এগুলোর মূল্য সম্বন্ধে তাদের অবচেতন মনের স্বীকৃতি রয়েছে বলেই লিলুর বিষয়বুদ্ধি নিয়ে তারা এগিয়ে আসে এগুলোর মূল্যায়নের জন্যে এবং স্বার্থবুদ্ধিবশে বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায় এগুলোর উপর। এমনকি ফরমায়েশ করবার ঔদ্ধত্যও প্রকাশ হয়ে পড়ে কখনো কখনো। স্বার্থপরের বিষয়বুদ্ধিপ্রসূত এই নিয়ন্ত্রণ-প্রচেষ্টা সময়ে সময়ে জুলুমের পর্যায়ে নামে। এবং তখনই শুরু হয় মনুষ্যাত্মা, মনুষ্যত্ব ও মানবতার দুর্দিন।
সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শন আত্মার উপজীব্য বলেই যারা চেতনা-গভীর জীবন কামনা করে, এগুলোর স্রষ্টা তাদের আত্মীয়। আত্মার জগতে দেশ-কাল-জাত-ধর্ম নেই। তাই দেশ, কাল, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র কিংবা জাতীয়তায় চিহ্নিত নয় এ চেতনালোক। এখানে যে কেউ আত্মার খাদ্য যোগায় সে-ই আত্মীয়। যা কিছু এ চেতনার বিকাশবিস্তারের সহায়ক, তা-ই বরণীয়।
সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শনের ক্ষেত্রে মানুষের যা কিছু সার্থক সৃষ্টি তা চেতনা-প্রবণ বিশ্বমানবের সাধারণ সম্পদ, রিথ ও ঐতিহ্য। একক চন্দ্র-সূর্য যেমন সবার এজমালি হয়েও প্রত্যেকের অখণ্ড সম্পদ, এবং দ্বন্দ্ব না করেই প্রত্যেকেই নিজের ইচ্ছা ও প্রয়োজন মতো পেতে পারে এগুলোর প্রসাদ; তেমনি সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত আর দর্শনও দেশ-কাল-জাত-ধর্ম নিরপেক্ষ সর্বমানবিক সম্পদ। কল্যাণ ও সুন্দরের ক্ষেত্রে কোনো মানবতাবাদীই মানে না জাত ও ভূগোল।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতকার ও দার্শনিক। তাই রবীন্দ্রনাথ চেতনা-প্রবণ মানুষমাত্রেরই আত্মীয়। পাক-ভারতে ইতিপূর্বে মানবাত্মার এত বিচিত্র খাদ্য আর কেউ রচনা করেননি। পৃথিবীর ইতিহাসেও এমন রকমারি ফসলের স্রষ্টা সুদুর্লভ! এত বড়ো মানবতাবাদীও ঘরে-ঘরে জন্মায় না। পৃথিবীর আত্মীয়-সমাজে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পরমাত্মীয়। কেননা, যে-ভাষা আমাদের জীবনানুভূতির ও জীবনোপভোগের বাহন, যে-ভাষা আমাদের জীবনস্বরূপ, সেই আত্মার ভাষাতেই আমাদের আত্মার উপজীব্য দিয়ে গেছেন তিনি। এত বড়ো সুযোগ ও সৌভাগ্যকে হেলা করার মতো নির্বোধ হই কী করে! জীবনের সঙ্গে জীবনের যোগ সাধনের যে-দিশা ও দীক্ষা আমরা তাঁর কাছে পেয়েছি, আজকে গরজের সময়ে যদি তা আমাদের পাথেয় করতে পারি, তবেই ঘটবে আমাদের মনের মুক্তি। আর আমাদের চেতনায় পাব মানবতার স্বাদ।
সম্প্রতি জাতির হিতকামী, কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রভাবের মধ্যে অমঙ্গলের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করে শঙ্কিত, আতঙ্কিত কিংবা দুর্ভাবনাগ্রস্ত। রবীন্দ্রসাহিত্য নাকি আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংসী। অন্য কোনো বিদেশী সাহিত্যের কু-প্রভাব কিংবা কুফল সম্বন্ধে কিন্তু চিন্তিত নন তারা। অন্তত তাঁদের কর্মে ও আচরণে এখনো প্রকাশ পায়নি সে-ত্রাস। নইলে ইসলামী রাষ্ট্রের মুমীন নাগরিকের উপর চীন-রাশিয়ার ধনসাম্যবাদী নাস্তিক্য সাহিত্যের প্রভাবের মধ্যে নিশ্চয়ই অমঙ্গল দেখতেন তারা এবং শঙ্কিত হতেন মার্কিনী যৌন ও গোয়েন্দা সাহিত্যের জনপ্রিয়তা দেখে। এ বিষয়ে হিতবুদ্ধিপ্রসূত কোনো অসন্তোষও তাঁদের মুখে প্রকাশ পায় নি কিংবা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা করেছেন বলেও আমাদের জানা নেই।
তাদের এই নিশ্চিন্ত উদারতা দেখে মনে হয়, তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে, একাকিত্বে কিংবা স্বাতন্ত্রে মন-বুদ্ধি-আত্মার বিকাশ নেই, এবং বহির্বিশ্বের আলো-বাতাসের লালন না পেলে জ্ঞান প্রজ্ঞা-বোধের উন্মেষ হয় না কিংবা গণসংযোগ ব্যতীত ভাব-চিন্তা-কর্মের প্রসার অসম্ভব। কেননা, মানুষের জীবন পরিবেশ ও পরিবেষ্টনী নির্ভর। সে-পরিবেষ্টনী যার জগৎ-জোড়া, তার জীবনের বিস্তার ও চেতনার গভীরতা নিশ্চয়ই বেশি। তা হলে তাঁদের রবীন্দ্র-সাহিত্য বিরোধিতার কারণ অন্য কিছু। আমরা অন্তর্যামী নই। কাজেই সে-কথা থাক।
কিন্তু আমাদের অন্য প্রশ্নও আছে। স্বধর্মী বলেই যদি ভারতের জাতীয় কবি গালেব-হালি নজরুল পাকিস্তানী মুসলমানদের প্রিয় ও প্রেরণার উৎস হতে পারেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের অমুসলমান নাগরিকরাই বা কেন তাদের স্বধর্মী বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ প্রভৃতির সাহিত্য পড়ার সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে! হিন্দু-রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পড়ে যদি মুসলমানের সংস্কৃতি নষ্ট হয়, তা হলে হিন্দুর সংস্কৃতি নিশ্চয়ই প্রাণ পায়। পাকিস্তানের অমুসলমানেরও যদি সমনাগরিকত্ব স্বীকৃত হয়, তা হলে তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিচর্চার অধিকারও মেনে নিতে হবে। সংখ্যাগুরুর স্বার্থে সংখ্যালঘুর অধিকার হরণ নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক। অতএব শিশু, ছাত্র, মহিলা, সৈনিক, বুনিয়াদী গণতন্ত্রী প্রভৃতির জন্যে যেমন রেডিয়ো-টেলিভিশনে স্বতন্ত্র আসরের ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনি শক্তি বৈষ্ণব ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরও থাকা উচিত। কেননা, সমদর্শিতাই সুবিচারের পরিমাপক।
মহৎচিত্তের ভাব-চিন্তা জ্যোৎস্নার মতোই সুন্দর, স্নিগ্ধ ও প্রীতিপদ। জ্যোৎস্না কখনো ক্ষতিকর হয় না। ও কেবল আলো ও আনন্দ দেয়, স্বস্তি ও শান্তি আনে আর দূর করে ভয় ও বিষাদ। মহৎসৃষ্টিও মানুষের মনের গ্লানি মুছে দিয়ে চিত্তলোকে আশা ও আনন্দ জাগায়, প্রজ্ঞা ও বোধি জন্মায়, আর জগতে ও জীবনে লাবণ্যের প্রলেপ দিয়ে বৃদ্ধি করে জীবন-প্রীতি,–দীক্ষা দেয় মনুষ্যত্বে ও মানবতার মহিমায় চেতনায়। এই কারণেই তো সাহিত্যরস তথা কাব্যরস ব্রহ্মাস্বাদ সহোদর। জীবনে মানুষ ও প্রকৃতির দেয়া দুঃখ-যন্ত্রণার অন্ত নেই। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ও দর্শন এসব জীবন-যন্ত্রণা ভুলবার অবলম্বন। তা থেকে বঞ্চিত হলে কী করে বাঁচবে হৃদয়বান চেতনা-প্রবণ মানুষ!