অষ্টাদশ পুরাণানি চ রামস্য চরিতানি চ
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।
আঠারো শতক অবধি এ বিরূপতা যে ছিল, তার প্রমাণ মিলে অবজ্ঞাসূচক একটি বাঙলা ছড়ায়। এতে কাশীরাম দাসের নাম রয়েছে :
কৃত্তিবেসে কাশীদেসে আর বামুণ-ঘেঁষে
–এ তিন সর্বনেশে।
শাস্ত্রকথার বাঙলা তর্জমার প্রতিবাদে মুসলমান সমাজও সতেরো শতক অবধি মুখর ছিল, তার আভাস রয়েছে বিভিন্ন কবির কৈফিয়তের সুরে। এদের কেউ কেউ তীব্র প্রতিবাদীও।
শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৩১০ খ্রীস্টাব্দে) বলেন :
নানা কাব্য-কথা-রসে মজে নরগণ।
যার যেই শ্ৰধাএ সন্তোষ করে মন।
না লেখে কিতাব কথা মনে ভয় পায়
দূষিব সকল তাক ইহ না জুয়ায়।
গুনিয়া দেখি আহ্মি ইহ ভয় মিছা
হয় ভাষায় কিছু হয় কথা সাচা।
সৈয়দ সুলতান [১৫৮৪ খ্রী.) বলেছেন :
কর্মদোষে বঙ্গেত বাঙ্গালী উৎপন
বুঝে বাঙ্গালী সবে আরবি বচন।
ফলে,
আপনা দীনের বোল এক না বুঝিলা
প্রস্তাব পাইয়া সব ভুলিয়া রহিলা।
কিন্তু,
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন
সেই ভাষা হয় তার অমূল্য রতন।
তবু,
যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে
পঞ্চালি রচি করি আছত দূষিতে।
মুনাফিক বোলে মোরে কিতাবেতে পড়ি
কিতাবের কথা দিলু হিন্দুয়ানি করি।
অবশ্য,
মোহোর মনের ভাব জানে করতারে
যথেক মনের কথা কহিমু কাহারে।
আমাদের হাজী মুহম্মদও [ষোল শতক) নিঃসংশয় নন, তাই তিনি দ্বিধামুক্ত হতে পারেন নিঃ
যে-কিছু করিছে মানা না করিঅ তারে
ফরমান না মানিলে আজাব আখেরে।
হিন্দুয়ানি লেখা তারে না পারি লিখিতে
কিঞ্চিৎ কহিলু কিছু লোকে জ্ঞান পাইতে।
মনের দিক দিয়ে নিঃসংশয় না হলেও যৌক্তিক বিচারে এতে পাপের কিছু নেই বলেই কবির বিশ্বাস। তাই তিনি পাঠক সাধারণকে বলছেন :
হিন্দুয়ানী অক্ষর দেখি না করিঅ হেলা
বাঙ্গালা অক্ষর পরে আঞ্জি মহাধন
তাকে হেলা করিবে কিসের কারণ।
যে-আঞ্জি পীর সবে করিছে বাখান
কিঞ্চিৎ যে তাহা হোন্তে জ্ঞানের প্রমাণ।
যেন তেন মতে যে জানৌক রাত্র দিন।
দেশী ভাষা দেখি মনে না করিও ঘীণ।
এঁর পরবর্তী কবি মুতালিবেরও (১৬৩৯ খ্রী.) ভয় :
আরবিতে সকলে না বুঝে ভাল মন্দ
তে কারণে দেশী ভাষে রচিলু প্রবন্ধ।
মুসলমানি শাস্ত্র কথা বাঙ্গালা করিলু
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু।
কিন্তু মাত্র ভরসা আছএ মনান্তরে।
বুঝিয়া মুমীন দোয়া করিব আমারে।
মুমীনের আশীর্বাদে পুণ্য হইবেক
অবশ্য গফুর আল্লা পাপ ক্ষেমিবেক।
আমীর হামজা (১৬৮৪ খ্র.) রচয়িতা আবদুন নবীরও সেই ভয় :
মুসলমানী কথা দেখি মনেহ ডরাই
রচিলে বাঙ্গালা ভাষে কোপে কি গোঁসাই।
লোক উপকার হেতু তেজি সেই ভয়।
দৃঢ়ভাবে রচিবারে ইচ্ছিল হৃদয়।
রাজ্জাক নন্দন আবদুল হাকিমের (সতেরো শতক] মনে কিন্তু কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব তো নেই-ই পরন্তু যারা এসব গোঁড়ামি দেখায়, তাদের প্রতি তাঁর বিরক্তি তীব্র ভাষায় ও অশ্লীল উক্তির মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন তিনি।
যেইদেশে যেই বাক্য কহে নরগণ
সেইবাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন
মারফত ভেদে যার নাহিক গমে।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবেরগণ।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মন না জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ না যায়।
মাতা-পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।
হিন্দুয়ানী মাতৃভাষার প্রতি এতখানি অনুরাগ সে-যুগের আর কোনো মুসলিম কবির দেখা যায় না।
অতএব, সতেরো শতক অবধি মুসলমান লেখকেরা শাস্ত্রকথা বাঙলায় লেখা বৈধ কি-না সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন না। আমরা শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম প্রমুখ অনেক কবির উক্তিতেই এ দ্বিধার আভাস পেয়েছি। সুতরাং যারা বাঙলায় শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেছেন, তাঁরা দ্বিধা ও পাপের ঝুঁকি নিয়েই করেছেন। এতে তাদের মনোবল, সাহস ও যুক্তি-প্রবণতার পরিচয় মেলে।
উন্নাসিক ব্রাহ্মণ্য অভিজাতদের কাছে বাঙলা ছিল ভাষা। উন্নাসিক মুসলিমদের কাছে হিন্দুয়ানী ভাষা। কারুর চোখে প্রাকৃত ভাষা (দ্বিজ শ্রীধর ও রামচন্দ্র খান ১৬ শতক), কারুর মতে লোক ভাষা (মাধবাচার্য ১৬ শতক), কেউ বলেন লৌকিক ভাষা (কবিশেখর ১৭ শতক), অধিকাংশ লেখক দেশী ভাষা এবং কিছুসংখ্যক লেখক বঙ্গভাষা বলে উল্লেখ করতেন। বহিরাঞ্চলে এ ভাষার নাম গৌড়িয়া!
.
০৩.
মধ্যযুগে হিন্দুয়ানী ভাষার প্রতি মুসলমানদের বিরূপতা ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস প্রসূত। কিন্তু উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে সে বিরূপতাও রাজনৈতিক যুক্তিভিত্তিক হয়ে আরো প্রবল হবার প্রবণতা দেখায়।
তুর্কী ও মুঘলেরা এদেশে মুসলিম শাসন দৃঢ়মূল করবার প্রয়োজনে বিদেশী ও দেশী মুসলিম মনে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ জিইয়ে রাখতে প্রয়াসী হন। ধর্মের উৎসভূম আরব এবং শাসক ও সংস্কৃতির উদ্ভবক্ষেত্র ইরান-সমরখন্দ-বুখারার প্রতি জনমনে শ্রদ্ধাবোধ ও মানস-আকর্ষণ সৃষ্টির ও লালনের উদ্দেশ্যে কাফের-বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে স্বাতন্ত্র্যবোধ জিইয়ে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠীর একটি সচেতন প্রয়াস ছিল। আলাউল হক, তাঁর পুত্র নুরকুতবে আলম, জাহাগীর সিমনানী, আলসানী, শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ প্রভৃতির পত্রে এ মনোভাবের আভাস আছে। আর মুসলিম রচিত ইতিহাসের ভাষায় আর ভঙ্গিতেও হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষ এবং অবজ্ঞা প্রায় সর্বত্র পরিস্ফুট। অনুকূল পরিবেশে এই বহির্মুখী মানসিকতা মুসলিম মনে ক্রমে দৃঢ় হতে থাকে। ইরানে সাফাবী বংশীয় রাজত্বের অবসানে কিছুসংখ্যক বাস্তুত্যাগী ইরানী নাকি বাঙলায়ও বসবাস করতে এসেছিল। সম্ভবত তাদের সাহচর্য আভিজাত্যলোভী দেশী মুসলমানদের বহির্মুখী মানসিকতাকে আরো প্রবল করেছিল। ফারসি ভাষার বাস্তব গুরুত্বে ও সংস্কৃতির মর্যাদায় প্রলুব্ধ বাঙালি তা গ্রহণে-বরণে (উনিশ শতকের বাঙালির ইংরেজি ও বিলেতি সংস্কৃতি গ্রহণের মতোই) আগ্রহ দেখাবে–এ-ই ছিল স্বাভাবিক।