সেকালের ধর্মমত আর একালের মতবাদ দুটোই মূলত সামান্য অর্থে ধর্ম,–জীবনযাত্রীর নিয়ামক। একটা ঐশ্বরিক, অপরটা নিরীশ্বর তথা মানবিক–পার্থক্য এটুকুই। কিন্তু কোনোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। মানবিক সমস্যার সমাধানে কোনোটাই নয় পুরো সমর্থ। তবু গণহিতৈষণা-কামীর গণবাদ শ্রেয় এবং গণতন্ত্র উন্নততর ব্যবস্থা।
সেকালে ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন, প্রচারক ছিলেন, ছিল ধর্মগ্রন্থ। একালেও মতবাদের প্রবর্তক আছেন, সংবাদপত্রই এর গ্রন্থ এবং সাংবাদিকরাই এর প্রচারক। এজন্যে আজ সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরাই মানব ভাগ্যের নিয়ামক।
সেকালে পৃথিবী ছিল খণ্ডে বিভক্ত, আর সে-কারণে সমাজগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন। একালে পৃথিবী হয়েছে অখণ্ড ও সংহত। মানুষের প্রয়োজন ও সমস্যা হয়েছে একই সূত্রে গ্রথিত। যৌথ প্রয়াস ছাড়া কোনো প্রয়োজনই মেটে না; সহযোগিতা ছাড়া মেলে না কোনো সমস্যার সমাধানও। এমনি। অবস্থায় ধর্মীয় ও জাতীয় স্বাতন্ত্র-প্রবণতা কেবল অকল্যাণই আনবে। স্বাতন্ত্র ও সৌজন্য; স্বার্থ ও সহযোগিতা; ধর্মবোধ ও মানবতা এবং জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধনেই কেবল আজকের মানবিক সমস্যার সমাধান হতে পারে।
আগের যুগের মানবতাবোধ ছিল ব্যক্তি-মানসের উৎকর্ষের ফল। এ যুগে মানবতাবোধ সমাজ-মানসে সংক্রমিত না হলে মানুষের নিস্তার নেই। সংবাদপত্র হচ্ছে গণসংযোগের মাধ্যম। কাজেই মানবতা-প্রচারকের ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে সাংবাদিককেই। স্বার্থ বজায় রেখেও সৌজন্য দেখানো সম্ভব অথবা সৌজন্য বজায় রেখেও স্বার্থসচেতন থাকা যায়–লি মুক্ত স্বার্থে ও সৌজন্যে যে বিরোধ নেই–এ কথা আজ মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ব্যষ্টি নিয়েই সমষ্টি। ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র্য যেমন প্রয়োজন, সামষ্টিক দায়িত্ব এবং কর্তব্যবুদ্ধিও তেমনি আবশ্যিক। আগের মতো ক্ষণিকের উত্তেজনায় কিংবা লিল্লায় আপাত স্বার্থে ধর্ম, জাতি ও রাষ্ট্রের নামে বিরোধের ব্যবধান সৃষ্টি না করে মিলনের মহাময়দান তৈরির ব্রত গ্রহণ করতে হবে সাংবাদিককে। দেশ-ধর্ম বর্ণ নিরপেক্ষ নির্ভেজাল মানবতার বিকাশের সাধনার আজ বড়ো প্রয়োজন। ধর্মীয়, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থচেকে করতে হবে বিশ্বমৈত্রী ও করুণার অনুগত এবং এগুলো রক্ষার ও বৃদ্ধির অনুকূল। আজ সহ-অবস্থান ও সহযোগিতার নীতিই মানবিক সমস্যা সমাধানের দৃষ্টিগ্রাহ্য একমাত্র উপায়।
এ নীতি প্রচারের গুরুদায়িত্ব, এ কঠিন কর্তব্য ও নেতৃত্বের এ অধিকার আজ সংবাদপত্রের। সংবাদপত্রের কাছে বিশ্বের কল্যাণকামী মানুষ মাত্রেরই তাই আজ অনেক প্রত্যাশা।
মুক্তির অন্বেষায়
প্রায় দশলাখ বছর আগে প্রাণিজগতে যখন মনুষ্য শ্রেণীর উদ্ভব, তখন থেকেই হয়তো শুরু হয় মানুষের মুক্তির অন্বেষা। জন্মমুহূর্ত থেকেই শিশু যেমন বুঝবার চেষ্টা করে তার পরিবেশকে, এও ছিল হয়তো তেমনি অবচেতন প্রয়াস। দিন যায়, বর্ষ যায়, এমনি করে বয়ে যায় লক্ষ লক্ষ অব্দ। এক সময়ে তার অবোধ মনে সৃষ্টি হয় বোধের, যেমন শিশু অর্জন করে তার বোধশক্তি।
তার বোধ-বুদ্ধির বিকাশ ছিল মন্থর, কিন্তু বিরামহীন ও প্রবহমান। তার আত্ম-শক্তি-চেতনাও ছিল তার বোধ-বুদ্ধির আনুপাতিক। এবং অজ্ঞতার দরুন সে-শক্তির প্রয়োগ-সামর্থ্য ছিল তার আরো কম। প্রয়োগ-বাঞ্ছাই যোগায় প্রয়াসের প্রেরণা। আবার প্রত্যয়হীন বাঞ্ছও বন্ধ্যা। কাজেই প্রয়োগ-বাঞ্ছার সঙ্গে প্রত্যয় ও প্রয়াসের মেল-বন্ধন না হলে সাফল্য থাকে অনায়ত্ত। আর তেমনি অবস্থায় আসে নিষ্ক্রিয়তা। তখন বুদ্ধি ও শক্তি দুটোই আচ্ছন্ন হয় জড়তায়। শীতকালীন ঔষধির মতো দুটোই আত্মগোপন করে সুপ্তির গহ্বরে।
এমন মানুষ হয় প্রয়াস-বিহীন প্রাপ্তিকামী। তারা পরোপজীবী ও পরনির্ভর। এ রকম মানুষের সংখ্যাই অধিক। তাই মানুষের সংখ্যার অনুপাতে মানুষের কৃতি ও সাফল্য নিতান্ত নগণ্য। চেতনার ও চিন্তার, বুদ্ধির ও কর্মের, প্রয়োগ-বাঞ্ছ ও প্রয়াসের যোগ হয়েছে তেমন মানুষের সংখ্যা যে গোত্রে বেশি, সে-গোত্রের অগ্রগতিও হয়েছে সে অনুপাতে। আর অন্য গোত্রগুলো প্রকৃতির কৃপা জীবী হয়েই রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে।
এ কারণেই মানুষের যা কিছু সাফল্য ও কৃতিত্ব তা গুটিকয় মানুষেরই দান। এই গুটিকয় মানুষের উদ্ভাবনের ও আবিষ্কারের, চিন্তার ও চেতনার ফসলই সাধারণ মানুষের সম্বল ও সম্পদ। এই স্বাচ্ছন্দ্য-সুখেই, এই গৌরব-গর্বেই মানুষ প্রাণিশ্রেষ্ঠ।
সেকালে মানুষের জগৎ ছিল অঞ্চলের দিগন্তে সীমিত। সেজন্যে মানুষের কোনো কৃতিই হতে পারে নি সর্বমানবিক সম্পদ। তাই আজো কেউ রয়েছে আদি অরণ্যচারী, আর কেউ হয়েছে নভোচর।
পরমুখাপেক্ষী মানুষের এই নিষ্ক্রিয়তা কেবল বেদনাদায়কই নয়, সমস্যাপ্রসূও। কেননা এদের চেতনার বিকাশ নেই, নেই সৃষ্টির প্রয়াস। এদের এগুবার আগ্রহ নেই, আছে সুস্থির থাকার বাসনা। তাই নিশ্চিত পুরোনো-প্রীতি আর অনিশ্চিত নতুন-ভীতিতে তাদের মন-মানসের পরিক্রমা অবসিত। আচার-সংস্কারের পরিসরে স্বস্তি খোঁজে তাদের জীবন। স্বাচ্ছন্দ্য-বৃদ্ধির কাক্ষা নিয়ে নতুন সৃষ্টির আগ্রহে অজানার ঝুঁকি নিতে তারা নারাজ। তাই জীবন-সচেতন কর্মী-মনীষীর নব চেতনালব্ধ চিন্তা কিংবা প্রয়াসার্জিত কৃতি গ্রহণেও তারা বিমুখ। তারা কেবলই রুখে দাঁড়ায়, কেবলই পিছু টানে। চেতনায়, চিন্তায় ও কর্মে অগ্রসর মানুষের জীবন তাই দ্বন্দ্ববহুল ও বিঘ্নসঙ্কুল। আজ অবধি মানুষের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের মর্মকথা এ-ই।