অতএব, গোড়া থেকেই বাঙলা ভাষার অনুশীলনে মুসলমানরা বিবিধ কারণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আজো সে-দ্বিধা থেকে তাদের অনেকেই মুক্ত নয়। এভাবে বাঙলা মুসলিম গুণী-জ্ঞানীর আন্তরিক পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত ছিল। তার ফলে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য-ক্ষেত্রে মুসলিম অবদান যতখানি থাকা বাঞ্ছনীয় ও স্বাভাবিক ছিল, তা মেলেনি। সৈয়দ সুলতানও এই দ্বিধাগ্রস্তদেরই অন্যতম। বহু যুক্তি দিয়ে তিনি একদিকে নিজেকে বাঙলা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, অপরদিকে বিরূপ সমালোচনা প্রতিহত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
বাঙলা-সাহিত্যের আঁধার-যুগের ইতিকথা
চর্যাগীতিকে দশ থেকে বারো শতকের বাঙলা রচনা বলে ধরা হয়। এর পরে তেরো শতক থেকে চৌদ্দশ পঞ্চাশের মধ্যেকার কোনো বাঙলা রচনার নিশ্চিত নিদর্শন মেলে না। তাই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ মনে করেন, এ সময় বাঙলায় কিছুই রচিত হয়নি এবং তারা তুর্কী বিজয়কেই এ-জন্যে দায়ী করেন। তাঁরা বলেন, তুর্কী বিজয়ের ফলে বাঙলা দেশে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চলে। দেড়শ, দুশ কিংবা আড়াইশ বছর ধরে হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার চালানো হয়। কাফেরদের উপর। তাদের জীবন-জীবিকা এবং ধর্ম-সংস্কৃতির উপর চলে বেপরোয়া ও নির্মম হামলা। উচ্চবিত্ত ও অভিজাতদের মধ্যে অনেকেই মরল, কিছু পালিয়ে বাঁচল, আর যারা এর পরেও মাটি কামড়ে টিকে রইল, তারা ত্রাসের মধ্যেই দিন-রজনী গুনে গুনে রইল। কাজেই ধন, জন ও প্রাণের নিরাপত্তা যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে প্রাণ নিয়ে সর্বক্ষণ টানাটানি, সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার বিলাস অসম্ভব। ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্মেষ-বিকাশের কথাই উঠে না। এই হল তাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত।
ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন থেকে ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় অবধি সব ইতিহাসকারেরই একই সিদ্ধান্ত। বাংলা দেশে তুর্কী বিজয় সম্বন্ধে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতাদের মনে একটা বিজাতীয় বিরূপতা সব সময় সক্রিয় থাকে, ফলে তাঁদের সহজ বিচারবুদ্ধি এখানটায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। নইলে তাঁদের রচনায় উক্তির অসঙ্গতি, তথ্যের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার ফিরিস্তি এমন উল্কট হয়ে ফুটে উঠত না।
যে তুর্কী বর্বরতার বরাত দিয়ে বাঙলা সাহিত্যের বন্ধ্যাযুগের ইতিকথা তৈরী হয়েছে, সে তুকী-বিজয় ও তুর্কী শাসনের খসড়াচিত্র এখানে তুলে ধরছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রকাশিত History of Bengal-কে সাধারণত নির্ভরযোগ্য ইতিহাস বলে স্বীকার করা হয়। তারই দ্বিতীয় খণ্ডের আলোকে এ সময়কার রাজনৈতিক ইতিহাসের আভাস ও ফলশ্রুতি দেবার চেষ্টা করব।
মধ্যযুগের ইতিহাস সে-যুগের আবহেই যাচাই করতে হবে। সে-যুগে পরমতসহিষ্ণুতার কিংবা বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সৌজন্যমূলক শ্রদ্ধার একান্ত অভাব ছিল। পরাক্রান্ত শক্তি মাত্রেই পরপীড়ক ছিল। তার উপর ছিল ফৌজী বর্বরতা–যা এ-যুগেও বিরল নয়। এটিলা, চেঙ্গিজ, হালাকু থেকে তৈমুর-নাদির অবধি এশিয়ার যে-কোন দিগ্বিজয়ীর কথা স্মরণ করলেই এ তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শাসক কিংবা বিজেতার কোনো জাতধর্ম নেই। তাদের লোভের কিংবা ক্ষোভের কবলে যে পড়ে সেই উৎপীড়িত হয়। তাই দুনিয়ার রাজবংশাবলীর ইতিহাসে আত্মীয় হত্যার নজিরই বেশি। দুনিয়াতে চিরকাল রাজা-প্রজা, শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিত–এই দুই শ্ৰেণীই আছে। সেই রাজা শাসক বা শোষক স্বদেশী-স্বজাতি হোক কিংবা বিদেশী-বিজাতি হোক তাতে কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্মীয় ও জ্ঞাতি হত্যার নজির হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান প্রভৃতি পৃথিবীর রাজবংশের ইতিহাস মাত্রেই বিদ্যমান।
ঐতিহাসিক মধ্যযুগে মুসলমানরাই প্রধানত পরাক্রান্ত ও দিগ্বিজয়ী। কাজেই তাদের অন্যায়, উৎপীড়ন ও বর্বরতার দৃষ্টান্ত সহজেই চোখে পড়ে। আসলে সে-যুগের সভ্যজগতের ইতিহাস সর্বত্রই একরূপ। পনেরো শতকের ইটালিতে পোপ পঞ্চম নিকোলো (১৪৪৭-৫৫) পেগান, মন্দির, মূর্তি, ইমারত ও শিল্পকৃতি ভেঙে প্রাসাদ ও গির্জা তৈরি করিয়েছিলেন। ফরাসী বিপ্লবকালে লুই ও রাজবংশীয়দের হত্যা, গ্রীক-তুর্কী যুদ্ধে গ্রীকদের আনাতোলীয়া অঞ্চলে তুর্কী নিধন, হিরোসিমা নাগাসাকির হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি পুরোনো প্রবৃত্তিরই নতুন প্রকাশ। উত্তেজনাবশে ভাল মানুষও যে হিংস্র শ্বাপদ হয়ে উঠতে পারে তার চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের পাক-ভারতে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬-৫০এর বেপরওয়া হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজে। সেকালের যুদ্ধনীতি ও শাসনরীতি ছিল ভিন্ন। রাজা-প্রজা তথা শাসক-শাসিতের কর্তব্য, দায়িত্ব এবং অধিকারবুদ্ধিও ছিল অন্যরকম। জাতি ও বর্ণ-দ্বেষণা আজো সুসভ্য আমেরিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ও ভারতে তীব্র সমস্যা হয়েই রয়েছে। সে যুগে যে ছিল–তা এমন আর ক্ষোভের কি! তবু যারা ক্রীতদাসকেও নিজের সমান মর্যাদা দিয়েছে, উচ্চপদে বসিয়েছে, জামাতা করেছে, সিংহাসন দিয়েছে, তারা কি একেবারে অমানুষ হতে পারে? উদারতা ও মানুষের প্রতি নিঃসঙ্কোচ শ্রদ্ধার এমনি দৃষ্টান্ত আর কোনো জাতির মধ্যে পাওয়া যায় না। সত্য বটে, মুসলমানেরা অমুসলিম দেশ জয় করতে গিয়ে ধনের লোভে ও ফেরারী শত্রুর খোঁজে গির্জা-মন্দির-বিহার আক্রমণ করেছে, মন্দির ও মূর্তি ভেঙেছে, ধন-রত্ন লুট করেছে। যেখানে স্থায়ী আস্তানা গেড়েছে সেখানে মন্দিরকে মসজিদ করেও নিয়েছে। আত্যন্তিক স্বধর্মপ্রীতি ও বিধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা এমনি অপকর্মে সেনাদলকে চিরকালই অনুপ্রাণিত করে। পৌত্তলিক সমাজ থেকে গড়ে ওঠা নিরাকার একেশ্বরবাদী মুসলিম মানসে পৌত্তলিকতার প্রতি অবজ্ঞাটাও ছিল তীব্রতর। কাজেই যুদ্ধকালে বর্বর ফৌজী-উত্তেজনার সময় মন্দির-মূর্তি ভাঙা ও ধনরত্ন লুট করা সে-যুগের কোনো বিজেতা-বাহিনীর পক্ষে কলঙ্কের কথা নয়। বিজাতি বিধর্মী বিজেতারা চিরকালই তা করেছে, দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বত্র এর নজির রয়েছে। মুসলমানেরা এর ব্যতিক্রম নয়। যুদ্ধ ছাড়া শান্তির সময়ে খেয়ালের বশে কিংবা বিজাতি-বিদ্বেষের প্রাবল্যে কোনো মুসলমান শাসক মন্দির মূর্তি ভাঙেননি। বরং কেউ কেউ পাপের ভয় উপেক্ষা করেও মন্দির তৈরিতে অর্থসাহায্য করেছেন, দেবোত্তর জমি দিয়েছেন। এদেশে আসিয়া মুসলমান রাজারা সংস্কৃত হরফে মুদ্রা ও লিপি ছাপাইয়াছেন, বহু বাদশা হিন্দু মঠ ও মন্দিরের জন্য বহু দানপত্র দিয়াছেন। সে-সব ঐতিহাসিক নজির দিন-দিন নূতন করিয়া বাহির হইতেছে। (ক্ষিতিমোহন সেন)। তারপর যখন হিন্দু মুসলমান অধ্যুষিত দেশে রাজায়-বাদশায় যুদ্ধ হয়েছে, তখন ধর্মস্থানের উপর হামলা (বিশেষ কারণ না ঘটলে–যেমন মন্দিরে শত্রুর আশ্রয় নেয়া, আত্মগোপন করা ইত্যাদি) হয়নি। ভারতের কোনো মুসলমান বিজেতাই স্বধর্মপ্রচারের মহৎ উদ্দেশ্যে দেশ জয় করেননি— রাজত্বলোভেই অস্ত্রধারণ ও প্রয়োগ করেছেন। মুসলমান বিজেতারা এদেশে রাজ্য স্থাপন করেই হিন্দু পাইক (পদাতিক সৈন্য) ও কর্মচারী নিয়োগ করতে থাকেন। রাজ্য শাসনে ও রাজস্বব্যবস্থায় এমনকি সৈনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এবং গৌড়ের সুলতানেরা মুসলমান হইলেও রাজকার্য প্রধানত হিন্দুর হাতেই ছিল। (সুকুমার সেন)। অধিকাংশ আফগানই তাঁহাদের জায়গীরগুলি ধনবান হিন্দুদের হাতে ছাড়িয়া দিতেন।–এই জায়গীরগুলির ইজারা সমস্ত ধনশালী হিন্দুরা লইতেন এবং ইহারা ব্যবসায় বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন। (স্টুয়ার্টের বাঙলার ইতিহাস)। পাঠান রাজত্বকালে জায়গীরদারেরা দেশের ভিতরে রাজস্ব আদায়ের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। দেশে শাসন ও শান্তিরক্ষার জন্য হিন্দুদের উপরেই তাদের নির্ভর করতে হত। সেইজন্য পাঠান আমলে হিন্দু ভূস্বামী ও অধিকারীদের যথেষ্ট উল্লেখ দেখা যায়। (বাঙলার নব জাগৃতি, বিনয় ঘোষ পৃ. ২৮।)