১২. আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী অপ্সরী সঙ্গোপনে!
সেথা সুখ নাই, দুঃখ নাই সেথা
–দিবা কি নিশা।
গানেরি আড়ালে সাড়া দেয় শুধু সে অমরা
বাহির ভুবনে এই বাহু পাশে দিবে না ধরা। (বিস্মরণী)
১৩. আমারে করেছে অন্ধ গন্ধ ধূমে দেহ-ধূপধার,
মাদক সৌরভে তার চেতনা হারায়।
বিষরস পান করি স্বাদ পাই স্বরগ সুধার,
চির বন্দী আছি তাই স্বপ্ন কারায়। (স্পর্শ রসিক)
১৪. দেহ ভরি কর পান কবোষ্ণ এ প্রাণের মদিরা
ধূলা মাখি খুঁড়ি লও কামনার কাঁচমণি হীরা।
অন্ন খুঁটি লব মোরা কাঙালের মত
ধরণীর স্তন যুগ করে দিব ক্ষত।
নিঃশেষ শোষণে, ক্ষুধাতুর দশন-আঘাতের করিব
জর্জর–আমরা বর্বর।
ওরে মূঢ়! জ্বেলে নে রে দেহ-দীপে স্নেহ
ভালোবাসা নব জন্ম আশা (মোহমুদার)
১৫. দেহে মোর আকণ্ঠ পিপাসা। ……. নিষ্ফল কামনা
মোরে করিয়াছে কল্প সহচর
সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি
মিথ্যা সনাতনী।
সত্যেরে চাহি না তব, সুন্দরের করি আরাধনা।
জানিতে চাহি না আমি কামনার শেষ কোথা আছে।
ব্যথায় বিবশ, তবু হোম করি জ্বালি কামানল!
এ দেহ ইন্ধন তায়–সেই সুখ।
চিনি বটে যৌবনের প্রেম দেবতারে,
নারীরূপা প্রকৃতিরে ভালবেসে বক্ষে লই টানি,
রহস্যময়ী স্বপ্ন সখী চির অচেনারে
মনে হয় চিনি যেন–এ বিশ্বের সেই ঠাকুরানী। (পান্থ)
১৬. সেই রূপ ধ্যান করি অঙ্গে মোর জাগিল
যে স্কুরৎ কদম্ব শিহরণ।
দেহ হতে দেহান্তরে বাধিলাম কি সহজে প্রীতি
প্রেম সেতুর বন্ধন।
পাপ-মোহ-লালসার লাল নীল রশ্মিমালা বরতনু
ঘেরিয়া তোমারি
লাবণ্যের ইন্দ্র ধনু শোভা ধরে–নাই জ্বালা,
মুগ্ধ হনু আনন্দে নেহারি। [অকাল সন্ধ্যা
১৭. ভালো যারা বাসে তারাই চিনেছে,
তুমি আঁকিয়াছ তারে–
সে দিনের সেই তরুণীরে নয়–নিখিলের
বনিতারে।
যার তনু ঘেরি, আরতি করিল শরতের
আলোছায়া–
মানস বনের মাধবী সে হল? ফাগুনের ফুল
কায়া! (মাধবী)।
১৮. বধূও জননী পিপাসা মিটায় দ্বিধাহারা–
রাধা ও ম্যাডোনা একাকারা!
অধরে মদিরা, নয়নে নবনী,
একি অপরূপ রূপের লাবণী।
সুন্দর! তব একি ভোগবতী
মরম পরশী রসধারা। (বাধন)
১৯. (হে দেহ) হাসি ক্রন্দন তব উৎসব!
পিরীতির পারাবার
অধরে, উরসে, চরণ সরোজে
আরতি যে অনিবার। (মৃত্যুশোক)
২০. রূপের আরতি করিনু আঁধারে।
আবেশে নয়ন মুছি–
হেরি দেহে মনে বাধা নাই আর,
–উদ্বেল অম্বুধি! (বিস্মরণী)
স্মরগরলে কবি বুঝেছেন : শুধু দেহে ও রূপে এ ক্ষুধা মিটবার নয়, যেন দেহাতীত এমন কিছু আছে যা সত্যিকার তৃপ্তি–নিবৃত্তি দিতে পারে, কিন্তু তা কি তিনি স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন নি!
বুঝি না, দোহার মাঝে কেবা নিদ্রা যায়,
কেবা জাগে কার চেতনা হরিয়া। (রূপ মোহ)
দেহ ও দেহস্থিত আত্মাকেও তিনি এক বলে উপলব্ধি করেছেন :
দেহের মাঝে আত্মা রাজে–
ভুল সে কথা, হয় প্রমাণ,
আত্মা-দেহ ভিন্ন কেহ
নয় যে কভু এক সমান। (পরমক্ষণ)
তিনি এই জীবনকে এবং যৌবন-ধর্মের স্বাভাবিক চাহিদা রূপ-দেহ-প্রণয়-সম্ভোগকে অস্বীকার করেননি। তিনি একান্তভাবে, জীবনধর্মী বলেই মৃত্যুর পরপারে আর জীবনের–চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। মৃত্যু তাঁর নিকট অন্ধকার ও ধ্বংসের প্রতীক। তাই বলে তাঁর এই রূপ-প্রণয়ের সাধনাকে কামজ মনে করবার হেতু নেই। একে তো তিনি দেহাতীত ও রূপাতীত সৌন্দর্য এবং সম্ভোগ বাসনাকে স্বীকার করেছেন, অধিকন্তু তাঁর রূপ ও প্রণয় পিপাসার মধ্যে এমন এক তীব্র ও গভীর অনুভূতি, এমন এক অনন্য সৌন্দর্য দৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে, যা ভূমির হয়েও ভূম্যেতর। এই প্রকার রূপ-সৌন্দর্য পিপাসা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–যারা সৌন্দর্যের মধ্যে সত্যি সত্যি নিমগ্ন হতে অক্ষম, তারাই সৌন্দর্যকে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের ধন বলে অবজ্ঞা করে–কিন্তু এর মধ্যে সে অনির্বচনীয় গভীরতা আছে, তার আস্বাদ যারা পেয়েছে, তারা জানে সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ান্ত শক্তিরও অতীত–কেবল চক্ষু কর্ণ দূরে থাক, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না।–(ছিন্নপত্র)
এই উক্তি মোহিতলাল সম্বন্ধে সর্বৈব প্রযোজ্য। এমনিতর ব্যাকুলতাই তার কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে। এ স্তরে তিনি জেনেছেন দেহে রূপ, রূপে রতি ও কামে প্রেম জন্মায়। সে প্রেম। সম্ভোগলিন্দু নয়, একপ্রকার মানসোপভোগই কাম্য। তখন দৈহিক রূপ সৌন্দর্যানুধ্যানের সোপান কিংবা অবলম্বন মাত্র।
এ বোধে উত্তরণের পর মোহিতলাল যথার্থই শিল্পী–নিষ্কাম সৌন্দর্যের সাধক। কিন্তু তাতেও যেন কোথায় অতৃপ্তির বেদনা জেগে থাকে। যেন কামে-প্রেমে একটা দ্বন্দ্ব, রূপে-অপরূপে যেন টানাটানি–একটা আলো-আঁধারি কিংবা কায়া-ছায়ার মায়াপ্রপঞ্চ তাঁকে অস্থির ও উদ্বিগ্ন রাখছে। তবু স্বীকার করতে হয় Byron-এর মতো উচ্ছলতা, Shelley-র মতো উদ্দামতা এবং Keats-এর মতো আকুলতা তার নেই। তবে Keats যেমন বুঝেছেন–
Heard melodies are sweet
But those unheard are sweeter
তেমনি মোহিতলালও উপলব্ধি করেছেন–এই যৌবন এই রূপ এই দেহ সত্য হলেও স্বপ্ন এবং রূপের আরতি সুন্দরতর।
বল দেখি, কমলের বঁধূ অলি, না সে ওই আকাশের রবি?
রূপ যে স্বপ্ন তারকামনার ধন নয় বাসনার ছবি।
রূপসীরে করে পূজা, প্রেয়সীরে ভালবাসে কবি।
রূপ নহে সেই রস, রতি নয় সে শুধু আরতি,
মনের নিশীথে সে যে চিত্তাকাশে অপরূপ জ্যোতি।
সে তো নহে ভোগ প্রয়োজন,
সে নয়, প্রাণের ক্ষুধা প্রেম নয়, সে তো দেহ পদ্মে মধু আস্বাদন।
উঁহু দোঁহা ভুঞ্জে শুধু, দুই আমি এক আমি হয়,
আত্মরস রসাতলে স্বর্গ-মর্ত নিখিলের লয়! (রতি ও আরতি)