এঁদের মধ্যে আবার মোহিত মজুমদার ক্লাসিকধর্মী বলে, যতীন্দ্রনাথ নতুন জীবন-দৃষ্টির জন্যে, কাজী নজরুল নতুন ভাব-চিন্তা-আদর্শ ও আঙ্গিকের প্রবর্তক হিসেবে এবং জসীমউদ্দীন প্রাচীন পল্লী-সাহিত্য ধারার অনুসারীরূপে বিশেষভাবে খ্যাতিমান।
মোহিত মজুমদার ক্লাসিকধর্মী হলেও তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাষা এবং য়ুরোপীয় ভাবাদর্শের প্রভাব কম নয়, তবু তাঁর একটা নিজস্ব ভাবলোক, মতপথ এবং গতি ও ভঙ্গি রয়েছে, যা অন্যত্র সুদুর্লভ। তাই তিনি অনন্য ও তাঁর কবিতা বিশিষ্ট। তাঁর কাব্যে সবচেয়ে যে বস্তুটা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে কাব্যের আঙ্গিক বা কবিতার Diction. শব্দ চয়নে আভিজাত্য, ছন্দে গাম্ভীর্য ও লালিত্য, ভাবাদর্শের অনন্যতা, প্রকাশ-ভঙ্গির-বৈশিষ্ট্য ও সংযম তাঁর কাব্যকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এককথায় মোহিতলালের কাব্য Classical in form আর Romantic in Spirit.
কবি আদর্শবাদী ও শিল্পী। তাঁর কাব্যে ব্যবহারিক জীবনের রোগ-শোক, জরা-মৃত্যু-ব্যথা, অথবা নিজের বা মনুষ্য-সাধারণের দৈনন্দিন জীবনের আনন্দ-বেদনা, অভাব-অনটন, অত্যাচার নিপীড়নের কাহিনী স্থান পায়নি–কারণ তাঁর মতে:
জীবন যাহার অতি দুর্বহ, দীন দুর্বল সবি,
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ সেই জন বটে কবি।
অতএব তাঁর কাব্য-প্রেরণার উৎস–ব্যবহারিক জীবন কিংবা মনুষ্য-সাধারণ নয়। তাঁর কাব্যে কোথাও বৈষয়িক জীবন-চেতনার অভিব্যক্তি নেই। কবি রসাদর্শের (art for arts sake) অনুসারী। তাঁর ভাব-চিন্তার ধারা তন্ময় নয়–মন্ময়। ব্যবহারিক জীবনে সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা ও কলকোলাহলের ঊর্ধ্বে মনোময় কল্পজগৎ সৃষ্টি করে তাতে তিনি বিহার করেন। বাস্তব জীবনকে আড়াল করে স্বপ্নের স্বর্গলোকে কামনার কামিনী-সাধনায় তার শিল্পীমন পরিতৃপ্তি খোঁজে। তাঁর নিজের কথায়:
১. এ হৃদয়ে আজো তাই রহিয়াছে অমৃতের তৃষ্ণা।…
… সকল কল্লোল মাঝে নীরব নিকুঞ্জ গড়ি করিতেছে নিভৃত কূজন।
—(উৎসর্গ–স্বপন পসারী)
২. যে স্বপন তুমি দেখিয়াছ রাতে–
মনে নাই যাহা জাগিয়া প্রাতে,
তবু আঁকা আছে হৃদয়ের পাতে
জল-রেখা রঙ্গিলা–
সেই জলছবি ফুটাইবে কবি।
–অপরূপ সেই লীলা।
আনন্দ ধন-রস-সরসিত,
দিবসের জ্বালাহরা
ঘুচে যাবে খেদ, যত ভেদ-ভয়,
কায়া আর ছায়াবৃথা সংশয়,
স্বর্গ হইবে ধরা। (স্বপন পসারী)
৩. ভুলের ফুলের মোহন মালিকা
গাঁথিয়াছে হের স্বপ্ন বালিকা।
যে বীণা বাজাতে আলো-নীহারিকা
ছায়া পথে যায় থামি–
তারি সুরে হেঁকে পথ চলি ডেকে।
স্বপন-পসারী আমি। (স্বপন পসারী)
৪। যত ব্যথা পাই, তত গান গাই–গাঁথি যে সুরের মালা!
ওগো সুন্দর! নয়নে আমার নীল কাজলের জ্বালা!
আঁখি অনিমিখ, মেটে না পিপসা, এ দেহ দহিতে চাই!
সুখ-দুঃখ ভুলে যাই। (ব্যথার আরতি)
৫. দেহী আমি, মন্দিরে মন্দিরে তাই পরশ ভিখারী,
…. পরশ-রসিক আমি, অন্ধ আঁখি তারা
আমার আকাশ তাই শশী সূর্য হারা।
পদতলে পৃথ্বি আছে আলিঙ্গনে চৌদিকে বিথারি–
আলো নাই, আছে শুধু প্রাণের আরাম। (স্পর্শ রসিক)
৬. ঘোমটা-পরা মিথ্যাময়ী সেই যে আমার সর্বজয়ী!
জনমকালে কখন সে যে জড়িয়েছিল কণ্ঠহারে–
একটি চুমায় বন্ধ করে রাখল প্রাণের নিশানটারে! (অ-মানুষ)
৭. সুখ-দুঃখের বিলাস-বাঁশরী তানে,
সুর দিব আমি হাস্য-অশ্রু-গানে,
ফুটাব ঝরাব ফুল-পল্লব বারোমাস। (মৃত্যু)
৮. রূপ-মধু সৌরভের স্বপন সাধনা
করিনু মাধবী মাসে; ইন্দ্রিয় গীতায়
রচিনু তনুর স্মৃতি। (ফুল ও পাখী)।
তাঁর এই কল্পলোকে তিনি যে রস পান করেন–তা এ জগতে দুর্লভ। এই ভাব-সর্বস্ব কল্পলোকাশ্রয়ীদের সুবিধে এই যে, এখানে জীবন সংঘাতমুখী নয়–একেবারে নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন।
মোহিতলালের অনুভূতির সে-জগৎ প্রশস্ত নয়। তাই সেখানে তাঁর জীবন-লীলায় বৈচিত্র্য বিরল। নানা ভাবে, নানা ধারায় জীবনকে উপলব্ধি করবার প্রয়াস তাতে অনুপস্থিত। তাঁর প্রাণও উচ্ছল নয়–এ জন্যে তাঁর ভাবাবেগে উদ্দামতা নেই, তবে তাঁর অনুভূতি তীক্ষ্ণ ও গভীর। এ কারণে কবি সর্বত্র সংযতবাক ও গম্ভীর। আঙ্গিকের আভিজাত্য, বাভঙ্গির গাম্ভীর্য, অনুভূতির অনুচ্ছলতা, মননশীলতা প্রভৃতি তাঁর কাব্যমাধুর্যকে ফল্গুধারার মতো গুপ্ত ও মন্দ-প্রবাহিণী করে রেখেছে। ঊর্মিমুখর স্রোতস্বিনী করে তোলেনি। ফলে তাঁর কাব্যে শুধু বিশেষের অধিকার আছে, তার দুর্গম কাব্যবীথি সাধারণের জন্যে দুরতিক্ৰমণীয়। এসব কারণে উঁচুদরের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাঁর কবিখ্যাতি সাধারণ্যে বিস্তৃত হয়নি। কবিও এ ব্যাপারে সচেতন : তিনিও বলেছেন,-I shall dine late but the dining room will be well lighted, the guests few and select.
কবি কল্পলোকে যে পিপাসা নিয়ে বিচরণ করেন, সে পিপাসা হচ্ছে–রূপ ও প্রণয় পিয়াস। কবি উপলব্ধি করেছেন–দেহে রূপ, রূপে প্রণয় এবং প্রণয়ে সম্ভোগ লিপ্সা জাগে। অতএব, রূপ। প্রণয় ক্ষুধা চরিতার্থতা লাভ করতে পারে একমাত্র দেহকে অবলম্বন করেই। এই দেহ-কেন্দ্রী রূপ ও প্রণয় সাধনাই হচ্ছে তার প্রথম দিককার কাব্যের মূল সুর।
যে রূপের পিপাসায় প্রেম হল জীবন অধিক (প্রেম ও জীবন)
এ ব্যাপারে মোহিতলাল কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের ভাবশিষ্য। দেবেন্দ্রনাথের সাধনাও ছিল রূপ সাধনা। তবে তিনি প্রধানত নিসর্গ রূপপিয়াসী।