দরিয়াও বলেন :
মুরলী কৌন বজ রৈ হো।
গগন মংডল কে বীচ?
যা মুরলীকে ধুন সে
সহজ রচা বৈরাট।
যা মুরলী কী টেরহি সুন সুন
রহী গোপিকা মোহী।
সব্দ ধুন মিরদংগ বজত হৈ
বারহ মাস বসংত।
অমহদ ধ্যান অখংড আতুর রে
ধ্যায়ত সব হী সংত।
কানুহ গোপী করত নৃত্যহি
চরণ বপু হি বিনা।
নৈন বিন দরিয়ার দেখে
আনংদ রূপ ঘনা।
একেতো সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানগণ ধর্মান্তরিত ভারতীয়দের বংশধর; তাদের রক্ত-সংস্কারে ভারতীয় প্রভাব বিদ্যমান, তার উপর ইসলামের একটি বিশিষ্ট শাখা-সুফী মতবাদ ভারতে প্রাধান্য লাভ করে, সুতরাং মুসলমানদের মন, ইন্দ্রিয়, আত্মা ও ধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভারতীয় ভক্তিবাদ তাদেরকে সহজেই প্রভাবিত করতে পেরেছিল। তাই বাঙালি কবি শাহনূরের কথায় মুসলমানদের রাধাকৃষ্ণ রূপক গ্রহণের সংগত কারণ খুঁজে পাই :
সৈয়দ শাহনূরে কয় রাধা কানু চিন হয়
রাধাকানু আপনার তনেরে।
আরো স্পষ্ট হয় যখন শুনিঃ তন রাধা মন কানু শাহনূরে বলে।
অথবা :
সৈয়দ শাহনূরে কয়, ভব কূলে আসি
রাধার মন্দিরে কানু আছিলা পরবাসী?
অথবা, ওসমানের কথায় :
রাধাকানু একঘরে কেহ নহে ভিন
রাধার নামে বাদাম দিয়ে চালায় রাত্রিদিন,
কানুরাধা একঘরে সদায় করে বাস
চলিয়া যাইবা নিঠুর রাধা কানু হইবা নাশ।
সৈয়দ মর্তুজাও বলেন :
আনন্দমোহন মওলা খেলএ ধামালী।
আপে মন আপে তন আপে মন হরি
আপে কানু আপে রাধা আপে সে মুরারী।
সৈয়দ মর্তুজা কহে সখি, মওলা গোপতের চিন।
পুরান পিরীত খানি ভাবিলে নবীন।
এর সঙ্গে তুলনীয় :
রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি
অন্যোন্যে বিলাসয় রসাস্বাদন করি। (চৈতন্যচরিতামৃত)।
বিকৃত বৈষ্ণব সাধক–বাঙলার বাউল ও অন্যান্য উপ-সম্প্রদায়ের অনেকগুলোই রাধাকৃষ্ণের রূপকে দেহতত্ত্ব তথা জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদপ্রয়াসী। শুধু তাই নয়, আধুনিক উর্দু কবি হাফিজ জলন্ধরী থেকে বাঙলা কবি নজরুল, জসীমউদ্দীন প্রভৃতি অনেককেই এ রাধাকৃষ্ণ কাব্য-প্রেরণা দান করেছেন।
ফলত, বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মননের ক্ষেত্রে বৈষ্ণব-মতের প্রভাব ও প্রেরণা ছিল গভীর ও ব্যাপক। এজন্যে ষোলো শতককে বাঙলার রেনেসাঁর যুগ বলা হয়। বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ ও বাঙালির মানবতাবোধ বৈষ্ণবান্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল। বাঙলা গীতিকবিতায় প্রেমের অনন্য অনুভূতির অনুপম বিকাশ, চরিত সাহিত্য সৃষ্টি, তত্ত্বালোচনার সূত্রপাত, কীর্তনের বিভিন্ন সুরের আবিষ্কার, সর্বোপরি মানুষের মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি–জীবে ব্ৰহ্ম ও নরে নারায়ণ দর্শন এবং প্রীতিতত্ত্বে দীক্ষা বাঙলাভাষা ও বাঙালির প্রতি চৈতন্য মতবাদের অমূল্য অবদান।
মতবাদীর বিচারে রবীন্দ্রনাথ
০১.
ইংরেজ-শাসন ও ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে অকালে, অতর্কিতে ও অভাবিতভাবে ঘটল আমাদের মধ্যযুগের অবসান। এ যেন অমাবস্যার নিশীথে হঠাৎ সূর্যোদয়, এ যেন কাঁচা ঘুমে জেগে উঠা। আধুনিক যুগের এই ঊষালগ্নে চকিত-চমকিত জনের মানস স্বাস্থ্যানুসারে কেউ বিমূঢ়, কেউ বিরক্ত আবার কেউ বা কৌতূহলী। নবযুগের সূচনায় যাকে সপ্রতিভ কৌতূহলী হিসেবে পাই তিনি রামমোহন। পশ্চিমী চেতনার বাতায়নিক বায়ু সেবনে তাঁর চিত্তলোক প্রসারিত–প্রতীচ্য জ্ঞানরশ্মিতে তার প্রজ্ঞালোক উদ্ভাসিত, তার উদ্যম উদ্দীপ্ত–তাই তিনি চঞ্চল, মুখর ও অক্লান্ত। তার মধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করি বুদ্ধির মুক্তি–পশ্চিমী জীবন-চেতনার প্রথম ফল।
পাশ্চাত্য হাওয়া অনেককাল কোলকাতার চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারেনি, কেননা, ইংরেজি শিক্ষা তখনো পরিব্যাপ্ত হয়নি মফস্বল অঞ্চলে। এখানেই আমরা বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত থেকে ইয়ং বেঙ্গল অবধি সবাইকে চেতনা-চঞ্চল দেখি। তখন পাশ্চাত্য নাস্তিক্য দর্শন, যন্ত্রবিজ্ঞান এবং ফরাসী বিপ্লবের মহিমাই ছিল মুক্তবুদ্ধি তরুণদের অনুধ্যেয়। অন্যেরা গ্রহণ-বর্জনের টানাপড়েনে দ্বিধান্বিত, কেউ কেউ বিপর্যস্ত। বস্তুত রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, রামকমল, কৃষ্ণকমল প্রভৃতি কয়েকজন ছাড়া তারুণ্যের অবসানে আর সবাই অর্থাৎ ইয়ং বেঙ্গলেরা হিন্দুয়ানীতেই স্বস্তি খুঁজেছেন ১৮৬০-এর আগে ও পরে। অবশ্য লালবিহারী, কৃষ্ণমোহন, মধুসূদন প্রমুখ খ্রীস্টানই রয়ে গেলেন। তখন ব্রাহ্ম হওয়া আর ব্রাহ্ম থাকাই ছিল চরম আধুনিকতা তথা প্রগতিশীলতা।
এভাবে নাস্তিক্য দর্শন তাঁদের জীবনে হল ব্যর্থ, যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসাদ ছিল অনায়ত্ত আর ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব রইল অনাগত।
আগে ছিল ভূমি-নির্ভর কড়ির জীবন। এখন নগরে দেখা দিল বেনে সমাজের কাঁচা টাকার লেনদেন। নগুরে বাঙালি ব্রিটিশ বেনের বেনিয়া-ফরিয়া-কেরানী হয়েই সে-কাঁচা টাকার প্রসাদে ধনী ও মানী। বুর্জোয়া-জীবনের পরোক্ষ স্বাদ পেয়েই তারা ধন্য ও কৃতার্থ।
তারপর ক্রমে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হল। প্রতীচ্য চেতনারশ্মি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু সে-চেতনা ছিল গোড়া থেকেই বিকৃত, বিসদৃশ, অস্পষ্ট ও অজাতমূল। বৈশ্য বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যের মধ্যযুগীয় ভূমি-নির্ভর সামন্তিক সমাজে হঠাৎ করে চালু হল পশ্চিমের শিল্পায়ত সমাজের বুর্জোয়া অর্থনীতি। অকালে ও অস্থানে এই অতর্কিত ব্যবস্থা নিয়ে এল এদেশের নিস্তরঙ্গ আর্থিক জীবনে চরম বিপর্যয়। সাম্রাজিক শোষণ, ঔপনিবেশিকতা, যন্ত্ৰজাত পণ্যপ্রাধান্য, অটল সামন্তব্যবস্থা, জনগণের অশিক্ষা, বুর্জোয়া জীবনানুরাগ আর মনোজগতে শিক্ষালব্ধ মানবিক ও আত্মিক জীবন-চেতনার প্রসার প্রভৃতি এক অদ্ভুত পরিস্থিতির জন্ম দিল, যার সমাধানবুদ্ধি ছিল না। বিমুগ্ধ, বিমূঢ়, বিভ্রান্ত ও বিপর্যপ্ত জনগণের।