স্মার্ত রঘুনন্দন ও রঘুনাথ শিরোমণির ব্রাহ্মণ্য আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিয়ে বৈষ্ণব বিপ্লবের যে প্লাবন এল তাতে পশ্চিমবঙ্গেও কিন্তু সবাই চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত হয়নি বা রাধাকৃষ্ণের রূপকে ভক্তি বা বৈরাগ্য সাধনা করে নি। হয়তো চৈতন্যদেবের উপর অভিমান, অথবা রাধা-কৃষ্ণ রূপক থেকে প্রেরণার অভাব। তাই একদল লোক ভিন্ন পথে একই সাধনা করে চলল, এরা বাঙলার বাউল। বাউল আর বৈষ্ণবে সাধনাগত মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। পরিণামে তারা। একই গন্তব্যে পৌঁছে। একদল মুসলমান হিন্দুয়ানীর প্রতি অবজ্ঞাবশত পীর-মুর্শিদের রূপকে সাধনা করেছে। আর একদল হিন্দুর যোগ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতির সমন্বয়ে এক তত্ত্ব-দর্শন খাড়া করেছে। ফলত, বাঙলায় চতুর্বিধ শাখার সাহিত্য আমরা পাচ্ছি: ১. বৈষ্ণবপদ সাহিত্য ২. বাউল সাহিত্য, ৩. মুরশিদা ও ৪. মারফৎ সাহিত্য। এ সবকটির মূল উৎস মায়াবাদ আর মুসলমানের সূফীতত্ত্ব। মায়াবাদও সূফীমতের সংমিশ্রণে ও সমন্বয়ে উদ্ভূত। শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও নানাভাবে নানাদিকে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা সেদিন নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল প্রচুর। সাহিত্যে, শিল্পে, স্থাপত্যে, সংগীতে সর্বত্র এর সাক্ষ্য মিলে। এ ধারায় চললে আজ বাঙলার সংস্কৃতি কিরূপ নিত তা হয়তো কল্পনা করা সম্ভব–কিন্তু নিরর্থক। কারণ, মধ্যপথে অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চেষ্টায় রামায়ণ-মহাভারতের বহুল চর্চা হিন্দু-মানসকে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যমুখী করে দিল। অপরপক্ষে ফরাজেয়ী-ওহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে শরীয়তের প্রতি অত্যধিক অনুরাগ মুসলমানগণকেও রক্ষণশীল এবং আরব-ইরানী তমদুনের পূজারী করে তুলল। ফলে, বাঙলার সংস্কৃতি সম্ভাব্য পরিণতি লাভ করতে পারল না।
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অনেক কবি বৈষ্ণবপদ-সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। তাদের কেউ করেছেন নেশার ঝেকে আর কেউ করেছেন পেশা হিসেবে। নেশার ঝেকে করার দারণ দুটো :১. সূফী মতবাদের সাথে বৈষ্ণবাদর্শের আত্যন্তিক সাদৃশ্য ও আচারিক মিল, ২. জগৎ ও জীবনের চিরাবৃত রহস্য, জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের কৌতূহল প্রভৃতি মানুষের মনে যে জিজ্ঞাসা জাগায়, তার সদুত্তর সন্ধান-প্ৰয়াসজাত যে অভিব্যক্তি তাতে দেশী বহুল প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ রূপকের ব্যবহার। বৈষ্ণবদের নামকীর্তন, জীবে দয়া, বর্ণভেদ প্রথার বিলোপ সাধন, বিনয়, নামে রুচি, দশা, সখীভাব, ঐশ্বর্য প্রদর্শন, রাগানুগ্লাভক্তি, তালাক প্রথা, পুনর্বিবাহ প্রভৃতি সূফীদের যিকর, খিদমত, সামা, হাল, সদাসোহাগ, কেরামতি, তরিকত, হকিকত, মারফত প্রভৃতির অনুকরণ মাত্র। ফানাফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহও রাধাকৃষ্ণের অভেদতত্ত্ব বা যুগল রূপ পরিকল্পনার উৎস স্বরূপ। এমনকি অদ্বৈতবাদী হিন্দুর দ্বৈতাদ্বৈতবাদও সূফীর দ্বৈতবাদ থেকে উদ্ভূত। অবশ্য বেদান্ত প্রভাবে পরে সূফীদের কেউ কেউ দ্বৈতাদ্বৈতবাদী হয়েছিলেন। সুতরাং সুফী মতাসক্ত বাঙালি মুসলমানদেরকে বৈষ্ণব সাধনা অনুপ্রাণিত করবে তাতে আশ্চর্য কী? এজন্যেই সাধক নূর কুতুবে আলম এবং সৈয়দ মর্তুজা ফারসি গজল যেমন লিখেছেন, বাঙলা রাধাকৃষ্ণপদও তেমনি রচনা করেছেন। তারা দুই তত্ত্ব অভিন্নরূপে দেখেছেন। রাধাকৃষ্ণ যে জীবাত্মা ও পরমাত্মা, দেহ ও প্রাণ এবং ভক্ত ও ভগবানের পরিভাষারূপে পাক-ভারতের সর্বত্র গৃহীত হয়েছিল, এঁদের এবং পাক-ভারতের বিভিন্ন ভাষায় মুসলিম রচিত পদ ও দোহাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তা ছাড়া মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে চিরজিজ্ঞাসু–সেই অনাদিকাল থেকে মানুষ নানাভাবে এ প্রশ্নের সদুত্তর সন্ধান করেছে। আজও তার অবসান হয়নি। কারণ, আজো সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সমাধান মেলেনি। এই চিরন্তন জিজ্ঞাসার রূপ মানুষ অবিশেষে একই, কাজেই চিন্তাধারাও কমবেশি একই রূপ। কেননা, সবারই যে চিত্তকাড়া কালার বাঁশী লাগিছে অন্তরে। ইরানী ভাষা ও সাহিত্যে অপটু বাঙালি মুসলমান তাই রাধাকৃষ্ণের দেশী রূপকে জগৎ, জীবন আত্মপরমাত্মায় রহস্য উদঘাটনে প্রয়াসী হয়েছে। শুধু বাঙালি মুসলমানই বা বলি কেন; দাদু, কবীর, রজব, তাজ প্রভৃতি অবাঙালি মুসলমানও রাম সীতা ও রাধা-কৃষ্ণকে বাদ দিতে পারেননি। রাধাকৃষ্ণ রূপক তাঁদের মনন-প্রকাশের বাহনরূপে কাজ করেছে। সতেরো শতকের দরিয়া সাহেব বলেন:
আদি অংত মেরা হৈ রাম।
উন বিন ঔর সকল বেকাম ॥
কহা করা যে মান বড়াই।
রাম বিনা সরহী দুখ দাঈ ॥
কবি শেখ বলেন :
চরণ কমল হী কী।
লোচনর্মে লোচ ধরী
রোচন হরৈ রাচ্যো
সোচধাম ধনকৌ।
সোক নেস নেক হু।
কলেস কৌ ন লেস রহ্যো।
সুমরি শ্রীগোকলেস
গো কলেস মনকৌ।
মইজুদ্দিন বলেন :
বৃংদাবনকী কুংজ গলিন মে
টুংটত টুংটত হারী
দৈহৌ দরস মোহি আপনি।
মৌজ সে এহো কৃষ্ণ মুরারী
পিয়া মোহি আস তিহারী।
আফসোস বলেন :
নিশিদিন কৃষ্ণ মিলন কো সখিয়া
আস লগায়ে ঠাড়ি রহত হৈ।
আফসোস পিয়াকী নেহ-সুরতিয়া।
নিরখত নর ঔনারী রহত হৈঁ।
কবি কাইম বলেন :
হরি হেরত মৈ কিরতা বাবরী
নৈননি সেঁ কব আবৈ
হরি কো লখি কাইম সখিয়া সে
কাহে ন ধূম মচাবৈ।
সাধক এয়ারী বলেন :
হৌ তো খেলৌ পিয়া সংগ হোরী,
জবতে দৃষ্টি পরৌ অবিনাসী
লাগী রূপ ঠগৌরী।
কহ য়ারী যদি কর হরিকী
কোই কহৈ কো কহৌরি