ব্রাহ্মণ্যবাদীদেরও এ ব্যাপারে প্রধান পুঁজি মায়াবাদ। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হল বলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই প্রথম বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসবাদকে স্বীকৃতি দিল অর্থাৎ মায়াবাদকে ভাঁওতা হিসেবে নয়, জীবনে সাধ্য ধর্ম-দর্শনরূপেই গ্রহণ করল তারা। এর ফলে জীবনে চতুরাশ্রম গ্রহণ একরূপ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল। এইরূপে হয়তো এই প্রথম দ্রাবিড়-আর্যের ধর্মসমন্বয় পূর্ণতা পেল। এমনি করে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিমার্গের সমান আদর ও কদর প্রতিষ্ঠিত হল। আর্যের ব্ৰহ্মবাদ, দ্রাবিড়ের মায়াবাদ এবং উভয়ের সমন্বয় ও সংমিশ্রণজাত ভক্তিবাদ সচ্চিদানন্দ শক্তি পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রসার লাভ করল। এতেও মূলত দ্রাবিড় সংস্কৃতি প্রাধান্য পেল। ভারতে মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিবর্তন ও রূপান্তরের ধারা ছিল এরূপই।
মুসলমানদের কোরআনের মধ্যেই সূফীতত্ত্ব নিহিত ছিল বলে অনেকের বিশ্বাস। ভাবপ্রবণ হৃদয়বান ইরাকীদেরকে প্রথমে তা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মূলত কোরআন থেকেই সূফীমতের সমর্থন পাওয়া গেলেও এর পুষ্টি ও প্রসার ঘটে ভারতীয় বেদান্তের পরোক্ষ এবং নিউল্ল্যাটনিক দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। দেখতে দেখতে ইরাকে-ইরানে মরমীয়াদের সংখ্যা আশাতীতরূপে বেড়ে গেল। হাফেজ, রুমী, জামী, নিযামী, ওমর খৈয়াম প্রমুখ কবির সৃষ্টির মাধ্যমে তা ইরানের সীমা অতিক্রম করে গোটা মুসলিম জগতে ছড়িয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, সূফীদের আল্লাহ আর সচ্চিদানন্দে দৃশ্যত পার্থক্য কিছুই নেই।
মুসলমান অধিকারের পূর্বে ও পরে ভারতে যারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন তাঁরা সবাই সূফী দরবেশ ছিলেন। এই মরমীদের অনেকেরই সঙ্গে শরীয়তের বাহ্যানুষ্ঠানের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। অথচ ধর্ম আচারিক ও আনুষ্ঠানিক না হলে সাধারণ লোকের পক্ষে ধর্মাচরণ দু:সাধ্য। সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক ও পারমার্থিক সাধনা বাহ্যানুষ্ঠান ও আচরণের মাধ্যমেই চলে। ফলত, পীর দরবেশ-আউলিয়া প্রচারিত ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ভারতের প্রথম যুগের মুসলমানগণ মুসলিম সংস্কৃতি পুরোপরি গ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পীর-পূজা প্রচলিত হয়। এইভাবে। এতে কোনো হিন্দুপ্রভাব নেই। তবে এই পীরবাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ও হিন্দুর গুরুবাদের পূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে।
সূফীদের মূলবক্তব্য হচ্ছে : সৃষ্টিটা স্রষ্টার আনন্দজাত। আনন্দিত স্রষ্টা বললেন: কুফায়াকুন (Be it so, and it is so) অর্থাৎ সৃষ্টিটা কারো অনুরোধে বা গরজে হয়নি। স্রষ্টা তার খেয়াল খুশির খাতিরে আনন্দ-সহচর হিসাবেই তা করেছেন। এ তাঁর লীলা। অসমানে প্রণয় হয় না। নিদ্বন্দ্ব, নির্বিঘ্ন ও অকৃত্রিম আনন্দ পেতে হলে বন্ধুর সাহচর্যই কাম্য। কারণ, হৃদয়ের অসংকোচ প্রকাশ একমাত্র প্রণয়ের সম্পর্কেই সম্ভব। সুতরাং স্রষ্টা যেখানে আত্মোপভোগের জন্যেই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেখানে সৃষ্টি-সেরা মানুষের সঙ্গে তাঁর বান্দা-মনিব-সম্পর্ক হতে পারে না। তাহলে যে সৃষ্টির সার্থকতা থাকে না–স্রষ্টার উদ্দেশ্যই যে ব্যর্থ হয়। যেখানে প্রণয় আছে, সেখানে গতিবিধি অবাধ হওয়াই স্বাভাবিক,–কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলের বাধা সেখানে অবাঞ্ছিত নয় শুধু, অসম্ভবও। কাজেই আল্লাহর সঙ্গে যেখানে মানুষের প্রণয়ের সম্পর্ক সেখানে বান্দা-মনিবের, পিতা-পুত্রের বা ভক্ত-ভগবানের সম্পর্ক কল্পনা করাও বাতুলতা। কাজেই নামাজ, রোজা বা ইত্যাকার আনুগত্যের প্রশ্নই অবান্তর। ফলে শরীয়ৎ সেখানে নিরর্থক। অনুরাগে প্রণয়ের উন্মেষ, বিরহ বোধে উপলব্ধি এবং মিলনে এর সার্থকতা। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে–প্রেমিক প্রেমাস্পদ পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ করতে আকুল হবে, পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। এ প্রেম জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম। জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার খণ্ডিতাংশ। বিন্দু বিন্দু বারি নিয়ে সমুদ্র। কিন্তু বিন্দুর একক শক্তি কতটুকু! তাই তার অস্তিত্ব রক্ষার গরজেই সমুদ্রের জন্যে তার আকুলতা। নইলে যে তার অপমৃত্যু সুনিশ্চিত! বিন্দুস্বরূপ জীবাত্মার তাই পরমাত্মার জন্যে এত আকুলতা। গরজ জীবাত্মার, তাই সে প্রেমিক–তাই সে রাধা। পরমাত্মারও গরজ আছে–যেমন সমুদ্রও বারিবিন্দুর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোনো বিশেষ বিন্দুর জন্যে তার বিশেষ আকুলতা নেই। এজন্যেই জীবাত্মা সদা উদ্বিগ্ন পাছে সে বাদ পড়ে। তাই রাধা বলে–এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে; না-জানি কানুর প্রেম তিলে জনি টুটে। প্রেমের পরিণতি একাত্মতায়, যখন বলা চলে আনলহক বা সোহম। এই অবস্থাটা সূফীর ভাষায় ফানাফিল্লাহ বা বাকাবিল্লাহ, বৈষ্ণবের কথায় যুগল রূপ বা অভেদ রূপ। (তু. চৈতন্যদেব মুই সেই, মুই সেই)–এ দুটো কথায় সূক্ষ্ম-দার্শনিক অর্থে মারপ্যাঁচ আছে। তবে অবস্থা ও অভিপ্রায়টা মূলত একই।
কুনফায়াকুন দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। পক্ষান্তরে, একোহম বহুস্যাম অদ্বৈতবাদনির্দেশক। সূফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী কিন্তু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে, পরিণামে অদ্বৈত সত্তার প্রয়াসে। সুফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের প্রেমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্ত বিরহবোধের উদ্বোধনই সুফী বৈষ্ণবের প্রধান কাজ। কেননা, রুমীর কথায়–