সৈয়দ আহমদ ও তীতুমীরের শাহাদতের পরেও চেষ্টা চলেছিল সংগ্রাম চালিয়ে যাবার। কিন্তু বৃটিশের ভয়ে বিত্তবানেরা ওহাবীদের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাদের বিরত হতে হল। কিন্তু ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন তারা ত্যাগ করে নি; ফলে অন্তত বাঙলা, বিহার ও সেকালীন উত্তর ভারতে শরীয়তী ইসলাম দৃঢ়মূল হল। এও একটা বড় লাভ। বাঙলা দেশে এ আন্দোলন বিশ শতকের প্রথম দুদশক পর্যন্ত বেশ প্রবলভাবেই চলেছিল, তার রেশ কোনো কোনো অঞ্চলে যেমন চাটগাঁয়ে ও উত্তরবঙ্গে এখনো বর্তমান। এ ক্ষেত্রে কেরামত আলী, হাজী শরীয়ৎ উল্লাহ, দুদুমিয়া, ইমামুদ্দিন, মুন্সী মেহেরুল্লাহ প্রমুখের কৃতিত্ব এবং আহলে হাদীস, শর্ষিনা ও ফুরফুরার প্রভাব স্মরণীয়।
বাঙলা দেশে যাকে ফকির বিদ্রোহ বলে, উত্তরবঙ্গে মজনু শাহর নেতৃত্বে সেই অবাধ লুটতরাজও বৃটিশ-বিরোধী মনোভাব প্রকাশের বা বৃটিশশাসন অস্বীকারের প্রচেষ্টামাত্র। এক শ্রেণীর আলেমের মতে বিজাতি ও বিদেশী রাজের শাসন অমান্য করা ও দেশের বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রাখা মোমেনের কর্তব্যেরই অঙ্গ। মজনু শাহ ও তাঁর অনুচরদের মনে এ শিক্ষাই ক্রিয়া করেছিল। তাই তাদের আচরণ ও কাজের পশ্চাতে এই আদর্শই সক্রিয় ছিল। ঢাকার সরফরাজ খান, বীরভূমের আসাদুজ্জামান খান, মুর্শিদাবাদের উজীর আলী প্রমুখের বিদ্রোহও মুসলমানের আযাদী-উদ্যমের সাক্ষ্য বহন করছে। আজিমুদ্দিনের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ও অর্থপূর্ণ ভূমিকাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। অতএব দেখা যাচ্ছে, নদীর পাড়ভাঙার মতই অতর্কিতে যখন আযাদী গেল, তখন মুসলিম মনে জাগল এক অসহ্য গ্লানিবোধ এবং তা-ই লাভ-ক্ষতির পরওয়াহীন বিক্ষোভে, বিরোধিতায় ও সংগ্রামে রূপ পেল।
এদিকে বাঙলাদেশে ইংরেজ সুকৌশলে সরকারি দপ্তর থেকে মুসলিম তাড়ন শুরু করে দিল। এতে শাসন পরিচালনে কোনো অসুবিধেও হল না তাদের। গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলিম নিয়োগ ছিল নিষিদ্ধ। পুরোনো আমলা অবসর নিলে তার পদে হিন্দুই নিযুক্ত হত। নতুন প্রভুর অযাচিত অনুগ্রহে আপুত হিন্দুসমাজ সোৎসাহে ইংরেজিও শিখতে লাগল। ফলে ১৮২০ খ্রীস্টাব্দের দিকে মুসলিম-শূন্য হল সরকারি দপ্তর। কাজেই ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে ইংরেজিকে দরবাবি-ভাষা রূপে চালু করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। মুসলিম কাযীর পদও বাতিল হল ১৮৩৮ খ্রীস্টাব্দে।
আমরা মুখে যাই বলি না কেন, আসলে লেখা-পড়ার মুখ্য উদ্দেশ্য চাকরি- এক কথায় লেখাপড়াও বৃত্তিমূলক। চাকরির আশা নেই দেখে অভিভাবকদের কাছে সন্তানদের লেখাপড়ার কোনো গুরুত্ব রইল না, এভাবে লক্ষ্যহীন-ভরসাহীন শিক্ষা চলতে পারে না।
তার উপর ১৮২৮ খ্রীস্টাব্দে জনহিতকর দাঁতব্য লাখেরাজ আয়েমা বাজেয়াপ্ত হওয়ায় মুসলমানের শিক্ষার পথও হয়ে গেল রুদ্ধ। এরূপে মুসলমানদের শেষ আশা এবং আশ্রয়ও নষ্ট হল। কাজেই ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দের দিকে অশিক্ষিত কুলি-কাঙালে পরিণত হল মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা। এভাবে যে দুর্ভাগ্যের দুর্দিন নেমে এল তা সুদীর্ঘ ষাট-সত্তর বছরকাল স্থায়ী হয়েছিল, তারপর ক্রমে ক্রমে সুদিনের সূর্যরশ্মি দেখা দিতে থাকে।
পলাশীর প্রান্তরে জয়লাভ করে ইংরেজরা দেশের ভাগ্যবিধাতা হল বটে, কিন্তু তারা এদেশ শাসন করবে কি শোষণ করবে, তা তখনই স্থির করতে পারে নি। মনস্থির করতে পুরো পঁচিশটি বছর লেগেছিল তাদের। অবশেষে সাব্যস্ত হল তারা শাসন ও শোষণ দু-ই সমানে চালিয়ে নেবে। এসবের চমকপ্রদ দলিল ও বিবরণ পাওয়া যাবে ডক্টর ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের Early Administrative System of East India Company নামক মূল্যবান গ্রন্থে। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেই শাসন-শোষণের সুবিধার জন্যে ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে সরকার যে নতুন ভূমিস্বত্ব ও রাজস্বব্যবস্থা চালু করে, তাতে কাঁচা মুদ্রার অভাবে অভিজাত মুসলমানেরাও জমিদাবি ক্রয় করে সম্পদশালী থাকতে পারল না।
১৮৫৭-৫৮ খ্রীস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবে ওহাবী আন্দোলনের মনোভাবও যে সহায়তা করেছিল, তা অবশ্যস্বীকার্য। সিপাহী বিপ্লবকালে স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজ-পক্ষে ছিলেন। এই দূরদর্শী মনীষীই প্রথম উপলব্ধি করলেন, হিন্দুরা যখন বৃটিশের সহযোগিতা করছে, তখন মুসলমানদের এই বৃটিশ-বিদ্বেষ, অসহযোগ ও সগ্রাম আত্মধ্বংসী বই কিছুই নয়। এই সর্বনাশ থেকে উদ্ধারের উপায়। হিসেবে বৃটিশ-প্রীতি ও সহযোগের মনোভাব সৃষ্টির জন্যে তিনি মুসলিম সমাজে প্রচারণা চালাতে লাগলেন। তাঁর মতবাদ মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজে অভিনন্দিত হল। তখন থেকেই মুসলমানেরা আচরণে বৃটিশ-বিদ্বেষ ত্যাগ করে এবং অভিমান ছেড়ে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু তখন কাঙাল মুঠে-মজুরের সমাজে ইংরেজি শেখার গুরুত্ব বুঝবার ও ব্যয়ভার বহন করবার মতো যোগ্যতা আর বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না, তাই অর্ধশতাব্দীকালের মধ্যেও বিশেষ কোনো ফল দেখা গেল না।
এ সময় থেকেই শিক্ষিত হিন্দুসমাজে স্বাজাত্য ও অধিকারবোধ জাগতে থাকে। ফলে বৃটিশ সরকার এখন থেকে মুসলমানের প্রতি প্রসন্ন ও হিন্দুর সম্পর্কে সতর্ক হতে থাকে।
আমরা মুসলিম মনের বিক্ষোভ, বৃটিশ-বিদ্বেষ ও ইংরেজি বর্জনকে মুসলমান-জাতির বোকামি বলব না; মর্যাদাবান মানুষের মতো তারা নির্ভীকচিত্তে ও সমুন্নত শিরেই দুর্ভাগ্যকে জয় করতে চেয়েছিল। বাইরের দাসত্ব তখনো তাদের মনের মহিমাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। কারণ আত্মসচেতন ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ মাত্রেরই কাছে জানের চেয়ে মান বড় এবং তার চাইতেও বড় স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা হারিয়ে যদি তারা লাভ-ক্ষতির বেনেসুলভ খতিয়ান তলিয়ে না দেখে, তবে তাদের ব্যবহারিক জীবনের লোকসান যত বেশিই হোক না কেন, অন্তৰ্জীবনের ঐশ্বর্যের প্রভাব আমাদের আনন্দিত করে। অবশ্য ক্ষতি যা হল, তা অপরিমেয় এবং এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ যুগেও আমাদের পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় লাগবে।