সে-যুগের হিসেবে বাঙলা রোমান্টিক সাহিত্য পরিমাণে প্রচুর, যদিও বৈশিষ্ট্যে বিচিত্র নয়। চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে যার শুরু, বটতলার বদৌলতে আজ অবধি তার ইতি ঘটেনি। অধিকাংশ রোমান্স উনিশ-বিশ শতকে দোভাষী রীতিতে রচিত এবং রূপে-রসে নিতান্তই তুচ্ছ, আর ভাবে ও ভঙ্গিতেও বৈশিষ্ট্যহীন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত লোকের সাহিত্য সৃষ্টি হওয়ার পর ওসব রচনার আর কোনো সাহিত্যিক মূল্যই নেই এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্যও নগণ্য। তাই আমরা ওগুলো বাদ দিয়ে আঠারো শতক অবধি রচিত ও জ্ঞাত রোমান্সগুলোর নাম করছি।
চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে কিংবা পনেরো শতকের প্রথম দশকে রচিত হয় শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ-জোলায়খা। ষোল শতকে পাচ্ছি দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু, মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী, শাহ বারিদ খানের বিদ্যা সুন্দর। সতেরো শতকের উপাখ্যান হচ্ছে : দোনা গাজীর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান, কাজী দৌলতের সতীময়না লোর চন্দ্রানী, আলাউলের পদ্মাবতী, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান, সপ্তপয়কর, রতন-কলিকা-আনন্দ-বর্মা, মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবতী, আবদুল হাকিমের লালমতী সয়ফুল মুলুক, ইউসুফ-জোলেখা, নওয়াজিশ খানের গুলে বকাউলী, পরাওলের শাহপরীর কেচ্ছা, মঙ্গল চাঁদের শাহ্ জালাল-মধুমালা। (এতে মঙ্গল কাব্যের মর্মগত অনুকৃতি আছে), সৈয়দ মুহম্মদ আকবরের জেবল মুলুক-সামারোখ, শরীফ শাহ্র লালমতী সয়ফুল মুলুক আর আঠারো শতকে রচিত হয়েছে খলিলের চন্দ্রমুখী, মুহম্মদ মুকিমের গুলে-বকাউলী, কালাকাম, মৃগাবতী, মুহম্মদ আবদুল করিম খোন্দকারের তামিম আনসারী, রফিউদ্দিনের জেবলমুলুক সামারোখ, শাকের মাহমুদের মধুমালা-মনোহর, নুর মুহম্মদের মধুমালা, রামজয়ের শশিচন্দ্রের পুঁথি, দ্বিজপশুপতির চন্দ্রাবলী, গরীবুল্লাহর ইউসুফ-জোলেখা, সোনাভান, সৈয়দ হামজার মধুমালতী, জৈগুনের কেচ্ছা, মুহম্মদ আলী রাজার তমিমগোলাল চৈতুন্ন সিলাল, মিশরী জামাল, মুহম্মদ আলীর শাহ পরী মল্লিকা জাদা, হাসান বানু, আবদুর রজ্জার্কের সয়ফুল মুলুক লালবানু, শমশের আলীর রেজওয়ান শাহ, মুহম্মদ জীবনের বানু হোসেন বাহরাম গোর কামরূপ কালাকাম প্রভৃতি।
বাঙলা ভাষার প্রতি সেকালের লোকের মনোভাব
॥ ভাষা বিদ্বেষ ॥
ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন না হলে আগের যুগে কোনো বুলিই লেখ্যসাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হত না। আদিযুগে সংস্কৃতই ছিল পাক-ভারতের ধর্মের, শিক্ষার, দরবারের, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের ভাব-বিনিময়ের বাহন। বৌদ্ধ ও জৈনমত প্রচারের বাহনরূপেই প্রথম দুটো বুলি–পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যিক ভাষার স্তরে উন্নীত হয়। তারপর অনেককাল রাষ্ট্রশাসন কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগেনি বলে আর কোনো বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি। পরে সাহিত্যের প্রয়োজনে নাটকে শৌরসেনী, মারাঠী ও মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতে থাকে। আরো পরে রাজপুত রাজাদের প্রতিপোষকতায় শৌরসেনী অপভ্রষ্ট বা অবহট্ঠ সাহিত্যের ভাষার রূপ পায়।
এরপরে মুসলমান আমলে ফারসি হল দরবারী ভাষা। মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এদেশী জনজীবনে যে ভাব-বিপ্লব এল, বিশেষ করে তারই ফলে আধুনিক পাক-ভারতিক আর্যভাষাগুলোর দ্রুত সাহিত্যিক বিকাশ সম্ভব হল। এক্ষেত্রে ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই সব কয়টি আঞ্চলিক বুলি লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এ ব্যাপারে রামানন্দ, কলন্দর, নানক, কবীর, দাদু, একলব্য, রামদাস, চৈতন্য, রজব প্রভৃতি সন্তগণের দান মুখ্য ও অপরিমেয়।
এদিক দিয়ে পূর্বী বুলিগুলোর ভাগ্যই সবচেয়ে ভাল। এসব বুলি যখন সৃজ্যমান তখন এদের জননী অর্বাচীন অবহট্ঠ বৌদ্ধ বজ্রযান সম্প্রদায়ের যোগ-তন্ত্র-শৈবমত প্রভাবিত এক উপশাখার সাধন-ভজনের মাধ্যম হবার সুযোগ পায়–যার ফলে আধুনিক আর্য ভাষার (অবহট্ঠ থেকে ভাষাগুলোর সৃষ্টিকালের বা দুইস্তরের অন্তর্বর্তীকালের বা সন্ধিকালের) প্রাচীনতম নিদর্শন-স্বরূপ চর্যাগীতিগুলো পেয়েছি।
তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন-সাহিত্যের বাহন হল। আর এর দ্রুত বিকাশের সহায়ক হল চৈতন্য-প্রবর্তিত মত। আবার আঠারো-উনিশ শতকে খ্রীস্ট ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারের, হিন্দু সমাজ সংস্কারের এবং কোম্পানীর শাসন পরিচালনের প্রয়োজনে বাঙলা গদ্যের সৃষ্টি ও দ্রুত পুষ্টি হয়। এসব আকস্মিক সুযোগ সুবিধা পেয়েও বাঙলা ভাষা স্বাভাবিক ও স্বাধীন বিকাশ লাভ করেনি; কারণ পর পর সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজির চাপে পড়ে বাঙলা কোনোদিন জাতীয় ভাষার বা সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ভাষার মর্যাদা পায়নি। আজ অবধি বাঙলা একরকম অযত্নে লালিত ও আকস্মিক যোগাযোগে পুষ্ট।
হয়তো দেশ শাসনের প্রয়োজনেই দেশীভাষার অনুশীলনের প্রবর্তনা দিয়েছিলেন সুলতান সুবাদারগণ। যেমনটি ফোর্ট-উইলিয়াম কলেজে দেখেছি পরবর্তীকালে। কিন্তু সুলতান-সুবাদারের প্রবর্তনা সত্ত্বেও সাধারণভাবে অনেক কাল অভিজাতরা বাঙলাভাষার প্রতি বিরূপ ছিল। হয়তো বুলি বলেই এ অবজ্ঞা। ফলে উনিশ শতকের আগে বাঙলা কোনোদিন শক্তিমানের পরিচর্যা পায়নি, তাই অন্তত দশশতক থেকে বাঙলাভাষায় সৃষ্টিকর্ম শুরু হলেও তা সময়ের অনুপাতে অগ্রসর হতে পারেনি। শেক্সপিয়র যখন তাঁর অমর নাটকগুলো রচনা করছিলেন, তখন আমাদের ভাষায় মুকুন্দরাম ও সৈয়দ সুলতানই শ্রেষ্ঠ লেখক। প্রতিভার অভাব হেতুই আমাদের হিন্দু-মুসলমানের রচনা পুচ্ছগ্রাহিতায় তুচ্ছ।