চ. মুসলমান আক্রমণকারীরা নাহয় গৌড়-লখনোতিতে চলার পথে, যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা রাজধানী দখলের সময়ে মন্দির ভেঙেছে, প্রধান ব্যক্তিদের হত্যা করেছে, গ্রাম লুট করেছে; কিন্তু তাদের সংখ্যা কয়টি ও কয়জন? দেশব্যাপী হিন্দু যারা বেঁচে রইল তাদের বাড়ির এবং দেশের অন্যান্য মন্দিরের পুথিপত্র নষ্ট হবার কারণ কি? এ তো গৌড়ের কথা। রাঢ়ে-বঙ্গে তো মুসলমানের পা বহুকাল পড়েনি, যখন পড়েছে তখন যুদ্ধক্ষেত্রেই জয়-পরাজয় নিশ্চিতভাবে নির্ণিত হয়েছে, মন্দির ভাঙার কিংবা নির্বিচারে লোকহত্যার প্রয়োজন হয়নি। সেখানকার হিন্দুর বাঙলা-সংস্কৃতে কী অবদান আছে? গৌড়-লখনেতিতে কাফেররা কি কেবল নিগৃহীতই হচ্ছিল; রাজনীতি ও কূটনীতির নিয়মানুসারে কেউ কেউ কি অনুগৃহীত হয়নি? তাদের দান কী?
ছ. ভারতে সর্বত্র ইংরেজের শাসনকাল সমান নয়। বাঙলাতেই তো ১৮২ বছর মাত্র। তবু আমরা কী দেখলাম? এর মধ্যেই আমাদের সর্বাত্মক বিবর্তন ও রূপান্তর জন্মান্তরেরই নামান্তর নয় কি? তা হলে মুসলমান রাজত্বের প্রথম আড়াইশ বছরেও (বিজ্ঞানযুগ নয় বলে হয়তো খুব মন্থরগতিতে) দেশের সমাজ সংস্কৃতি ক্ষেত্রে রূপান্তর ও বিবর্তন নিশ্চয়ই ঘটেছে, যার ক্রমিক ও পূর্ণ বিকশিত রূপ পাচ্ছি ভাস্কর রামানুজ-নিম্বার্ক-বল্লভ-কলন্দর-রামানন্দ-কবীর-নানক-একলব্য রামদাস-দাদু-রজ্জব-চৈতন্যের মতবাদে। ক্ষিতি মোহনসেনের ভারতের মধ্যযুগে সাধনার ধারা, হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা, তারাঠাদের, Influence of Islam on Indian culture সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের The Hindu view of life, বিনয় ঘোষের বাঙলার নবজাগৃতি, উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের ভারত দর্শন সার প্রভৃতি গ্রন্থে আমাদের উক্তির সমর্থন রয়েছে।
এ ব্যাপারে সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, নবদেবী-বনবিবি, কালুরায়-কালুগাজী, ওলাদেবী-ওলাবিবি প্রভৃতি উপ ও অপদেবতার উদ্ভব ও পূজা-শিনীর কথাও স্মরণীয়।
বৃহৎ বঙ্গে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, বাঙলা দেশে পাঠান প্রাবল্যের যুগ এক বিষয়ে বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রধান যুগ। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গদেশের সভ্যতার যে শ্রী ফুটিয়াছিল, এই পরাধীনতার যুগে সেই শ্ৰী শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল। এই পাঠান প্রাধান্য যুগে চিন্তাজগতে সর্বত্র অভূতপূর্ব স্বাধীনতার খেলা দৃষ্ট হইল। অরবিন্দ পোদ্দারের মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য ও মানবধর্ম গ্রন্থেও তুর্কী বিজয়ের সুফলের কথা আছে এবং বৈষ্ণব মত যে সুফী মতের প্রভাবপ্রসূত তা সুকুমার সেনও কিছুটা স্বীকার করেন। (বাঙ্গাল সাহিত্যের ইতিহাস-পূর্বার্ধ পৃ. ২৪৫)।
জ, বাঙলা দেশ উজাড় হল বলে বাঙলা সাহিত্য, দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে সৃষ্টি হয় নি, এ-ই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু সিদ্ধাদের চর্যাপদ ছাড়া বাঙলায় আর কিছুই সৃষ্টি হয়েছিল কি? উচ্চবর্ণের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মুসলিম বিজয়ের পূর্বেকার কোনো বাঙলা রচনার সন্ধান বা উল্লেখ পাওয়া যায় কি? লক্ষণ সেনের সভায় বাঙলায় লিখিয়ে কবি ছিলেন কি? শৌরসেনী ছাড়া অন্য কোনো অবহট্টেই কি লিখিত বিশেষ কোনো রচনা আছে [ODBL-P. 113]? গৌড়ী অবহট্টে রচনার রেওয়াজ না থাকলে প্রাচীন বাঙলাতেই বা থাকবে কেন? ধ্বংসের মধ্যেও মূর্ধাহত বাঙালি প্রাকৃত পৈঙ্গল ও সদুক্তিকর্ণামৃত সংকলন করবার প্রেরণা ও সংকলনের জন্য কবিতা পেলেন কোথায়? আর প্রাকৃত-অবহট্টের মতো বাঙলা কবিতা থাকলেও কি এরূপ সংকলন হত না? এ সময়ে রচনার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে এ সময়কার কিছু কিছু সংস্কৃত রচনার (পুরাণাদির) সন্ধান মিলল কিরূপে? বাঙলা কি তখন শিক্ষিত লোকের সাহিত্য রচনার বাহন হবার যোগ্য হয়েছিল? সে-যুগের ধর্মসম্পৃক্ত সাহিত্য ভাষায় সৃষ্টির বা অনুবাদের পক্ষে বাধা ছিল না কি? চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস ছাড়া কোনো বামুন আদিস্তরে বাঙলায় কিছু লিখতে সাহস বা আগ্রহ দেখিয়েছেন কি?
অষ্টাদশ পুরাণানি চ রামস্য চরিতানি চ।
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।
কিংবা কৃত্তিবেসে, কাশীদেসে আর বামুনঘেঁষে এ তিন সর্বনেশে বুলিটা আঠারো শতক অবধি কথায় ও কাজে অন্তত কিছুটা কি চালু ছিল না?
ঝ. হিন্দুর বেদ-পুরাণাদি রইল, লক্ষ্মণ সেনের সভাকবিদের গ্রন্থও রইল, মুসলমানেরা কি শুধু বেছে বেছে বাঙলা বই নষ্ট করেছিল যে চর্যাপদ নেপাল দরবারের আশ্রয়ে টিকে রইল আর শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন) বাঁকুড়ার গোয়ালঘরে আশ্রয় পেল? শ্রীকৃষ্ণ-সন্দর্ভের আর কোনো কপি পাওয়া গেল না কেন? শেখ শুভোদয়া কী বলে? বাঙলা দেশে কি আগুন-পানি-উই-কীট সে যুগে ছিল না? জনপ্রিয় না হলে এ-যুগের ছাপা বইও কি দুর্লভ ও ক্রমে লুপ্ত হয় না? ভাষার পরিবর্তনে ও জনপ্রিয়তার অভাবে (যদি বাঙলায় কিছু রচিত হয়েও থাকে) আলোচ্য যুগের বাঙলা বই কি লুপ্ত হতে পারে না? শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ কী লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় গ্রন্থ নয়?
নেপালেই বা চর্যাপদের একাধিক পুথি পাওয়া গেল না কেন? ষোলো-সতেরো শতকে রচিত বহু পুথি কি লুপ্ত হয়নি? শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের তারিখটি এবং কৃত্তিবাসের আত্মকথা প্রচুর পাওয়া যায় না কেন?