ইংরেজ আমলে দেশী খ্রীস্টানের ক্ষেত্রেও আমরা এমনি এক বিশেষ অবস্থা লক্ষ্য করি। ব্রিটেন থেকে স্বজাতি আনয়ন সম্ভব না হলে ইংরেজরা দেশী খ্রীস্টানকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে আশ্বস্ত হত, কিন্তু তেমন কোনো প্রয়োজন না হওয়ায় যদিও প্রচারকদের উৎসাহে ও তৎপরতায় খ্রীস্টান হয়েছে অনেক, কিন্তু শাসকের স্বজাতি বলে অনুগ্রহ পেয়েছে সামান্য। স্বজাতির পোষণে তাদের আত্মবিকাশ ছিল দুর্লক্ষ্য।
কাজেই সময় এসেছে নতুন দৃষ্টিতে ইতিহাস পাঠের। তুকী-মুঘল মুসলিম শাসনে আর্থিক, শৈক্ষিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দেশী মুসলমানের সুযোগ ও সুবিধা, অবস্থা ও ভূমিকা, কৃতি ও সংস্কৃতি কী ছিল তা যাচাই করা প্রয়োজন। আমরা সাদা চোখে দেখছি পল্লী-আগ্রায় কিংবা দক্ষিণাত্যে অথবা গৌড়-সোনার গা-ঢাকা-মুর্শিদাবাদে পদস্থ দেশী মুসলমান অনুপস্থিত।
বাংলা দেশের ইতিহাসের যে-অংশের বিস্তৃত বিবরণ আমাদের হাতে এসেছে সে-অংশেও অর্থাৎ নওয়াবী আমলেও আমরা খাঁটি দেশজ বাঙালি পাইনে। বিদেশী মামলুকের মর্যাদা আর সুযোগও পায় নি দেশী গেরস্থ। উত্তর ভারত থেকে আগত ব্যক্তির পুত্র হুগলীবাসী জাস্টাস সৈয়দ আমীর আলী নওয়াবী আমলের বাংলার উচ্চ বর্ণের মুসলমানদের বংশধর সম্পর্কে বলেছেন,
These are called Hidustanis and few of them ever understand Bengali. In most of the districts of upper Bengal, such as Beerbhoom, Midnapur, Dinajpur, Maldah, Purneah and to some extent the English district of twenty four pergunnahs, the Mohammedans speak urdoo, though not with the same purity as a native of Lucknow or Delhi, and know only enough of Bengali for the purposes of social intercourse with their Hindoo neighbours.
নওয়াবী আমলে এই বহিরাগত মুসলমান বড় চাকুরেরা ও তাদের পরিজনেরা (This class of Muslims) treated the language of the subject races with contempt….. they were as ignorant of native vernaculars as any English administrator of the day.
এও সত্য যে সিরাজদ্দৌলা-মীর কাসেমের পতনের পর বিদেশাগত অনেক অভিজাতই উত্তর ভারতে চলে যায়, যারা নানা অসামর্থে যেতে পরে নি, সেই স্বল্প সংখ্যক পরিবারের কথাই বলেছেন সৈয়দ আমীর আলী ও ডক্টর মল্লিক।
অতএব, এই তুর্কী-মুঘল-ইরানী অবতংসরা ইংরেজ প্রশাসকদের মতোই সযত্নে স্বাতন্ত্র রক্ষা করেই প্রজা-সাধারণের সুখ-দুঃখ করেছিলেন প্রত্যক্ষ, আর পীড়ন-শোষণ চালিয়ে ছিলেন সর্বপ্রকার ছোঁয়া বাঁচিয়ে। দেশী খ্রীস্টান ও গোরা খ্রীস্টানের যেমন রয়েছে সমাজে ও ধর্মশালায় স্বাতন্ত্র, তেমনি শাসক ও শাসিত মুসলমানে ছিল দুস্তর ব্যবধান। সে-স্বাতন্ত্রের প্রাচীর অতিক্রম করে সাতশ বছরেও মিলতে পারে নি তারা। তাই রাজদরবারের বিদেশী মামলুক আর হাবসী দাসেও বর্তেছে তখৃতের অধিকার, হিন্দুরও ছিল বিদ্রোহের সুযোগ, কেবল দেশী মুসলমানেরই ছিল না পাত্তা। এখানে হাসান গঙ্গা বাহমন, ঈশা খান, কালা পাহাড়, মালিক কাফুর, মালিক খসরু, জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ (যদু) প্রভৃতি দেশী হিন্দুর বংশধরদের দৃষ্টান্ত দেওয়া হবে অসঙ্গত। কেননা, তাঁরা হিন্দু হিসাবেই বড়ো হয়েছিলেন অথবা ছিলেন বড়ো হিন্দু পরিবারের সন্তান।
দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস লেখক ডাব্লিউ. এ. হান্টারের ভূমিকা ছিল অনেকটা পশ্চিম এশিয়ার টি, ই, Lawrence-এর মতোই। মুসলিম মনে হিন্দু-বিদ্বেষ ও ব্রিটিশ-প্রীতি জাগানোর অভিনব কৌশল হিসেবে চমকপ্রদ নানা বানানো কথা তিনি তথ্যের আকারে সাজিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। একশ বছর ধরে মুসলমানরা তাই কপচিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। এ-গ্রন্থে যদি কোনো সত্য থেকেও থাকে তবে তা বিদেশাগত শাসকশ্রেণী সম্পর্কেই প্রযোজ্য–দেশী মুসলমান সম্পর্কে নিশ্চিতই নয়।
তাছাড়া নওয়াবী আমলের বাঙলা কখনো ১৯০৫ সনের পরবর্তীকালের ভৌগোলিক বাঙলা ছিল না। বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যা মিলেই বাঙলা, অন্তত সিরাজুদ্দৌলার বাঙলা ছিল বাঙলা-বিহার। আর তা ১৯০৫ সন অবধি ছিল স্থায়ী। কাজেই একালের বাঙলার ইতিহাস চর্চায় বিহারকে বাদ দেয়া যায় না। পলাশী-উত্তর বাঙলায় হিন্দু ও ইংরেজের ভূমিকা ও তাদের শাসন-পীড়ন কিংবা পোষণ-শোষণ নীতি বাঙলা-বিহারে সমভাবে ছিল কার্যকর। বিহারকে বাদ দিয়ে কোম্পানী আমলের বাঙালি মুসলমানের বিত্তবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে-সব কথা ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্যরূপে চালু রয়েছে, তা ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসার ফল নয়, হান্টার শ্রেণীর ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রশাসনিক প্রয়োজনপ্রসূত দান, সাম্রাজ্যিক নীতি প্রেরণাপ্রসূত বিশ্লেষণ। এজন্যে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বাঙালি মুসলমানের তথাকথিত অনীহা, লাখরাজ, আইমা, তঘমা, মদদ-ই মাশ ইত্যাদি হারানোর প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম প্রভৃতি বিহারী মুসলিম-জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য।
তখন হয়তো দেখা যাবে ইংরেজের প্রতি বিরূপতা কিংবা ইংরেজির প্রতি অনীহাই বাঙালি মুসলমানকে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বিরত রাখে নি, শিক্ষার Tradition ছিল না বলেই তারা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠায় নি। অবশ্য উচ্চবিত্তের মুসলমানরাও যথাসময়ে সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে দিয়েছিল এবং তাদের অনেকের শিক্ষা পূর্ণতা পায় নি পরিবেশের অভাবেই। কেননা ইংরেজি শিক্ষা চালু হয়েছিল কোলকাতায়। সেখানে উচ্চবিত্তের মুসলমান ছিল অনেককাল অনুপস্থিত। কোলকাতা ও তার চার পাশের হিন্দুরাই পেয়েছিল ইংরেজি শিক্ষা প্রথমদিকে এবং ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ব্যতীত বৈদ্য, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানের কাছে ইংরেজি শিক্ষার দ্বার পারিবেশিক কারণেই রুদ্ধ ছিল বহুকাল। বিহারে বিদেশাগত মুসলিম অভিজাতের সংখ্যা ছিল বেশি, তাই ইংরেজি শিক্ষায় তারা পিছিয়ে পড়েনি।