জনসাধারণ ছিল অশিক্ষিত, আর প্রচারক ছিলেন পীর-দরবেশ, কাজেই যুক্তি প্রয়োগে নয়– কেরামতি, সামাজিক-সাম্য ও ভাবালুতা সম্বল করেই প্রচারিত হয়েছিল ইসলাম। তাই অধ্যাত্ম মহিমামুগ্ধ তত্ত্বপ্রবণ মনে ইসলামের ব্যবহারিক শিক্ষা বিশেষ সক্রিয় হতে পারে নিঃ যেমন শিয়া, ইসমাইলী সম্প্রদায় কিংবা চিশতিয়া-আদি সূফী খান্দানীদের ধর্মবোধ আজো পীরকেন্দ্রী। মারফত-পন্থ নামে চিহ্নিত করে ইত্যাকার মতবাদকে শরীয়তী-ইসলামেরও উপরে স্থান দেয়া হয়েছে।
ফলে পাক-ভারতের দীক্ষিত মুসলমান কোনোদিন দৃঢ়-প্রত্যয়ী মুসলিম হতে পারে নি। তাই নানক-কবীর-চৈতন্যের মাহাত্ম্য-মুগ্ধ মুসলমান ইসলাম ছেড়ে তাদের শিষ্য হয়েছিল। যারা রইল, তারাও পূর্বপুরুষের বিশ্বাস-সংস্কার পুরো ত্যাগ করতে পারে নি।
তাই বাঙলা দেশে আমরা কিছুকাল আগে পর্যন্ত সত্যপীর, বনবিবি কালুগাজী, ওলাবিবি প্রভৃতি মুসলিম-পূজ্য উপদেবতা পাচ্ছি। এভাবে পাক-ভারতে একপ্রকার লৌকিক ইসলাম দাঁড়িয়ে যায়। মাদার-পন্থী ফকিরেরা ও শাহ বু-আলি কলন্দরের যোগমার্গ আরো বাড়িয়ে দিল এ-বিকৃতি। যোগপন্থী দেহাত্মবাদী বাউল-বিকৃতিও মুসলিম সমাজকে পেয়ে বসেছিল। একে তো মুসলমান শাসকজাতি-শাসিত সম্প্রদায়ের তুলনায় ঐশ্বর্যবান–সবক্ষেত্রে ধনে না হোক, মানে ও মনে তো বটেই! তাই আবার ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার একান্ত অভাব। কাজেই বিকৃতি ও উজ্জ্বলতা ছিল প্রকট ও প্রবল। আকবরের আমলে রাজশক্তির প্রশ্রয়ে তা আরো বেড়ে গেল। আকবরের রাষ্টচেতনা ছিল সে যুগের পক্ষে অভিনব। তিনি রাজ্যের স্থায়িত্বের খাতিরে এক-জাতিতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে স্বধর্ম ও সংস্কৃতি ত্যাগ করলেন। সম্রাটদের মধ্যে তিনিই প্রথম দাড়ি চাঁছলেন, রাজপুতদের মতো পোশাক পরলেন, দরবারে নানা হিন্দুয়ানী তথা রাজপুত আচার চালু করলেন আর সামাজিকভাবে হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক পাতলেন।
ইলাহি মত আসলে একজাতি এক রাষ্ট্র-তত্ত্বের বাস্তবায়নের উপায়রূপেই পরিকল্পিত। না ব্রাহ্মণ্য, না-ইসলামী আবহাওয়ায় মানুষ হলেন জাহাগীর। ফলে মুসলিম প্রজা-সাধারণের মধ্যে ধর্মানুরাগের অভাব লক্ষ্য করে কিছু সংখ্যক আলেম বাদশাহর ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য ব্যাখ্যায় আত্মনিয়োগ করলেন মোজাদ্দেদ-ই আফিসানি শেখ আহমদ সিরহিন্দ। এ আন্দোলন পুরুষ পরম্পরায় চলেছিল এবং সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। তারই ভাবশিষ্য ছিলেন শাহ ওয়ালী উল্লাহ। এঁর সংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানবুদ্ধি ইসলাম এবং মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রবোধের একটি আশ্চর্য সুন্দর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিল। কিন্তু পতন-যুগের শিথিল-চরিত্র মুসলমান সমাজে তা বিশেষ কার্যকর হয়নি। তারপর কিছুকালের মধ্যেই ঘুণে-ধরা। রাষ্ট্রশক্তির পতন অনিবার্য হয়ে উঠল। একদিন বাঙলা-বিহারে দণ্ডধর হল বিদেশী বেনে-শক্তি। ভারতের সর্বত্র ক্রমে খসে পড়তে লাগল দেশী শাসন-দণ্ড। তা পড়ল বটে; কিন্তু মুসলমান চরিত্র হারালেও মর্যাদা ও অভিমান হারায় নি তখনো। বৃটিশ মুসলমানের এই মনোভাব টের পেয়েছিল গোড়াতেই। তাই কার্যত দণ্ডধর হয়েও তারা নামত দেওয়ানই রইল বহুকাল। তারা জানত মুসলমান তাদের রাজশক্তি হিসেবে স্বীকার করতে চাইবে না। এরূপ ঘটনা আমরা ইতিহাসে আগেও দেখেছি; মুসলমানেরা তখত নিয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করেছে, কিন্তু কোনো হিন্দু প্রশ্রয় পায়নি। তাই মালিক কাফুর, গণেশ টিকতে পারেন নি আর জগৎশেঠ-রাজবল্লভ মসনদ দখল করতে সাহস করেন নি।
মুসলমান নিজেদের জীর্ণতার কথা বহুকাল টের পায় নি, যদিও মারাঠা, শিখ ও ইংরেজ কার্যত ভারতের মালিক হয়ে উঠেছিল। যখন টের পেল তখন সব শেষ হয়ে গেছে। তবু তারা নিঃশেষে ভেঙে পড়ে নি। হৃত রাজ্য ও গৌরব ফিরে পাবার সংগ্রামে তারা মেতে উঠল নতুন উদ্যমে। এবার নেতৃত্ব দিলেন সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী। ইনি ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভাবশিষ্য এবং আরবের সংস্কার-নেতা মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের মতবাদে মুগ্ধ। মুসলমান আমলে যা ছিল একান্ত ধর্ম-সংস্কারান্দোলন, তা-ই এখন ধর্মসংস্কারের আবরণে রূপ নিল আযাদী সংগ্রামের। তাঁরও যতটা ইসলামী জোস্ ছিল, রাষ্ট্রনীতিক দৃষ্টি ততটা ছিল না। তাই তিনি ঘরের পাশের বৃটিশকে শত্রু ভাবলেন না, যুদ্ধ করতে গেলেন বালাকোটে ক্ষয়িষ্ণু শিখ-শক্তির বিরুদ্ধে। ভাবী শত্রু শিখ এভাবে হতবল হচ্ছে দেখে সৈয়দ আহমদের প্রতি হয়তো বৃটিশ সহানুভূতিশীল ছিল। পরে নানা সঙ্গত কারণেই ওহাবীরা বৃটিশ বিরোধী হয়। আযাদী সংগ্রামে মুসলমানদের আত্যন্তিক উত্তেজনা দানের জন্যেই তিনি ভারতকে দারুলহরব বলে ঘোষণা করেছিলেন। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সদিচ্ছা ছিল; কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টি ছিল না। তাই তলিয়ে দেখবার বা বুঝবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর মোকাবেলা করবার এতটুকু যোগ্যতাও আর মুসলমানদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। যোগ্যতা বা কৌশল ছাড়া কেবল মনের বলে কিংবা গায়ের জোরে কিছু হবার নয়। এই সামগ্রিক দূরদৃষ্টির অভাবে তাঁর সাধনা ও সংগ্রাম ব্যর্থ হল। যদিও আযাদী-লুব্ধ গাঁয়ের তরুণও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই যেহাদে। স্বেচ্ছায় প্রাণ দিয়েছে হাজার হাজার আযাদীমত্ত তরুণ। একই কারণে ব্যর্থ হল বাঙলা দেশে তাঁর শিষ্য তীতুমীরেরও সগ্রাম।