চিরদিন চিরদিন।
রূপের পূজারী আমিরূপের পূজারী।
মোহিতলালও বলেছেন–আমি কবি অন্তহীন রূপের পূজারী।
কবি-চিত্তে রূপের পিপাসা–রূপ আগে পরে ভালবাসা (রতি ও আরতি)। Taso বলেছেন, That thou art beautiful and I am not blind; মানে, তোমার রূপ আছে আমারও আছে পিপাসা। রবীন্দ্রনাথের কথায় : ও রূপের কাছে এ ক্ষুধা তাই চিরদিন জাগিয়া রবে। Keats-8 657676901-A thing of beauty is a joy forever. মোহিতলাল মননশীল, তাই তিনি মানস রূপের পূজারী :
যেই আমি আমা হতে মুক্তি চাই কল্পনার নিশীথ স্বপনে,
সেই আমি বাঁধি পুন আপনারে চেতনার জাগ্রত ভুবনে।
আমারি ঐশ্বর্য তাই হেরি আমি তার দেহ মাঝে,
তাই সে সুন্দর হেন, সাজিয়াছে মোর দেওয়া ফুল্লফুল সাজে। (রতি ও আরতি)
মোহিতলালের সাধনায় তিনটি স্পষ্ট স্তর রয়েছে। স্বপন পসারী-বিস্মরণী স্তর, স্মরগরলের স্তর এবং হেমন্ত গোধূলির স্তর। স্বপন পসারীতে উন্মেষ, স্মরগরলে পূর্ণ বিকাশ এবং হেমন্ত গোধূলিতে অবসান। প্রথম স্তরকে রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমলের যুগের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরকে মানসীর সঙ্গে মিলানো যায় না। কারণ মানসীর নিষ্ফল কামনা ও সুরদাসের প্রার্থনায় কবির দেহ-সম্ভোগ লিপ্সার ইতি ঘটেছে এবং অনন্ত প্রেম কবিতায় প্রেমের বিকাশ, বিস্তার ও চরম পরিণতি সম্বন্ধে অপরূপ উপলব্ধি রয়েছে।
কবি বুঝে নিয়েছেন–
ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব
কেহ নহে তোমার আমার।
এবং
আকাক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের। (নিষ্ফল কামনা)
আরো উপলব্ধি করেছেন :
বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার চিরকাল রবে সে কি
ক্রমে ধীরে ধরে নিবিড় তিমিরে ফুটিয়া উঠিবে নাকি
পবিত্র মুখ, মধুর মূর্তি স্নিগ্ধ আনত আঁখি?
হৃদয় আকাশে থাক না জাগিয়া দেহহীন তব জ্যোতি।
তোমাতে হেরিব আমার দেবতা হেরিব আমার হরি
তোমার আলোকে জাগিয়া রহিক অনন্ত বিভাবরী। (সুরদাসের প্রার্থনা)
এ উপলব্ধির চরম বিকাশ অনন্ত প্রেম কবিতায় :
তোমারেই আমি বাসিয়াছি ভাল শতযুগে শতবার
যুগে জনমে জনমে অনিবার।
আমরা দুজন করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
আজ সেই চির দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে।
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
এর পরে রবীন্দ্রনাথ এক অশরীরী রূপ-সৌন্দর্যকে ভালবেসে প্রণয়-ক্ষুধায় চরিতার্থতা লাভ করেছেন। মোহিতলাল কিন্তু এই মার্গে পৌঁছতে পারেননি। তিনি স্বপনপসারী ও বিস্মরণীতে দেহ সম্ভোগে রূপ-সৌন্দর্য-প্রণয় পিপাসা মেটাতে চেয়েছেন। অবশ্য ভাবের ঘোরে ধ্যানের চোখে কায়া কখনো কখনো ছায়াতে এবং মায়াতে মিলিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের রাহুর প্রেম-এ যে প্রবৃত্তি বেগ প্রকাশ পেয়েছে, এ স্তরে মোহিতলালও প্রায় সেই আবেগে চঞ্চল এবং লিপ্সায় মুখর। তার কয়েকটি অভিব্যক্তি :
১. কনক-কমল রূপে প্রেম যদি ফুটি উঠে
তবেই আমার মানস-মরাল অলস পক্ষপুটে
চকিতে জাগিয়া উঠে। (রূপতান্ত্রিক)
২. আমার দেবতা–সুন্দর সে যে!
পূজা নয়, ভালোবাসি!
সুন্দর লাগি ভালোবাসা মোর,
অন্তর আঁখি ফুটে!–(রূপতান্ত্রিক)
৩. থাক্ তোলা আলবোলা পেয়ালায় মুখ ধর!
চেয়ে দেখ মন-ভোলা দুনিয়া কি সুন্দর! (দিলদার)
৪. দিকে দিকে প্রিয়ারি পিরীতি।
উথলিছে লাবণ্যের মত! সে মিলন
অহরহ কোথা নাই বিরহ কল্পনা!…
আলোক আঁধারে দ্বন্দ্ব।
ঘুচে গেল মানবেরি পিপাসার সাথে। (পুরূরবা)
৫. রানীর মুকুটখানির কথা প্রেমির মনে জাগে
নারীর পূজার তরেই সে যে রাজার বিভব মাগে। (নারী)
৬. রস–সে যে রূপে পড়িয়াছে ধরা, কোথা নহে নিরাকার,
অরূপ রূপের উপাসনা–সে যে অন্ধের অনাচার! (একখানি চিত্র দেখিয়া)
৭. পাপের লাগিয়া ফুটিয়াছে হেন অতুল অবনী ফুল (প্রেম)?
রসে রূপে আর সৌরভে যার চরাচর সমাকুল!
পরতে পরতে দলে দলে যার অমৃত পরাগ ভরা–
মধুহীন যারে করিবারে নারে শোক তাপ ব্যাধি জরা। (পাপ)
৮. নীল ফুলে ভরা কুঞ্জ বিতানে।
চেয়ে আছি আমি কার মুখপানে
হয়ে গেছি ভোর রূপ সুধা পানে,
চেয়ে আছি অনিমেষ…
রূপের প্রভায় ঝলসে নয়ন
সীমা নাই, সীমা নাই।…
সেতো নহে শুধু দেহ বিভঙ্গ
কালো আঁখি আর কেশ তরঙ্গ,
বিষ অধরে মুকুতা সঙ্গ,
সে যে সবই রূপ! সে যে অনঙ্গ
দিব্য আলোক বিভা। (পূর্ণিমা স্বপ্ন)
৯. সৃষ্টি হতে এতকাল এই যে পীড়ন–
এত কালি, এত ধূলা এত পাপ তাপে,
তবু কি মরেছি আমি? নবীন জীবন।
জন্মে জন্মে লভিয়াছি প্রেমের প্রতাপে। (ভ্রান্তি বিলাস)
১০. মধু সৌরভ-সৌরভ মধু। মধু আর শুধু মধু,
আপনারি প্রাণ দুইখানি হয়ে হল বর হল বধূ!
পাপড়ি কি পাখা চেনা নাহি যায়, কার মধু
নাহি গুঞ্জন, শুধু সুধা পান শুধু সুখ! (আঁধারের লেখা)
১১. আকাশের তারা যেমন জ্বলিছে জ্বলুক
অসীম রাতি,
ওর পানে চেয়ে ভয়ে মরে যাই, চাহি না
অমৃত ভাতি।
ধরার কুসুম বার বার হাসে, বার বার কেঁদে
আঁধারে আলোকে শিশিরে কিরণে আমি
হব তার সাথী। (কামনা)
এখানে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। তিনিও ভালবাসি নারী নরে, ভালবাসি চরাচরে সুখ পেতে চেয়েছেন এই হাসি-অশ্রুময় ধরণীতে। তিনিও স্বর্গের অনন্ত সুখ ভীরু!স্বরগে অন্ অনন্ত সুখ! ওহো, এ কি যাতনা!