উপায় বের করতেই হবে–পুরোনো কখনো নতুন মানুষের প্রয়োজন মিটাতে পারে না। অতীত কখনো বর্তমানের চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ নয়, তা-ই যদি হতো তাহলে তো নিত্য বর্তমানই থাকত কাল–তার না থাকতো অতীত, না থাকতো ভবিষ্যৎ–এমনকি এ কালভাগ থাকতো অকল্পনীয়।
তাই পরিহার করতে হবে অতীতের ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রবোধ, পুরোনো ন্যায়-নীতি ও আদর্শ চেতনা। বাঁচার উপায় বের করতেই হবে–এমনকি তা যদি Flamingo-দের মতো আত্মহত্যার মাধ্যমেও করতে হয়, তাহলেও। বাঁচার তাগিদে আগেও কোনো প্রাণী মারতে বা মরতে দ্বিধা করেনি। আজো করবে না, বাঁচার জন্যেই আজো মানুষ মরতে ও মারতে প্রস্তুত। অন্ন ও আনন্দের ভারসাম্য চাই আজ। বাস্তব পন্থা অবলম্বন না করে হৃদয়বেদ্য মহৎ ও বৃহৎ বুলির চাতুরী দিয়ে ভোলানো যাবে না আজকের মানুষকে। এমনি বুলি শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস। আমাদের ভুললে চলবে না, যে বিজ্ঞান দর্শন, শিল্পকলা প্রভৃতির স্রষ্টা হলেও মানুষ প্রাণী–আর সব কিছুর স্থান জীবের জৈব চাহিদার পরে। Old order must change yeilding place to new.
বৈষ্ণব মতবাদ ও বাঙলা সাহিত্য
আর্যপূর্ব যুগে ভারতে দ্রাবিড়গণই বিশেষ প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিল। তারা সংখ্যায় যেমন অধিক ছিল, দণ্ডশক্তি এবং সংস্কৃতিতেও তেমনি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। কাজেই মনে করা যেতে পারে আর্যপূর্ব যুগে ভারতে যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিরাজ করত তা বাহ্যত এবং প্রধানত দ্রাবিড় সভ্যতা।
দ্রাবিড়গণ সেমিটিক গোত্রীয় হলেও, ভারতের আবহাওয়ায় তাদের মন ও মননের পরিবর্তন হয়েছিল। কায়ার চেয়ে ছায়ার মায়ায় ক্রমশ অভিভূত হয়ে পড়েছিল তারা। জীবনবাদের চেয়ে জীবনুক্তিই সাধ্য-সাধনার মুখ্য লক্ষ্য হয়ে উঠল। ভোগবাদ যেখানে বৈরাগ্যের নিকট পরাজিত হয়, সেখানে অলস-নিষ্ক্রিয়তা তথা ভাবপ্রবণতা ছাড়া আর কী আশা করা যায়! বাহ্যজগতের প্রতি বিরাগ ও মনোজগতের প্রতি অনুরাগই তাই তাদের বড় দার্শনিক করে তুলল বটে, কিন্তু নির্বোধ বিষয়ী করে রাখল। দৃশ্যজগৎকে তুচ্ছ করে, অদৃশ্যজগৎকে উচ্চ করে তার সাধনায় যখন দ্রাবিড়গণ বিভোর, তখন ভারতে এল আত্মপ্রত্যয়শীল, সগ্রামী, জীবনবাদী যাযাবর আর্য। বাধা দেবার মতো দণ্ডশক্তি দ্রাবিড়দের ছিল না। উৎপীড়ন যখন অসহ্য হয়, তখন নিতান্ত নিরীহ এবং দুর্বলও মরণ কামড় দিতে চেষ্টা করে। দ্রাবিড়গণ সেরূপ বাধা দিয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা দাক্ষিণাত্যে ও পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে বাঁচল। অভিজাত অনার্যেরা আর্যসমাজে মিশে গেল। তবু বহু অনার্য আর্য-খপ্পরে পড়ে গেল এবং আর্যসমাজে তারা নিগ্রহ ভোগ করতে থাকল।
আর্যগণ দ্রাবিড়দের মাথার অধিকার পেল বটে, কিন্তু মনের কাছে হার মানল। দ্রাবিড়দের যুগান্তরের ভাবচিন্তা কি ব্যর্থ হবে? তাই এদের মানস-সংস্কৃতির কাছে বাহুবলে বলীয়ান আর্যগণ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। যেমন পরবর্তীকালে রোমকগণ করেছিল গ্রীকদের কাছে, আরবগণ করেছিল ইরানীদের নিকট। বাহুবল বাক্যবলের কাছে হার মানল। মাংসপিণ্ড থেকে মন যে অনেক বড়, তা স্বীকৃতি পেল। ক্রিয়াকাণ্ড ও. যাগ-যজ্ঞপ্রধান আর্যধর্মের উপর পড়ল দ্রাবিড় প্রভাব। আচারসর্বস্ব আর্যধর্মে প্রবিষ্ট হল ভাববাদ। জীবনবাদী,জীবনধর্মী আর্যদের তৃতীয়নেত্র উন্মীলিত হল, মায়াবাদ প্রাণধর্মী আমানসের সরস সতেজ ক্ষেত্রে বইয়ে দিল উদাস হাওয়া।
দিন যায়। দ্রাবিড় প্রভাবে আর্য ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি রূপান্তরিত ও পুষ্ট হতে থাকে। আর্য দ্রাবিড়ে নতুন শক্তি গড়ে উঠে। কিন্তু বিষয়বুদ্ধি-নিপুণ দণ্ডশক্তি মায়াবাদকে আত্মস্বার্থ সিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বর্ণাশ্রম নিপীড়নের ঘূপকাষ্ঠরূপে দেখা দিল। সদুদ্দেশ্য নিয়ে যা প্রতিষ্ঠিত, অসদুদ্দেশ্য সিদ্ধির তাই বাহন হয়ে দাঁড়াল।
অত্যাচার, উৎপীড়ন যখন চরম আকার ধারণ করল, তখন ধীরে ধীরে সমাজমনে দেখা দিল অসন্তোষ। এই অসন্তোষই পুষ্ট হয়ে একসময় প্রবল বিদ্রোহ ও সর্বাত্মক বিপ্লবে পরিণত হল। এর সার্থকনাম নেতা হচ্ছেন বর্ধমান মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধ। এঁদের আগে তেইশজন তীর্থঙ্কর ও বহু বৌধিসত্ত্ব এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই মায়াবাদ এদেরও মূলধন। এই বিপ্লবের বন্যায় যুগসঞ্চিত কলুষ-জীর্ণ প্রাচীন যত সব-কিছুই ভেসে গেল–বেদ গেল, ব্রাহ্মণ গেল, দেবভাষাও মর্যাদাচ্যুত হল, বর্ণাশ্রম গেল। স্বর্গ-নরক-দেবতা কারুর অস্তিত্ব স্বীকৃতি পেল না। সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা, জীবে-দয়া, জাতিভেদের অসারতা প্রভৃতি প্রচারিত হল। সর্ব বন্ধনকে দলিত করে বিঘোষিত হল মনুষ্যত্বের জয়। আর্য-অনার্যের বিভেদ ঘুচে গেল। গণতন্ত্র হল না সত্য, কিন্তু গণমানস স্বীকৃতি পেল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম জনসাধারণের আচরণসাধ্য ছিল না, শাস্ত্রে ছিল না অধিকার, নিজের মনের কথা স্বমুখের বুলিতে দেবতার কাছে নিবেদন করবার উপায় ছিল না। পুরোহিতের মাধ্যমে দেবতার সঙ্গে যে কৃত্রিম সম্পর্ক ছিল, তাতে সংস্কারের দৃঢ় বন্ধন ছিল না। তাই বুদ্ধ ও মহাবীরের ডাকে বিপুল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল সহজেই।
ধর্মদর্শন হিসেবে মায়াবাদই ছিল বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের পুঁজি। মায়াবাদ যতই শ্রোত্ররসায়ন হোক না কেন, (একে অবসর সময়ে ভাবপ্রবণ দুর্বলচিত্তে প্রশ্রয় দিতে বেশ লাগে সত্য) কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। কারণ, জৈবসাধনা হচ্ছে ধন-জন-মানের সাধনা। এটা প্রাকৃতিক বা প্ৰাবৃত্তিক। সুতরাং প্রারম্ভিক উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনা যখন চলে গেল, তখন বোঝা গেল জৈবধর্মের প্রতিকূল এ বৈরাগ্যবাদ– এ জীবন-মুক্তির সাধনা প্রাত্যহিক জীবনে আচরণ-সাধ্য নয়। তাই বৌদ্ধ-জৈন ধর্মে বিকৃতি ও সমাজ-জীবনে বিকার অবশ্যম্ভাবীরূপে দেখা দিল। শঙ্কর প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এ বিকৃতি ও শৈথিল্যের সুযোগ গ্রহণ করলেন।