সামন্ততন্ত্রের বিলোপ, শিল্পবিপ্লব, বেনেবুদ্ধি, সাম্রাজ্যলি প্রভৃতি ছিল ইংরেজের জীবন চেতনাজাত ও সমাজ-প্রতিবেশ-পরিস্থিতি প্রসূত স্বাভাবিক জীবনচর্যার প্রসূন। সে-পরগাছা লালনের প্রস্তুতি ছিল না আমাদের দেশে। যে আবহাওয়ায় ও-সবের উন্মেষ ও বৃদ্ধি, সে-আবহাওয়া ছিল অনুপস্থিত ও অজ্ঞাত। তাই এদেশের মাটি ও-সবের কোনোটাই গ্রহণ করেনি বটে, কিন্তু সবগুলোর পীড়ন সইতে হয়েছে তাকে। অতএব, ইংরেজি শিক্ষার সূচনায় যে অকাল বসন্তের আভাস দেখা দিয়েছিল, রঙধনুর মতোই মিলিয়ে গেল সে-ক্ষণবসন্ত। বাসন্তী হাওয়া গায়ে লাগার আগেই যেন দেখা দিল হিমেল হাওয়ার দৌরাত্ম্য। কৃত্রিম আশ্বাস এভাবে বিদায় নিল অকৃত্রিম যন্ত্রণার জন্ম দিয়ে।
অজ্ঞ, মূক ও দৈব নির্ভর মানুষের দারিদ্র্য দুঃখ বেড়ে চলল বটে, কিন্তু এটি নিয়তির লীলা ও আল্লাহর মার বলেই জেনে আত্মপ্রবোধ পাওয়া কঠিন হল না। কাজেই কিসে কী হয়, সে তত্ত্ব রইল অজ্ঞাত।
যারা নগুরে তারা ইংরেজ বেনের উচ্ছিষ্ট পেয়েই ধনী ও ধন্য। ব্যবহারিক জীবনের ঐশ্বর্যে, চাকচিক্যে ও ভোগের নতুনতর রীতির আস্বাদনে তারা বিমুগ্ধ। যাদের বদৌলতে এ প্রাপ্তি, সেই ইংরেজ এখন তাদের প্রমূর্ত ভগবান। ছায়াকে কায়া বলে অনুভব করার বিড়ম্বনা তখনই টের– পাওয়ার কথাও নয়।
এঁদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ও মননশীল, তারা জীবনের অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গতির ঈষৎ অনুভূত পীড়া ও বেদনা থেকে মুক্তি কামনায় য়ুরোপীয় জীবন প্রতিবেশের আর এক দান বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও শিল্প চর্চায় আত্মনিমগ্ন থেকে চিত্তলোক প্রসারে আনন্দিত হতে চেয়েছেন।
য়ুরোপে যন্ত্র-শিল্পের প্রসার, মানসোৎকর্ষ ও বৈশ্য সভ্যতার বিকাশ তথা বুর্জোয়া সমাজের প্রাধান্য ছিল ঐতিহাসিক বিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী অভিব্যক্তি এবং সে কারণেই স্বতঃস্ফূর্ত। এর কোনোটাই অনুকূল ছিল না আমাদের দেশে। এজন্যে আমাদের জ্ঞানী-মনীষীরা য়ুরোপীয় জীবনের ও যুগের মর্মবাণী স্বরূপে উপলব্ধি করতে হয়েছেন অসমর্থ। তবু অবচেতন প্রেরণায় নতুন যুগ ও পরিবেশকে তারা গ্রহণে ছিলেন উনুখ, যদিও সামর্থ্য ও সুযোগ ছিল সামান্যই। ব্যবহারিক জীবনে বুর্জোয়ার ঐশ্বর্য অর্জনের উপায় ছিল না বলে তাদের সাধনা হয় অন্তর্মুখী। এভাবে আর্থিক জীবনে প্রতিহত হয়ে তারা মানবিক ও আত্মিক চেতনা প্রসারে হন প্রয়াসী। ব্যবসায় দ্বারকানাথের অসাফল্য দেশের স্বাদেশিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক চেতনা বৃদ্ধির নিমিত্ত হয়েছে, দেখতে পাই।
য়ুরোপীয় বুর্জোয়া সমাজের ব্যবহারিক ও মানস ঐশ্বর্যে মুগ্ধ লুব্ধচিত্ত বাঙালির ঘরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। এই ঘরে সামন্ত জীবনের দাপট ও বুর্জোয়া জীবনের ঐশ্বর্যের আশ্চর্য মিলন। হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বেই য়ুরোপে বুর্জোয়া জীবন বিকাশের পূর্ণতা লাভ করে। তার জন্মোত্তরকালে বুর্জোয়া সমাজের গ্লানি, ত্রুটি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হতে থাকে। কিন্তু সে খবর উনিশ শতকেও এদেশে পৌঁছেনি। কাজেই বুর্জোয়া সমাজ; বেনে বুদ্ধি ও বৈশ্য সভ্যতাই ছিল শিক্ষিত বাঙালির অনুধ্যেয় জীবন স্বপ্ন। তাতে আবার ঠাকুর পরিবারের সন্তানেরা তখনো বুর্জোয়া জীবনের কোনো প্রসাদ থেকেই ছিলেন না বঞ্চিত। ধন-মান-যশ-প্রতিপত্তি যা-কিছু মানব কাম্য, যা-কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন তা ছিল জন্মসূত্রেই আয়ত্ত। এ জীবন দেশগত তথা প্রতিবেশ প্রসূত নয়-এ হচ্ছে দেখে শেখা ও পড়ে পাওয়া কৃত্রিম ও অনুকৃত জীবন– এ দেশে অজাতমূল। কাজেই গোটা দেশের প্রয়োজন ও সমস্যার সঙ্গে এ জীবনের যোগ ছিল না–তাই দায়িত্ব ও কর্তব্য চেতনাও ছিল অনুস্থিত। কিন্তু নেতৃত্বের সহজ অধিকার বশে তারা সভাপতিত্ব করতেন বটে, কিন্তু তাতে সেবার প্রেরণা ছিল না, ছিল সৌজন্যের আড়ম্বর।
এ হেন পরিবেশের সন্তান রবীন্দ্রনাথের অসামান্যতা এখানে যে তিনি মানুষ অবিশেষের প্রতি। প্রীতির অনুশীলনে সাফল্য লাভ করেছিলেন। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ মানুষের মানবিক গুণে ও আত্মিক উৎকর্ষে আস্থা রাখতেন, অনুকূল আবহাওয়ায় মানুষের সদ্বুদ্ধি ও সৌজন্যেই পীড়ন ও পাপমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠবে–এ ধারণা বশেই তিনি জাগতিক সব অন্যায়-অনাচারের ব্যাপারে মানুষের বিবেক ও বোধের কাছেই আবেদন জানিয়েছেন। কোনো বাস্তব পন্থায় সমাধান প্রয়াস তার কাছে হয়তো মনে হয়েছে কৃত্রিম ও জবরদস্তিমূলক–যা স্বতঃস্ফূর্ত নয় বলেই টেকসই নয়।
দৈশিক পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক অমোঘতায় যে চেতনার জন্ম, সে-চেতনা সমস্যার প্রকৃতি ও সমাধানের উপায় নির্ধারণে সহজেই সমর্থ। কিন্তু যে-চেতনা পড়ে পাওয়া এবং পরিসুতি ও অনুশীলন প্রসূত তা তত্ত্বপ্রবণই করে–সক্রিয়তা দেয় না। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধও তাই। সংবেদশীলের মহাপ্রাণতাজাত সমস্যা-বিব্রত দেশকর্মীর নয়।
এজন্যেই তিনি চাষী-মজুরের হিতকামনা করেছেন, তাদের স্বাবলম্বী হবার প্রেরণা দিতেও চেয়েছেন। সমবায় সমিতি গড়েছেন কিন্তু প্রজাস্বত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন নি। জমিদার যে পরোপজীবী ও পরস্বাপহারী তা উপলব্ধি করেও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদে সক্রিয় হন নি।