রবীন্দ্রনাথ নিজের সুদীর্ঘ জীবনে সমান্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তিনটেই স্বচক্ষে দেখেছেন– বুঝবার শক্তিও তার নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন আত্মিকবোধ না জন্মালে বাহুবলে আর্থিকসাম্য স্থাপন স্থায়ী হতে পারে না। বুদ্ধির সঙ্গে আবেগের যোগ না ঘটলে তা স্বভাবে পরিণতি পায় না। স্বেচ্ছা সম্মতি আর জবরদস্তির সায় এক বস্তু নয়।
কবি-মনীষী রবীন্দ্রনাথ মানুষের প্রতি মানুষকে শ্রদ্ধাবান করে তুলবার সাধনাই করেছেন, কল্যাণ ও সদ্বুদ্ধি প্রসূত স্বেচ্ছাসম্মতি দানে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছেন। মানবকল্যাণকামী স্বেচ্ছা-সৈনিক। তাঁর এই জীবন-দৃষ্টিকে বুর্জোয়া উদারতা ও দাক্ষিণ্য বলে উপহাস করা অসৌজন্য।
গল্পে-প্রবন্ধে-নাটকে-কাব্যে কত ভাবে তিনি দ্বেষ-দ্বন্দ্ব, বিভেদ-বিরোধ, শোষণ-পীড়ন ও অপ্রেম-অশ্রদ্ধামুক্ত সমাজ-চিন্তা জাগানোর চেষ্টা করেছেন! ন্যায়যুদ্ধে কত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি!
তবু, তা কারো ism-সম্মত হল না বলে তাদের কাছে তা অকেজো ও অশ্রদ্ধেয়। কাজেই রবীন্দ্রসাহিত্য আজ তাদের কাছে না ঘরকা না ঘাটকা! মানুষকে ভালবাসার এ এক অভিনব বিড়ম্বনা!
মসি-সংগ্রামীর সমস্যা
এ যুগে লেখকেরা বঞ্চিত শোষিত মানুষের ত্রাণের জন্যে লেখনী ধারণ করেছেন। মসি যুদ্ধে মানুষের মতি ফেরানোর এই অভিনব ও সুপরিকল্পিত প্রয়াসে চরিত্রবান সাহিত্যিকদের আন্তরিকতার অভাব নেই। এঁদের লক্ষ্য দ্বিবিধ : প্রত্যক্ষভাবে শোষিতদের ও সহানুভূতিশীলদের সচেতন ও সগ্রামী করে তোলা আর পরোক্ষে শোষকদের অন্যায়বিমুখ ও সুবিবেচক করা।
কিন্তু মুখ্য কিংবা গৌণ লক্ষ্য–কোনোটাই আশু ফলপ্রসূ নয়। কেননা যারা লেখেন তারা এমনকি বিত্তহীন হলেও-মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত। যাদের জন্য তাঁদের সংগ্রাম তারা অশিক্ষিত, অজ্ঞ, মূক এবং মধ্যবিত্তদের সঙ্গে তাদের মানস-সূত্র অসংযুক্ত। আর যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তারাও এ সাহিত্যে অবহেলাপরায়ণ। কাজেই এ সাহিত্যের দ্বারা অশিক্ষিত শোষিতজন বিক্ষুব্ধ ও সংগ্রামী হয় না। আর শোষক বুর্জোয়ারাও ন্যায়নিষ্ঠ ও দায়িত্বসচেতন হওয়ার গরজ বোধ করে না।
সুতরাং আপাতত, দেখা যাচ্ছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ লক্ষ্য যারা, তাদের কাছে এ সাহিত্য পৌঁছেই না।
তাহলে, এ সাহিত্য কাদের জন্যে, কাদের কাছে এ সব লেখার আবেদন? ..
না বললেও চলে যারা বঞ্চিত কিংবা শোষিত, তাদের চেতনা সূক্ষ্ম নয়; তারা কেবলই মার খায়, আর তাকে নিয়তি কিংবা বিধিলিপি বলে মেনে নেয়। আন্দোলন করবার, বিদ্রোহী হবার, কিংবা নেতৃত্ব দেবার স্বপ্ন অথবা সামর্থ্য তাদের কোনো কালেই ছিল না। তাদের জাগাবার, সংগ্রামী প্রেরণা দেবার কিংবা নেতৃত্ব দানের গরজ বোধ করেছেন চিরকালই মধ্য অথবা উচ্চবিত্তের সংবেদনশীল মানবতাবাদী শিক্ষিত মানুষ। মার্কস-এঙ্গেলস্ থেকে মাও-সে-তু অবধি সব নেতাই মধ্য ও উচ্চবিত্তের লোক। অতএব মানবতাবাদী সমাজতন্ত্রী লেখকের উদ্দিষ্ট পাঠক মধ্য ও উচ্চ বিত্তের শিক্ষিত জনগণই। তাদের কিছু সংখ্যক লোককে লেখার মাধ্যমে সংবেদনশীল ও সংগ্রামী করে গড়ে তুলতে পারলেই তাদের মাধ্যমেই গণসংযোগ ও গণ-আন্দোলন সম্ভবপর হয়। দুনিয়া জুড়ে সৈন্যরা ছড়িয়ে রয়েছে, কেবল সেনাপতিরই অভাব। দুর্যোগ-দুর্দিনে শিক্ষিত সংবেদনশীল দৃঢ়চিত্ত সাহসী ও ত্যাগপ্রবণ কর্মীর নেতৃত্বই সংগ্রামে সাফল্য দান করে।
সংবেদনশীলতা ও মনুষ্যত্ব সব হৃদয়ে সুলভ নয়। পরিশীলন ও পরিচর্যায় এর বিকাশও হয়তো সামান্যই হয়। সহানুভূতি ও মনুষ্যত্ব মন-মেজাজের বিশেষ গড়ন-প্রসূত। নীতিকথায় এক্ষেত্রে মন ফেরানো অসম্ভব। এ অবস্থাকে স্বাভাবিক ও অপ্রতিরোধ্য বলেই মেনে নিতে হবে। তাছাড়া উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বিত্তশালী হবার নানা সুযোগ ঘটে। শিক্ষিত, কুশলী ও নীতিভ্রষ্ট নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে প্রলোভন সংবরণ করা সহজ নয়। কাজেই যে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর উপর জনকল্যাণ ও গণমুক্তি নির্ভরশীল, তাদেরও রয়েছে চোরাবালির মতো প্রতারক মন।
একেবারে নিঃস্ব না হলে সাধারণত মানুষ নিশ্চিত বর্তমান ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা বাড়ায় না। ব্যতিক্রম কেবল অসামান্যতারই পরিচায়ক। তাই দেখা যায় Boss ও বিবেকের দ্বন্দে প্রায়ই Boss-এর জয় হয়। কেননা চাকুরে-কুকুরে সমান–হুকুম করিলেই দৌড়িতে হয়।
এজন্যে মধ্যবিত্তে দীর্ঘস্থায়ী চারিত্রিক দার্ট সুদুর্লভ। আবার টাকার এমন কুহক যে লোকে লাথিও খাচ্ছে এবং নিকটে গিয়া যে-আজ্ঞাও করছে। এমনো দেখা যায় মধ্য বয়সে মানুষ ন্যায় নীতি-আদর্শের বন্ধন মুখোশের মতোই হঠাৎ পরিহার করে। বাইরের লোক তার খোলস পালটানো দেখে নিন্দে করে। কিন্তু কোন্ বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে মানস ও বৈষয়িক সংগ্রামে সে পর্যদস্ত ও পরাজিত, তা তারা ভাবতে-বুঝতে চায় না। তেমন অবস্থায় একজন সংগ্রামপ্রবণ, আদর্শবাদী মানুষও একান্তভাবে বিষয়ী স্বার্থপর হয়ে উঠে। তখন আল্লাহর দয়া, মনিবের দক্ষিণ্য ও বিবির দিদার ছাড়া কিছুই তার কাম্য থাকে না। তখন আদর্শের রূপায়ণ-ব্ৰতী কোনো বুদ্ধিজীবী একাকী দায়িত্ব পালনে কিংবা কর্তব্য সাধনে ভয় পায়। তার রাত্রি-নিশীথের সংকল্প দিন-দুপুরে আত্মপ্রকাশের সাহস হারায়। তেমন লোক বক্তব্য প্রকাশের জন্যে কেবলি আকুলিবিকুলি করে সহায়-সমর্থনের জন্যে নিজের চারদিকে তাকায়, কাকেও না পেয়ে গুমরে মরে, ব্যথায় জর্জরিত হয়, ক্ষোভের যন্ত্রণায় ছটফট করে,–কিন্তু একা মৃত্যুর কিংবা পীড়ন বরণের ঝুঁকি নিতে জৈব কারণেই অসমর্থ।