১. অজর অমর হয়ে নিত্যের নন্দনে।
থেকো না অরূপ রূপে।…
নব নব জন বিবর্তনে আঁখি যুগ
চিনি লবে আঁখি যুগে, চির পিপপাসায়।
বার বার হারায়ে হারায়ে ফিরে পাব
দ্বিগুণ সুন্দর।…
নিত্যেরে কে বাসে ভালো? চিরস্থির ধ্রুব
অন্তর রজনী কিম্বা অনন্ত দিবস?
নহি তাই অনুরাগী। আমি চাই আলো
ছায়ারি পশ্চাতে; চাই ছন্দ, চাই গতি
রূপ চাই ক্ষুব্ধ সিন্ধু তরঙ্গ শিয়রে—
ধরিতে না ধরা যায়, পুলকে লুটায়। (পুরূরবা)
২. আমি চাই এই জীবনেরে জুড়ে বুকে করি লব সব,
জীবনের হাসি জীবনের কলরব।
জীবনের হাসি জীবনের দুখ
জীবনের আশা, জীবনের সুখ
পরাণ আমার চির উৎসুক
লইতে পাত্র ভরি
অধরে তুলিব ধরি
ধরণীর রস জীবনের রস যত।…
তারপর–আমার আমিটা একেবারে শেষ হোক
করিব না কোনো শোক,
মৃত্যুর পরে চাহিব না কোনো সুন্দর পরলোক। (মৃত্যু)
৩. জীবন মধুর! মরণ নিঠুর তাহারে দলিব পায়,
যত দিন আছে মোহের মদিরা ধরণীর পেয়ালায়!
দেবতার মতো কর সুধা পান।
দূর হয়ে যাক হিতাহিত জ্ঞান।…
অপরূপ নেশা অপরূপ নিশা
রূপের কোথাও নাহি পাই দিশা। (অঘোর পন্থী)
৪. ত্যাগ নহে, ভোগ–ভোগ তারি লাগি যেই জন বলীয়ান,
নিঃশেষে ভরি লইবারে পারে, এত বড় যার প্রাণ। (পাপ)
৫. জানি শুধু–যাব বহুদূর, আসিয়াছি বহদূর হতে!
জানি না কোথায় কবে।
পথ চলা শেষ হবে
লুকাইবে লোক-লোকান্তর অন্তহীন অন্ধকার স্রোতে। (পথিক)
৬. (দেহ) তোমারি সীমায় চেতনার শেষ,
তুমি আছ তাই আছে কাল দেশ,
দুঃখ-সুখের মহা পরিবেশ!
দেহলীলা অবসানে
যা থাকে তাহার বৃথা ভাগাভাগি
দর্শনে-বিজ্ঞানে।…
আর তুমি প্রেম!–দেহের কাঙ্গাল!
হারাইলে আর পাবে না নাগাল।
…. পড়িবে না চোখে সেই রূপ-রেখা–
স্বপনের সঙ্গিনী। (মৃত্যুশোক) শুধু এখানেই শেষ নয়, কবি মনে করেন, হৃদয়ের রূপ প্রণয় স্নেহ ভালবাসার ক্ষুধা ভবতৃষ্ণা জাগিয়ে রাখে। তাতেই জন্মান্তর হয় এবং স্বর্গের নিত্য আনন্দ-ভোগের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি মেলে। গৌতম বুদ্দের ভব তনহার শাস্তিস্বরূপ জীবজন্ম বা হিন্দুমতের পাপজনিত জন্মান্তর এ নয়, এ হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে জীবনের আনন্দ উপভোগ করবার জন্যে ধূলার ধরায় ফিরে ফিরে আসা।
১. শিয়রে মৃত্যুর ছায়া, চক্ষে ভাসে তবু
নন্দনের চিরন্তন আনন্দ স্বপন!…
প্রেম যে আত্মার আয়ু! ক্ষয় নাহি তার
জন্মে জন্মে তাই মোরা একই বধূ বর। (জন্মান্তরে)
২. এ ধরার মর্মে বিধে রেখে যাব স্নেহ ব্যথা, সন্তান পিপাসা,
তাই রবে ফিরিবার আশা।
তারি তরে, ওরে মূঢ়। জ্বেলে নেরে দেহ-দীপে
স্নেহ ভালবাসার নবজন্ম আশা। (মোহমুঘর)
স্বর্গও মিথ্যা–
৩ সত্য শুধু কামনাই মিথ্যা চিরমরণ পিপাসা।
দেহহীন, স্নেহহীন, অর্থহীন বৈকুণ্ঠ স্বপন।
যমদ্বারে বৈতরণী, সেথা নাই অমৃতের আশা
ফিরে ফিরে আসি তাই, ধরা করে নিত্য নিমন্ত্রণ (পান্থ)।
৪. নবীন জীবন জন্মে জন্মে লভিয়াছি প্রেমের প্রতাপে। (ভ্রান্তি বিলাস)
শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ হেমন্ত গোধূলির আমলে কবি তার আত্মভাব সাধনার মূল সুরটি হারিয়ে ফেলেছেন; লীলা চঞ্চল, দৃপ্ত-দুরন্ত সে যৌবন আর নেই। যৌবনের পুরোহিত প্রেমদেবতার আধিপত্য লুপ্ত হয়ে গেছে। যৌবন মদমত্তায় যে রূপ-প্রণয়কে জীবনে চরম ও পরম কাম্য বলে মনে করেছিলেন, যৌবনাবসানে কবির মোহ যখন গেল ছুটে, স্বপ্ন গেল ভেঙে, কঠোর বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে কল্পলোকবিহারী কবি তখন উপলব্ধি করলেন, রূপ প্রণয় সম্ভোগ প্রেম প্রভৃতি সব অনিত্য এবং নিঃসার। ফলে তার হৃদয়-মনে এল হাহাকার, ক্লান্তি, অবসাদ। যৌবনের সেই মিথ্যা ভোগেচ্ছাকে জীবনধর্ম বা দেহের নিয়তি বলে স্বীকার করে নিলেন। বিগত জীবনে ফেলে আসা দিনগুলোর জন্যে কোথায় যেন একটু ব্যথা বাজে, কেন যেন অনুশোচনা হয়। স্বপ্ন ভঙ্গে, আহত কবির চিত্ত বিক্ষুব্ধ অশান্ত ও ব্যথিত। তাই তিনি আকুলভাবে অকূল শান্তি ও বিপুল বিরতি আশায় গঙ্গাতীরে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছেন।
৩ যৌবন নিশার সেই স্বপন সঙ্গিনী,
সহসা উষার সাথে মিলাইল ত্বরা,
অন্তরীক্ষে, পূরূরবা মায়া বসুন্ধরা
কাঁদিয়া খুঁজিছে তারে দিবস যামিনী।
হায় নর! বৃথা আশা, বৃথা এ ক্রন্দন!
উর্বশী চাহে না প্রেম প্রেমের অধিক
চায় সে দৃপ্ত আয়ু, দুরন্ত যৌবন!
ফাগুনের শেষে তাই সে বসন্ত পিক
পলায়েছে; মরু পথে, হে মৃত্যু
কে রচিবে পুনঃ সেই প্রফুল্ল নন্দন? (স্বপন সঙ্গিনী)
৪. অসময়ে ডাক দিল হায় বন্ধু একি পরিহাস।
ফাগুন হয়েছে গত, জানো নাকি এ যে চৈত্র মাস?
বাতাসে শিশির কোথা ফুলেদের মুখে হাসি নাই,
কোকিল পলায়ে গেছে, গোলাপ যে বলে–যাই।
একদিন এ জীবনে পূর্ণিমার ছিল না পঞ্জিকা!
নিত্য জ্যোত্সা ছিল নিশা হেমন্ত ও শারদ চন্দ্রিকা!
শ্রাবণে ফাগুন রাতি উদিয়াছে বহু বহু বার
শীতে রৌদ্রে গাঁথিয়াছি চম্পা আর চামেলীর হার।
জীবনের সে যৌবন মরু পথে সেই মরুদ্যান
পার হয়ে আসিয়াছি আজ শুধু করি তার ধ্যান।
দুদিনের এই সুখ, দুদিনের এই সুন্দর ভুল
এরি লাগি সৃষ্টিপথ অহরহ মেলিছে মুকুল। (অকাল বসন্ত)
৫. রূপ মধু সৌরভের স্বপন সাধনা।
করিনু মাধবী মাসে, ইন্দ্রিয় গীতায়।
রচিনু তনুর স্তুতি। প্রাণ সবিতায়।
অঞ্জলিয়া দিনু অর্ঘ্য-প্রীতি নির্ভাবনা,
নিষ্ফল ফুলের মতো অচির শোভনা
সুন্দরের কামনারে গাঁথি কবিতায়। (ফুল ও পাখি)