.
০২.
অতএব রবীন্দ্রসাহিত্যের অপমৃত্যু আসন্ন! অবশ্য কাল সবকিছুকেই গ্রাস করে। রবীন্দ্রনাথও একসময় প্রাচীন কবি হবেন, তার অধিকাংশ রচনা মূল্য হারাবে–রবীন্দ্র-মহিমাও হবে ম্লান। ইতিমধ্যেই আধুনিক কবিতা ও গান রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। কিন্তু এত শিগগির যে রবীন্দ্রনাথ অশ্রদ্ধেয় হয়ে উঠবেন, তা ছিল অভাবিত।
অবশ্য এর মধ্যে ভরসার কথা এই যে এ বিরূপতা বিচারের ফল নয়– আদর্শিক প্রতিপক্ষতার স্বাক্ষর মাত্র। আদর্শে অনুগত মানুষের বিচারশক্তি থাকে না–থাকে আচ্ছন্ন মনে advocacy-র প্রবণতা। আদর্শিক প্রয়াসের সিদ্ধিবাঞ্ছায় তারা চালিত হয় আবেগে–বিবেক-বুদ্ধি হয় অবহেলিত।
উৎপাদন ও বণ্টন বৈষম্যেই-যে সমাজে ধনবৈষম্য ও তজ্জাত অন্যান্য সর্বপ্রকার উপসর্গের সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু সচেতন বা অচেতন শ্রেণীসংগ্রাম আধুনিক কালের চেতনাপ্রসূত–পুরাকালে এর উপস্থিতির সাক্ষ্য মেলে না। পৃথিবীর বিভিন্ন যুগের চিন্তানায়ক ও বিপ্লবীদের চেতনায় এর কোনো নজির পাইনে। মুসাতে দেখি পাপ-ভীতি, ঈসার মধ্যে পাই ধনভীতি ও প্রীতির কথা, হযরত মুহম্মদের বাণীতে দেখি দাস ও দরিদ্রের প্রতি দাক্ষিণ্যের কথা এবং সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব কিন্তু ধন সাম্যের নয়। বুদ্ধে রয়েছে জন্ম-জরার ত্রাস আর করুণা ও মৈত্রীর কাক্ষা ও ধন-বিরাগ, ব্রাহ্মণ্য ধর্মে পাই লোভের পরিণামভীতি ও ভোগে অনাসক্তির গুরুত্ব। চৈতন্য প্রচার করেছেন বৈরাগ্য ও ও প্রীতির মহিমা, কনফুসিয়াস কিংবা লাও সে (Lao tse) ধনসাম্যের কথা বলেননি। এঁদের সবারই আবেদন ছিল মানুষের আত্মার কাছে, সদ্বুদ্ধির প্রতি। এরা সবাই যুগানুগত ও মানবতাবাদী।
সুশৃঙ্খল সমাজ লক্ষ্যে সবাই চেয়েছেন নীতিনিষ্ঠা ও ন্যায়-সত্যের প্রতিষ্ঠা, উৎসাহ দিয়েছেন দয়া-দাক্ষিণ্যে–কিন্তু ধন বৈষম্যের অভিশাপের কথা কারো মুখে শোনা যায়নি। বস্তুত মার্কস-পূর্ব যুগে উৎপাদন ও বণ্টন বৈষম্যই যে মানবিক যন্ত্রণার গোড়ার কথা এবং সামাজিক মানুষের ব্যবহারিক জীবনের ইতিহাস যে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিকথা, তা কখনো উচ্চারিত হয়নি। অবশ্য এসব মনীষীর চিন্তা ও কর্মের মধ্যে যদি কেউ শ্রেণীসংগ্রাম এড়ানোরই অবচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করেন, তা হলে আমরা নাচার।
কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের চিন্তানায়ক রুশো-মন্টেগ-ভলট্যায়ার কিংবা মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন থেকে আজকের দিনের যে কোনো দেশের অধিকাংশ কম্যুনিস্ট নেতা, কর্মী কিংবা চিন্তাবিদ বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া এমনকি পুঁজিপতির সন্তান। Zeno থেকে Nicolite খ্রীস্টান বা জোসেফ প্রোচোন, বাকুনীন বা Hippie অবধি কোনো anarchist-ই গরিব ঘরের নন। কাজেই Suffering থেকেই সংগ্রামের শুরু অর্থাৎ শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম চিরন্তন–এই তত্ত্বে সত্য নেই। অতএব চিরকাল মানবিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা বা সংগ্রাম করেছেন মানবতাবাদীরাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শোষিত দরিদ্ররা এত প্রচারণার পরেও আত্মস্বার্থে ধনসাম্যতন্ত্রে তথা সমাজতন্ত্রে আজো উৎসাহবোধ করছে–না এটিই কি শ্ৰেণীচেতনা ও শ্রেণীসংগ্রামের অনুপস্থিতির বড় প্রমাণ নয়। এতে বোঝা যায় মানবতাবোধ, মানবপ্রীতি, সংবেদনশীল মন, সংগ্রামী প্রেরণা প্রভৃতি আবেগযুক্ত হলেই ব্যক্তিবিশেষ শোষণ-পীড়ন ও দারিদ্র্যমুক্ত মনুষ্য-সমাজ বাঞ্ছা করে কিংবা গঠনে উদ্যোগী হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন কালের মানবতাবাদী মানবদরদীরা সহানুভূতির আবেগেই সুশৃঙ্খল ও সুখী সমাজ গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। প্রত্যেকেই দেশকালের প্রেক্ষিতে জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষের সামাজিক তথা আত্মিক কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করেছেন। ক্রমে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে, জীবিকা হয়েছে অপ্রতুল, পৃথিবী হয়েছে সংহত, কাজেই সমস্যাও হয়েছে জটিল–সমাধানের উপায়ও হয়েছে বহু ও বিচিত্র। মার্কসোত্তর যুগে মার্কসপন্থীর সমাজতন্ত্র তাই মানব-সমস্যা সমাধানের নতুনতম পন্থা। গরিবদেশের সমস্যা সমাধানে সমাজতন্ত্র তথা ধনসাম্যবাদ প্রবর্তন অবশ্যম্ভাবী–তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এটিও স্থায়ী সমাধান নয়, ঐতিহাসিক ধারার আধুনিক রূপ মাত্র।
অতএব হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি সবাই একই লক্ষ্যে কাজ করে এসেছেন, পার্থক্য কেবল পথ ও পদ্ধতির। সবাই মানবদরদী ও মানবতাবাদী। সবার জ্ঞান-বুদ্ধি অভিজ্ঞতা অভিন্ন ছিল না, কাজেই উপায়ও এক থাকেনি। মানুষের সমস্যাও পরিবেশগত। তাই সমাধান পদ্ধতিও হয়েছে স্থানিক ও কালিক। তাই কারো কল্যাণ প্রচেষ্টাই স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করে সর্বকালিক ও সর্বমানবিক হয়নি।
রবীন্দ্রনাথও মানবতাবাদী। তিনি মুখ্যত কবি-মনীষী–কর্মী নন। তাঁর কর্তব্য ছিল মানুষকে আত্মিক চেতনায় প্রবুদ্ধ করা–বাস্তবে রূপায়ণ নয়। আবহমান কালের ধারায় তিনি যুগ-প্রতিনিধি। তার আবেদন মানুষের সদ্বুদ্ধি ও বিবেকের কাছে। ক্যুনিস্টদের আবেদনের লক্ষ্যও তাই। কম্যুনিস্ট বল প্রয়োগে বিশ্বাসী। মানবতাবাদী কবি স্বতঃস্ফূর্ত কল্যাণ-বুদ্ধির বিকাশে আস্থাবান। সামন্তবাদী, ঔপনিবেশিকতাবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, অধ্যাত্মবাদী প্রভৃতি সংজ্ঞায় চিহ্নিত করে কোনো মানবতাবাদীকে বিচার করা অবিচারের নামান্তর। নিজের মত-পথকেই কেবল একমাত্র ও অভ্রান্ত ভাবা অসহিষ্ণুতা ও মানব-মনীষার প্রতি অশ্রদ্ধা তথা ব্যক্তিক সত্তার অবমাননার নামান্তর।