আমাদের ধারণায় তুর্কীবিজয় ও তার পরেরকার গৌড়রাজ্যের চিত্র এরূপঃ
তুর্কীরা যুদ্ধ করে যখন দেশ জয় করেছে (আসলে বখতিয়ার খলজী অনায়াসেই দেশ দখল করেন, হত্যাকাণ্ডের বিশেষ প্রয়োজন হয়নি, কারণ রাজা পালিয়ে গিয়েছিলেন]; তখন সাময়িকভাবে হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজ চলেছিল (যেমনটি চলে থাকে)। তারপর দেশ শাসনে তারা মনোযোগী হয়। গোড়ার দিকে উদ্ধত অসহযোগীদের শায়েস্তা করতে হয়, ফলে বিশেষ বিশেষ লোকের উপর অত্যাচার চলে। কিছু কিছু লোকের ধন-জন-প্রাণ হরণ করা হয় (যেমনটি নিয়ম ও প্রয়োজন)। তারপর রাজত্ব স্থায়ী করার গরজেই শাসিতদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা দানে শাসকবর্গ বাধ্য হয় এবং যেহেতু দেড়শ বছর ধরে গৌড় সিংহাসনের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা ছিল না, মসনদ নিয়ে নিত্য কাড়াকাড়ির আশঙ্কা থাকত, সেহেতু সিংহাসনাভিলাষীরা সামন্ত, সর্দার ও ভূঁইয়াদের স্বপক্ষে টানবার জন্যে সুশাসন চালাবার চেষ্টা করতেন এবং সে সূত্রে সুশাসনের নামে বেশকিছুটা অতিরিক্ত উদারতা ও সদাশয়তা দেখাতেন এবং জনপ্রিয়তার জন্যে জনগণকে প্রশ্রয় দিতেন। এও অনুমান করা যায় যে, তাঁরা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হবার গরজে প্রজাদের গোড়ার দিকে করভারে পীড়া দিয়েছেন। ইংরেজদের যেমন দেখেছি, তেমনি মুসলমানেরাও উত্তম্মন্যতা (Superiority complex) নিয়ে চলত, আর শাসিতদের অবজ্ঞা ও অনুকম্পা দেখাত; নির্বোধ ও সাধারণ মুসলমানেরা সে-অবজ্ঞা কথায় ও আচরণে প্রকাশ করত। কীর্তিলতা ও চৈতন্যমঙ্গলে যেমন দেখা যায় এজন্যে হিন্দু। মনেও ক্ষোভ ছিল (যেমন মধ্যযুগের হিন্দুরচিত নানা গ্রন্থে মুসলমানদের প্রতি বিরূপতা দেখা যায়; বৃটিশ আমলের দেশীয় সাহিত্যে যেমন ইংরেজ-বিদ্বেষ প্রকট)। এজন্যে সময় ও সুযোগমতো তারা তিলকে তাল করে রটিয়ে দিত। (কিছুকাল আগে যেমন পাকিস্তানে হিন্দু-নারী হরণের ও হিন্দুর উপর নানা লঘুগুরু অত্যাচারের অলীক সংবাদ কলকাতায় শোনা যেত)। শাসক-শাসিতের সম্পর্ক বিজাতির ও বিদেশীর হলে এমনটিই হয়, না হয়ে পারে না। শাসকের দোষ খোঁজার ও দেখার জন্যে এবং ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগের জন্যে এমনি অবস্থায় মনটি তৈরি হয়েই থাকে। (গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধীদলের ভূমিকা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।) ঐতিহাসিকের কর্তব্য সব কথা আক্ষরিকভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস না করে সত্য ও সারটুকু হেঁকে নেয়া। আর অদ্ভুত ও অসম্ভব কথা এ যুগেও রটে– সুতরাং সে-যুগে নানা কারণে এর বাহুল্য যে ছিল এবং অজ্ঞতার সুযোগ এবং যাচাই করবার উপায়ের অভাবে সেগুলো যে সহজে বিশ্বাস হত তা না বললেও চলে। আজকের মতোই ভালয় মন্দয় শাসনকার্য চলত, মাঝে মাঝে অমানুষ শাসকের হাতে পড়লে তার ব্যতিক্রম ঘটত–আজও যেমন ঘটে। এজন্যে মানুষের ভাব-চিন্তা কিংবা আনন্দ-উৎসব বন্ধ থাকেনি–থাকে না। তবে অনুকূল-প্রতিকূল পরিবেশে তার উৎকর্ষ-অপকর্ষ ঘটে। তাও এসব বাধার যা-কিছু গুরুত্ব সাধারণের কাছেই–প্রতিভাধরের কাছে কখনোই নয়। তার প্রমাণ বিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য।
এবার বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের কথায় আসা যাক। চর্যাগীতি যে বাঙলা এ বিশ্বাস থেকেই বাঙলা সাহিত্যের তামস-যুগ তত্ত্বের উদ্ভব। অথচ চর্যাগীতি যে প্রাচীন বাঙলা তা আজো সর্বজন স্বীকৃত সত্য নয়। হিন্দি, মৈথিল, উড়িয়া, অসমীয়াও এর দাবীদার। ডক্টর সুকুমার সেন, অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন প্রমুখ বাঙালি বিদ্বানেরাও ওদের দাবীর আংশিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। সব সিদ্ধার বাড়ি বাঙলায় নয়, বাঙলা তখনো শালীন ও লেখ্য সাহিত্যের ভাষা নয়, আঞ্চলিক বুলি মাত্র। কাজেই উড়িষ্যা, মিথিলা কিংবা আসামের লোকের বাঙলা পদ রচনা করার তখনো সাধ-সাধ্য থাকার কথা নয়। অতএব সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, চর্যাপদ অর্বাচীন প্রাচ্য (গৌড়ী?) অবহট্টে রচিত। সে সময় আঞ্চলিক বিকৃতিজাত সামান্য প্রভেদ থাকলেও উড়িয়া-বিহারী-বাঙলা ও আসামী অবহট্ট মোটামুটি অভিন্ন ছিল। নাথ সহজিয়া পন্থের অন্যতম প্রসারক্ষেত্র চন্দ্ররাজদের রাজ্য পূর্ববঙ্গ। কাজেই মানিকচাঁদ-ময়নামতী-গোপীচাঁদের দেশে (আধুনিক কুমিল্লাদি জেলায়) বহুল চর্চার ফলে নেপালেও চর্যাগীতি সম্ভবত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশাদি পূর্ববাঙলার লোকেরাই নিয়ে যান চর্যাগীতিতে বঙ্গ-গৌড়ীয় বিকৃতি এসেছে। এতেই বাঙলার দাবী জোরালো হয়েছে। মুনিদত্তের টীকাযুক্ত চর্যাগীতি নেপালে নেওয়ারী হরফে লিখিত পুথিতেই পাওয়া গেছে। বিদেশে বিভাষীর পক্ষে ভিন্ন ভাষার অলিখিত শাস্ত্রচর্চা সম্ভব নয়। কাজেই চর্যাগীতি নেপালে স্বাভাবিকভাবেই লিখিত ও টীকা সম্বলিত হয়েছে। কিন্তু আসাম-বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যাতেও তার লেখ্যরূপ ছিল বলে মনে করবার সঙ্গত কারণ নেই। নাথ সহজিয়া-শন্থ যোগ-তান্ত্রিক বজ্রযান বৌদ্ধদের বিকৃত উপশাখা। কাজেই উপসম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বেশি ছিল না এবং তারা স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপন। করেনি। অতএব সেকালের বাঙালি-বিহারী-আসামী-উড়িয়া সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বের দাবী বা যোগ্যতা এদের ছিল না। সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পাল আমলের। মধ্যকাল থেকেই সংস্কৃত চর্চা করত। কারণ শাস্ত্রচর্চার ও শাসন পরিচালনের বাহন ছিল সংস্কৃত। তাই প্রাচ্য অবহট্টেরও লেখ্যরূপ মিলে না। গৌড়ী-মাগধী অবহট্টেই যদি লেখার রেওয়াজ না থাকে, তা হলে তখনো নিতান্ত অবজ্ঞেয় আঞ্চলিক মুখের বুলি আসামী-বাঙলা-উড়িয়া-বিহারীতেই বা লেখ্য রচনার সম্ভাব্যতা কোথায়? কাজেই এদেশে চর্যাগীতির কোনো লেখ্যরূপ ছিল না এবং এগুলো মুখে মুখে রচিত ও গীত লোকসাহিত্য বা লোকায়ত শাস্ত্ররূপেই চালু ছিল বলে আমাদের ধারণা। অতএব, আমাদের অনুমান এই যে চর্যাগীতি লিখিত রচনাও নয়, বাঙলাও নয়– অর্বাচীন গৌড়ী-মাগধী অবহট্ট এবং মৌখিক রচনা। ডক্টর সুকুমার সেনও বলেছেন–অসমীয়া ভাষীদের দাবী অযৌক্তিক নয়, কেননা যোড়শ শতাব্দী অবধি (বাঙলা ও অসমীয়া) দুই ভাষায় বিশেষ তফাৎ ছিল না এবং উড়িয়া-আসামীদের সঙ্গে বাঙলার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আদিতে এই তিনটি একই ভাষা ছিল। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর হইতে মূল ধারা হইতে উড়িয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে।4- ৫ কাজেই ভাষার এক সাধারণ স্তর থেকে বাঙলা, উড়িয়া, মৈথিল অসমীয়ার উদ্ভব। ডক্টর সুকুমার সেন এর নাম দিয়েছেন, প্রত্ন-বাঙ্গালা-অসমীয়া-উড়িয়া।৬ এই সাধারণ স্তর আমাদের ধারণায় অর্বাচীন অবহট্ট বা আধুনিক ভাষাগুলোর লক্ষণ স্ফুটনকালীন অবহট্ট। অতএব চর্যাগীতি কেবল বাঙলার নয়, উক্ত অপর ভাষাগুলোও সাধারণ ঐতিহ্য এবং এর ভাষা আলোচ্য সবকয়টি ভাষার জননী।