এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে ১৮৬০ থেকে ১৯৪৭ সন অবধি সাধারণভাবে ইংরেজি শিক্ষিত অভিজাত ও নেতৃস্থানীয় মুসলমানেরা বৃটিশবিরোধী ছিল না। কিন্তু আরবি-ফারসি শিক্ষিত মুসলমানদের আযাদী স্পৃহা এতই তীব্র ছিল যে, আযাদী লাভের আশায় মৌলবী-মোল্লারাই সাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন কাফের বলে নিন্দিত হিন্দুদের সঙ্গে। এঁরা শেষ অবধি কংগ্রেস-পন্থী তথা হিন্দু মুসলিমের একজাতীয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন। কংগ্রেস, খেলাফত সমিতি বা মুসলিম লীগের আহ্বানে অশিক্ষিত নিঃস্ব মুসলমান যেভাবে অকপট সাড়া দিয়েছিল, অশিক্ষিত অমুসলমান কোনোদিন স্বাধীনতা সগ্রামে সেভাবে সাড়া দেয়নি।
বিশ্বাসের অঙ্গীকারে জন্মায় ধর্মবোধ। আস্তিক মানুষের জীবন চালিত হয় ধর্মবিশ্বাসের আনুগত্যে। এবং ধর্মমাত্রই পুরোনো। কাজেই আস্তিক মানুষ জীবনযাত্রার নীতি-আদর্শ খোঁজে অতীতে। এমন মানুষ পরিবেষ্টনীকে অবহেলা করে এবং দেশ-কালের চাহিদা ও প্রভাব এড়িয়ে আদর্শ জীবনের অদ্ভুতস্বপ্ন রচনা করে স্বস্তি পায়। সম্মুখদৃষ্টিকে পশ্চাতে নিবদ্ধ করার মতো কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় নিহিত থাকে তাদের ব্যর্থতার বীজ। ইসলামের উদ্ভবযুগের ঋজু অবিকৃত ধর্মবিশ্বাসই আরবদের দিগ্বিজয়ী করেছিল–মুসলমানেরা এ-কথা ভুলতে চায় নি। এবং একেই আত্মোন্নয়নের একমাত্র ও ধ্রুব উপায় বলে মেনেছে। তাই ধর্মবোধের মাধ্যমে মুসলমানদের প্রেরণাদানের ও পতনরোধের চেষ্টা হয়েছে সর্বত্র। পাক-ভারতের ইতিহাসের ধারায় আমরা তাই বারবার একই আহ্বান শুনেছি, শেখ আহমদ সিরহিন্দী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, তিতুমীর, কেরামত আলী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদুমিয়া, হালী-ইকবাল-জলন্ধরী-ফররুখ প্রভৃতি ধর্মবেত্তা, সমাজনেতা ও কবি-দার্শনিকের মুখে। ওহাবী-ফরায়েজীর পিউরিটানিক গোঁড়ামির তথা গ্রহণবিমুখতা ও বর্জন-প্রবণতার কারণও ছিল এ-ই। কল্যাণচিন্তায় এঁদের আন্তরিকতা ছিল, কিন্তু কালিক জীবনচেতনা ছিল না, ছিল না স্থানিকবোধও। তাই তেরোশ বছর আগের মরুভূ আরব তারা কখনো অতিক্রম করতে পারেন নি।
আত্মপ্রত্যয়হীন মানুষ আত্মসংকোচনকেই আত্মরক্ষার উপায় বলে জানে। স্বশক্তিতে আস্থাবান মানুষ চারদিককার সবকিছু আত্মসাৎ করে হয় বড়ো। অতএব যদিও তাদের লক্ষ্য ছিল মহান কিন্তু সামর্থ্য ছিল সামান্য, মনন ছিল সীমিত এবং পথ ছিল ভ্রান্ত। গ্রহণ, বরণ, বর্জন ও সমন্বয় সাধনের মধ্যেই যে ব্যক্তিজীবনের বৃদ্ধি এবং জাতীয় জীবনের প্রগতি পন্থা নিহিত, তা বুঝিয়ে দেবার জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদের মতো আরো অনেক ব্যক্তিত্ব ও চিন্তানায়কের স্থানিক ও কালিক প্রয়োজন ছিল।
ওহাবী-ফরায়েজী আন্দোলন প্রবল হলেও সর্বশ্রেণীর লোকের যে এতে সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল না, তা না বললেও চলে। বিশেষ করে উচ্চবিত্তের অভিজাত মুসলমানের ভূমিকা এতে দুর্লক্ষ্য। ফলে ধর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমান সমাজের দারিদ্র-মুক্তি ও আযাদী স্বপ্ন সফল হয়নি। এমনকি তাঁদের প্রচেষ্টায় এদেশী মুসলমানের পতন পথ রুদ্ধ হয়েছিল বলেও প্রমাণ নেই। বরং ইংরেজ বিদ্বেষহেতু ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের বিরূপতা মুসলিম মধ্যবিত্ত ঘরে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। ফলে অর্থাগমের পথ রুদ্ধ রইল দীর্ঘদিন। এমনকি এই বিরূপতা বশে মাদ্রাসায়ও নাম-ঠিকানা লেখা ও পড়ার জন্যে ইংরেজি হরফও শেখানো হয় নি। অথচ প্রশাসনিক ভাষার সঙ্গে এই লৈপিক পরিচয় বৈষয়িক কারণেই জরুরী ছিল।
অবশ্য মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এতেই রোধ করা যেত না, যেমন জাত নষ্ট ও সমাজ বিচ্যুতিভয় হিন্দুদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ ও বিলেত গমন রোধ করতে পারে নি। কিন্তু এর বিস্তার মন্থর হল অন্য কারণে। হিন্দুসমাজে নিম্নবর্ণের মধ্যে যেমন, পুরুষানুক্রমে নিম্নবিত্তের দেশজ মুসলমানদের মধ্যেও তেমনি শিক্ষার ঐতিহ্য ছিল না। তারা বাঙলা বা আরবি শিক্ষাও গ্রহণ করে নি কোনোদিন। অতএব মসজিদ-কেন্দ্রী আরবি ফারসি শিক্ষায়ও তাদের কোনো কালে আগ্রহ ছিল না। নিরক্ষরতা ছিল সর্বব্যাপী। কেবল গায়ে গায়ে দু-চারটি লোক লেখাপড়া জানত। এরাই হত নায়েব গোমস্তা পীর-মুনশী-মুয়াজ্জিন। বিহারে-উত্তরপ্রদেশে উচ্চবিত্তের অভিজাত বেশি ছিল, তাই ওহাবী আন্দোলনের কেন্দ্র হয়েও সেখানে ইংরেজি শিক্ষা প্রসার লাভ করেছিল এবং বাঙলার উচ্চবিত্তের অভিজাত মুসলমানরা ও রাজসরকারের পদস্থ কর্মচারীরা ছিল অবাঙালি। তাঁদের অধিকাংশই সিরাজদ্দৌলা-মীরকাশেমের পতনের পর উত্তর বিহারে ও উত্তর ভারতে চলে যায়। আর যারা নানা কারণে রয়ে গেল, তারা গোড়া থেকেই ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করছিল। তাদের এবং দেশী মধ্যবিত্ত মুসলমানের সংখ্যা ছিল নগণ্য। আবার পড়তে গেলেও পড়া হয় নি অধিকাংশের। তাই ব্রিটিশ আমলে বাঙলার মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়েনি। আবার মৌলানা কেরামত আলী, ইমামুদ্দিন প্রভৃতি ধর্ম-সংস্কারকদের প্রবর্তনায় চট্টগ্রাম বিভাগে আরবি শিক্ষা বিস্তার পায়।
আঠারো শতকের শেষার্ধ থেকেই য়ুরোপে দৈশিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। উনিশ-বিশ শতকে ঘটে তার উগ্রবিকাশ এবং পৃথিবীব্যাপী বিস্তার। এর আগে ধর্মীয় ঐক্যবোধ ভিত্তিক একপ্রকার জাতীয়তাবোধ মানুষের ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবমুক্ত এদেশী হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ ছিল প্রবল। এমনকি প্রতীচ্য শিক্ষার আলো প্রাপ্ত অনেক চিন্তাবিদ মনীষী-কবি-সাহিত্যিকও এ সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন না। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-স্যার সৈয়দ আহমদ-আমীর আলী প্রভৃতি অনেকের জাতি-চেতনা এ সূত্রে স্মর্তব্য। তাই সে-যুগে দৈশিক জীবন-চেতনা ছিল দুর্লভ। ভৌগোলিক পরিবেষ্টনীগত জীবনের ও প্রয়োজনের অস্বীকৃতিতে হিন্দু আত্মত্রাণের প্রেরণা খুঁজেছে স্বধর্মে ও উত্তরভারতের বৈদিক, রাজপুত ও মারাঠা ঐতিহ্যে এবং মুসলমানও ত্রাণ সন্ধান করেছে তার স্বধর্মে ও আরব-ইরানে। এটির নাম স্বাধর্ম– প্যান হিন্দুইজম ও প্যান ইসলামইজম। ফলে মধ্য ও উচ্চবিত্তের হিন্দু-মুসলমান নানা কাজে একত্রিত হয়েছে কিন্তু তাদের মিলন হয় নি। যদিও তারা একই হাটে বেচা-কেনা করেছে একই বাটে হেঁটেছে, একই মাঠে ফসল তুলেছে, একই বন্যায় পীড়িত হয়েছে এবং মরেছে একই মহামারীতে। তারা পাশাপাশি বসেছে, ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়েছে,– বাইরে সর্বত্র মিলেছে, সহযোগিতা করেছে, অন্য সব কিছুই দেয়া-নেয়া করেছে, মনটাই কেবল দেয়া-নেয়া করে নি, তারা মনটা ফিরিয়ে রেখেছিল দেশবহির্ভূত ধর্মের ও ঐতিহ্যের আনুগত্যবশে। ওটার নাম স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধর্ম যার অপর নাম দেশকালহীন আদর্শিক জাতীয়তা। কিন্তু এই আদর্শিক জাতীয়তা কোন্ শ্ৰেয়সের সন্ধান দিয়েছে!
ইতিহাস পাঠকের দু-একটি জিজ্ঞাসা
এ যুগের মতবাদের মতোই ধর্মমাত্রেই কোনো বিশেষ অঞ্চলের মানুষের বিদ্রোহ-বিপ্লবের দান। কোন বিশেষ অঞ্চলের মানুষের সামাজিক, আর্থিক নৈতিক কিংবা প্রশাসনিক বিপর্যয়ের প্রতিকারকল্পে জ্ঞানী-মনীষীর চিন্তা ও প্রয়াস প্রথমে মনন-বিপ্লবরূপে এবং পরে জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে দ্ৰোহরূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিপ্লব-বিদ্রোহের অবসানে দ্রোহীদের জয়ে তাদের পরিকল্পিত ও অনুসৃত নিয়ম-পদ্ধতি ও নীতি-আদর্শ পরিণামে নবধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। বিপ্লবের আগুনে দগ্ধ হয়ে মানুষ সোনার মতোই জীবনে পায় লাবণ্য, মননে পায় ঔজ্জ্বল্য। সে তাপ অবসিত হলে আবার নেমে আসে গ্লানি। ম্লান হয়ে উঠে সমাজ-সংস্কার। নবতর অভাব ও প্রয়োজনবোধ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় মাথা উঁচু করে। নতুন ভাব-চিন্তা ও আয়োজন-বুদ্ধি নিয়ে পূরণ করতে হয় প্রয়োজন। উদ্ভব হয় নতুনতর ধর্মের। যারা প্রয়োজন-সচেতন ও আয়োজনে তৎপর তারা তরে, আর যারা প্রয়োজন মতো আয়োজনে অসমর্থ তারা মরে।–এ-ই প্রকৃতির নিয়ম। তাই ধর্মের অকারণ উদ্ভব যেমন নেই, তেমনি নেই কালান্তরে তার উপযোগ। হৃত-উপযোগ ধর্ম কালান্তরে প্রাণের প্রেরণা নয়, জীবনের অবলম্বন নয় সমাজের উপসর্গ–প্রগতির অন্তরায়।