ঐনবার বংশের কামেশ্বর-পুত্র রাজা ভোগীশ্বরই বিদ্যাপতির রচনায় প্রথমোল্লিখিত ব্যক্তি। ভোগীশ্বর দিল্লীর তুঘলক সুলতান ফিরোজ শাহর (১৩৫১-৮৮) সমসাময়িক ও প্রিয় বন্ধু ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন বিদ্যাপতি :
ভোগী সরাঅ বর ভোগ পুরন্দর। …
পিঅ সখা ভণি পিঅরোজ সাহ সুরতান-সমানল।
এই ভোগীশ্বরের রাজত্বকালেই যে বিদ্যাপতি গান রচনা শুরু করেন, তার প্রমাণ–এর পূর্বেকার মিথিলার কোনো রাজা বা রাজপুরুষের নাম মেলে না বিদ্যাপতির পদে। ভোগীশ্বরের পত্নীর নাম ছিল পদ্মাদেবী। বিদ্যাপতি বলেন: বিদ্যাপতি কবি গাবিআরে
তোকে অছ গুণক নিধান
রাউ ভোগিসর গুণ নাগরা রে
পদমা দেবী রমাণ।
ভোগীশ্বরের পুত্র গণেশ্বরের সঙ্গে ২৫২ লক্ষণ সংবতে আরসালান (আসলান) নামের এক রাজ্যলোভী তুর্কীর যুদ্ধ হয়, এই যুদ্ধে আরসালান পরাজিত হয়। কিন্তু পরে একসময় উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এবং সে-সুযোগে আরসালান গণেশ্বরকে হত্যা করে মিথিলার শাসক হয়। কীর্তিলতা সূত্রেই আমরা এ সত্য জানতে পাই :
লখখন সেন নরেশ লিহিঅ জবে পখখ পঞ্চদ্বে
তনুহমাসহি পঢ়ম পখখ পঞ্চমী কহি অজে।
রজ্জলুব্ধ আসলান বুদ্ধি বিক্কম বলে হারল।
পাস বইসি বিসবাসি রাএ গএনেসর মারল।
এর থেকে আমরা দুটো বিষয়ে ইঙ্গিত পাই, ক. ২৫২ সংবতের তথা ১৩৮১ (২৫২– ১১২৯) খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই ভোগীশ্বরের মৃত্যু হয় আর ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের পরে কোনো সময়ে গণেশ্বর আরসালানের হাতে প্রাণ হারান। এবং খ. ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই গান লেখার মতো বয়স হয়েছিল বিদ্যাপতির। অতএব বিদ্যাপতির জন্ম হয় ১৩৬০-৬৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে।
কীর্তিলতা থেকেই জানা যায়, গণেশ-পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ জৌনপুরের রাজা ইব্রাহিম শাহ শর্কীর (১৪০১-৪০ খ্রীস্টাব্দে) আশ্রয় ও সহায়তা পেয়েছিলেন। অতএব অন্তত ১৪০১ খ্রস্টাব্দ অবধি মিথিলা আরসালানের অধিকারে ছিল।
ইব্রাহিম শর্কী গণেশ-পুত্র কীর্তিসিংহকে মিথিলার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। কীর্তিসিংহের আগ্রহে তার বীরত্ব-কথা বর্ণিত বলেই গ্রন্থের নাম কীর্তিলতা। কীর্তিসিংহের পরে মিথিলার রাজা হন কামেশ্বরের অপর পুত্র ভবসিংহ। তার পরে রাজত্ব করেন তাঁর পুত্র দেবসিংহ। পিতৃদ্রোহী শিবসিংহ পিতা দেবসিংহকে তাড়িয়ে নিজেই রাজা হলেন। শিবসিংহের পিতা দেবসিংহ আবার সিংহাসন পেয়েছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অপর পুত্র পদ্মসিংহ রাজা হন। অবশ্য এঁদের কেউ বেশিদিন রাজত্ব করেননি। তবে শিবসিংহ প্রতাপশালী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে গৌড়ের রাজা গণেশের মিত্রতা ছিল এবং তিনি সম্ভবত মিথিলাকে জৌনপুরের প্রভাবমুক্ত করেন। শিবসিংহের আমলেই বিদ্যাপতি তার অধিকাংশ পদ এবং গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কাজেই শিবসিংহ ও বিদ্যাপতির যশ ও খ্যাতি পারস্পরিক প্রীতি ও গুণগ্রাহিতার ফল। গণেশের বিরুদ্ধে ইব্রাহিম শর্কীর গৌড় অভিযানকালে (১৪১৫ খ্রীস্টাব্দে) শিবসিংহ ইব্রাহিম শর্কীর হাতে নিহত অথবা বন্দী হন। এবং শর্কী দেবসিংহকে আবার রাজা করেন। কাজেই ১৪১৫ খ্রীস্টাব্দে শিবসিংহের রাজস্ব শেষ হয়। শ্রীধরের কাব্য প্রকাশ গ্রন্থের পুষ্পিকা সূত্রে বলা যায় (২৯১ ল. সং + ১১১৯) শিবসিংহ ১৪১০ সনের দিকে পিতৃসিংহাসন দখল করেছিলেন। দেবসিংহের পরে তাঁর অপর পুত্র পদ্মসিংহ রাজা হন। পদ্মসিংহের পরে হয়তো দেবসিংহের ভাই ত্ৰিপুর সিংহের (নৃপনারায়ণ) পুত্র অর্জুন ও অমর সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। এই সুযোগে নেপালের সপ্তরী জনপদের পুরাদিত্য অর্জুন ও অমরকে পরাজিত ও হত্যা করে দ্রোণবারে স্বাধীন রাজা হন। তাঁর সভাতেই বিদ্যাপতি এই বিপর্যয়ের সময় আশ্রয় পান। হয়তো শিবসিংহের পরিবারও রাজবনৌলি গ্রামে বিদ্যাপতির তত্ত্বাবধানে ছিলেন। পদ্মসিংহের পর দেবসিংহের ভাই হর বা হরিসিংহের পুত্র নরসিংহ বা নৃসিংহ রাজত্ব পেয়েছিলেন। এই নৃসিংহ বা নরসিংহের একটি শিলালিপি মিলেছে মাধিপুরা মহকুমার কানাদাহা গাঁয়ে। এতে শক শাশ্ব মদন: তথা ১৩৭৫ শক বা ১৪৫৩-৫৪ খ্রীস্টাব্দ পাওয়া যায়। অতএব নরসিংহ অন্তত ১৪৫৩-৫৪ খ্রীস্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন। নরসিংহের আদেশে বিদ্যাপতি বিভাগসার, তাঁর স্ত্রী ধীরমতির আগ্রহে দানবাক্যাবলী, পুত্র ভৈরব সিংহের আজ্ঞায় দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী রচনা করেন। দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণীতে কবি নরসিংহ ও তাঁর পুত্র ধীর সিংহকে রাজা বলে বর্ণনা করেছেন। অতএব পিতার জীবিত কালেই পুত্র রাজা বা যুবরাজ হয়েছিলেন। নরসিংহেরই বিরুদ ছিল দর্পনারায়ণ। এই দর্পনারায়ণের আদেশেই কবি ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণী রচনা করেন। শিবসিংহের দুই জ্ঞাতি ভাতার নাম ছিল রাঘবসিংহ ও রুদ্ৰসিংহ এবং ধীরসিংহের পুত্র ও পৌত্রেরও যথাক্রমে এ দুটো নাম ছিল। বিদ্যাপতির তিনটে পদে রাঘব সিংহের ও দুটো পদে রুদ্র সিংহের নাম আছে। ধীর সিংহের সময়েই তাঁর পুত্র-পৌত্রকে পাওয়া যায়, কাজেই রাঘব ও রুদ্র শিবসিংহের জ্ঞাতিভ্রাতা না হয়ে যদি ধীরসিংহের পুত্র এবং পৌত্রও হয়, তাতে বিদ্যাপতির জীবৎকালের পরিসরে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। অতএব, বিদ্যাপতি আনুমানিক ১৪৫৫ খ্রীস্টাব্দ অবধি গ্রন্থ ও পদ রচনা করেছেন। আমরা উপরে যা আলোচনা করেছি, ছকে তা এরূপ দাঁড়ায়।