পীড়নমুক্ত মনুষ্য সমাজ দেখবার জন্যে তাঁর আবেগ ও আকুলতার অন্ত ছিল না। এ ব্যাপারে তাঁর উদ্বেগও ছিল অশেষ। কিন্তু কৃত্রিম বুর্জোয়া পরিবেশে মানুষ হয়েছিলেন বলে সমাধানের বাস্তবপন্থা গ্রহণে ছিলেন অসমর্থ। এজন্যে রবীন্দ্রনাথ হিতকামী দার্শনিক–কর্মী পুরুষ নন।
কৌতূহল থাকলে তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ কার্লমার্কসকে (১৮১৮-৮৩) চাক্ষুষও করতে পারতেন। তাঁর প্রৌঢ় বয়সে রাশিয়ায় মার্কসের আদর্শ সমাজ মূর্তিলাভ করতেও দেখলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সে-প্রভাব অনুপস্থিত। এমনকি রাশিয়া স্বচক্ষে দেখেও তিনি দ্বিধামুক্ত হননি। মার্কসবাদের প্রয়োগক্ষেত্র হওয়া উচিত ছিল ভারতবর্ষ। কেননা বর্ণে বিন্যস্ত ও দারিদ্রক্লিষ্ট ভারতেই ছিল সাম্যবাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। যেহেতু জনমনে ছিল মধ্যযুগের ঘোর, সামন্ত ও পেটি বুর্জোয়া জীবন ছিল প্রসারমুখী, এর জ্ঞানী-মনীষীরা ছিলেন বুর্জোয়া-জীবনের মানস-ঐশ্বর্যে বিমুগ্ধ এবং তার উপর ছিল পরাধীনের অসামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাসের অভাব; সেহেতু সাম্যবাদ এখানে শিকড় গাড়তে পারেনি। এ আবহাওয়ার সন্তান মানবতাবাদী মানবদরদী রবীন্দ্রনাথও তাই চিন্তানায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেননি। মার্কস পেলেন তার অবহেলা।
প্রসঙ্গত নজরুল ইসলামের নামও এ সূত্রে মনে পড়ে। স্বাধীনতা ও সাম্যকামী হয়েও তিনি মার্কসবাদ গ্রহণ করেননি। উভয়ের ক্ষেত্রেই কারণ সম্ভবত অভিন্ন। বুদ্ধিগ্রাহ্য তত্ত্ব বা তথ্য কিংবা উপায় বা আদর্শ আবেগগত না হলে তা জীবনে আচরণীয় হয়ে উঠে না। বিশেষ করে আস্তিক ও আত্মবাদীরা নাস্তিক্য ভিত্তিক ধনসাম্যবাদ মানতে চায় না। কেননা তাদের চেতনায় Man does not live by bread alone তত্ত্বের গুরুত্ব অশেষ। এ শ্রেণীর লোকই Animal Farm জাতীয় গ্রন্থে নিজেদের বোধ ও বিজ্ঞতার সমর্থন পেয়ে আশ্বস্ত ও আনন্দিত হয়। কিন্তু ধনসাম্য যে মানুষের দেহ-মন-আত্মার পার্থক্য মুছে দেয় না কিংবা সত্তার স্বাতন্ত্র ও স্বাধীন বিকাশ যে ব্যাহত করে না, ধনসাম্য যে শক্তিসাম্য ঘটায় না এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, প্রজ্ঞা, দর্শন প্রভৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র ও প্রতিষ্ঠা বুর্জোয়া কিংবা পুঁজিবাদী সমাজের মতোই যে সম্ভব, কেবল তা নয়; ব্যবহারিক, সামাজিক জীবনেও সামর্থ্যানুসারে প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি তা মান-যশ-প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে অক্ষুণ্ণ–বরং বাড়ে। কেননা ধনে লভ্য কৃত্রিম শক্তির প্রয়োগ এখানে অচল বলেই যোগ্যের প্রতিষ্ঠা লাভ যে সহজ–তা তারা বুঝতে চায় না।
ধন্যসাম্যবাদীরা খাদ্যবস্তুর অভাব, তার উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটিই মানুষের যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা, পীড়ন-শোষণ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উৎস বলে বিশ্বাস করে। জীবিকা তথা খাদ্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন-আহরণ যারা করে তারা শ্রমজীবী শ্ৰেণী আর যারা কৃত্রিম উপায়ে পরোপজীবী তারা শোষক শ্ৰেণী। এদের সম্পর্ক হয়েছে উৎপাদক ও নিষ্ক্রিয় উপভোগীর, শোষক ও শোষিতের, পীড়ক ও পীড়িতের, বুর্জোয়া ও প্রলিতারিয়েতের, পুঁজিবাদী ও দরিদ্রের, সামন্ত ও ভূমিদাসের, মালিকের ও মজুরের, ধনী ও নির্ধনের, বেনের ও ক্রেতার, মহাজন ও খাতকের, মেহনতি জনতা ও পরশ্রমজীবী সবলের। কাজেই এদের মধ্যে সচেতন কিংবা অচেতন একটা দ্বন্দ্ব; বৈর কিংবা প্রতিপক্ষতা রয়েছে। এর নাম শ্রেণীসংগ্রাম। জীবন-চেতনার বিশেষ বিকাশের সঙ্গেই। এর শুরু। এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি; জীবিকার দুর্লভতা, জীবনবোধের প্রসার ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে এ সগ্রাম স্পষ্ট ও তীব্রতর হচ্ছে। অতএব মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে উৎপাদনে ও বণ্টনে সমতা বিধান করে প্রত্যেক মানুষের জীবিকার সুব্যবস্থা করার মধ্যেই। তাই মানবিক ভাব-চিন্তা কর্ম এই শ্রেণী- সংগ্রামের অবসান কল্পে উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যে নিয়োজিত হওয়া আবশ্যক। এজন্যেই বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত প্রভৃতিরও এ সমস্যা সমাধানে হাতিয়ার রূপে ব্যবহারের উপযোগী হতে হবে। এসবের আলাদা কোন উদ্দেশ্য বা সার্থকতা থাকতে পারে না– অন্তত থাকা উচিত নয়। এগুলো আগে পরশ্রমজীবী শোষকদের চিত্তবিনোদনে নিয়োজিত হয়েছে,এখন হবে শোষিতের মুক্তি সংগ্রামের সহায়ক। কাজেই রাষ্ট্রসংস্থার নিয়ন্ত্রণে জনগণের কর্ম ও চিন্তাগত যৌথ প্রয়াসে মানবিক সমস্যার সমাধান ও জীবিকার সুব্যবস্থাই হচ্ছে দৃষ্টিগ্রাহ্য একমাত্র উপায়।
রবীন্দ্রনাথ মার্কসবাদী ছিলেন না, তাঁর রচনা এই সংগ্রামী প্রেরণা প্রসূত নয়। তার মানবতাবোধ ও মানবপ্রীতি বুর্জোয়া উদারতার প্রসূন মাত্র। কাজেই রবীন্দ্রসাহিত্য কালপ্রবাহে দেশের মৃত ঐতিহ্য মাত্র। এর মূল্য ইতিহাসের উপাদান হিসেবেজীবনের উপকরণ রূপে নয়। অতএব বামপন্থীদের চোখে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্যের কোনো উপযোগ মূল্য নেই। এক্ষেত্রে মুসলিম তমদুনবাদীদের মতও স্মরণীয়। তাদের কাছেও রবীন্দ্রসাহিত্য তাদের সংস্কৃতিবিধ্বংসী। একদলের পক্ষে পরিত্যাজ্য বুর্জোয়া সাহিত্য বলে, অপর দলের কাছে অশ্রদ্ধেয় হিন্দুয়ানী বলে। তাদের ধারণায় রবীন্দ্রনাথ যুগের সৃষ্টি ও যুগধর–যুগোত্তর কিংবা যুগ প্রবর্তক নন।