এভাবে আশীর্বাদকে অভিশাপ ভেবে তারা যে কেবল নিজেরা ঠকেছে তা নয়, ভাবী মানুষের অগ্রগতিও করেছে ব্যাহত। অতএব, আদিম স্তরে আবদ্ধ আরণ্য-মানুষের কথা তো উঠেই না, এমনকি দুনিয়ার অগ্রসর মানুষের সংস্কৃতি-সভ্যতাও সময় আর সংখ্যার পরিমাপে শোচনীয় ভাবে সামান্য।
যতই মন্থর ও বাধাগ্রস্ত হোক, তবু প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির দাস মানুষের মুক্তি অন্বেষার ও প্রয়াসের একটি প্রবহমান ইতিহাস আছে। সে-ইতিহাস অবশ্যই গুটিকয় চিন্তাশীল ও কর্মীমানুষের চিন্তা ও কর্মের ইতিকথা। এ ভাবে একজনের চিন্তা অন্য সবার সংস্কারে এবং একজনের কর্ম অন্যদের আচারে হয় রূপায়িত ও পরিণত। অতএব, একের চিন্তা ও কর্মের ফসল সমাজবদ্ধ অঞ্চলবাসী গোত্রের মানস ও ব্যবহারিক সংস্কার এবং আচার তথা চেতনা ও জীবিকা-পদ্ধতিরূপে পরিচিত।
প্রমাণে ও অনুমানে জানা যায়, Animism, Magic belief, Totem, Taboo gyfo Pagan ও প্রতীকতার স্তর পার হয়েই ধর্ম-দর্শনের স্তরে উন্নীত হয়েছে মানুষ। এখনো অবশ্য সর্বস্তরের মানুষই মেলে অল্পবিস্তর। এ সব মতবাদ বিশ্বাস-ভিত্তিক। এ বিশ্বাসপ্রসূত ভয়-ভরসা নির্ভর জীবনধারা চলেছে আজো। প্রকৃতির পোষণ ও পীড়ন থেকে মুক্তি-কামনায় মানুষ স্বাধীন ও স্বস্থ জীবনোপায় সন্ধানে বেরিয়ে, ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন স্তর উত্তীর্ণ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আজকে অবস্থায়।
অঞ্চল ও গোত্রে সীমিত জীবনে আচার-সংস্কারের এরূপ ঐক্যমত ছিল সমাজ-বন্ধনের ও সমাজ-শৃঙ্খলা রক্ষার সহায়ক। অভিন্ন মত ও স্বার্থভিত্তিক ঐক্য অন্য অঞ্চলের ভিন্ন গোত্রীয় লোকের আক্রমণ প্রতিরোধের হয়েছিল সহায়ক আর সহজ করেছিল যৌথ প্রচেষ্টায় জীবিকার্জন।
কাজেই একস্তরে গোত্ৰ-চেতনা ও পরবর্তী স্তরে ধর্মীয়-ঐক্য চেতনা ছিল মানুষের আত্মরক্ষার ও আত্মোন্নয়নের সহায়ক। Pagan মত ও ধর্মমতের পার্থক্য এখানে, যে Pagan মতের ভিত্তি হচ্ছে ভয়-বিস্ময়-ভরসা ও কল্পনা। আর ধর্মমত হচ্ছে বিশ্বাসের অঙ্গীকারে যুক্তি ও তাৎপর্যের সমন্বিত রূপ। যে-যুক্তির ভিত্তি জ্ঞানও নয়, প্রজ্ঞাও নয়, কেবলই বিশ্বাস, তা ফুটো পাত্রে জল ধরে রাখার মতো অলীক। সে-যুক্তি প্রমাণ নয়,অনুমান। বিশ্বাস ও যুক্তি এমনিতেই পরস্পর বিপরীত ভাব। বিশ্বাস অন্ধ ও বন্ধ্যা, আর যুক্তি জ্ঞান ও জ্ঞানপ্রসূ। বিশ্বাসের উৎস মানসপ্রবণতাজাত ভাব, আর যুক্তির ভিত্তি বাস্তব প্রমাণ। তাই বিশ্বাসে যুক্তি আরোপ করা পুতুলে চক্ষু বসানোরই নামান্তর।
দুধ শিশুর খাদ্য। শৈশবোত্তর কালে মানুষ সে-খাদ্যে বাঁচে না। তখন অন্য খাদ্য প্রয়োজন। তেমনি Animism থেকে Religion অবধি বিশ্বাস ও ব্যবস্থা সমাজবদ্ধ মানুষের শৈশব-বাল্যের সংস্কৃতি, সভ্যতা কিংবা জীবন-জীবিকার প্রয়োজন মিটিয়েছে। এক বয়সের অবলম্বন অন্য বয়সের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। তাই পুরোনো সবকিছু জীর্ণপত্র ও ছিন্ন বস্ত্রের মতো পরিহার করে নতুনের প্রতিষ্ঠা করেছে মানুষ। কাজেই পুরোনো জীবনবোধ ও রীতিনীতি নতুন মানুষের জীবন যাত্রার অনুকূল নয়। কিন্তু বিশ্বাস-সংস্কারের ব্যাপারে সে পুরোনোকেই শ্রেয় ও সত্য মনে করে। এজন্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে পরিবর্তনকে স্বীকার করে,-পরিবর্তন যে পরিবর্ধনও তা সহজেই মেনে নেয়। কিন্তু তার বিশ্বাস ও আচার সংস্কারের ক্ষেত্রে সে সত্য ও শ্রেয়সের চিরন্তনত্বে আস্থাবান। ব্যবহারিক জীবনের ক্ষেত্রে মানুষ চিরকালই বিনাদ্বিধায় নতুনকে গ্রহণ করেছে, পরম আগ্রহে বরণ করেছে শ্রেয়ঃ-কে। কিন্তু মনোজীবনে তার রয়েছে অচলায়তনের বাধা। সেখানে সে পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কারের অনুবর্তনে আশ্বস্ত থাকে–আয়ত্তগত সংকীর্ণ চেতনার পরিসরে সে যেন খুঁজে পায় নিজেকে–এতেই তার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য। তাই নিষ্ক্রমণের সিংহদ্বার খুলে দিয়ে বাইরের উদার আকাশের আলো-হাওয়ায় কেউ আহ্বান জানালেও বের হতে সাহস পায় না সে। পাছে অনিশ্চিত অজানায় বেঘোরে মরতে হয়–এই তার ভয়। চিন্তনে ও সৃজনে সে নিষ্ক্রিয় বলেই সে বিবেচনা শক্তিহীন, সে গোঁড়া; সে রক্ষণশীল। তার নতুন-ভীতি ও পুরোনো-প্রীতির এই কারণ।
বলেছি গুটিকয় লোক ছাড়া আর সব পরচিন্তা ও পরসৃষ্টিজীবী। বিরূপ সংখ্যাগরিষ্ঠের বিমুখতার ফলে মনুষ্য-সমাজের অগ্রগতি ছিল নিতান্ত মন্থর এবং সময় সময় হয়েছে ব্যাহত।
যেহেতু পুরোনোর অপর নাম জরা ও জীর্ণতা, আর নতুন-মাত্রই জীবন ও শক্তির প্রতীক; সেহেতু নতুনকে শেষ অবধি ঠেকিয়ে রাখা যায় না যায়নি। কেননা বন্যা বাঁধ মানে না। তাই সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করেই এগিয়েছে সংস্কৃতি ও সভ্যতা,–ভাব-চিন্তার হয়েছে বিকাশ ও বিস্তার। কিন্তু তবু তার উত্তরণ ঘটেনি যুগের তোরণে। কেননা, কোনো বিকাশই হতে পায়নি সর্বাত্মক ও সর্বমানবিক। আজকের মানুষের বারো আনা দুঃখই এ পিছিয়ে-পড়া মানুষের মানস মুক্তির অভাব প্রসূত। সব মানুষের মনে যতদিন জ্ঞান-প্রজ্ঞাজ যুক্তির জন্ম না হবে, ততদিন সমাধান নেই মানবিক সমস্যার।
আদিম মানুষের জীবনবোধ ছিল অবিকশিত। তার জৈবিক চাহিদা ছিল সীমিত। জীবন ছিল আঞ্চলিক। জীবিকা ছিল পরিবেষ্টনীগত। তাই গোত্রীয় ঐক্যই ছিল নিদ্বন্দ্ব-নির্বিঘ্ন জীবন ও জীবিকার দৃষ্টিগ্রাহ্য উপায়। প্রকৃতি ও পরিবেষ্টনীর অনুগত জীবনে তাই বিবেচিত হয়েছিল শ্রেয়। বলে। কথায় বলে, Necessity is the mother of invention, এই প্রয়োজন-বুদ্ধিই উপযোগ সৃষ্টির যুগিয়েছে প্রেরণা। পূজ্যের অভিন্নতা পূজারীকে করেছে ঐক্যবদ্ধ। Fatherhood of deity, brotherhood of men-তত্ত্বে দিয়েছে প্রেরণা ও প্রবর্তনা। সেদিন সে-অবস্থায় এর থেকে কল্যাণকর আর কিছুই হতে পারত না হয়তো। উপযোগবুদ্ধিজাত এই ঐক্য জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে দিয়েছে যৌথ প্রয়াসের সুযোগ দিয়েছে নিরাপত্তার আশ্বাস ও আত্মপ্রসারের প্রেরণা।