এমনিতেই আভিজাত্যলোভে শিক্ষিত দেশী মুসলমানরা চিরকাল নিজেদের বিদেশাগত মুসলমানের বংশধর বলে পরিচয় দিয়ে আসছে। ফজলে রাব্বী খান বাহাদুর তাঁর হকিকতে মুসলমানে বাঙ্গালা (অনুবাদ : The Origin of the Musalmans of Bengal, 1895 A. D.) গ্রন্থে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বাঙালি মুসলমানেরা প্রায় সবাই বহিরাগত। আঠারো শতকে কোম্পানী শাসন প্রবর্তিত হলেও নবাবী আমলের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া অনেককাল বিলীন হয়নি। ফারসি ছিল ১৮৩৮ খ্রীস্টাব্দ অবধি দরবারী ভাষা। কাজেই ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত সমাজ তখনো মধ্যযুগীয় আমীরী স্বপ্নে বিভোর, যদিও তাদের অজ্ঞাতেই তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছিল। তখন দুর্ভাগ্যের দুর্দিন সত্যই তাদের সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল, তখনো হৃতসর্বস্ব মুসলমান উত্তর ভারতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল জ্ঞাতির ঐশ্বর্যগর্বে নিজের দীনতা ভুলবার নিষ্ফল আশায়। তখন আরবি নয়, এমনকি ফারসিও তত নয়, উর্দু প্রীতিই তাদের মানসিক সান্ত্বনার অবলম্বন হল। উর্দু ভাষা না থাকিলে আজ ভারতের মোসলমানগণ জাতীয়তাবিহীন ও কিরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হইত, তাহা চিন্তা করিবার বিষয়। বাংলা দেশের মোসলমানদিগের মাতৃভাষা বাংলা হওয়াতে, বঙ্গীয় মোসলমান জাতির সর্বনাশ হইয়াছে। এই কারণে তাহারা জাতীয়তাবিহীন নিস্তেজ দুর্বল ও কাপুরুষ হইয়া দিয়াছে। [১৯২৭ সন, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার জীবন চরিত : ভূমিকা, মোহাম্মদ রেয়াজদ্দিন আহমদ। ইনি নিজে ছিলেন বাংলা লেখক ও সাংবাদিক। তাই নওয়াব আবদুল লতিফের (১৯২৬-৯৪) মুখে শুনতে পাই: বাঙলার মুসলিম ছোটলোকদের ভাষা বাংলা। আর অভিজাতদের ভাষা উর্দু।
বাঙলার প্রতি মুসলমানদের মনোভাব কত বিচিত্র ছিল তার দু-একটি নমুনা দিচ্ছি: A Muhammadan Gentelman about 1215 B. S. (1808 A. D.) enjoined in his deathbed that his only son should not learn Bengali, as it would make him effiminate. … Muhammadan gentry of Bengal too wrote in Persian and spoke in Hindustani.
(JASB, 1925 PP 192-93; A Bengali Book written in Persian Script : Khan Saheb Abdul Wali). মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদের পূর্ব উদ্ধৃত উক্তিও স্মর্তব্য।
মীর মশাররফ হোসেন তাঁর আমার জীবনী (১৩১৫ সন) গ্রন্থে লিখেছেন : মুন্সী সাহেব (তাঁর শিক্ষক) বাঙ্গালার অক্ষর লিখিতে জানিতেন না। ….বাঙ্গালা বিদ্যাকেও নিতান্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন। …. আমার পূজনীয় পিতা বাঙ্গালার একটি অক্ষরও লিখিতে পারিতেন না।
মীর মুশাররফ হোসেনের গৌরাই ব্রীজ বা গৌরীসেতু গ্রন্থের সমালোচনা প্রসঙ্গে বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমচন্দ্র? যে মন্তব্য করেছিলেন তাতেও মুসলিম সমাজমনের পরিচয় পাই: যতদিন উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদিগের মধ্যে এমত গর্ব থকিবে যে তাঁহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না বা বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দু-ফারসির চালনা করিবেন, ততদিন সে (হিন্দু-মুসলমান) ঐক্য জন্মিবে না।
[হিন্দু মুসলমান ঐক্য তখনো ছিল না– শাসক-শাসিত সুলভ অবজ্ঞা বিদ্বেষের জেরই বিদ্যমান ছিল!]
বাঙ্গালা ভাষা হিন্দুগণের ভাষা। (নবনুর; ভাদ্র ১৩১০ সন : মুসলমানের প্রতি হিন্দু লেখকের অত্যাচার লেখক কেন চিৎ মর্মাহতের হিতকামিনা। ইনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।)
আমি জাতিতে মোসলমান,–বঙ্গভাষা আমার জাতীয় ভাষা নহে। [হিন্দু মুসলমান (ঢাকা ১৮৮৮ সন) গ্রন্থে লেখক শেখ আবদুস সোবহান। ইনি ইসলাম সুহৃদ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।].
শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ, তাঁর পুত্র শাহ্ আবদুল কাদির ও ওয়াহাবী (মুহম্মদী) আন্দোলনের প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আন্দোলনের বাহন ছিল উর্দু। সে সূত্রেও ইসলামি সাহিত্যের আধারূপে উর্দু ধর্ম ও জাতি-প্রাণ মুসলিম চিন্তাবিদদের প্রিয় হয়ে উঠেছিল। এ কারণে শেখ আবদুর রহিম, নওশের আলি খান ইউসুফজাই, মৌলানা আকরম খান প্রমুখ অনেক বাঙলা লেখকও উর্দুর প্রয়োজনীয়তা (পাকিস্তান পূর্বযুগেও) অনুভব করতেন। শেখ আবদুর রহিম বলেছেন:….বঙ্গীয় মুসলমানদিগের পাঁচটি ভাষা শিক্ষা না করিলে চলিতে পারে না–ধর্ম ভাষা আরবি, তৎসহ ফারসি এবং উর্দু এই দুইটি, আর রাজভাষা ইংরেজী তৎসহ মাতৃভাষা বাঙ্গালা। (৮ই পৌষ ১৩০৬ সন– মিহির ও সুধাকর)।
মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খান বলেছিলেন–উর্দু আমাদের মাতৃভাষাও নহে, জাতীয় ভাষাও নহে। কিন্তু ভারতবর্ষে মোছলেম জাতীয়তা রক্ষা ও পুষ্টির জন্য আমাদের উর্দুর দরকার। (তৃতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সম্মেলন : অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণ।)
সাধারণভাবে বলতে গেলে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বাবধি (১৯২০ খ্র;) এক শ্রেণীর বাঙালি মুসলমান উর্দু-বাঙলার দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এঁদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষিত এবং জমিদার অভিজাতরাই ছিলেন বেশি। বাঙালি মুসলমানের অশিক্ষার সুযোগ ঊনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথম তিন দশক অবধি স্ব-আরোপিত (Self assumed) অবাধ নেতৃত্ব পেয়েছিলেন নবাব আবদুল লতিফ, আমীর হোসেন (বিহারী), সৈয়দ আমির আলি, নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নবাব আলি প্রমুখ বহিরাগত মুসলিমের উর্দুভাষী বংশধরগণ। তাঁরাই বাঙালি মুসলমানের মুখপাত্র হিসেবে উর্দুকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা রূপে বিদ্যালয়ে চালাবার স্বপ্ন দেখতেন। পাকিস্তান-উত্তর যুগে তাঁদেরই বংশধর কিংবা জ্ঞাতিত্ব লোভীরাই উর্দুকে বাঙালির উপর চাপিয়ে দেবার প্রয়াসী ছিলেন। আজো একশ্রেণীর শিক্ষিত লোক ও সাহিত্যিক বাঙলায় আরবি-ফারসি শব্দের বহুল প্রয়োগ দ্বারা উর্দুর স্বাদ পাবার প্রয়াসী!