বাত্মক ছিল না। তাছাড়া, ১৮৬০ সনের পরে ওহাবী আন্দোলন স্তিমিত এবং সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুসলমান সমাজে ইংরেজ ও ইংরেজি প্রতি প্রবল হতে থাকে। তবু বিশ শতকের দ্বিতীয়পাদের আগে বাঙলার মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষা লক্ষণীয়ভাবে প্রসারলাভ করে নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কালাপানি পার হলে জাত-যাওয়া ও সমাজ-চ্যুতি নিশ্চিত জেনেও উনিশ শতকে কোনো হিন্দু বিলেত যাওয়ার সুযোগ ছাড়ে নি। ওহাবী প্রভাব নিশ্চয়ই হিন্দুর ঐ ধর্মীয় সংস্কার ও লাঞ্ছনাভীতির চেয়ে প্রবল ছিল না কখনো। আসলে নিম্নবর্ণের হিন্দুর যেমন, নিম্নবিত্তের মুসলমানেরও তেমনি লেখাপড়ার ঐতিহ্যই ছিল না।
ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুর নতুন বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক পরিবেশে অর্থাগম হল অপরিমেয়। বিত্তশালী শ্রেণী গড়ে উঠল তাদের নিয়ে। অন্যান্য হিন্দু ও মুসলমানের অবস্থা রইল অভিন্ন। তাদের দারিদ্রদুঃখ বাড়ল ভিন্ন কারণে। গ্রামীণ কৃষি-শিল্পজাত পণ্য বিনিময় (Bartar) নীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের প্রভাবে মুদ্রা বিনিময় (Money currency) রীতিতে পরিবর্তিত হওয়াতে আর্থনীতিক কাঠামোতে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া দেশের কৃষি-শিল্প নিয়ন্ত্রণের সাম্রাজ্যিক নীতির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিদেশী পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য হয় তারা। এভাবে আয়ের পথ হল রুদ্ধ-ব্যয়ের পথ হল বিস্তৃত। তাই দারিদ্র্য হল ক্রমবর্ধমান। অন্যদিকে বুর্জোয়া রাজত্বে ইংরেজি জানা হিন্দু দালাল-মুৎসুদ্দী-বেনিয়ান-চাকুরে বেতন, ঘুষ ও সুদের আকারে কাঁচামুদ্রা অর্জন করে ঐশ্বর্যবান হতে থাকে যখন, তখন বিদেশাগত মুসলমানের স্বল্পসংখ্যক বংশধর ছোট লোকদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে পৈত্রিক-সম্পত্তি-নির্ভর নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে মশগুল। কাজেই উচ্চবিত্তের ব্রাহ্মণ-কায়স্থের মতো বহিরাগত উচ্চবিত্তের মুসলমানও যে কোম্পানী রাজত্বের প্রসাদ পেয়ে ধনী-মানী শ্রেণীরূপে গড়ে উঠতে পারত, সে-সম্ভাবনা হল তিরোহিত। তাদের ঔদাসীন্যে হিন্দু বুর্জোয়া শ্ৰেণীই কেবল গড়ে উঠল-হিন্দু-মুসলিম মিশ্র বুর্জোয়া শ্রেণী আর গড়ে উঠতে পারল না। এবং এই শ্রেণীতে মুসলিম নামধারীর অনুপস্থিতিই ছিল ধর্মীয় স্বাজাত্যগর্বী বাঙালি মুসলমানের ক্ষোভের কারণ। কিন্তু বহিরাগত মুসলিম অবতাংসরা বুর্জোয়া বিত্তের অংশ পেলে দেশী মুসলমানের বাস্তব ও বৈষয়িক কী উপকার হত–কেবল জাতীয় গৌরব-গর্ব করবার মতো নির্বোধ আত্মপ্রসাদ পাওয়া ছাড়া। যে-কয়টি পরিবার ইংরেজ আমলের দুশ বছর ধরে জমিদার হিসেবে টিকে ছিল, তারা দেশী মুসলমানের শিক্ষা বিস্তারে কী সহায়তা করেছে, স্কুল-কলেজ গড়েছে কয়খানা, ছাত্রবৃত্তি দিয়েছে কয়টি! অবশ্য পার্থিব নেতৃত্ব এবং অপার্থিব পুণ্য অর্জনের জন্য দান করেছে প্রচুর-লিল্লাহ দিয়েছে বটে। এরাই আরব-ইরানের খোয়াব দেখিয়ে, সমরকন্দ-বোখারার স্মৃতি জাগিয়ে, উর্দুর মহিমা কীর্তন করে স্বস্থ হতে দেয় নি বাঙালি মুসলমানকে। বারবার বহির্মুখখা ও ছিন্নমূল করবার সচেতন প্রয়াসে তারা দেশী লোকের অগ্রগতির পথ করেছিল রুদ্ধ; দৈশিক জীবন-চেতনা প্রসারে দিয়েছিল বাধা। সে-প্রয়াসে আজো তাদের বিরতি-বিরাম নেই।
অতএব মুসলিম শাসনকালে বিদেশাগত মুসলিম চাকুরে ও অভিজাতদের দ্বারা দেশী মুসলমানের কী উপকার হয়েছিল, আর ইংরেজ আমলে এদের তমঘা, আইমা মদদ-ই মাশ ও জমিদারী বাজেয়াপ্তির বা হারানোর ফলে বাঙালি মুসলমানের কী ক্ষতি হল, তা আজ খুঁটিয়ে দেখবার-বুঝবার প্রয়োজন আছে। নতুবা স্বধর্মীকে স্বজাতি মনে করে অভিন্ন স্বার্থের সুবাদে আস্থা রাখার বিড়ম্বনা কখনো ঘুচবে না।
1. Syed Ameer Ali; A Cry from the Indian Mohammedans Nineteenth Century, London. August 1882, PP 199-200 as quoted by Dr. Muin-ud Din Ahmed Khan, Islamic Studies P.P. 284 Journal of the Islamic Research Institute of Pakistan Vol. VI no 3 for September, 1967.
2.. Dr. A. R. Mullick-British Policy and the Muslims in Bengal 1757 1856. Asiatic Society of Pakistan Publication 1961, Dacca P. 48.
চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা
প্রত্যেক মানুষেরই চলনে-বলনে-করনে নিজের মনের মতো নীতি-পদ্ধতি রয়েছে। অন্যকথায় বলা যায়, প্রত্যেকেরই জীবনে স্ব স্ব পছন্দসই মত ও পথ আছে। এর সাধারণ নাম আদর্শবাদ। Men are born-Philosophers বলে যে-কথাটি চালু আছে, তার সোজা অর্থ দাঁড়ায় প্রত্যেক মানুষই স্ব স্ব জগতে ও জীবনে দার্শনিক। এ দৃষ্টিতে দেখলে, কোনো আদর্শই মিথ্যা বা নিরর্থক বলে মনে হবে না। কাজেই প্রত্যেক আদর্শেরই ব্যক্তিক, স্থানিক ও কালিক উপযোগ থাকে। এ সূত্রেই স্বীকার করতে হয়, যে-কোনো আদর্শেরই সর্বজনীন ও শাশ্বত হবার যোগ্যতা নেই। এ কারণেই যুগে যুগে দেশে দেশে আদর্শবাদের জন্ম ও মৃত্যু হয়েছে।