এদের উদ্দেশ্য ও সাধনা সার্থক হয়েছিল। ইসলাম সত্য সত্যই বড় বাধা পেল। এর গতি চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ইসলাম আর প্রচার বা প্রসার লাভ করল না। এর আগে মদিনা থেকে পশ্চিম পাঞ্জাব অবধি ইসলামে দীক্ষা অপ্রতিহত ছিল। শুধু তাই নয়, বহু মুসলমান তাঁদের মতে দীক্ষিতও হল– বিশেষত শিখ ও বৈষ্ণব ধর্মে। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের আওতায়ও এরা রইল না। এগুলো হিন্দু-মুসলিম ধর্মদর্শনের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম। কিন্তু প্রচারকগণ নামত হিন্দু বিধায় এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, রাধা, কৃষ্ণ, রাম, সীতা, দেরতা প্রভৃতি নামসার হিন্দুয়ানীর রেশ থাকাতে, এরা জাতি অর্থে হিন্দুই রয়ে গেল। তাতে উত্তরকালে রাজনীতিক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা হয়। সুতরাং এরা নামগত জাতিতে হিন্দু এবং ধর্মগত জাতিতে আলাহিদা। যেমন রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্মে হিন্দুয়ানীর চেয়ে খ্রীস্টানী ও মুসলমানী কম নয়, তবু ব্রাহ্মবাদের ঐতিহ্যবোধে এবং রামমোহন নামের মাহাত্মে ব্রাহ্মগণ নিজেদের ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের শাখানুসারী বলে মনে করে। ফলত এরা জাতি হিসেবে হিন্দুই রয়ে গেল। বস্তুত, রামমোহনের ব্রাহ্মধর্ম সচেতনভাবে খ্রীস্টধর্মের প্রসার রোধকল্পে প্রবর্তিত হয়েছিল ও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল।
উক্ত সব সাধকের মধ্যে জোলা শ্রেণীর কবীর ও ধূনকর সম্প্রদায়ের দাদু ও রজ্জব মুসলমান ছিলেন। মুসলমান হয়েও তারা ধর্মান্দোলন শুরু করেছিলেন তার কারণ, এরা নিম্নশ্রেণীর উৎপীড়িত হিন্দু-সমাজ থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সূফীদের হাতে। শরিয়তী ইসলামের সঙ্গে পরিচয়ের অভাব, পূর্ব-সংস্কারগত মায়াবাদের প্রভাব এবং সূফীতত্ত্বের উদার আবহাওয়া এদেরকে ভাবরসে বা প্রেমসাধনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। বৈচিত্র্য ও বিভেদের মধ্যেও যে আত্মার স্বরূপ এক ও অবিকৃত, এই সমন্বয়পন্থিগণ তা-ই প্রচার করেছেন। এসব ধর্মান্দোলনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল বর্ণভেদ প্রথা ও শাস্ত্রে অনধিকার রহিতকরণ এবং মনুষ্যসত্তার মর্যাদা দান। তা পুরোপুরি সফল হল। তাই ইসলাম আর প্রসার লাভ করেনি। ইসলামের প্রভাবই সমাজ সংস্কারে প্রয়োজনীয় ফল দান করল। যেমন, য়ুরোপে ইসলামের অনুকরণে Protestant মত প্রচারই নবযুগ সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
বাঙলাদেশে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে চণ্ডীদাসও এরূপ একজন সাধক ছিলেন। সূফীপ্রভাবে তিনিও প্রেমধর্ম প্রচার করেন এবং বর্ণভেদের বিরুদ্ধে তিনিও বলে উঠেন: শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। এর পরে মাধবেন্দ্রপুরী এবং তার পরে শ্রীচৈতন্য।
ভাগবতে ভক্তিবাদের উল্লেখ ছিল। কিন্তু তা মুসলিম বিজয়ের পূর্বে প্রসার লাভ করে নি। গীতগোবিন্দে আধ্যাত্মিকতা নেই, বিদ্যাপতিতেও না। গীতগোবিন্দ, বিদ্যাপতির পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণবিজয়, কৃষ্ণধামালী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। (শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ), শিবশিবানীর ছড়া বা গাথা প্রভৃতি আদিরসাত্মক রচনা সমাজ-জীবনের বিকৃতির এবং রাজনৈতিক নিবর্ষিতার যুগে নৈতিকতা শিথিল গণমনের রস-পিপাসা মিটাবার জন্যে রচিত হয়েছিল। ইত্যাকার আদিরসাত্মক রচনা সম্বন্ধে হুমায়ুন কবীর যথার্থই বলেছেন: সমাজ জীবনে যখন মন্দা পড়েছে, বিলাসের আড়ম্বরে জাতির চরিত্রতেজ ও শৌর্য যখন ম্লান, তখনই বিদ্যাসুন্দরের এবং এ ধরনের কাহিনীর প্রাদুর্ভাব। পাঠান রাজত্বের অবসানের যুগে শ্রীধরের বিদ্যাসুন্দর, মোগলশক্তির আসন্ন ভাঙনের দিনে কৃষ্ণরামের বিদ্যাসুন্দর এবং নবাবী আমলের অবসানে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের আবির্ভাবে এ-কথার সাক্ষ্য মেলে। রাজশক্তির পতনের দিনে ঐশ্বর্য ও বিলাসের আড়ম্বর সমস্ত দেশেই দেখা দেয়, বাঙলা দেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি; তাই অবনতিপ্রবণ সমাজের বিকৃত রুচির প্রতিচ্ছায়া হিসাবে বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়ও বারে বারে অশুচিরূপে ফুটে উঠেছে।… রাজসভার কৃত্রিমতায় সে কাহিনী যত পঙ্কিল হয়ে উঠেছে ধর্মপ্রেরণার অবান্তর আগ্রহে তাকে সজীব করবার চেষ্টাও হয়েছে তত বেশি। ভারতচন্দ্র তাই ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতীক–জীবনের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মন্দার দিকে তার আবির্ভাব স্বাভাবিক ও সঙ্গত।
বিপরীতধর্মী দুই সংস্কৃতির মোকাবিলায় নিপীড়িত নিম্নবর্ণের হিন্দুসমাজ-মনে, তার ধর্মবিশ্বাস ও জীবনদর্শনে যে সাড়া জাগল, তারই ফলে বাঙলায় বৈষ্ণব ও বাউল মতবাদের উদ্ভব ও পরিণতি। অবশ্য দক্ষিণ ভারতেই এর প্রথম বিকাশ। এখানে ভক্তিবাদে যে মনোবৃত্তির প্রকাশ তাতে দ্রাবিড়সুলভ ভাবাবেগের প্রাচুর্য ছিল, আর ছিল তীব্র প্রাণময়তা। দ্রাবিড়রক্তের উত্তরাধিকারী বাঙলায়ও বৈষ্ণব ভক্তিবাদ একইরূপ উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনার সৃষ্টি করল। এমনিতে বাঙালি চিরকাল ভাবপ্রবণ ও স্পর্শকাতর। সামান্য কারণেই উচ্ছ্বসিত, উত্তেজিত, উন্মত্ত বা অভিভূত হয়ে পড়ে। এজন্যেই এরা যখন সাহিত্য সৃষ্টি করে তখন তা গীতিকবিতা হয়ে উঠে, সামাজিক আন্দোলনে সাময়িক ঝড় উঠে। রাজনীতিতে ভয়ংকর বিপ্লব ঘটায়, এজন্যেই এরা তর্ক করে যুক্তি মানে, কিন্তু হৃদয়ানুভূতিগোচর না হলে আচরণ করে না।
বৈষ্ণব মত ও সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছিল পশ্চিম বাঙলায়। এদের প্রভাবও বিশেষভাবে পড়েছিল পশ্চিম বাঙলায়। তার কারণ, হুমায়ুন কবীরের ভাষায় : পশ্চিম বাঙলায় শালবন আর কাঁকরের পথ–দিগন্ত-প্রান্তর দৃষ্টিসীমার বাইরে মিলিয়ে আসে। শীর্ণ জলধারার গভীর রেখা কাটে দীর্ঘ সংখ্যাহীন স্রোতস্বিনী। বাতাসে তীব্রতার আভাস, তপ্তরৌদ্রে কাঠিন্য, দিনের তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট দীপ্তির পর অকস্মাৎ সন্ধ্যার মায়াবী অন্ধকারে সমস্ত মিলিয়ে যায়। রাত্রিদিনের অনন্ত অন্তরালে মনের দিগন্তে নতুন জগতের ইঙ্গিত নিয়ে আসে, তপ্ত রৌদ্রোলোকে মূর্ধাহত ধরণী অন্তরকে উদাস করে তোলে। পশ্চিম বাঙলার প্রকৃতি তাই বাঙালির কবিমানসকে যে রূপ দিয়েছে, তার মধ্যে। রয়েছে লোেকাতীত রহস্যের আভাস, অনির্বচনীয়ের আস্বাদে অন্তর সেখানে উন্মুখ ও প্রত্যাশী জীবনের প্রতিদিনের সগ্রাম ও প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণে। কিন্তু পূর্ব বাঙলায় এতবড় ধর্ম ও সাহিত্য আন্দোলনের প্রভাব যে পড়েনি তা নয়, তবে তা যেন কতকটা প্রথা রক্ষার তাগিদে কৃত্রিম চর্চা। পূর্ববঙ্গে মানুষ ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাই ছিল বেশি, তাই লক্ষ্য তার প্রায়ই ভূমির দিখে। কৃচিৎ ভূমার দিকে তা ধাবিত হয়েছে। ফলে এখানে প্রাত্যহিক জীবনের সুখ দুখ-দ্বন্দ্ব ও প্রেম-স্নেহ-বিরহ-মিলনের গান-গাথা এবং দেবদ্রোহী, বীর্যমান, মর্যাদাবান, মানবতার প্রতীক চাঁদ সদাগর চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। কারণ পূর্ববঙ্গের নিসর্গ হৃদয়কে ভাবুক করেছে বটে, কিন্তু উদাসী করে নি। দিগন্ত প্রসারিত প্রান্তরে রয়েছে অহোরাত্র জীবনের চঞ্চললীলা। পদ্মা-যমুনা মেঘনার অবিরাম স্রোতোধারায় নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস। প্রকৃতির বিপুল শক্তি নিয়তই উদ্যত হয়ে রয়েছে, কখন আঘাত করবে তার ঠিকানা নেই।… সেই জীবন ও মরণের অনন্ত দোলার মধ্যে সংগ্রামশীল মানুষ প্রকৃতির সে ঔদার্য, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের সেই ভয়ঙ্কর শক্তি ভোলবার অবসর কই? চরের মানুষ নদীর সাথে লড়াই করে, জলের ঐশ্বর্যকে লুটে জীবনের উপাদান আনে। তাই লোকাতীতের মহত্ত্ব হৃদয়কে সেখানেও স্পর্শ করে, কিন্তু মনের দিগন্তকে প্রসারিত করেই তার সমাপ্তি, প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণের সেখানে অবকাশ কই?… পূর্ববাঙলার প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও মহিমা সত্ত্বেও নিসর্গের সঙ্গে সগ্রামশীল মানুষ মুহূর্তের জন্যও নিজের সত্তা ভুলে থাকতে পারেনি। বৌদ্ধ বিপ্লবে যে সাম্যবাদ পূর্ব বাঙলার মজ্জাগত, মুসলিম বিজয়ে তা আরো প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করল এবং সেই সঙ্গে জেগে উঠল নতুন আত্মপ্রত্যয়, নতুন ব্যক্তিত্ববোধ এবং স্বাধিকারের জ্ঞান। এভাবে পূর্ব বাঙলার ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিদ্রোহ-ধর্মী মন সহজেই ইসলামের সংসারমুখী সন্ন্যাস-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে নিল। (বাঙলার কাব্য)।