এইরূপে মোহিতলালের সকাম রূপপিপাসা ও প্রণয়ক্ষুধা নিষ্কাম বিদেহ রূপ সাধনার আভাস দিয়ে থেকে গেছে; তা রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে জগতের গিরি নদী সকলের শেষে কামনার মোক্ষধাম অলকার তীরে পৌঁছতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ যেমন রূপসাগরে ডুব দিয়েছেন অরূপরতন আশা করি, তেমনি আশ্বাস মোহিতলাল কোথাও পাননি। তাই তাঁর ক্রন্দন
মোর কামকলা কেলি উল্লাস
নহে মিলনের মিথুন বিলাস–
আমি যে বধূরে কোলে করে কাঁদি, যত
হেরি তার মুখ…
আমার পিরীতি দেহরীতি বটে, তবু সে যে বিপরীত
ভক্ষ্ম-ভূষণ কামের কুহকে ধরা দিল স্মরজিত!
ভোগের ভবনে কাঁদিছে কামনা
লাখ লাখ যুগে আঁখি জুড়াল না।
দেহের মাঝারে দেহাতীত কার ক্রন্দন সঙ্গীত (স্মরগরল)
[কবি শেখরের সখি, কি পুছসি অনুভব মোয় পদ স্মরণীয়।
২. একে দুই কাজ নাই, দুয়ে এক ভালো
তুমি আমি বাঁধা রব নিত্য আলিঙ্গনে।
নিভে যাক রাধিকার নয়নের আলো
রাধার মরণ হোক তোমার জীবনে।
আমি প্রেম, তুমি প্রাণ-বারি ও পিয়াস
এক পাত্রে রহে যেন দ্বন্দ্ব যাক থামি। (ভ্রান্তি বিলাস)
৩. একদিন আছিল যা সফেন তরল।
আজ সে যে নিরুজ্জাস! (উৎসর্গ)
৪. আমি মদনের রচিনু দেউল দেহের দেহেলী পরে
পঞ্চশরের প্রিয় পাঁচফুল সাজাইনু থরে থরে।
দুয়ারে প্রাণের পূর্ণ কুম্ভ
পল্লবে তার অধীর চুম্ব,
রূপের আধারে স্বস্তিক তার আঁকিনু যতন ভরে। (স্মরগরল)
৫. আমার অন্তর লক্ষ্মী দেহ-আত্মা-মানসের
শেষ তীর্থে শুচি স্নান করি দাঁড়াইল।
মুক্ত লজ্জা,
সর্বরাগহারা এবে, তাই তার রূপরেখা
অনিন্দ্য সুন্দর।
প্রাণের সঙ্গীত রসে একপাতে ধরেছিনু
ইন্দ্রিয়ের পঞ্চ উপাচার
বুঝি না দোহার মাঝে কেবা নিদ্রা যায়,
কেবা জাগে কার চেতনা হরিয়া
৬. দেবী সে প্রেয়সী নয়। এ যে তাই
আরো রূপ।
একি মোহ স্নেহ অবসানে– (রূপ মোহ)
৭ সৃষ্টির ভরা ভারি হয়ে এল, ভেঙ্গে যায় রূপের চাপে
তবু রূপ চাই স্নায়ু চিরে চিরে, আয়ু যে ফুরায় তাহারি দাপে!
রূপ নয় আর প্রিয়েরি লাগিয়া প্রেমের ছলা
সে যে নিজ তরে কামনা নটীর নৃত্যকলা। (রুদ্রবোধন)
৮. সুখের স্বপনে সুমধুর ব্যথা কেন জেগে রয়! (বসন্তবিদায়)
৯. কোথা সেই রূপ চোখ দিয়ে যারে যায় না ধরা,
যে রূপ রাতের স্বপন-সভায় স্বয়ম্বরা।
কোথা সেই তুমি দেখেছিনু যারে দেখারও আগে। (নিশিভোর)
১০. শত যুগ ধরি রূপসী বসুধা
মিটাইতে নারে অসীম যে ক্ষুধা
এক যৌবনে ফুরাবে সে সুধা?
তারি পরে যমকূপ।
হায় সখি, হায়! তবু এ ধরায় এত রঙ এত রূপ।
অসীম ক্ষুধার একটু সে সুধা যে করে পুলকে পান,
সে যে জীবনের বনে বনে পায় সুমধুর সন্ধান! (দিনশেষ)
এবার কবি জেনেছেন :
১১. জেনেছি কোন্ সাগর-কূলে।
আলোক লতা উঠছে দুলে
পেয়েছি সেই জ্যোতির আভাস
আর কিছু না চাই। (নতুন আলো)
১২. নয়নে লেগেছে আজ অবনীর বৃন্দাবনী মায়া,
যে জীবন যৌবনের ক্ষয় নাই, খেদ নাহি যায়–
হাসি অশ্রু দুই-ই-এক, একই শোভা গোলাপে শিশির!
জীবন বসন্ত শেষ–শেষ নাই পূর্ণিমা নিশির।… …
জীবনের মতো প্রেম উবে যায় যাদুমন্ত্র বলে,
ভাসে শুধু এক সুর–সুখহীন একান্ত উদাস।
১৩. সেই প্রেম! জন্ম জন্ম তারি লাগি ফিরিছে সবাই!
এই দেহ পাত্র ভরি যেই দিন উঠিবে উছলি–
যুচিবে দুরূহ দুখ মৃত্যুভয় রবে না যে আর। (বুদ্ধ)
১৪. মৌনবতী সে রাজকন্যারে আর কেহ চিনিল না–
শুধু মোর লাগি সে মূক অধরে মনোহর মন্ত্রণা!
তনুর প্রভায় অতনুরে নাশি
মোরে চিরতরে করিল উদাসী।…
অয়ি সুন্দরী ভুবনেশ্বরী!
আমার জগতে তবু হায় বাণীরাগ রঙ্গিণী,
হেরিনু তোমারে মনোমন্দিরে রূপ রেখা বন্দিনী।
আমারে লইয়া একি লীলা তব? (শেষ আরতি)
কবি ভুবেনশ্বরীর লীলা বুঝেও শান্তি পেলেন না–
১৫. এ যে মৌন অট্টহাস মরণের জ্যোৎস্না জাগরণ।
যৌবন দেহের ব্যাধি, রূপে যেন তাহারি বিকার!
মনে হয়, খুলে গেছে প্রকৃতির মুখ-আবরণ—
দিবসের লীলা শেষে নিশাকালে একি হাহাকার। (নিযুতি)।
সুতরাং এই স্তরে কবির তৃপ্তি–অতৃপ্তির, জানা-অজানার দ্বন্দ্বের নিরসন আর হল না, তাই আমরা বলেছি, কবি সাধন-মার্গের শেষপ্রান্তে অলকার তীরে পৌঁছতে পারেননি। কবি বুঝেছেন দেহাতীত রূপ–কামাতীত সৌন্দর্যই যথার্থ চাওয়ার ও পাওয়ার বস্তু। উপভোগ, তৃপ্তি কিংবা প্রশান্তি মেলে তখনই যখন রূপ নিরূপে পায় সূক্ষ্মতা, সৌন্দর্যানুভূতি নিরবয়বে পায় স্থিতি। কিন্তু তা তাঁর বোধে স্থায়ীভাবে ধরা দেয়নি। কায়ার প্রতিভাস ছায়ারূপে মাঝে মাঝে জেগেছে বটে, কিন্তু সে ছায়াও মায়া বিস্তার করে পালিয়েছে–জ্যোতিষ্মন হয়ে তার অন্তর্লোকে স্থিতি লাভ করেনি। আকূতি ও বেদনাতেই তাই কবির সাধনা অবসিত প্রশান্তিতে পরিসমাপ্ত নয়। মোহিতলাল ভোগের কবি– ত্যাগের নন-বেদনারও নন, তিনি জীবনধর্মী। প্রাণ-ধর্মের প্রাচুর্যে তাঁর বেদনাও মাধুরী হয়ে ফুঠে উঠেছে। তার কাছে জীবনের বড়ো প্রেম:
হায় প্রেম ক্ষণপ্রভা! এ জীবন আঁধার বিধুর!
জীবনের চেয়ে ভালো সে প্রেমের ক্ষণিক পুলক। (প্রেম ও জীবন)
তিনি একান্তভাবে জীবনধর্মী বলেই মৃত্যুর পরপারে আর জীবনের চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। মৃত্যু তাঁর নিকট অন্ধকার ও ধ্বংসের প্রতীক। এমনকি স্বর্গের নিত্য অনন্ত সুখও তাকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে তিনি বিহারীলালের ভাবশিষ্য। এ হাসি-অশ্রুময় জগতের আকাশ জল বাতাস আলোতে যে আরাম, যে সুখ, যে মাধুরী তা স্বর্গে নেই। তাই স্বর্গসুখ অনভিপ্রেত। এ সূত্রে রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপও স্মরণীয়। কবি বলেন