এজন্যেই দেশী লেখক-প্রকাশকের নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন তরী বাঞ্ছায় বিদেশী গ্রন্থের আমদানি বন্ধের আমরা বিরোধী। জীবনের আর আর ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতি ও ব্যবহারিক অসুবিধা স্বীকার করেও দেশী শিল্প ও সম্পদের আনুকূল্য করব। কিন্তু মনের চাহিদার ক্ষেত্রে দইয়ের সাধ ঘোলে মিটানো অসম্ভব। এখানে রস-পিপাসা মিটাতে অকৃত্রিম রসেরই প্রয়োজন। জৈব চাহিদা আর মানস-প্রয়োজন অভিন্ন নয়। লা মিজারেবল, ওয়ার এ্যান্ড পিস, মাদার, জঁ ত্রিস্তফ কিংবা ঘরে বাইরে পড়ার সাধ আনোয়ারা, মনোয়ারা, সোনাভান পড়ে মিটবে না। তাছাড়া এ যখন আমার শখের ও সাধের পড়া, এখানে বাধ্য করা পীড়নেরই নামান্তর। আমি পড়ি–আমার বৈষয়িক, আর্থিক, জৈবিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভুলে থাকবার জন্যে, আর আমার চিত্তের সৌন্দর্য-অন্বেষা ও রসপিপাসা চরিতার্থ করবার জন্যে। আমি পড়ি–আমার আত্মার বিকাশ কামনায়–আমার চেতনার প্রসার বাঞ্ছয়,–আমার মানবিকবোধের উন্নয়ন লক্ষ্যে ও আমার মানবতাবোধের বিস্তার করে।
যাতে আমি আনন্দ পাইনে, তা দিয়ে আমি কী করে সৃষ্টি করব আমার পলাতক মনের আনন্দ-লোক! কাজেই বইয়ের ক্ষেত্রে স্বাদেশিকতা কল্যাণকর নয়। দেশের ভালো বই পড়ব তো নিশ্চয়ই, গর্বও বোধ করব তার জন্যে। সে-বইয়ের যে প্রতিযোগিতার ভয় নেই, তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
রবীন্দ্রনাথের জন্মথিতিতে তাঁর সম্বন্ধে কিছু লিখে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা প্রকাশ করব বলেই কলম হাতে নিয়েছিলাম। নানা কথার চাপে মূল বিষয় হারিয়ে গেছে বটে, তবে মূল উদ্দেশ্য হয়তো ব্যর্থ হয় নি। কেননা, রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রীতিই এসব বাজে কথা জাগিয়েছে আমার মনে। সবভাষা আমাদের জানা নেই। বিশ্বের সেরা বইগুলো কখনো পড়া হবে না জীবনে। এইসব বই যে-সব মহত্মনের সৃষ্টি, সে-সব মনের ছোঁয়াও মিলবে না কখনো। রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের সে-সব মহৎ মনের প্রতিনিধি রূপে গ্রহণ করে বঞ্চিত আত্মাকে প্রবোধ দিতে চাই আমরা। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্রষ্টাদের চিত্তদূত-মানবতার দিশারী, আমাদের সামনে এক আলোকবর্তিকা, এক অভয়শরণ, এক পরম সান্ত্বনা। আমার ভাষাতেই তার বাণী শুনতে পাই, তাঁর ভাষাতেই আমার প্রাণ কথা কয়–আমার এ সৌভাগ্যের তুলনা নেই। জয়তু রবীন্দ্রনাথ।
বাঙলা প্রণয়োপাখ্যানের উৎস
মুসলমানেরাই যে এদেশে মানবিক-রসাশ্রিত সাহিত্যধারার প্রবর্তন করেন, এ তথ্য এখন আর কারুর কাছেই নতুন নয়। এটি হচ্ছে ইরানী সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। দরবারের ইরানী ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এদেশের হিন্দু-মুসলমানের পরিচয় একই সূত্রে ও একই সময়ে ঘটলেও প্রভাবের তারতম্য ঘটেছে বিস্তর। অপেক্ষাকৃত সংস্কারভারমুক্ত একেশ্বরবাদী মুসলমানের স্বাজাত্যবোধ ইরানী সংস্কৃতি স্বীকরণে সহায়তা করেছে প্রচুর, কিন্তু সংস্কার-পঙ্গু হিন্দুর পক্ষে ছয়শ বছরেও তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাই মুসলমানেরা যখন আধুনিক সংজ্ঞার বিশুদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি করছিল, তখনও হিন্দুরা দেবতা ও অতিমানব জগতের মোহ ত্যাগ করতে পারেনি। চর্যাকার থেকে করিওয়ালা অবধি হিন্দুর হাতে দেবমাহাত্মজ্ঞাপক ধর্মীয় প্রচার সাহিত্যই পেয়েছি। ধর্মভাগ জাগানো এর লক্ষ্য-সাহিত্য-শিল্প এর আনুষঙ্গিক রূপ এবং সাহিত্য রস এর আকস্মিক ফল। অপরদিকে মুসলমানদের হাতে বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা বিচিত্রভাবে সৃষ্ট ও পুষ্ট হতে থাকে।
মুসলমান রচিত সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিক রস বা মানবতা। একালে মানবতা বলতে যা বোঝায়, এ কিন্তু তা নয়। এ মানবতা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নির্দেশ করে। অর্থাৎ বিস্ময়-চঞ্চল কল্পচারী মানুষের প্রকৃতি, নিসর্গ ও মানস-সৃষ্ট দেব-দানব সম্বন্ধীয় আদিম কৌতূহল চোখে-দেখা মানবমুখী হয়ে উঠে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে ওরাও রইল মানুষকেও জিজ্ঞাসার বিষয় করে নিল। প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত, লৌকিক ও অলৌকিক, স্বপ্ন ও কল্পনা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষের কোনো সীমারেখা স্বীকৃত নয় এ লোকে। নদী-নগরী, গিরি-মরু-কান্তার, আকাশ-মাটি-সাগর ও স্বর্গ-মর্ত্য পাতালের পরিসরে দেব-দানব রক্ষা-যক্ষের সমবায়ে গড়ে উঠেছে এ জগৎ। বাহুবল, মনোবল আর বিলাস-বাঞ্ছাই সে জীবনের আদর্শ। সংগ্রামশীলতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা সে-জীবনের ব্রত এবং ভোগই লক্ষ্য। এক কথায়, সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্বিক জীবনের উল্লাসই এ সাহিত্যে প্রকটিত।
সংস্কৃতের পাক-ভারতিক ভাষায় প্রথম বিশুদ্ধ সাহিত্যিক শালীন রচনা হচ্ছে আবদুর রহমানের সংনেহয়-রাসয় বা সন্দেশ রাসক। এটি হচ্ছে একটি দূতকাব্য এবং বারো শতকে অপভ্রংশে বা অবহট্টে রচিত। মূলতানবাসী কবি আবদুর রহমান তাঁতি মীর হোসেনের সন্তান। অতএব দেশজ মুসলমান।
অপভ্রষ্টে বা অবহট্টে রচিত দ্বিতীয় কাব্যের নাম পহুরিরায় রাসউ বা পৃথ্বীরাজ রাসক। এর রচয়িতা চন্দ বলি বা চন্দ বরদাই। জনপ্রিয়তার ফলে ভাষা ক্রমে আধা-হিন্দিতে রূপান্তরিত হওয়ায়, এটি কালে আদি হিন্দি কাব্যরূপে প্রখ্যাত হয়। এ দুটোই দিওয়ান জাতের কাব্য। আনন্দ ধর রচিত সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ মিশ্রিত কাব্য মাধবানল-কামকলাও এখানে উল্লেখ্য।