দানা চু অন্দর জমিন পেন্হা শওয়াদ।
বাদ আঁজা সারে সবজি বস্তা শওয়াদ।
জীবাত্মা তখন বংশীর ন্যায়–বশোনা আজয়ে ফুঁ হেকায়েত মি কুনদ…..এজন্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন :
বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো
রয়েছে দীপ না আছে শিখা, এই কি ভালে ছিল রে লিখা
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
তাই সূফী গজলে ও বৈষ্ণবপদে আমরা মিলন-পিপাসু বিরহী-আত্মার করুণ ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাই। সূফী-গজল ও বৈষ্ণবপদসাহিত্য মানবাত্মার চিরন্তন Tragedy-র সুর ও বাণী বহন করছে। না-পাওয়ার বেদনা আর পেয়ে হারানোর শঙ্কা–কোটার চেয়ে কোন্টা কম! তাই চিরকাল হিয়ার পরশ লাগি হিয়া যেমন কাঁদে এবং লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়া রাখলেও হিয়া, জুড়ায় না, তেমনি দুহু ক্রোড়ে দুহঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া। এর শেষ নেই–সমাধান নেই। এ সাধনাও বড় কঠিন সাধনা। ঘৃণা-লজ্জা-ভয়–এ তিন থাকতে কিছু হয় না। ধন-জন-মানের আকাঙ ক্ষা ত্যাগ করলে, তবে ঘৃণা-লজ্জা-ভয় ঘুচে যায়। এজন্যেই এতে সবার অধিকার নেই। সূফী বৈষ্ণবেরা তাই পণ্ডিত ও ধর্মধ্বজীদের উপহাস করেন। হাফেজ বলেন :
ঢালো সুরা সখি, সাজাও পেয়ালা শরম আছে কি তায়।
প্রেমের মরম তারা কি জানে লো ধরম যাহারা চায়
চণ্ডীদাস বলেন,
মরম না জানে ধরম বাখানে এমন আছ যারা,
কাজ নাই সখি, তাদের কথায় বাহিরে রহুন তারা।
মুসলমানদের ভারত অধিকার ভারতবর্ষের সামাজিক ও কৃষ্টির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইতিপূর্বে শক-হুঁনদল এসেছিল; ভারতবাসীরা অনায়াসে তাদের গ্রহণ করতে পেরেছিল। কিন্তু বহিরাগত তুর্কী মুসলিমকে এদেশীয় সমাজ আত্মস্থ করতে পারে নি। তার কারণ, মুসলমানেরা শুধু বিশেষ আকৃতি, প্রকৃতি ও বাহুবল সম্বল করে আসে নি, এনেছিল যুক্তি নির্ভর এবং প্রত্যয়-দৃঢ় ধর্ম, সমাজ, আচার আর রাষ্ট্রাদর্শ যার সামাজিক ও পারমার্থিক প্রভাব ছিল অসাধারণ। এত অসাধারণ যে, তা আজকের দিনের বলশেভিকবাদের চেয়েও সর্বগ্রাসী এবং আণবিক বোমার চেয়েও বিস্ময়কর। ফলে, মুসলমানদের একদেহে লীন করা কোনো মতেই সম্ভব হয় নি। কিন্তু আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ্য-ধর্মও পর্যদস্ত হবার নয়। এর অন্তর্নিহিত শক্তিও এই নবশক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার যোগ্য ছিল। ফলত, ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম না হল ইসলামে বিলীন, না পারল মুসলমানদের বিলীন করতে। বিজেতা ও বিজিতের তথা শাসক ও শাসিতদের মধ্যেকার এ স্নায়বিক দ্বন্দ্ব বড় তীব্র হয়ে দেখা দিল। কেউ কাকেও না পারে গ্রহণ করতে, না পারে গ্রহণ করাতে। অবস্থাটা যেন কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান। উভয় পক্ষই বুঝল এ অবস্থা অসহ্য, এর আশু সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু এসব অভিজাত হিন্দুর কথা।
এদিকে বর্ণাশ্রম কণ্টকিত অনুদার রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে নিপীড়িত শূদ্রগণ ইসলামের সাম্য ভ্রাতৃত্বের চুম্বকার্ষণে এতই বিচলিত হয়েছিল যে, স্বধর্মে সুস্থির থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। আগ্রহ প্রবল হলেও মন যা চায় তা পাওয়া অধিকাংশের পক্ষেই সহজ ছিল না। নবধর্ম গ্রহণে বাধা ছিল ত্রিবিধ : প্রথমত, প্রাচীন সংস্কারের মোহ ও ভয় : দ্বিতীয়, হিন্দু-সমাজপতির কোপ-দৃষ্টি, তৃতীয়, ইসলাম সম্বন্ধে অনিশ্চিত জ্ঞান। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার-বঞ্চিত নিপীড়িত নিম্নবর্ণের হিন্দুগণ ইসলামের উদার সমাজ-ব্যবস্থা ও সাম্য দর্শনেই প্রলুব্ধ হয়েছিল এবং আজন্ম পোষিত মায়াবাদের সঙ্গে বহুশ্রুত সূফীতত্ত্বের অপূর্ব সামঞ্জস্য দর্শনে কিছুটা আশ্চর্যও হয়েছিল। এভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুগণের ঘরের বাঁধন আলগা হয়ে গেল, পথে নামল, কিন্তু ইসলামের আশ্রয় নিতে পূর্বোক্ত কারণে ছিল প্রচুর শঙ্কা। দাদুর ভাষায়–হিংদু তুরুক ন হোইবা সাহিব সেতী কাজ। অতএব নির্ভে নিৰ্পৰ্থ হোই। তাই ঘরেও নয়, গন্তব্যেও নয়, পথ চলে পথের দিশা পাওয়ার প্রয়াস দেখা দিল। হিন্দুর মায়াবাদ ও মুসলমানদের সূফীতত্ত্বের সমন্বয়ে নবদর্শন আবিষ্কৃত হল, অর্থাৎ নতুন ধর্ম সৃষ্টি হল। সক্রেটিসের Knoweth thyself, উপনিষদের আত্মানাং বিদ্ধি, ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু। বা উপনিষদের তং বেদ্যং পুরুষৎ বেদ মা বো মৃত্যু পরিব্যথা। এই হল নবধর্মের মূল দর্শন বা মন্ত্র। ধর্ম সাধনার উদ্দেশ্য যখন মনের মানুষকে পাওয়া, তাহলে হিন্দুয়ানী বা মুসলমানীর বেড়াজালে আটকে পড়ার দরকার কী? শঙ্করাচার্যের দর্শন তখনও আলোচিত তত্ত্ব এবং ফারসি-সাহিত্যের মারফত হাফেজ, জামী, রুমী, আত্তার, খৈয়ামের বাণী মুখে মুখে উচ্চারিত সত্য। কাজেই এ আন্দোলনের ইন্ধন ছিল হাতের কাছেই।
এরূপে ভারতের দিকে দিকে ধর্ম সমন্বয় ও ঐক্যের বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ভাস্কর, মাধব, রামানন্দ, নানক, কবীর, একলব্য, দাদু, চৈতন্য, রামদাস, নিস্বার্ক, বল্লভ প্রমুখ বহু সাধক-প্রচারকের আবির্ভাব ঘটল। শাস্ত্রাধিকার, সামাজিক সত্তা ও জীবনে নিরাপত্তাবোধের অবচেতন প্রেরণা থেকেই হয়তো এসব ধর্মান্দোলন শুরু হয়, কিন্তু অনতিকাল মধ্যে এগুলো ইসলাম ও দণ্ডধর মুসলিম শক্তিকে বাধা দেবার বা বিতাড়িত করবার সচেতন প্রয়াস হিসেবে প্রকট হয়ে উঠে। শিখ ও বৈষ্ণবান্দোলনে এ উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল– তার বহু প্রমাণ রয়েছে। রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে বাদশাহ আকবর থেকে গান্ধীর কাল পর্যন্তও সমন্বয়-সাধনা অব্যাহত ছিল। এ পথে গান্ধীর রামধুন সংগীত ও নজরুলের কয়েকটি কবিতাকে শেষ প্রয়াস বলে ধরে নেয়া চলে। এসব সংগীত সূফী কবির দিওয়ান, গজল ও রুবাইর অনুকরণে রচিত হয়েছে। চর্যাগীতিও দোহার আমল থেকেই গণভাষায় রচিত পদ ও দোহা ধর্মমত ও তত্ত্ব প্রচারের বাহনরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।