.
০৪.
আবার এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার ছিদ্রপথে আরো ক্ষতিকর বিভ্রান্তির প্রসার ঘটছে। আমাদের রাষ্ট্রবাসীরা সুযোগ-সুবিধে মতো কখনো ইসলামী জাতীয়তার, কখনো বা রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার অঙ্গীকারে চলে। এমনকি গোত্রভিত্তিক জাতীয়তাও চেতনার গভীরে ক্রিয়াশীল। তাই প্রায় প্রতি নাগরিকই এই দ্বৈতসত্তার পীড়ায় অসুস্থ। ফলে পাঠান-বালুচ-সিন্ধি-পাঞ্জাবি বাঙালি সত্তার সঙ্গে কখনো মুসলিম-চেতনার কখনো বা পাকিস্তানী-চেতনার যোগে-বিয়োগে রাষ্ট্রিক জাতীয়তা দৃঢ়মূল হবার অবকাশ পাচ্ছে না। প্রত্যয় ও অঙ্গীকারের মেল-বন্ধন না হলে সমস্যার সমাধান নেই।
মনকে চোখ ঠাওরিয়ে যদি গোঁজামিলে মিলনসেতু তৈরি করি, কিংবা ফাঁকি দিয়ে ফাঁক পূরণ করি, তাহলে না-ঘরকা না-ঘাটকা-চেতনা প্রশ্রয় পাবেই এবং তাতে রাষ্ট্রিক স্বার্থ ব্যাহত হবেই।
অজ্ঞতা, অন্ধতা ও ভাবাবেগ মানব-চৈতন্যের স্থায়ী অবস্থা নয়, কাজেই অবাস্তব-অযৌক্তিক কিছু বেশিদিন টেকে না। সে-যুগ আর নেই, যখন ইসলাম-বিদ্বেষী কামাল আতাতুর্ক ছিলেন পাক ভারতীয় মুসলমানের চোখে জাতীয় বীর ও ইসলামের ত্রাণকর্তা। তিনি কোরান, মসজিদ ও আরবি-অসহিষ্ণু হলেও তাকে নিয়ে স্বধর্মীর গৌরব-গর্বে ও এদেশের মুসলমানের মাতামাতির অন্ত ছিল না। প্যান-ইসলামী সে-আবেগ আজ বিলুপ্ত। তাই খ্রীস্টান রাষ্ট্রগুলো তো বটেই। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও–মিশর, মরোক্কো, সুদান, আলজিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতিও ধর্মীয় আবেগ থেকে মুক্ত। আজ দুনিয়ার সব রাষ্ট্রই–ধর্মভিত্তিক নয়-রাষ্ট্রসীমা ভিত্তিক জাতীয়তায় আস্থাবান এবং এ অঙ্গীকারেই সমৃদ্ধিকামী।
আমাদের ছাত্ররা দেশের ইতিহাস ও সাহিত্য-গ্রন্থে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার এই বিভ্রান্তিকর দ্বৈতবোধই লাভ করে। ফলে তাদের জাতীয়তাবোধ প্রয়োজনানুরূপ ঋজু, পষ্ট ও দৃঢ় হয় না। এ জাতীয়তাবোধের ভিত্তি চোরাবালি, ফলত রাষ্ট্রের পক্ষে মারাত্মক।
ধর্মীয় জাতীয়তায় আস্থা রাখলে, ইরানী, আফগানী প্রভৃতি যে-কোন বিদেশী স্বধর্মীর শাসনে এ দেশের লোক নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করবে, যেমন তুর্কী-মুঘল আমলে দেশী মুসলমানরা শাসকের স্বাধৰ্ম গর্বে খুশি থাকত। আজকের জগতে এহেন নির্বোধ আত্মপ্রসাদ কাম্য কি! অতএব, তুর্কী-মুঘল আমলে দেশী মুসলমান স্বাধীন ছিল কি-না, গৌড়ের স্বাধীন সুলতানী আমল বাঙালিরও স্বাধীনতার যুগ কি-না, মুঘল সুবাদার আলীবর্দী-সিরাজদ্দৌলার শাসন বাঙলাদেশে বাঙালির স্বরাজের প্রতীক কি-না বিচার-বিবেচনা করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সময় এসেছে।
আরো একটি ভাববার কথা আছে। বিধর্মীর সঙ্গে রাষ্ট্রিক যুদ্ধে যেহাদী-প্রেরণা-পন্থা গ্রহণ করলে স্বধর্মীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধে কোন্ প্রেরণা কাজ করবে? মনে রাখা দরকার যে রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবোধ দৃঢ়মূল হলেই মানুষ স্বদেশের স্বার্থে সর্বাবস্থায় সংগ্রামী প্রেরণা পায়। কাজেই আশুপ্রয়োজন মিটানোর জন্যে জাতীয়তাবোধের মতো অতি গুরুতর ধারণার সংকোচন-প্রসারণে যথেচ্ছ অপব্যবহার পরিণামে অহিতকর।
জীবন, সমাজ ও সাহিত্য
কলাবিদেরা বলেন, যেখানে Photography-র শেষ; সেখান থেকেই চিত্রকলার শুরু। যেখানে কথার শেষ, সেখান থেকেই সুরের আরম্ভ। প্রয়োজন ছাড়িয়েই সৌন্দর্যের প্রতিষ্ঠা, নকশা অতিক্রম করেই সাহিত্যের সৃষ্টি। স্বাভাবিক ভঙ্গির অস্বীকৃতিতেই নৃত্যের উদ্ভব। কাজেই কলা মাত্রেই কৃত্রিম। তুচ্ছকে উচ্চ করে তোলা, ক্ষুদ্রকে বৃহৎ করা, কৌৎসিত্যে লাবণ্য দেয়া, সরলকে জটিল করা, ঋজুকে বক্র করে তোলা, সামান্যকে অসামান্যতা দেয়া, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা কলা-শিল্পীর দান। যা নেই তা সৃজন করা, যা কাম্য তা পাইয়ে দেয়াই শিল্পীর দায়িত্ব। অতএব, স্বাভাবিকতায় শিল্প নেই। অতিক্রান্ত স্বভাবই শিল্পকলা। তাই শিল্পীমাত্রেই স্রষ্টা। এবং স্রষ্টা কখনো অনুকারক হতে পারেন না। অথবা কোনো অনুকারকই স্রষ্টার সম্মান পান না। অতএব সৃষ্টি মাত্রেই মৌলিক।
যা আছে তা নয়, যা থাকা উচিত, যা শ্রেয় কিংবা প্রেয়, এমনকি যা প্রয়োজন তার স্বপ্ন দেখা, অন্যের মনে সে-স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাই শিল্পীর ব্রত। এই অর্থে সাহিত্যাদি কলা একাধারে জীবন স্বপ্নের উৎস, আধার ও প্রতিচ্ছবি। অতএব, শিল্পকলা চিরকালই জীবন-স্বপ্নের রূপায়ণ ঘটিয়েছে, জীবনের প্রয়োজনই মিটিয়েছে। কাজেই Art for arts sake বলে যে-বাজে কথাটা রটেছিল, তাতে না ছিল ইতিহাসের সমর্থন, না ছিল শিল্পবোধের পরিচয়।
কেননা মানুষের কোনো কর্ম বা আচরণ প্রয়োজন-নিরপেক্ষ হতে পারে না। এ প্রয়োজন অবশ্যই মানস অথবা ব্যবহারিক হবে। এ প্রয়োজন নিয়ম-নীতি-নিয়ন্ত্রণ মানে না এবং মানুষে মানুষে তা অভিন্নও নয়। এ প্রয়োজন স্কুল কিংবা সূক্ষ্ম, বাহ্য কিংবা আন্তর, বৈষয়িক কিংবা মানসিক, পার্থিব কিংবা আধ্যাত্মিক হতে পারে। তাই এ প্রয়োজন বিচিত্র ও বহু। মানুষের জীবনবোধ ও প্রয়োজনবুদ্ধি বিশ্বাস, সংস্কার, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অজ্ঞতা, বিস্ময়, কল্পনা, বোধ, বুদ্ধি, ভীতি, সাহস, ভাব-চিন্তা, উপলব্ধি, উপযোগবুদ্ধি, রূপচেতনা প্রভৃতি অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। সেজন্যেই তা আপেক্ষিক। এগুলোর আনুপাতিক উপস্থিতি ও অভাবই মানুষের জীবনবোধে ও শ্ৰেয়োচেতনায় বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন দান করে। তাই কারো ভাল কারো কাছে মন্দ, একের কাছে যা অপরিহার্য, তা-ই অন্যের কাছে বিলাস মাত্র। ফলে সমাজে, সাহিত্যে, শিল্পে ও দর্শনে জীবনবোধের ও জীবনদৃষ্টির প্রকাশ বিচিত্র ও বহুধা। এজন্যেই শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনকে জাতীয়, ধর্মীয়, নৈতিক কিংবা সামাজিক রূপ দেয়ার নির্দেশ দান নির্বুদ্ধিতায় পরিচায়ক। কেননা জীবনবোধ ও উপযোগবুদ্ধি ফরমায়েশে তৈরি হয় না। চেতনানুসারেই মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্ম অভিব্যক্তি পায়। ফলে কেউ জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ, কেউ ধর্মীয় বোধে অনুপ্রাণিত, কেউ সমাজচিন্তায় বিব্রত, কেউবা জীবনের নৈতিক গুরুত্বে আস্থাবান। তাই সবাইকে নির্দেশে নিবর্ণ করার অভিপ্রায় শিল্পতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান প্রজ্ঞা-মননের দৈন্যপ্রসূত। মানুষ মেশিন নয়, কাজেই তার কাছে অভিন্ন ভাব-চিন্তা-কর্মের পৌনপুনিকতা কিংবা অভীষ্ট রূপ বা ফল, আশা করা বাতুলের দিবাস্বপ্ন মাত্র।