এ ছাড়া বিদ্যাপতি রচিত দানবাক্যাবলীর একটি প্রতিলিপি রয়েছে নেপাল রাজ গ্রন্থাগারে। ওটি নাকি বিদ্যাপতির স্বহস্তে সংশোধিত। নকলের তারিখও রয়েছে লং সং ৩৫১। এর সঙ্গে ১০৮০, ১১০৮, ১১১৯ ও ১১২৯ যোগ করলে যথাক্রমে ১৪৩১, ১৪৫৯, ১৪৭০ ও ১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ হয়। তবে ১৪৩১ খ্রীস্টাব্দ ধরাই সমীচীন।
১৩০৭ সালের সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ বিদ্যাপতির ভনিতাযুক্ত একটি অবহটঠপদ উদ্ধৃত করেছিলেন। পদটি নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিদ্যাপতি পদাবলীর বসুমতী সংস্করণে বিধৃত রয়েছে (পৃ. ২৩৬-৩৭ পদ সং ৯ ও পরিষৎ সং; পদ সং ৫৩১)। পদটির শুরু এভাবে :
অনল রন্ধ্রকর লকখন নরবই সক সমুদ্দকর অগিনি সসী
চৈতকারি ছঠি জেঠা মিলিও বার বেহপ এ জাউলসী।
দেবসিংহে জং পুহবী ছড়িঅ অদ্ধাসন সুররাএ সরূ
দুহু সুরতনি নীলে অবে শোয়উ তপন হীন জগতিমিরে ভরু।
শেষ—
আরন্তিয় অন্তেষ্টি মহামখ রাজসুয় অসমেধ যঁহা।
পণ্ডিতঘর আচার বখানিয় যাচক কা ঘর দান কঁহা।
বিদ্যাপতি কবিবর এহু গাবয় মানব মন আনন্দ ভয়ও
সিংহাসন শিবসিহ বইঠঠো উচ্ছব বৈরস বিসরি গয়েও।
এখানে প্রদত্ত সন (অনল-৩, রন্ধ্র-৯, কর-২) = ল সং ২৯৩ এবং শক (সমুদ্র– ৪, কর– ২, অগ্নি– ৩, শশী-১) = ১৩২৪ শক।
ল, সংবত থেকে ১৩৭৩, ১৪০১, ১৪১২ বা ১৪২২ খ্রীস্টাব্দ মেলে আর শকাব্দ থেকে পাই ১৪০১-০২ খ্রীস্টাব্দ। কাজেই ১৪০১-০২ খ্রীস্টাব্দই নির্দেশিত হয়েছে বলে মানতে হয়। কেউ কেউ শকাব্দের কর স্থলে পুর ধরে একে ১৩৪৩ শক বা ১৪১২ খ্রীস্টাব্দ পেতে চান। এই সন শিবসিংহের (কাব্য প্রকাশবিবেক সূত্রে সিংহাসন আরোহণ ১৪১০ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে রাজত্বকালে পড়ে। কিন্তু এ পদটি অনেকের মতেই জাল। কেননা প্রথমত দেবসিংহের মৃত্যুর আগেই পিতৃদ্রোহী শিবসিংহ পিতাকে তাড়িয়ে রাজ্য দখল করেন, এ সংবাদ আমরা মোল্লা তাকিয়ার বয়ায সূত্রে জানতে পাই। দ্বিতীয়ত, পুরুষ পরীক্ষা সূত্রে বোঝা যায়, এই গ্রন্থ রচনাকালে দেবসিংহ জীবিত ছিলেন, ভাতি যস্য জনকোরণজেতা দেবসিংহ গুণরাশি:। তৃতীয়ত নৈমিষারণ্যে আশ্রিত। দেবসিংহের আদেশেই যে বিদ্যাপতি ভূপরিক্রমা রচনা করেছিলেন, তা ভূপরিক্রমা থেকেই জানা যাচ্ছে। অতএব শিবসিংহের রাজত্বকালে দেবসিংহ মৃত নয়, নির্বাসিত অথবা পলাতক ছিলেন।
কেউ কেউ কীর্তিলতার দুটো শ্লোকের তাৎপর্য অনুসরণে বিদ্যাপতির জন্ম সন ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ নিরূপণে প্রয়াসী। শ্লোক দুটো এরূপ :
১, বালচন্দ্র বিজ্জাবই ভাসা
দুহু নহি লগগেই দুজ্জন হাসা।
ও পরমেসর হরশির সোহই
ঈ নিশ্চই নাঅর-মন মোহই।
বালচন্দ্র ও বিদ্যাপতির ভাষা–এ দুইয়ের কোনোটিতেই দুর্জনের উপহাস লাগিবে না। যেহেতু চন্দ্র পরমেশ্বর মহাদেবের মস্তকে লাগিয়া থাকে, আর বিদ্যাপতির ভাষা নাগর জনের মনোমমাহন করে। [ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
২ মাধুর্য প্রসবস্থলী গুরু যশো শিক্ষাসখী।
যাবদ্বিশ্বমিদঞ্চ খেলনকবের্বিদ্যাপতের্ভারতী।
মাধুর্যের প্রসব স্থলী স্বরূপ যশোবিস্তারের শিক্ষাসখী সদৃশ খেলন কবি বিদ্যাপতির কবিতা সমস্ত বিশ্বে ব্যাপ্ত হইতে থাকুক। [ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
প্রথমটাতে বালচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাপতির ভাষা তুলিত হয়েছে। বিদ্বানরা মনে করেছেন, বিদ্যাপতি তখনো তরুণ। আর দ্বিতীয় শ্লোকে খেলনা কবি অর্থে (খেলুড়ে-বাল্যক্রীড়ার বয়স অতিক্রান্ত হয়নি যার) বালক কিংবা কিশোর কবি নির্দেশ করা হয়েছে বলেই তাদের ধারণা। কীর্তিলতা ১৪০১-০৪ সনের মধ্যে রচিত। কাজেই এঁদের মতে এটি কৃবির বিশ-বাইশ বছর। বয়সের রচনা। এজন্যে তাঁরা কবির জন্ম সন ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ বলে অনুমান করেন।
আগে কয়েকটি গীত রচনা করলেও পূর্ণাঙ্গ কাব্য হিসেবে কীর্তিলতাই বিদ্যাপতির প্রথম কৃতি। এজন্যেই কবি এই নব প্রয়াসকে নবচন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন : নবচন্দ্র যেমন নতুন ও ক্ষীণকায় বলে নিন্দনীয় নয়, তেমনি নতুন কবির প্রথম কাব্য বলে কীর্তিলতাও অবহেলার বস্তু নয়। এমনি তাৎপর্যেও উক্ত শ্লোকটি গ্রহণ করা সম্ভব।
সম্প্রতি খেলনকবের্বিদ্যাপিতর্ভারতী পাঠ কেউ কেউ অশুদ্ধ ও অর্থহীন বলে মনে করেন। তাঁদের মতে শুদ্ধ পাঠ হবে খেলতু কবের্বিদ্যাপতের্ভারতী। অতএব যা ছিল বিনয়বচন, তা গর্বিত আহবানে হল পরিণত। কাজেই উক্ত দুই শ্লোক অপরিণত অল্প বয়সের সাক্ষ্য নয়। বিশেষ করে বিদ্যাপতির পদে রাজা ভোগীশ্বরের উল্লেখ রয়েছে। জীবিত রাজা ভোগীশ্বরের প্রশস্তিই গেয়েছেন কবি তাঁর ভণিতায়। ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের আগে ভোগীশ্বরের মৃত্যু হয়। কাজেই এ সময়ে বিদ্যাপতির বয়স ১৫-২০ না হলে পাঠযোগ্য পদ রচনা সম্ভব না।
বিশ্ব-সমস্যা
উই, পিঁপড়ে, মৌমাছি, ভিমরুল প্রভৃতিও সমাজবদ্ধ জীব। কর্মে ও জীবিকায় এদেরও রয়েছে যৌথ জীবন। জলে-ডাঙায় এমনি আরো অনেক প্রাণী রয়েছে যারা সামাজিক ও যৌথ জীবনযাপন করে। এগুলো প্রাকৃত প্রাণী–স্বভাব বা সহজাত বৃত্তি-প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত। এদের জীবনে রীতি-নীতি কিংবা পদ্ধতির পরিবর্তন নেই– ডারুইনকে মেনেও বলা চলে কয়েক হাজার বছরের মধ্যে অন্তত দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি।
কিন্তু মানুষের জীবনেতিহাস অন্যরূপ। তার দৈহিক গঠন ও মানস সম্পদ তাকে প্রেরণা দিয়েছে প্রকৃতির আনুগত্য অস্বীকার করতে ও প্রকৃতির উপর স্বাধিকার বিস্তার করতে। তাই মানুষের প্রয়াস কৃত্রিম জীবন রচনার সাধনায় নিযুক্ত। প্রকৃতিকে জয় করার, প্রাকৃত সম্পদের উপযোগ সৃষ্টি করার সংগ্রামই মানুষের জীবন প্রচেষ্টার ইতিহাস। কাজেই মানুষের ইতিহাস–ক্রম পরিবর্তন, ক্রম আত্মবিস্তার ও ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার ইতিকথা। অতএব মানুষের জীবনযাত্রায় ও চিন্তায় চিরস্থায়ী কিছু অসম্ভব, অনভিপ্রেত, এমনকি দুর্লক্ষণ। মানুষের এই অগ্রগতির আঞ্চলিক ও গোত্রীয় ধারায় দৈশিক-কালিক প্রতিবেশের প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র প্রভৃতি যৌথ জীবনে আবশ্যক রীতি-নীতি-পদ্ধতি কিংবা আইন ও আদর্শ। পুরোনো যখন উপযোগ হারিয়েছে, জীর্ণপত্রের মতোই তা হয়েছে জীবন ধারণের পক্ষে অকেজো। তখন প্রয়োজনবুদ্ধি আবার সৃষ্টি করেছে নতুনতর রীতি-নীতি ও আদর্শ। এমনি করে লোকপ্রবাহ এগিয়ে এসেছে আজকের দিনে। এ তত্ত্ব বোঝে না কিংবা বুঝতে চায় না বলেই পাঁচ-সাত হাজার বছর আগের জীবন-চেতনা ও জীবন-রীতি যেমন সুলভ, আবার এই তত্ত্ব-সচেতন বলেই আজকের দিনে গ্রহলোক জয়কামী মানুষও দুর্লভ নয়। তাই মানুষের ইতিহাস পুরোনো চেতনা আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ইতিবৃত্তেরই নামান্তর। যেখানে পুরোনো চেতনা প্রবল, সেখানে অগ্রগতি ব্যাহত; যেখানে নতুন চিন্তা তীব্র ও আগ্রহ অমোঘ, সেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অতিক্রম করেই এগিয়েছে মানুষ। ঋতুবদল যেমন কালের পরিচায়ক ও পরিমাপক, তেমনি পাথেয় পরিবর্তনও চলমানতার লক্ষণ। শীত-বৃষ্টি রৌদ্রে যেমন পরিচ্ছদ ও আশ্রয় অভিন্ন নয়, তেমনি দেশ-কালভিত্তিক জীবনে দেশান্তর ও কালান্তর নতুন প্রয়োজন বোধের জন্ম দেয়। এ প্রয়োজনে সাড়া না দিলে জীবনে নেমে আসে বদ্ধতার বিকৃতি, অচলতার গ্লানি। প্রয়োজন-চেতনার অভাব কিংবা প্রয়োজন-অস্বীকৃতি জীবনের গতিশীলতা অস্বীকারের অপর নাম। মানুষের জীবন যে স্বরচিত এবং মানুষকে যে স্বশিক্ষিত হতেই হবে– এ বোধের অভাবেই অধিকাংশ মানুষ অচলতায় স্বস্তি খোঁজে–চিরন্তনতায় চায় আশ্বস্ত হতে। কিন্তু মানুষ যে সচল প্রাণী–জড়তা যে তার ধর্ম নয়–চলমানতাতেই যে তার জীবন-সত্য নিহিত, তা সে বুঝতে না চাইলেও প্রকৃতি আঘাত হেনে তাকে জানিয়ে দেয়। প্রকৃতির আঘাত আসে দুর্ভিক্ষ, মড়ক, দারিদ্র্য, অসততা, পীড়ন ও অপ্রেমরূপে। তখনই দেখা দেয় দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিদ্রোহ, পীড়ন, বিপ্লব ও সগ্রাম–আনে নতুন মতবাদ, নীতিবোধ, আদর্শ কিংবা ধৰ্মৰ্মত। এ জন্যেই যে স্থানিক প্রয়োজনে জরথুস্ত্রর কিংবা হযরত মুসা-ঈসা-বুদ্ধ-বর্ধমানের ধর্মমতের উদ্ভব, ও পরিবর্তিত পরিবেশে সে-প্রয়োজনের অবসানে স্বস্থানেই সেসব ধর্মমত হয়েছে বিলুপ্ত। আবার সে-সব ধর্ম দেশান্তরে গৃহীত হয়েছে বটে কিন্তু নতুন শক্তি হিসেবে সমাজে কিংবা মনে স্বদেশের মতো বিপ্লব ঘটায় নি। হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি সবাই পুরোনো-দ্রোহী ও নতুনের প্রতিষ্ঠাতা।