শিক্ষিত লোকের সংখ্যাল্পতার জন্যে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে এ সমস্যা আরো প্রকট ও তীব্র। কেননা, সেখানে সহানুভূতিশীল পাঠকও কম। এজন্যেই প্রাচ্যদেশে যদিও ধনবৈষম্য তীব্র, জীবিকা অর্জনের সুযোগ সীমিত, পীড়ন ভয়াবহ ও প্রবলের স্বৈরাচার নির্বিঘ্ন, তবু এখানে গণদরদী লেখক স্বল্প, পাঠক নগণ্য, সরকারও অসহিষ্ণু। তাই তারুণ্যের অবসানে অধিকাংশকেই দেখি ব্রতভ্রষ্ট ও খন্ত্রত।
তাছাড়া মধ্যবিত্ত সংজ্ঞাটিও আপেক্ষিক। প্রাচ্যদেশে যারা মধ্যবিত্ত, যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা য়ুরোপের কোনো কোন দেশের নিম্নবিত্তের লোকের চেয়েও তারা হীনাবস্থ। জীবনযাত্রার মান নিম্ন এবং রুচি অবিকশিত বলে এ দেশে যারা প্রাচুর্যের মধ্যে আছে বলে মনে করি, তারাও জীবনের নানা ভোগ্য-সামগ্রী থেকে বঞ্চিত। ফলে তারাও অভাব মুক্ত নয়–তারাও মনে কাঙাল। কাজেই প্রলুব্ধ হওয়া তাদের পক্ষেও সম্ভব ও সহজ। এবং কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের নানা প্ররোচনায় ও প্রলোভনে বিভ্রান্ত ও আদর্শচ্যুত করবার প্রয়াসী। সাহিত্য পুরস্কারের শিকার হয়ে প্রাণের কথা বিকৃত করে প্রকাশ করা বা বক্তব্য চেপে যাওয়া গরিব লেখকের পক্ষে সম্ভব। আবার প্রত্যয় দৃঢ়মূল নয়, অথচ বয়োধর্মের বশে ফ্যাশানের আনুগত্যে কেউ কেউ আদর্শবাদের বুলি কপচায়, একটু বয়স হলেই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে–দালালও হয়ে উঠে। যেমন গতশতকে ইয়াংবেঙ্গলদের প্রায় সবাই চল্লিশোত্তর জীবনে নিষ্ঠাবান গোঁড়া হিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। এসব নানা কারণে তারুণ্যের অবসানে আদর্শবাদী গণদরদী ন্যায়নিষ্ঠ সগ্রামপ্রবণ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকরা বদলে যায়, ভোল পাল্টায়।
নির্যাতিত মানবতার কথা ছেড়ে দিলেও দুনিয়াব্যাপী গণমানবের দুঃখের অন্ত নেই। যেখানে একনায়কত্ব, সেখানে পেটের ক্ষুধা যদি বা মেটে, মনের কথা প্রকাশের পথ নেই। তাতে মনের ঝাল মিটিয়ে প্রাণের জ্বালা জুড়োবার উপায় খুঁজে পায় না মানুষ। জীবনে সে আর এক যন্ত্রণা। যেখানে ডেমোক্রেসির মার্কা আঁটা সরকার পরমত অসহিষ্ণু সেখানেও সেই জ্বালা। ক্ষোভে-দুঃখে, জ্বালায়-যন্ত্রণায় বাকস্বাধীনতা মানুষের বেদনা উপশমের অন্যতম উপায়। কেননা, মানুষ প্রাণ নিয়ে বাঁচে না, বাঁচে মন নিয়ে। সে মনের উপর পীড়ন একসময় সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। তাই দৈহিক পীড়ন ঘটায় মৃত্যু, আর মানস নির্যাতন দেয় বিকৃতি। তখন গুপ্ত পথে বিষাক্তক্ষতের মতো তা পরিণামে প্রাণঘাতী বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও জিঘাংসা জাগায়। সমাজে-রাষ্ট্রে নেমে আসে বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা ও ব্যভিচার। ক্ষমতাপ্রিয় স্বার্থলোলুপ শাসকের দৌরাত্মও বেড়ে যায়। তখন রাষ্ট্র যেন লুটের মাল, শেষ মুহূর্ত অবধি যা পাওয়া যায় তাই লাভ–এই মনোভাবের বশে শাসক গোষ্ঠীও হয়ে ওঠে বেপরওয়া। ধন-জন সব ছারখার হয়ে যায় রক্তে আর আগুনে।
এসব পরিণাম যে শাসক গোষ্ঠীর অজানা, তা নয়, কিন্তু আপাত সুখের মোহে তাদের শ্রেয়োবোধ হয় অবলুপ্ত। অন্যদিকে সগ্রাম ও জীবনধ্বংসী দুর্ভোগ ছাড়া যে মুক্তি আসতে পারে না, তা যদিও সংগ্রামীদের বোধ বহির্ভূত নয়, কিন্তু যন্ত্রণা-বঞ্চনা সইবার ধৈর্যের অভাবে তারা সংকল্পচ্যুত ও পলাতক।
কাজেই আজকের দুনিয়ায় নিপীড়িত মানুষের জন্যে সংগ্রামের প্রস্তুতি পর্বে চাই বাক স্বাধীনতার আন্দোলন, আর এজন্যে চাই শিক্ষিত বয়স্ক মধ্যবিত্তের সহানুভূতি এবং তরুণ মধ্যবিত্তের সমর্থন, বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্তের সহায়তা এবং লিখিয়েদের উচ্চ ও নির্ভীক কণ্ঠ এবং অবিচলিত কলম। এ ব্যাপারে সমর্থন ও সহযোগিতাই শক্তির উৎস। এককভাবে মানুষ কেবল দুর্বল নয়-ভীরুও। জনবলই বল। আর মনোবলই সামর্থ্য। সঙ্শক্তির মতো শক্তি নেই, যৌথ কর্মে নেই অসাফল্য।
এদেশের প্রাচীন কবির এক আপ্তবাক্য বদংশত মা লিখ–আজ মিথ্যে বলে প্রমাণিত। কেননা সরকারের চোখে বক্তৃতা মারাত্মক, গদ্য লেখা দূষণীয় ও কবিতা নিষ্ফল। তাই দেখছি কবিতায় যে-কিছু বলা যায়, কিন্তু গদ্যে লিখলে হয় আপত্তিকর, আর বক্তৃতায় বললে হয় অপরাধ।
কবিতার আবেদন যদিও গভীর ও স্থায়ী, তবু তা স্বল্পসংখ্যক পাঠকে সীমিত। প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প এবং নাটকের আবেদনও সর্বজনীন নয়। বক্তৃতা গণমুখী,–তাই সরকার বক্তৃতাভীরু। দুনিয়ার প্রায় সব সরকারেরই এক চেহারা এক রূপ। তাই বলে কি কাফেলা স্থির হয়ে থাকবে, চিন্তার স্রোত কি শুকিয়ে যাবে! বাধা প্রবল ও বেপরওয়া হলে কালমাত্রা বেড়ে যায় এবং ক্ষয়-ক্ষতিও বেশি হয় বটে কিন্তু পরিণামে গণসগ্রামে সাফল্য সুনিশ্চিত।
মানবিক সমস্যার সমাধানে সংবাদপত্র
বিজ্ঞানীরা বলেন, চল্লিশ লাখ বছর আগে সচল প্রাণীরূপে প্রথম দেখা দেয় মাছ। আর ক্রমবিবর্তনে বা ক্রমোন্নয়নে মানুষ অবয়ব পায় দশ লাখ বছর পূর্বে। বিজ্ঞানীর বিবর্তনবাদে ও উদ্বর্তন তত্ত্বে আস্থা রেখে বলা চলে, মানুষের আরো কয়েক লক্ষ বছর কেটে গেছে দেহে-মনে উৎকর্ষ লাভের অবচেতন প্রচেষ্টায়। কিছুটা আভাসে, কিছুটা অনুমানে এবং কিছুটা নিদর্শনে আমরা মানুষের ইতিকথা পাচ্ছি মাত্র আট-দশ হাজার বছরের।
মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন ও বিশিষ্ট করেছে তার দৈহিক উৎকর্ষ ও আঙ্গিক সামর্থ্য। তার দুটো হাতের উপযোগই তাকে দিয়েছে প্রাণিজগতে শ্রেষ্ঠত্ব,–দিয়েছে জৈব-সম্পদে ও মানস-ঐশ্বর্যে অধিকার।