৬. তুমি নাই, প্রাণে মোর পিপাসাও নাহি
প্রিয়া নাই–প্রেম সেও গেছে তারি সাথে।
সংসার শর্বরী।
তব রূপ স্বপ্নে আমি করেছিনু ভোর।
গৃহ পরিহরি চলেছিনু কল্পবাসে। (নির্বেদ)
৭. ঘুচিল সংশয় মোহ–সত্য আর সুন্দরের ছল
বুঝিলাম দুই-ই মিথ্যা। সৎ শুধু প্রকাশ মহিমা ।
প্রাণস্পর্শী বিরাটের; তারি ধ্যানে সঁপিনু সকল। (প্রকাশ)
৮.। পরশ হরষে মজি নাই তাই গেয়েছি দেহের গান,
জেগে রব বলে করি নাই তার অধরের মধু পান।
রুদ্রের সাথে রতির সাধনা করিয়াছি একাসনে,
প্রাণের পিপাসা আঁখিতে ভরেছি রূপের অন্বেষণে।
সব যখন মিথ্যে হল, তখন :
অকূল শান্তি, বিপুল বিরতি আজিকে
মাগিছে প্রাণ।
৯. এমন প্রহর ভ্রমিবে না আর, ঠাই তার লবে চিনি
আর রবে না রূপের পিপাসা
আজি অ-ধরার অধর লাগি সারা প্রাণ উৎসুক
সে রসে বিবশ ঘুমাইবে মোর বাণী হারা
সুখ দুখ। (বাণী হারা)
প্রতিভাবান কবিদের রচনাবলীতে ভাবধারার একটা ঐক্য থাকে, একটি ভাব-সূত্রে গ্রথিত হয়ে রূপ রস ও ভাবের একটি অপূর্ব রসময় মানসমূর্তি অঙ্কিত হয়। অন্যকথায় সব রচনায় কবির আত্মভাব সাধনার বা কাব্যের মূল সুরের ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। মোহিতলালের কবিতায়ও এরূপ একটি যোগসূত্রের সন্ধান মিলে। এইজন্যই আমরা কবির কাব্য-প্রেরণার উৎস-রূপ ও প্রণয় পিপাসা আদিম বর্বর প্রবৃত্তির প্রতীক নাদির শাহ এবং বেদুইনের মধ্যেও দেখতে পাই। নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর এবং মৃত্যুশয্যায় নূরজাহান কবিতাদ্বয়েও রূপ ও প্রণয় পিপাসাই শেষ কথা :
১. তাহমিনা। তাহমিনা!
চাও, কথা কও! কোথা সুখ নাই
নাদিরের তোমা বিনা।
আজ নওরোজ রাতে
অশোক এসেছে, যৌতুক দিতে দিল তার ওই হাতে।
লুটাইনু পায়, বলিনু বাঁচাও! তুমি জানো সেই পাতা
যার রসে এই যাতনা জুড়ায়, আর কেহ জানে না তা। (নাদির শাহের শেষ)
২. এ বিশ বছর ধ্যান করি, কালি তার দেখা পেয়েছি ভাই।
মাফ পেয়েছি যে–ছুটি আজ থেকে,
হুকুম মিলেছে খোদাতালার,
সকল যাতনা জুড়াইয়া গেছে,
অবসান আজ সব জ্বালার। …
আমার কাহিনী তুই বুঝিবি না, বুঝেছে
সে কথা আর একজন।
দুনিয়ার মাঝে দরদী যেথায় করিবে।
অশ্রু বিসর্জন।
যেদিন চেয়েছি কবরে তাহার ব্যথায়
গুমারি গভীর রাতে,
অমনি আলো যে জ্বেলেছে দ্বিগুণ আগুনের ঝঞ্ঝাবাতে। (শেষ শয্যায় নূরজাহান)
৩. সেই মুখ, আর সেই চোখ, আর ছাউনি যে–
বাচ্চার পানে হরিণীর মত ফিরে চাওয়া পথের মাঝে।…
তারি মুখখানি মনে করে আমি গান বেঁধেছিনু
দিওয়ানা হয়ে
তেমন ব্যথা যে পাইনি কোথাও –ছুরি–ছোরা?
সে তো গেছেই সয়ে।
দারাত জ্বলের নামে গাঁথা সেই সুরটি পরাণ ছাইয়া আষে। (বেদুঈন)
৪. ভালো করে কাঁদো! ঢাকিওনা মুখ–
এত শোভা, মরি মরি
হাহাকার প্রাণ, তবু মনে হয় দেখে লই আঁখি ভরি!
ওই মুখ যবে জলে ভেসে যাবে আল্লার দরবারে,
রোজ কেয়ামত ভেরীর আওয়াজ থেমে যাবে একেবারে। (নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর)
মোহিতলাল ফারসি সাহিত্যের সূফীধারার অনুরাগী। জীবনকে সূফীদের ন্যায় প্রত্যক্ষ করতে তিনিও প্রয়াসী :
১. থাক তোলা আলবোলা পেয়ালায় মুখ ধর
চেয়ে দেখ মন ভোলা, দুনিয়া কি সুন্দর! (দিলদার)
২. যত নেশা হৌক রাতটি ফুরালে রয় তা কি?
তোমার সুর-সুরায় যে জন মস্তানা,
হুঁশ হবে তার আখেরি জামানা শেষ-দিনে।
বড় মিঠা মদ! ফের পেয়ালা ভর সাকী।
হরদম্ দাও! আজ বাদে কাল ভরসা কি? (গজল গান)
৩. য়ুসুফের রূপ দিনদিন যে গো ফুটে ওঠে,
কুমারী ধরম-শরম যে তার পায়ে লোটে।
জুলায়খার ঐ আবরু এবার গেল টুটে,
ইজ্জত রাখা ভার হল সেই লজ্জিতার। (হাফিজের অনুসরণে)
শব্দ, ভাষা ও ছন্দযোগে বিষয়ানুরূপ পরিবেশ সৃষ্টিতে মোহিতলালের কৃতিত্ব অসাধারণ। ফারসি সাহিত্যানুগ কবিতা রচনায় বা মুসলিম জীবনালেখ্য চিত্রণে তাঁর কৃতিত্ব লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে মোহিতলাল সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুসারী এবং এঁদের এ ধরনের কবিতাই নজরুল ইসলামকে উৎসাহিত করেছিল আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগে।
মোহিতলালের আর একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে তার মধ্যে ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতি প্রীতি যেমন প্রবল, তেমনি নতুন ভাব-চিন্তার অগ্রনায়ক বাঙালির মননও প্রচুর। এইজন্যে একদিকে অগ্নিবৈশ্বানর, পুরূরবা, মৃত্যু ও নচিকেতা, আবির্ভাব, রুদ্রবোধন, কন্যা প্রশান্তি প্রভৃতি কবিতায় যেমন তিনি হিন্দু তত্ত্ব-চিন্তার অনুসারী; তেমনি নারী স্তোত্র, বুদ্ধ, প্রেম ও সতীধর্ম অঘোর পন্থী, দেবদাসী, প্রেম ও জীবন প্রভৃতি কবিতায় বাঙালি সুলভ নতুন মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। এখানে কবির নিজস্ব মনন ও চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে। আমরা জানি মোহিতলাল মনেপ্রাণে স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বধর্মনিষ্ঠ। দেশাত্মবোধ ও ভারতীয় দর্শন-সংস্কৃতি প্রীতি তাঁর অস্থিমজ্জায়। তাঁর গদ্য রচনাবলীর মূল ব্যঞ্জনাই এসব। ফলে তাঁর মননশীল মন গ্রহণ বর্জনের একটি সুনির্দিষ্ট ধারা মেনে চলেছে। অন্য কথায় তিনি তার মনীষা ও রুচি অনুসারে হিন্দু তত্ত্ব-চিন্তা ও দর্শনের কিছু গ্রহণ কিছু বর্জন করে নিজস্ব একটা আদর্শ বা মতপথ খাড়া করেছেন। এজন্যে তাঁর কবিতার দু-এক জায়গায় সনাতন আদর্শ বিরোধিতা ও মতদ্রোহিতা প্রকাশ পেয়েছে :