১. নাসিরুদ্দীন নসরত শাহ (তুঘলক)
কবি শেখর ভণ অপরূপ রূপ দেখি
রাত্র নসরদ সাহ ভজলি কমল মুখি। (গুপ্ত ৩৪৯, মিত্র-মজুমদার ৯৩২)
অথবা
বিদ্যাপতি ভানি অশেষ অনুমানি।
সুলতান শাহ নাসির মধুপ ভুলে কমলবাণী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুথি সং ২৩৫৩)
২. নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ (গৌড়)
নাসির শাহ ভাণে
মুঝে হানল ময়ন বাণে
চিরঞ্জীব রহু পঞ্চ গৌড়েশ্বর
কবি বিদ্যাপতির ভাণে। (গুপ্ত : ৪৪, মিত্র-মজুমদার ৯৩১)
পাঠান্তর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুথি সং ২৬৪৮
সাহা হুসেন ভাণে
জাকে হানল মদন বাণে
চিরঞ্জীব রহু পঞ্চ গৌড়েশ্বর
কবি বিদ্যাপতি ভাণে।
৩. গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (গৌড়)
বিদ্যাপতি কবি ভাণ
মহলম যুগপতি চিরেজীব জীবথু
গ্যাসদেব সুরতান। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ৭৪, পদ সং ২৯)
৪. হুসেন শাহ শর্কী বা দ্বারবঙ্গের মখদুম শাহ সুলতান হোসেন:
ভণই বিদ্যাপতি নব কবিশেখর
পৃথিবী পুহবী] দোহর কঁহা
সাহ হুসেন ভৃঙ্গসম নাগর
মালতী সেনিক জহা। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ১৩১, পদ নং ১৫১)
৫. মালিক বাহারুদ্দীন :
বিদ্যাপতি কবি রভবে গাব
মালিক বহারদিন বুবই ভাব। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ১২০, পদ সং ১১০)
৬. আলম শাহ:
দশ অবধান ভন পুরুষ প্রেম গুনি
প্রথম সমাগম ভেলা।
আলম শাহ পহু ভাবিনি ভজি রহু।
কমলিনি ভমর ভুললা।
(রাগতরঙ্গিণী, পৃ. ৮৬, গুপ্ত সাহিত্য পরিষদ, সং পদ সং ৬, পৃ. ৫২৯, মিত্র মজুমদার ভূমিকা পৃ.)
অবশ্য উক্ত সুলতানগণকে গৌড়ের আলাউদ্দীন হোসেন শাহ আর তাঁর পুত্র নুসরতশাহ ও গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহ বলে অনুমান করে এগুলোকে সহজেই শ্রীখণ্ডবাসী বাঙালি কবি বিদ্যাপতির (কবিশেখর, কবিরঞ্জন) পদ বলেও প্রমাণ করা যায়, এবং অনেকেই তা করেছেন। কিন্তু তা করবার প্রয়োজন নাই। কেননা, এগুলোকে মৈলিথিল কবির রচনা বলে গ্রহণ করতে বাধা দেখিনে।
আমাদের ধারণায় বিদ্যাপতি, ১৩৬০-৬৫ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এং ১৪৫৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে পরলোক গমন করেন। আমরা এ-ও বিশ্বাস করি যে মৈথিল কবি বিদ্যাপতি অভিনব জয়দেব, নব কবিশেখর (কবিশেখর), কবিরঞ্জন, কবিকণ্ঠহার, পণ্ডিত ঠকুর, সদুপাধ্যায়, রাজপণ্ডিত প্রভৃতি উপাধি ছিল।
আর আমাদের ধারণায় বিদ্যাপতি শৈবই ছিলেন। আমাদের বৈষ্ণব বিদ্বানেরাই বিশেষ করে একে বৈষ্ণব বলে ভাবতে চান। তার কারণও রয়েছে।
চৈতন্যদেব স্বয়ং বিদ্যাপতির পদ আস্বাদন করতেন, সেই থেকে বিদ্যাপতি হয়েছেন মহাজন গোস্বামী। পাঁচশ বছর পরে আজ যদি বিদ্যপতি শৈব ছিলেন বলে কেউ দাবী করেন, তাহলে বৈষ্ণবের ভক্তি-বিশ্বাসের ভিতেই যেন ফাটল ধরে পায়ের নিচে চোরাবালি যেন সরে যায়! কেননা সাধন-ভজনের পবিত্র বাহন আকস্মিকভাবে যেন আদিরসের পঙ্কমণ্ডিত হয়ে উঠে। তাই বিদ্যাপতিকে বৈষ্ণব রাখতেই হয়, অথচ বিদ্যাপতি ছিলেন রাজপণ্ডিত ও স্মার্ত। সমাজকে স্মৃতির শাসনে রাখা তাঁর পবিত্র দায়িত্ব বলেই তিনি জানতেন। তাই কীর্তিলতা, কীর্তিপতাকা, পুরুষ পরীক্ষা ও গোরক্ষবিজয় নাটক ছাড়া তাঁর সব রচনাই স্মৃতিগ্রন্থ। আর রাধাকৃষ্ণ পদ তাঁর মানবিক প্রণয় সঙ্গীত। তার প্রমাণ তাঁর বিবিধ বিষয়ক গান ও আদিরসাত্মক পদ। যেমন :
অপনা মন্দির বৈসলি অছলহু
ঘর নহি দোসর কেবা
তহিখনে পহিয়া পাহুন আয়ল
বরিষয় লাগল দেবা।
কে জান কি বোলতি পিসুন পরৌসিনী
বচনক ভেল অবকাশে।
ঘর অন্ধার নিরন্তর ধারা।
দিবসহি রজনী ভাণে
কোনক কহব হমে কে পতিয়ায়ত
জগত বিদিত পচবাণে।
[নিগেন্দ্র গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ২৩৮, পদ সং ১৫]
অথবা—
বালম নিঠুর বয়স পরবাস
চেতন পড়োসিয়া নাহি মোর পাশ।
ননদী বালক বোলউ ন বুঝ।
পহিলহি সঁঝ শাও নহি সুঝ।
হসে ভরে যৌবতী রজনী অন্ধার
স্বপেনেহুঁ নহি পুর ভম কোটবার। ইত্যাদি
(গুপ্ত পৃ. ২৩৯-৪০ পদ সং ২১)
এসব পদও বৈষ্ণবপদের মতোই। কেবল রাধা-কৃষ্ণের নাম নেই। তাছাড়া বিদ্যাপতির হরগৌরী বিষয়ক পদ, প্রহেলিকা পদ, গঙ্গা ও রাম-সীতা বিষয়ক পদ আর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদে পার্থক্য দুর্লক্ষ্য। রসিক কবি সব দেবতাকে সমভাবেই ভক্তি করেন, বিদ্রূপও করেন অকাতরে। কাজেই পদাবলীতে বিদ্যাপতির ধর্মীয় আবেগ নয়–রসবোধই অভিব্যক্তি পেয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। অতএব রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ তাঁর বৈষ্ণব মতের পরিচায়ক নয়। প্রেম-সঙ্গীতের জন্যে বিষয় হিসেবে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলাই আর্কষণীয় বলে কবি রাধাকৃষ্ণলীলার পদই অধিক রচনা করেছেন। কবি, রসিক, পণ্ডিত ও ভাষার যাদুকর বিদ্যাপতি সংস্কৃত, অবহট্ট ও মৈথিল বুলিতে তাঁর জ্ঞান, চিন্তা, রসবোধ ও কাব্যকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন অবলীলায়।
.
পরিশিষ্ট
শতেক বছর ধরে বিদ্যাপতি সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছে বাঙলা ও বিহারে। কিন্তু করদ রাজ্য মিথিলার রাজবংশের রাজপঞ্জী, কুলপঞ্জী, লোকশ্রুতি নির্ভর আলোচনা কোনো স্থির সিদ্ধান্তের পথে এগিয়ে দেয়নি। লক্ষ্মণ সংবতের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারই এজন্যে অনেকটা দায়ী। এজন্যে বিদ্যাপতির জীবকাল সম্বন্ধে নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আজো সম্ভব হয়নি। বিদ্বানেরা আজ অবধি যে-সব মত চালু করেছেন, সেগুলো এখানে উদ্ধৃত হচ্ছে। তার আগে বিদ্যাপতি ও তাঁর রচনা সম্বন্ধে যারা আলোচনা করেছেন কিংবা তার পদাবলী সংকলন করেছেন অথবা তাঁর রচিত গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন, তাঁদের নাম উল্লেখ করছি।