খ. ফলে, তেরো-চৌদ্দ শতক অবধি বাঙলা ভাষা উচ্চবিত্তের লোকের সাহিত্য রচনার যোগ্য হয়ে উঠেনি। এ সময় প্রাকৃতজনের মুখে মুখে গান, গাথা ও ছড়া-পঁচালীই চলত।৭
গ. সংস্কৃতের কোনো ভাষাতেই রস-সাহিত্য চৌদ্দ শতকের পূর্বে রচিত হয়নি। ভাষাকে লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহন রূপেই প্রাকৃতজনেরা গ্রহণ করে। সাহিত্যের ভাষা। তখনো সংস্কৃত প্রাকৃত বা শৌরসনী অবহট্টই ছিল। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র ভাষায় রচন, পঠন ও শ্রবণ নিষিদ্ধ ছিল। সংস্কৃতের মাধ্যমে বৌদ্ধ শাস্ত্রেরও চর্চা প্রথায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর অপরিণত বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির কল্পনা ও সম্ভাব্যতা কোনো উচ্চশিক্ষিত লোকের মনে জাগে নি। পাল ও সেন আমলে সংস্কৃত চর্চা হয়েছে এবং মুসলমান বিজয়ের পর প্রাকৃতজনেরা প্রশ্রয় পেয়ে বাঙলা রচনা করেছে মুখে মুখে। তাই লিখিত সাহিত্য অনেককাল গড়ে উঠেনি। কিন্তু এতে ভাষা বিকশিত হয়েছে; তার প্রমাণ মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে (তথা শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে)। এ গ্রন্থেই দেখা যায়, ইতিমধ্যে এক ডজন ফারসি-তুর্কী শব্দ বাঙলা সাহিত্যের ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে।
ঘ, তেরো-চৌদ্দ শতকে সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র ছিল হিন্দু শাসিত মিথিলায়। তাই এ সময় বাঙলা দেশে সংস্কৃতচর্চা বিশেষ হয়নি, কেবল কিছু কিছু শাস্ত্রগ্রন্থের অনুশীলন হয়েছিল। মিথিলার পণ্ডিত চক্ৰায়ুধের মৃত্যুর পর নবদ্বীপ সংস্কৃতচর্চার তথা শাস্ত্রচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠে।
ঙ. তর্কের খাতিরে যদি স্বীকারও করা যায় যে আলোচ্য যুগে বাঙলায় কিছু কিছু পুথিপত্র রচিত হয়েছিল, তা হলেও জনপ্রিয়তার অভাবে, ভাষার বিবর্তনে এবং অনুলিপি করণের গরজ ও আগ্রহের অভাবে তা নষ্ট হয়েছে। যত্ন করে রক্ষা না করলে অপ্রিয় বা বাজে ছাপা বইও লোপ পায়। আগুন পানি-উই-কীট তো রয়েইছে। কিন্তু এ যুগে যে ভাষায় কিছু লিখবার রীতি ছিল না, তার বড় প্রমাণ পনেরো শতকের শেষাবধি নানা মঙ্গল গীতি, রামায়ণ গান, ভারত পাচালী এবং বিশ শতকেও পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়নামতী গানের লিখিতরূপ পাওয়া যায়নি। অথচ এগুলো সুপ্রাচীন।
চ. আবার লিখিত হলেও কালে লুপ্ত হওয়ার বড় প্রমাণ চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ, (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন), শেখ শুভোদয়া প্রভৃতির একাধিক পাণ্ডুলিপির অভাব।
ছ. চর্যাগীতি রচনার শেষ সীমা যদি বারো শতক হয়, তা হলে তেরো-চৌদ্দ শতক বাঙলা ভাষার গঠন যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। কাজেই এ সময়কার কোনো লিখিত রচনা না-থাকারই কথা। চর্যাগীতি ছাড়াও বারো শতকের বাঙলা-ঘেঁষা রচনার নমুনা মেলে শেখ শুভোদয়ার আর্যায় ও প্রাকৃত পৈঙ্গলের কোনো কোনো পদে। বাঙলা তখন সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, লক্ষ্মণ সেনের সভায় আমরা বাঙলা-কবিও দেখতে পেতাম এবং পূর্ববঙ্গ ও রাঢ়ের মতো হিন্দুশাসিত অঞ্চলে তেরো শতকে লিখিত বাঙলা রচনার নিদর্শন পাওয়া যেত।
জ. দেশজ মুসলমানের ভাষা চিরকালই বাঙলা। বাঙলায় লেখ্য রচনার রেওয়াজ থাকলে তুর্কী-বিজয়ের পূর্বের বা পরের মুসলমানের রচনা নষ্ট হবার কারণ ছিল না এবং মুসলিম বিজয়ে তাদের রচনার ধারাবাহিকতা ছিন্ন হওয়ার কারণ ঘটেনি। কেবল তাই নয়, বাঙলা লেখ্য ভাষা হলে গৌড়-সুলতানের দরবারে রাজ্যশাসনের প্রয়োজনে গোড়া থেকেই অন্তত বাঙলা ফরমান লিখিয়ে মুসলমান পাওয়া যেত। হিন্দুরা যে অশ্রদ্ধাবশত বাঙলায় কখনো সাহিত্য সৃষ্টি করতে চায়নি, লৌকিক দেবতার পূজাপ্রচার প্রয়াসীই ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে আঠারো শতক অবধি লিখিত হিন্দুর রচনায়।
পরাধীনতার গ্লানি হিন্দু-মনে অবশ্যই ছিল। তেমন অবস্থায়ও যে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হতে পারে তার সাক্ষ্য রয়েছে উনিশ-বিশ শতকের বাঙলা সাহিত্যে। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যে চারশ বছরেও আশানুরূপ উন্নতি ও বিকাশ হয়নি বাঙলা দরবারী কিংবা জাতীয় ভাষার মর্যাদা পায়নি বলেই।
অতএব, আমাদের অনুমান এই যে বাঙলা বারো, তেরো ও চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ অবধি লেখ্যভাষার স্তরে উন্নীত হয়নি। এটি হচ্ছে বাঙলার প্রাপ্তির কাল ও মৌখিক রচনার যুগ।
বিদ্যাপতির কাল নিরূপণ
বিদ্যাপতির আবির্ভাব কাল তথা জীবকাল নিঃসংশয়ে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি আজো। মুখ্যত লক্ষণ সংবই এরজন্যে দায়ী। মিথিলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই সংবৎ গণনার চারটি ভিন্ন রীতি ছিল ষোলো সতেরো শতক অবধি। মোটামুটিভাবে কোনোটির সঙ্গে ১০৮০, কোনোটির সঙ্গে ১১০৮, কোনোটির সঙ্গে ১১১৯-২০ এবং কোনোটির সঙ্গে ১১২৯ বছর যোগ করলে খ্রীস্টাব্দ মেলে।
আমরা বিদ্যাপতি-রচিত গ্রন্থে ও পদাবলীতে মিথিলার ও প্রতিবেশী রাজ্যের রাজপুরুষ, রানী ও রাজাদের নাম পাই। ভোগীশ্বর, গণেশ্বর, কীর্তিসিংহ, বীরসিংহ, ভবসিংহ, দেবসিংহ, হরসিংহ, শিবসিংহ, পদ্মসিংহ, নরসিংহ, রাঘবসিংহ, ভূপতি সিংহ, রাজবল্লভ, রুদ্র সিংহ, ধীরসিংহ, মিথিলারাজ ভোগীশ্বর-পত্নী পদ্মাদেবী, দেবসিংহ-পত্নী হাসিনী দেবী, শিবসিংহ-পত্নী লক্ষ্মীদেবী, পদ্মসিংহ-পত্নী বিশ্বাসদেবী, নারায়ণ-পত্নী মেনকা দেবী, রেণুকা দেবী, রাজা অর্জুন, চন্দ্ৰসিংহ, রূপিণী দেবী, ভূপতিনাথ, কংসনারায়ণ ও তৎপত্নী সুরমা দেবী, রাঘব সিংহ-পত্নী স্বর্ণমতী দেবী, পুরাদিত্য লক্ষ্মীনারায়ণ-পত্নী চন্দল দেবী প্রভৃতি এবং আরসালান, মালিক বাহারুদ্দিন, গিয়াসুদ্দিন, আলম শাহ, নসরত শাহ, ইব্রাহিম শাহ, হোসেন শাহ, ফিরোজ শাহ প্রভৃতি প্রতিবেশী রাজ্যের সুলতান ও রাজপুরুষদের নাম রয়েছে কবির গ্রন্থে ও পদাবলীতে।