উনিশ শতকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কৃত্রিম জাতীয়তা সৃষ্টির প্রয়াসে য়ুরোপ-আমেরিকায় বহু রক্তারক্তি হয়ে গেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ প্রয়াস নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ শতকে আবার তার পুনরাবৃত্তি চলছে আফ্রো-এশিয়ায়। হয়তো কেবল পরিণামে ব্যর্থ হবার জন্যেই।
আবার এর উল্টো সাধনাও লক্ষ্য করি– দেশ ভাগ করে জাতি-চেতনাকে খণ্ডিত করার অভিনব অপপ্রয়াস-সিরিয়া, কোরিয়া, জার্মানী, ইন্দোচীন প্রভৃতি স্মর্তব্য।
এই উভয়বিধ অপপ্রয়াস চলছে রক্তের অভিন্নতার প্রমাণে, ভৌগোলিক অবিচ্ছেদ্যতার যুক্তিতে অথবা আদর্শের ধ্বনি তুলে, ধর্মের দোহাই দিয়ে কিংবা আর্থনীতিক প্রয়োজনের গুরুত্ব দেখিয়ে। আসল কারণ শাসন-শোষণের লোভ। নইলে বিচ্ছিন্নতার প্রয়োজনে এক প্রকারের যুক্তি, আর সংহতির-বাঞ্ছয় বিপরীত যুক্তি একই কালে একই মুখ দিয়ে বের হতে পারত না। তাই কোথাও রক্ত, কোথাও ভাষা, কোথাও ধর্ম, আবার কোথাও আদর্শ কিংবা অর্থনীতি গুরুত্ব পাচ্ছে। দুষ্টবুদ্ধি প্রসূত না হলে নীতির ও যুক্তির এ অসঙ্গতি থাকত না।
.
০৩.
আমাদের পাকিস্তানও এ সমস্যার স্বীকার। বৃটিশ আমলে হিন্দুর পীড়নজাত প্রতিক্রিয়ার ফলে ভারতে মুসলমানেরা ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়ে উঠে। এর ফলে গড়ে উঠে পাকিস্তান রাষ্ট্র। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিবেশে আগের আবেগ ও স্বপ্ন অবলুপ্ত। তাই নতুন করে দেখা দিয়েছে জাতীয়তাবোধ সুষ্ঠু করার প্রয়োজন।
ধর্মীয় অভিন্নতাই পাকিস্তানী জাতীয়তার একমাত্র ভিত্তি। শাসন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিষম নীতি অনুসৃতির ফলে কেবল ধর্মীয় বন্ধন জাতীয়তার ভিত দৃঢ় রাখতে পারছে না। প্রবল পক্ষের প্রতি দুর্বল পক্ষের বর্ধিষ্ণু বিরূপতা রোধ করবার প্রয়াসে তাই সমাজ-সংস্কৃতির অভিন্নতা প্রমাণের অপচেষ্টা শুরু করেছেন সবল পক্ষ।
রাজনীতিক স্বার্থে গড়ে উঠেছে স্ব-ধর্মভিত্তিক এ জাতীয়তা। প্রীতিপ্রসূত নয় বলেই আত্মরতি হয়েছে প্রবল। শাসক-শাসিত তথা পীড়ক-পীড়িত সম্পর্কের উচ্ছেদ সাধন করে সাম্য ও সমদর্শিতার ভিত্তি রচনায় তাই আগ্রহ নেই তাদের। শোষণ কায়েম রাখবার কুমতলবে তারা শোষণ ও সম্প্রীতির ভারসাম্য স্থাপনে প্রয়াসী। এজন্যে তাঁরা এককালে একক ভাষার ফজলিয়ত বয়ান করেছেন, তারপর চালু করতে চেয়েছেন অভিন্ন হরফ, তারও পরে শুরু করেছেন আরবি ফারসি শব্দের মহিমা প্রচার। এ সঙ্গে রয়েছে বর্ণ ও বানান সংস্কারের জিকির। নায়ক রয়েছেন নেপথ্যে। ছদ্মনায়ক সেজেছেন যাঁরা, তাঁরা সব আমাদের ঘরের লোক। তাই যন্ত্রী ও যন্ত্র-চালিতের পার্থক্য বোঝা কঠিন। বিড়ম্বনাও বাড়ছে এজন্যেই। শিক্ষিত সরলজনেরা তাই বিভ্রান্ত কিংবা বিমূঢ়।
তবু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব যে বর্ণে-অবয়বে, মনে মেজাজে, বিশ্বাসে-সংস্কারে, আহার্যে-পোশাকে, আচার-আচরণে, ভাষায়-সংস্কৃতিতে–এককথায় জীবন-চর্যার সর্বক্ষেত্রে যে পার্থক্য ঘটায় তা ঢাকা দেবার জন্যে তাই এবার সেই পুরোনো জিকির আবার শুরু হয়েছে পাকিস্তান হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানের জন্যেই, ইসলাম দেশ-কাল-জাত জন্মের পার্থক্য স্বীকার করে না। অতএব, সারা পাকিস্তানে মুসলমানের জীবন-চর্যা হবে অভিন্ন। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানে যা নেই, পূর্ব পাকিস্তানে তা চলবে না–চলা উচিত হবে না। কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানীরা হচ্ছে আদমের আমল থেকেই মুসলমান আর পূর্ব পাকিস্তানীরা হচ্ছে ইসলামোত্তর যুগের দীক্ষিত মুসলমান! কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানীর অভিভাবকত্বে চলবে পূর্ব পাকিস্তানীর মুসলমানী জীবন। পশ্চিম পাকিস্তানের পাকা মুসলমানেরা যা কিছু করে, তা-ই হবে পূর্ব পাকিস্তানের অনুকরণীয়–কেননা এই কাঁচা মুসলমানের জন্যে তা-ই শ্রেয়। অতএব, রবীন্দ্ৰতিথি, বসন্তোৎসব কিংবা নববর্ষ বেদাৎ বলেই মুমীনের পরিহার্য। বাঙলাদেশ, বাঙলা ভাষা, বাঙালি প্রভৃতি আমল-ই-জাহিলিয়তের নামগুলো ভুলে যেতে হবে। সত্যের আলোক প্রাপ্ত মুমীন বলবে–পাকিস্তান, পাকজবান, পাকিস্তানী। মুসলমান হওয়া কি যেমন-তেমন কথা! মুসলমান করার ও মুমীন রাখার মহান ব্রত ও দায়িত্ব নিয়েই পাক সরজমিনে গড়ে উঠেছে ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামের অছি-সরকার। এ-ই যদি না হল তাহলে যে সবই বৃথা!
কথাগুলো শুনতে বিদ্রুপাত্মক বটে, কিন্তু এসব হাস্যকর যুক্তিই অত্যন্ত গুরু-গম্ভীর ভাষায় উচ্চারিত হয়। অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও সরল লোকেরা শুনে মুগ্ধ হয়, চরিত্রবান অক্ষম দেশহিতৈষীরা বেদনাবোধ করে, আর বিষয়ীরা এর থেকে ফায়দা উঠায়।
কিন্তু এ যুগে এটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ানোর কোনো কারণ ছিল না। কেননা, সমস্বার্থে মিলিত হওয়া, ঐক্যবদ্ধ হওয়া, সহ-অবস্থান করা এ যুগেই সম্ভব ও সহজ। বলতে গেলে এ যুগ কেবল জাতীয়তার নয়–আন্তর্জাতীয়তারও। ভৌগোলিক দূরত্ব, গোত্রীয় বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র, ভাষার পার্থক্য ও ধর্মীয় প্রভেদ এ যুগে মিলনের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সৌজন্য, সমদর্শিতা ও সমস্বার্থের ভিত্তিতে আজকাল পৃথিবীর দুই বিপরীত প্রান্তের লোকও একরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় একক জাতি গড়ে তুলতে পারে। আবার দুষ্টবুদ্ধি যে একক দেশ ও জাতিকে সহজেই বিভক্ত করতে সমর্থ তা আগেই বলেছি।