ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন না হলে আগের যুগে কোনো বুলিই লেখ্য সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হত না। আদিযুগে সংস্কৃতই ছিল পাক-ভারতের ধর্মের, শিক্ষার, দরবারের, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও বিভিন্ন অঞ্চলের লোকের ভাব-বিনিময়ের বাহন। তাই কোনো আর্য ভারতিক আঞ্চলিক বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা কিংবা শালীন সাহিত্যের বাহন হবার সুযোগ পায়নি। বৌদ্ধ ও জৈন মত প্রচারের বাহনরূপেই প্রথম দুটো বুলি–পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যিক ভাষার স্তরে উন্নীত হয়। তারপর অনেক কাল রাষ্ট্র শাসনের কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগেনি বলে পরে কোনো বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি। পরে সাহিত্যের প্রয়োজনে নাটকে শৌরসেনী, মারাঠি ও মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতে থাকে। আরো পরে রাজপুত রাজাদের প্রতিপোষকতায় শৌরসেনী অপভ্রষ্ট বা অবহট্ট সাহিত্যের ভাষার রূপ পায়।
এরপরে মুসলমান আমলে ফারসি হল দরকারী ভাষা। মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এদেশী জনজীবনে যে ভাববিপ্লব এল, বিশেষ করে তারই ফলে আধুনিক পাক-ভারতিক আর্য ভাষাগুলোর দ্রুত সাহিত্যিক বিকাশ সম্ভব হল। এক্ষেত্রে ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই সব কয়টি আঞ্চলিক বুলি লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এ ব্যাপারে রামানন্দ, কলন্দর, নানক, কবীর, দাদু, একলব্য, রামদাস, চৈতন্য, রজ্জব প্রভৃতি সন্তগণের দান মুখ্য ও অপরিমেয়।
এদিক দিয়ে পূর্বী বুলিগুলোর ভাগ্যই সবচেয়ে ভাল। এসব বুলি যখন সৃজ্যমান তখন এদের জননী অর্বাচীন অবহট্ট বৌদ্ধ ব্ৰজযান সম্প্রদায়ের যোগ-তন্ত্র ও শৈবমত প্রভাবিত এক উপশাখার সাধন-ভজনের মাধ্যম হবার সুযোগ পায়– যার ফলে আধুনিক আর্য ভাষার (অবহট্ট থেকে ভাষাগুলোর সৃষ্টিকালের বা দুইস্তরের অন্তর্বর্তীকালের বা সন্ধিকালের) প্রাচীনতম নিদর্শনস্বরূপ চর্যাগীতিগুলো পেয়েছি।
তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হল। আর এর দ্রুত বিকাশের সহায়ক হল বৈষ্ণবমত ও দেব পাঁচালী। পরবর্তীকালে খ্রীস্ট ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের, হিন্দুসমাজে সংস্কারের এবং কোম্পানীর শাসন পরিচালনের প্রয়োজনে বাঙলা গদ্যের সৃষ্টি ও দ্রুত পুষ্টি হয়। এসব আকস্মিক সুযোগসুবিধা পেয়েও বাঙলা ভাষা স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেনি; কারণ পরপর সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজির চাপে পড়ে বাঙলা কোনো দিন জাতীয় ভাষা বা সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ভাষার মর্যাদা পায়নি। আজ অবধি বাঙলা একরকম অযত্নে লালিত ও আকস্মিক যোগাযোগে পুষ্ট।
শিক্ষার, সাহিত্যের ও দরবারের ভাষা শিক্ষিত লোকের ভাষা। সেকালে শিক্ষিতের সংখ্যা। ছিল নগণ্য। কাজেই প্রাকৃতজন তাদের ভাব-ভাবনা ও অনুভূতি-উপলব্ধি প্রকাশ করত নিজেদের মুখের বুলিতেই। এভাবে তারা গান, গাথা, ছড়া, বচন ও রূপকথা-রসবার্তা তৈরি করে মুখে মুখে প্রচার করতে থাকে। বহু মুখের স্পর্শে ওগুলো রূপ ও রস বদলায়, ফলে ও-গুলোকে ব্যক্তিক রচনা বলে চিহ্নিত করা যায় না। তাই আজকাল এ সাহিত্যকে গণরচনা বলে নির্দেশ করা হয়। আমাদের আধুনিক সংজ্ঞায় এগুলোই লোক-সাহিত্য বা পল্লী-সাহিত্য। আঞ্চলিক বুলিতে রচিত বলে লোক সাহিত্য সাধারণত অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে দেশময় ব্যাপ্ত হতে পারত না। পল্লী-সাহিত্য সাহিত্য-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস-প্রসূত নয়। তবু মানবমনের কোমল অনুভূতির আন্তরিক প্রকাশ বলেই এগুলো সুন্দর এবং স্থানে স্থানে শিল্পগুণে মণ্ডিত। মুখের বুলির পুষ্টি ও বিকাশ হয়েছে প্রাকৃত . রচনা লোক-সাহিত্যের মাধ্যমেই। বাঙলা লোক-সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে–ডাক ও খনার বচন, ছড়া, প্রবাদ, রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা, যোগীপাল-ভোগীপাল, মহীপাল গীত (অপ্রাপ্য), ময়নামতী-গোপীচাঁদ-মানিকচাঁদ গীত, মীননাথ-গোখনাথ-হাড়িপা কাহিনী; শিবের-ছড়া, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, রাম পাঁচালী, ভারত কথা প্রভৃতি। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে ব্রাহ্মণ্য সমাজের কাহিনীগুলো রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ও মঙ্গল কাব্যাদিতে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ কাহিনী ময়নামতী-গোপীচাঁদকথা গাথা রূপেই রয়ে গেছে এবং পাল গীতি লোপ পেয়েছে।
অন্যান্য দেশের বুলি যেমন ধর্মমত প্রচারের বাহন বা রাজ্য শাসনের মাধ্যম কিংবা প্রাকৃতজনের রচনার অবলম্বন হয়ে ক্রমে সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে বাঙলার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে বলে রাখা ভাল, মুসলমান সুলতান-সুবেদারেরাও শাসিতদের জানবার ও শাসন পরিচালনার গরজেই বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির পোষকতা করেন। লেখ্য ভাষা বইপত্র ছাড়া লেখা যায় না, কাজেই গ্রন্থ লিখিয়ে নিতে হল–ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যেমনটি হয়ে ছিল। আর ভাষার বুনিয়াদ দ্রুত গড়ে উঠে এবং ভাষা পুষ্টি লাভ করে অনুবাদের মাধ্যমে। বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি।
অতএব আলোচ্য দুশ বছরের মধ্যেকার বাঙলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন না মেলার আমাদের অনুমিত কারণ এই :
ক. ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্য শাসনের বাহন হয়নি বলে বাঙলা তুর্কী বিজয়ের পূর্বে লেখ্য ভাষার মর্যাদা পায়নি।