স্বদেশে ধর্মমাত্রেই জীবন-চেতনারই প্রতিরূপ। তাই স্বদেশে যে-নতুন ধর্ম Practice, দেশান্তরে তা theory মাত্র। স্বদেশে যা real, দেশান্তরে তা-ই ideal এবং কালান্তরে তা। একটা idea, একটা কল্পনাসাধ্য Philosophy-র বেশি নয়। মানুষের সামান্য ধর্মের সাদৃশ্যবশে অঞ্চললাদ্ভূত ধর্ম দেশান্তরে প্রসার লাভ করে বটে, কিন্তু জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তা সম্পদ ও সম্বল হয়ে ওঠে না। যেহেতু তা theory হিসেবেই মন ভোলায়, তাই দেশান্তরে ব্যাপ্ত ও কালান্তরে স্থিতি পায়। কিন্তু ধর্ম যেখানে বাস্তব জীবনে সমস্যার সমাধান রূপে উদ্ভূত, সেখানে তা কালান্তরে হয় বিলুপ্ত। পশ্চিম এশিয়ার হযরত ইব্রাহিম থেকে হযরত ঈসা অবধি সকল চিন্তানায়ক। প্রবর্তিত ধর্ম-সমাজ এভাবে হয়েছে নিশ্চিহ্ন। স্বদেশে জরথুস্ত্রীর-জৈন-বৌদ্ধধর্মের পরিণামও স্মর্তব্য।
দেশ-কালের প্রতিবেশে উদ্ভূত বলেই তথা সামাজিক-নৈতিক-আর্থিক কিংবা প্রশাসনিক সমস্যার সমাধানের তাগিদজাত বিপ্লব-বিদ্রোহ প্রসূত বলেই ধর্ম তার উদ্ভব ক্ষেত্রের মানুষকে দেয় আত্মপ্রকাশের প্রেরণা ও আত্মবিস্তারের শক্তি। ইসলামের উদ্ভবে মরুভূ মক্কা-মদিনার জনগণ একদিন এমনি জীবন-স্বপ্নের বাস্তবায়নে বন্যার বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল অমোঘ শক্তিরূপে। চারদিককার ভুবন এলো তাদের দখলে। সিরিয়া-ইরাক-ইরান-মিশর-মরোক্কো-স্পেন-সিন্ধু-তুরান প্রভৃতি কত কত দেশ এল তাদের হাতে। পাঁচশ বছর ধরে চলল তাদের শাসন। পরিবর্তিত পরিবেশে তাদের ইসলামী প্রেরণা গেল উবে। মক্কা-মদিনার ঐতিহাসিক ভূমিকার হল অবসান। স্বদেশী ধর্ম মক্কা-মদিনার লোককে দিল ঐশ্বর্য ও সম্মান, করল শাসক, আর দেশান্তরে দীক্ষিত মুসলমানদের রাখল পরপদানত। স্বদেশে ইসলামের মুখ্যদান জিগীষা। কিন্তু দেশান্তরে দীক্ষিত মুসলমানদের মক্কা-মদিনাবাসীর মতো জিগীষু করেনি ইসলাম। অতএব দেশান্তরে ও কালান্তরে ধর্ম যে মানুষের জীবন-প্রয়াসে প্রেরণার উৎস হতে পারে না– কেবল আচার ও আচরণই নিয়ন্ত্রণ করে,–এ তথ্য ও তত্ত্ব নতুন প্রত্যয়ে গ্রহণ করা আবশ্যিক। নইলে বিভ্রমমুক্ত পথ মিলবে না এগুবার।
প্রায় আড়াইশ বছর ধরে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আবদুল আজিজ, আবদুল কাদির সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, বেলায়েত আলী, তিতুমীর, মক্কার মুহম্মদ ইবন্ আবদুল ওহাব, জামালউদ্দিন আফগানী, শরীতুল্লাহ, দুদুমিয়া, কবি হালী, কবি ইকবাল প্রমুখ বহু জ্ঞানী, মনীষী, চিন্তানায়ক ও দেশনেতা দুনিয়াব্যাপী মুসলমানদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, ধর্মনিষ্ঠা ও ধর্মাচারহীনতাই জাতীয় উত্থান ও পতনের কারণ। ইতিহাসের সমর্থন বিহীন এই ধারণায় গলদ ছিল বলেই তাদের প্রয়াস কোথাও সফল হয় নি। গত আড়াইশ বছর ধরে ধর্মীয় প্রেরণার মাধ্যমে তথা ধর্ম-সংস্কারের পন্থায়। মুসলমানদের উন্নতি বা আযাদী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বার বার। ধর্মের নামে তথা ধর্মভাবের মাধ্যমে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক উন্নতি লাভ করতে হলে দেশজ নতুন ধর্মের প্রয়োজন। কেননা দেশজ নতুন ধর্মই কেবল প্রাণে দিতে পারে প্রেরণা, বাহুতে দিতে পারে বল।
এ কারণেই সুলতান মাহমুদ থেকে আরম্ভ করে নওয়াব সিরাজদ্দৌলা অবধি সাতশ বছরের মধ্যে আমরা জ্ঞানী-গুণী কিংবা রাজা-বাদশা বা পদস্থ দেশী মুসলমান পাইনে। বহিরাগত নবধর্ম তাদের জীবনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল বলে প্রমাণ নেই। অথচ ভারতে অমুসলমানেরা রাজসরকারে যথাযোগ্য পদও পেয়েছেন, আবার স্বাধীন রাষ্ট্রও গড়ে তুলেছেন একাধিক। আর জ্ঞানী-মনীষীর তো কথাই নেই।
ভারতের অধিকাংশ মুসলমান নিম্নবর্ণের ও বিত্তের হিন্দু-বৌদ্ধ থেকে দীক্ষিত হলেও উচ্চবর্ণের লোকও নগণ্য ছিল না। তাদেরও তো কোনো দান ও উন্নতি জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সুলভ নয়। অতএব এর কারণ খুঁজতে হবে অন্যত্র।
আমরা দেখেছি মধ্য এশিয়ার নানা গোত্রীয় লোকই ভারতে আধিপত্য করেছে। তুর্কী-মুঘল ইরানীরাই দখল করেছিল রাজ-সরকারের সব উচ্চপদ। এজন্যে শাসকদের এ-দেশী স্বজাতির সহযোগিতা দরকার হয় নি। ফলে অমুসলমানের অংশ দেশী অমুসলমানেরা পেয়েছে এবং মুসলমানের অংশ সাতশ বছর ধরে ভোগ করেছে তুর্কী-মুঘল-ইরানীরাই। এভাবে বঞ্চিত রইল দেশী মুসলমানেরা। পদলাভের পথ রুদ্ধ ছিল বলেই হয়তো তাদের শিক্ষার প্রেরণাও ছিল না– ছিল না ধনাগমেরও সহজ উপায়। তাই অর্থে-বিত্তে কিংবা বিদ্যায় তারা সমাজের উঁচুস্তরে উঠতে পারে নি কখনো। এখনকার দিনে যেমন পূর্ব পাকিস্তানে কল-কারখানা গড়ে উঠেছে অনেক, কিন্তু মালিকানা রয়েছে অবাঙালির হাতে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান সমৃদ্ধ হচ্ছে, কার্যত বাঙালির দুঃখ ঘোচে নি। ঠিক এমনি অবস্থা ছিল ব্রিটিশ-পূর্ব যুগেও। দেশে ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু সে ঐশ্বর্য ছিল বিদেশাগত মুসলিমদের হাতে। আমাদের এ ধারণার পরোক্ষ সমর্থন পাই আরাকানের ইতিহাসে। সাময়িক বিচ্যুতি থাকলেও ১৬৬৫ সন অবধি চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অংশ। সেখানে তুর্কী-মুঘল-ইরানীর স্থায়ী প্রভাব ছিল না বলেই চট্টগ্রামবাসী বাঙলাভাষী বাঙালি মুসলমান রোসাঙ্গের শাসনকার্যে তাদের যথাযোগ্য স্থান পেয়েছে। তাই আমরা সতেরো শতকে আশরাফ খান, শ্রীবড় ঠাকুর, সৈয়দ মুসা, সোলায়মান, মাগন ঠাকুর, নবরাজ মজলিস প্রভৃতি দেশী মন্ত্রী পাই।