হযরত মুসার পাপবোধ সেদিন হয়তো কেনানে-মিশরে মানুষকে পীড়নমুক্ত করেছিল, কিন্তু অন্যত্র তা প্রভাব ছড়ায়নি হয়তো সে-পরিবেশের অনুপস্থিতির দরুনই। ধনলির ক্রুর লোভ ও নিষ্ঠুর পীড়নপ্রবণতার বিরুদ্ধে লড়েছেন হযরত ঈসা। সেকালের প্যালেস্টাইনের সামাজিক পরিবেশে এ দ্রোহের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেশান্তরে রোমা খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেও রোধ করতে পারেনি তাদের পতন কিংবা য়ুরোপে কোনো অঞ্চলের মানুষেরই মানসোকর্ষের কারণ হয়নি যিশুর ধর্ম। এমনকি তা ব্যবহারিক জীবন-প্রয়াসের অথবা নৈতিকজীবন ও মানবিকবোধ বিকাশের সহায়ক হয়েছিল বলেও তেমন দাবী করা চলে না।
বর্ণে বিন্যস্ত সমাজে ব্রাহ্মণ্য পীড়ন-শোষণ থেকে নির্যাতিত মানুষকে মুক্ত করে মানুষের ব্যক্তিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী ছিলেন দেব-দ্বিজ-বেদ-দ্রোহী মহাত্মা বুদ্ধ ও বর্ধমান। তাঁদের বাণী বিপ্লব ঘটিয়েছিল উত্তরপূর্ব ভারতে। তাদের সাম্য, মৈত্রী ও করুণার বাণী সেদিন এ অঞ্চলের মানবিক সমস্যার সমাধান দিয়েছিল। কিন্তু তাঁদের বাণী দেশান্তরে ভিন্ন পরিবেশে মানুষের মনের ও সমাজের রূপান্তর ঘটিয়ে কোনো নতুন যুগের সূচনা করেনি, মধ্য এশিয়ার রক্তপিপাসু শক-হূন-ইউচিদের চরিত্রে দেয়নি করুণা ও কোমলতার প্রলেপ কিংবা জীবন-রসিক চীনাদের করেনি বৈরাগ্যপ্রবণ।
একক স্রষ্টার নামে হযরত মুহম্মদের সাম্য ও ঐক্যের বাণী যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছিল মক্কা-মদিনায়। এই নবলব্ধ ঐক্য তাদের করেছিল অদম্য অপরাজেয় শক্তির অধিকারী। বন্যার বেগে তারা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। আত্মবিকাশ ও আত্মবিস্তারের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। কিন্তু সিরিয়া-ইরাক-ইরানে কিংবা মিশরে-মরোক্কে অথবা মধ্য এশিয়ায় ও ভারতে দীক্ষিত মুসলিম জীবনে সে-প্রাণপ্রাচুর্য, সে-বৈষয়িক উন্নতি, সেই মনোবল কখনো দেখা যায় নি। উল্লেখ্য যে, তুর্কী মুঘলের আত্মপ্রসার ইসলামের দান নয়। শক-হন-ইউচি-মোঙ্গলের এই বংশধরেরা বেঁচে থাকার দায়েই বাহুবল ও মনোবল-সম্বল জীবনযাপন করত। এদের পূর্বপুরুষেরাই কোরআনের ইয়াজুজ মাজুজ, এদের ভয়েই গড়তে হয়েছে চীন-ককেসাসের প্রাচীর। তবু এদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি চারদিককার জগৎ। সিরিয়া-ইরাক-ইরান-আর্মেনিয়া-রাশিয়া-ভারত-চীন চিরকালই যুগিয়েছে এদের পিপাসার রক্ত আর উদরের অন্ন। অনুর্বর মধ্য এশিয়ায় যখনই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অথবা অনাবৃষ্টির জন্যে চারণভূমির ও খাদ্যবস্তুর অভাব ঘটেছে তখনই তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছে মরীয়া হয়ে। অনিবার্য আসন্ন মৃত্যু থেকে বাঁচবার গরজপ্রসূত বলেই এই অভিযানে তারা ছিল অপ্রতিরোধ্য ও অপরাজেয়। কেননা, তারা জানত সামনে তাদের জীবন–পশ্চাতে মৃত্যু।
জীবনে-সমাজে-রাষ্ট্রে যখনই গ্লানি ও বিপর্যয় আসে, তখনই সাধারণ নায়কেরা মানুষকে স্বধর্মে তথা পিতৃপুরুষের ধর্মে নিষ্ঠ হতে উপদেশ দেন, তাঁদের মতে একমাত্র এ পথেই বিপন্মুক্তি সম্ভব। সবদেশে সবযুগেই সাধারণ মানুষের ধারণায় সঙ্কট উদ্ধারের এ-ই একমাত্র উপায়। তারা যদি নতুন ধর্মের প্রবর্তন চাইতেন, অন্তত গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করতেন, তা হলেই সুবুদ্ধির পরিচয় দিতেন। মোহগ্রস্ত চিত্তে পুরোনোই শ্রদ্ধেয়, নতুনমাত্রই অবেজ্ঞয় ও অনভিপ্রেত। অথচ তারা ভেবে দেখেন না যে হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি কোনো যুগের কোনো দেশের কোনো চিন্তানায়ক ও সমাজকর্মীই পিতৃপুরুষের ধর্মে সন্তুষ্ট ও সুস্থির ছিলেন না। তাঁরা সবাই পুরোনো ধর্মদ্রোহী ও নতুন ধর্মের প্রবর্তক। যারা তেমন অসামান্য মননশীল কিংবা সৃজনশীল নন, তাঁরাও reform করেছেন পুরোনো ধর্ম যুগের চাহিদা পূরণের জন্যেই।
কাজেই কোনো জ্ঞানী-মনীষীর কাছেই ধর্ম সর্বকালিক বলে বিবেচিত হয় নি কখনো। আল্লাও দেশ-কালের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন বাণী পাঠিয়েছেন তার নবীদের মুখে। সাধারণভাবে দেখতে গেলে ধর্ম-সমাজ-রাষ্ট্র কিংবা বিজ্ঞান-দর্শনের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যা কিছু নতুন হয়েছে, সবকিছুই এই পিতৃপুরুষের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-দর্শন প্রভৃতির অস্বীকৃতির তথা অগ্রাহ্যের ফল। এই দৃষ্টিতে যুগে যুগে দ্রোহী-নাস্তিকেরাই বিশ্বমানব ভাগ্যের দিশারী–দেশ-কালের মানবিক সমস্যার সমাধানদাতা। মানব সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছে এমনি দ্রোহীদের দানে।
পরিবেশবিরহী ধর্মের সৃষ্টি ও স্থিতি তথা আয়ু যে নেই, তার প্রমাণ পরিবর্তিত পরিবেশে ওগুলো উপযোগ হারিয়ে স্বদেশেই লোপ পায়, যেমন জন্মভূমিতেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে জরথুস্ত্রীয়, ইহুদী, খ্রীস্টীয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম।
কাজেই ধর্মনিষ্ঠাই মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে শক্তি, সম্পদ ও উন্নতির উৎস এবং ধর্মাচারহীনতাই বিপর্যয় ও অবক্ষয়ের কারণ–এ তত্ত্বে তথ্য নেই।
সত্য হচ্ছে এই, যে ক্রমপরিবর্তমান, ক্রমবর্ধমান ও ক্রমঅসমঞ্জস প্রয়োজন-সচেতনতা ও আয়োজন-বুদ্ধি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় সামর্থ্য না থাকলে রূঢ়িক কিংবা যৌগিক জীবন সমস্যাসঙ্কুল হয়ই–আর তাতে অভাব-অন্যায়-উৎপীড়ন দেখা দেয় এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত-দ্রোহও এড়ানো যায় না।
ইংরেজ আমলে মুসলিম-মানসের পরিচয়-সূত্র
পাক-ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয় মুখ্যত সূফী সাধকের দ্বারা। ইরানে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার পর কোরআনের ইসলামের উপর ইরানী অধ্যাত্মতত্ত্বের প্রভাব পড়ে সুপ্রচুর। কোরআনের ইসলামের মূলকথা : স্রষ্টা ও সৃষ্টি আলাদা, পরস্পরের সম্বন্ধ হচ্ছে বান্দা ও মনিবের। আল্লাহর নির্দেশিত বিধি নিষেধ মেনে চলাই মানুষের একমাত্র কর্তব্য। নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি অনিবার্য। আল্লাহর দেয়া বিধি-নিষেধও কোনো অধ্যাত্ম-জীবনের ইঙ্গিত বহন করে না, তা একান্তভাবেই মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার সম্পর্কিত। কাজেই কোরআনের শিক্ষায় কোথাও কোনো অস্পষ্টতা বা হেঁয়ালি নেই। সূফী মতবাদে কিন্তু বান্দা-মনিব সম্পর্কটি প্রায়ই অস্বীকৃত হয়েছে এবং ঘোষিত হয়েছে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে পরমাত্মা ও জীবাত্মার প্রণয় সম্পর্ক। এর পরিণাম দ্বৈতাদ্বৈতবোধে। অথচ ইসলামের মৌল কথা দ্বৈতবাদ। ফলত ইসলাম আর মুসলমানধর্ম এক থাকে নি। পাক-ভারতে এই মুসলমান ধর্মই প্রচলিত হয়েছিল, তার উপর শিয়ামতবাদও এখানে অপ্রচলিত ছিল না।