আমরা জানি, মুসলমান শাসকেরা কেবল নিজেদের মধ্যে মারামারিই জিইয়ে রাখেননি, রাজ্যবিস্তারেও উদ্যোগী ছিলেন। রাজ্যের সংখ্যাগুরু হিন্দুকে শক্ত করে রেখে, অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু সৈন্য-ও নিয়ে (যেমন তুঘান খান, ১২৭২-৮১) যুদ্ধাভিযান করা কিছুতেই সম্ভব হত না। কাজেই রাজ্যের স্থায়িত্বের গরজেই হিন্দু-নির্যাতন সম্ভব ছিল না। আর সুবাদারেরা ঘন ঘন মসনদ নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন বটে, তাতে রাজধানীতে ও যুদ্ধক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা ও প্রজার দুর্ভোগ হওয়া সম্ভব, অন্যত্র নয়। বিশেষ করে দুইজনের কাড়াকাড়ির অবসরে প্রজারা প্রশ্রয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আর প্রতিদ্বন্দ্বীরা যখন মুসলমান, তখন এরূপ ক্ষেত্রে কেবল হিন্দুর উপরই পীড়ন হওয়ার কারণ নেই। সে যুগে রাজধানীর যুদ্ধ ও রাজা বদলের সংবাদ রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয় মাসে নয় মাসেই পৌঁছত। প্রজাসাধারণের তাতে ক্ষতি-বৃদ্ধির তেমন কিছু ছিল না। এ সম্পর্কে মামলুক শাসন সম্বন্ধে ঐতিহাসিকের পূর্বোদ্ধৃত মন্তব্য স্মরণীয়। যুগান্তকর পলাশী যুদ্ধের খবরই বা কাকে বিচলিত করেছিল? শহুরে রাজনীতি, আন্দোলন কিংবা হাঙ্গামা এ দেশে আজো গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে না। এ প্রসঙ্গে ১৯৪২, ৪৬ ও ৫০-এর রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার কথা স্মর্তব্য। আরো আগের ইতিহাসের দৃষ্টান্তও নেয়া যায়। আকবরের সময়ে (১৫৭৫ খ্রী:) বাঙলা বিজিত হল বটে; কিন্তু আকবর-জাহাগীরের আমলে নিরঙ্কুশ মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেননা মুঘলে-পাঠানে তথা রাজশক্তি ও সামন্ত শক্তিতে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই ছিল। শাহজাহানের আমলে বাঙলায় মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল সত্য; কিন্তু হার্মাদদের উপদ্রবে মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ছিল না; আবার আওরঙ্গজীবের আমলে বাণিজ্য-ক্ষেত্রে য়ুরোপীয় বণিকদের দৌরাত্ম্য নতুন উপসর্গরূপে দেখা দিল। তা সত্ত্বেও বাঙলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ ছিল না। আর ভারতে ইসলাম প্রচারে কোনো কোনো রাজশক্তির সহানুভূতি ছিল হয়তো, কিন্তু সহযোগিতা যে ছিল না তা ঐতিহাসিকেরাও স্বীকার করেন। জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করার কাহিনীও অমূলক। এ ব্যাপারে বলবনী শাসন সম্বন্ধে ঐতিহাসিকের পূর্বোদ্ধৃত মন্তব্য স্মরণীয়।
এবার বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসাগুলো পেশ করছিঃ
ক. তুর্কী আক্রমণ ও বিজয় কি কেবল বাঙলা দেশেই ঘটেছিল, ভারতের অন্যত্র ঘটেনি? সেখানকার অবস্থা কিরূপ দাঁড়িয়েছিল?
খ. যুদ্ধকালে জীবন ও সম্পদ নষ্ট অনিবার্য। কিন্তু তাই বলে যারা রাজত্ব করতে আসে, তারা বিজিতদের ওপর নির্বোধের মতো চিরকাল বেপরওয়া অত্যাচার চালায় না এবং চালালে সে-রাজ্য ও রাজত্ব টেকে না। রাজনীতি ও শাসননীতিতে এমন নির্বোধ policy থাকতে পারে না। যারা কথায় কথায় বাঙলা দেশে দেড়শ, দুশ বা আড়াই শ বছরব্যাপী হিন্দু-পীড়নের কথা বলেন, তাঁরা ভেবে দেখেছেন কি, যে এটা ছয় থেকে দশ পুরুষের (generations) ব্যাপার? ইতিমধ্যে শাসক বদল হয়েছে কয়বার; generation ঘুরেছে কয়বার? দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে পুরুষানুক্রমে একই মতাদর্শে আস্থা রাখা, একই পীড়ননীতি চালু রাখা কিংবা একই কর্মে সক্রিয় থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব কি?
গ, জনাব গোপাল হালদার (বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা, ১ম খণ্ড) বলেছেন, বৌদ্ধদেরও উপর অত্যাচার হয়েছিল। দুর্গভ্রমে মগধের বৌদ্ধবিহার আক্রমণ ও সৈন্যভ্রমে ভিক্ষু হত্যার ব্যাপারটি যে একান্তই অজ্ঞানকৃত তা ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেছেন। বৌদ্ধদের সংখ্যা তখন বাঙলায় নেহাত নগণ্য এবং দণ্ডশক্তি তাদের কারো হাতে ছিল না। তারা তখন ব্রাহ্মণ্য সমাজের নিগ্রহপিষ্ট ও অনুকম্পাজীবী। কাজেই তাদেরকে নিপীড়িত করবার কারণ ও সুযোগে দু-ই ছিল অনুপস্থিত। মুসলমান বিজয়ে ব্রাহ্মণ্য পীড়ন-মুক্তির উল্লাসই কি নিরঞ্জনের রুমায় ব্যক্ত হয়নি?
ঘ. ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন, উচ্চ বর্ণ ও বিত্তের লোকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। তারপরেও বাঙলা দেশে–বিশেষ করে গৌড়ে-নদীয়ায় উচ্চবর্ণের এত হিন্দু রইল কী করে? বাঙলা দেশে উচ্চবর্ণের লোকের আনুপাতিক সংখ্যা যত, ভারতের অন্য কোনো প্রদেশে তত আছে কি? বাঙলার যে অংশ সুলতানদের পদতলে ও পদপ্রান্তে ছিল সেখানে হিন্দুর সংখ্যা বেশি কেন? রক্তে ও আগুনে এতকিছু ধ্বংস করার পরেও সব রইল কী করে? মন্দির ধ্বংস কিংবা হিন্দু নাগরিক হত্যা না করেই পূর্ববঙ্গ একশত বছর পরে (১৩০১ খ্রী.) জয় করা হয়। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করতে আসলে ১৫০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল।] রাঢ় অঞ্চলও তেরো শতকের তৃতীয়পাদ অবধি গঙ্গারাজদের দখলে ছিল। সেখানকার বাঙলা ও সংস্কৃত অবদানের নিদর্শন কী এবং কোথায়?
ঙ. সে যুগে কি নির্দিষ্ট প্রান্তরে নির্দিষ্ট সময়ে যুদ্ধ হত না? এবং সেনাপতির নিধনে, দুর্গ দখলে কিংবা তখৃত অধিকারে গোটা দেশ জিত হত না? গরিলা যুদ্ধ তথা গণসগ্রাম ছিল কি? রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখড়ের প্রাণ যায়–কথাটা কি আক্ষরিক অর্থে সত্য ছিল না? আমাদের মধ্যযুগীয় শেষ লড়াই পলাশীর যুদ্ধও এরূপ যুদ্ধ নয় কি? জয়ের পরে দুই একদিন নিশ্চয়ই যুদ্ধক্ষেত্রের চারপাশে, রাজধানী প্রবেশের পথে ও রাজধানীতে লুটতরাজ চলত (এ-ই নিয়ম)। তাই বলে তা বছরের পর বছর ধরে চলেছে বলে ভাববার কারণ কি? বর্গীর হামলার মতো রাজশক্তির ও রাজার সুপরিকল্পিত cold-blooded বর্বরতা, লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ডের নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর আছে কি? তবু বর্গী উপদ্রুত অঞ্চলে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, পালা-পার্বণ ও বিবাহ-উৎসবাদি কি বন্ধ ছিল? দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে নিপীড়ন চললে তা কি গা-সহা বা অভ্যস্ত হয়ে উঠে না? সে অবস্থায় জীবনযাত্রা কি বিকৃতভাবেও স্বাভাবিকতা লাভ করে না? তখন সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় খুব বাধা থাকে কি? ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষকালে যখন বাঙলা দেশের প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ হারাল তখনো কি কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখিত এবং বাঙলার দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রে কি ছাপা হয় নি? পলাশীর যুদ্ধের পরে, সিপাহী বিপ্লবকালে, ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের সময়ে কিংবা ১৮৪৬-৫০-এর পাক-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বেপরওয়া হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের সময়ে (সংবাদপত্রাদির মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও এবং অনেকের আত্মীয়-স্বজনের প্রাণ ও সম্পদহানি হওয়ার পরেও) বাঙলা দেশের অধিকাংশ লোকের প্রাত্যহিক জীবনে ও মননে বিপর্যয় ঘটার প্রমাণ আছে কি? তখন কি স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত, পার্বণ ও বিবাহাদি উৎসব বন্ধ ছিল?