সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে কেউ কেউ অনুযোগ করছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিবেশী মুসলমান সমাজকে অবহেলা করেছেন (এমনকি মুসলিম বিদ্বেষের অভিযোগও আছে)। শরৎচন্দ্র সম্বন্ধেও অনুরূপ কথা শোনা যায়। যারা এই নিন্দা উচ্চারণ করেন, তাঁরা কবি-সাহিত্যিক। তারাই আবার দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচারক। তাহলে হিন্দুর কাছে তাঁরা এই দাবী করছেন কেন? বঙ্কিমচন্দ্রের মতো এঁরা মুসলমানকে গালি দেননি, এটাই কি যথেষ্ট সৌজন্য ও উদারতা নয়? এদিকে তারা নিজেরা গত বিশ-ত্রিশ বছর ধরে হিন্দু-বিদ্বেষ প্রচার করেছেন। তাঁদের কোনো লেখায় হিন্দু-প্রীতি কিংবা সহিষ্ণুতার আভাস মাত্র নেই। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানীর শতকরা দশজন হিন্দুর নাগরিকত্ব তারা মুখে স্বীকার করেন বটে, কিন্তু ওদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক অধিকারও কার্যত অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই তাদের। নইলে ভাষা বদলাও, হরফ বদলাও, আরবি-ফারসি শব্দ বসাও কিংবা বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ বর্জন করো প্রভৃতি যখন তারা বলেন তখন তাঁরা দেশী হিন্দুর কথা ভাবেন না। সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে মুসলমানদের যা বর্জনীয়; হিন্দুর তাই বরণীয়। কাজেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিজের স্বার্থে অন্যের অধিকার হরণ কিংবা অন্যকে সমসুযোগ থেকে বঞ্চিত করা নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক অবিচার। আশ্চর্য, সর্বক্ষণ হিন্দু-বিদ্বেষ ও হিন্দুভীতি মনে পোষণ করেন যাঁরা, তাঁরাই রবীন্দ্রনাথের কাছে আশা করেছেন উদারতা ও প্রতিবেশীসুলভ প্রীতি, অথচ নিজেরা সে-উদারতা, সৌজন্য ও প্রীতির সুনশীলনে অনিচ্ছুক। মানুষের অবিবেচনারও একটা সীমা আছে। এ অনুযোগ যেন তাও অতিক্রম করছে। আমার বাড়ি যেতে কী নিয়ে যাবে আর তোমার বাড়ি গেলে কী খাওয়াবে-ন্যায়ের মতো এটিও একপেশে ন্যায়। রবীন্দ্রনাথেরা যে-ভুল ও অন্যায় করেছেন বলে তাঁরা মনে করেন, নিজেদের সে-ক্রটি থেকে মুক্ত রেখে ভবিষ্যতের মানুষের জন্যে আদর্শ স্থাপন করাই ছিল তাদের কর্তব্য। কিন্তু সে-ঔচিত্যবোধের আভাস নেই তাঁদের চিন্তনে কিংবা বচনে।
আরো একটি অপযুক্তি তারা প্রয়োগ করে থাকেন। তারা বলেন নজরুল এ ব্যাপারে আদর্শ। তিনি অসূয়ামুক্ত থেকে হিন্দু-মুসলমান ও তাদের ঐতিহ্যকে সমভাবে ভালবেসেছেন। তারা ভুলে যান যে মুসলমানেরা দেশগত পরিবেষ্টনীর প্রভাব এড়াতে পারেননি, তাই মুসলমানমাত্রেরই রচনায় দেশীয় ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটেছে। মধ্যযুগ থেকে বিশ শতকের প্রথম পাদ অবধি মুসলমানদের রচনায় এ মিশ্রণ দৃশ্যমান। হিন্দুর দেশ ও ধর্ম অভিন্ন অঞ্চলের, তাই যা দেশী তা ধর্মীয়ও বটে। এইজন্যেই হিন্দুর রচনা পুরোপুরি হিন্দুয়ানী বলে চিহ্নিত করা যেমন সহজ; তেমনি কঠিন নয় মুসলিম মনের উদারতা ও গ্রহণশীলতা প্রমাণ করাও। উভয়েই ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে মানবতাবাদী হওয়া সত্ত্বেও নজরুল ইসলামের অবচেতন উদারতার কারণ এই তত্ত্বেই নিহিত এবং রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির হিন্দুয়ানীর রহস্যও এ-ই। অতএব একের সৌজন্য ও উদারতা এবং অপরের সংকীর্ণচিত্ততা ও অনুদারতার সাক্ষ্য নয় এসব।
কাজেই আস্তিক মানুষের মধ্যে স্বধর্মনিষ্ঠ কেউ যদি প্রকাশে বিজাতি-বিদ্বেষ ব্যক্ত না করে থাকে–হোন না তিনি প্রতিবেশীর প্রতি অবহেলাপরায়ণ, তাহলেও তাকে উদার-হৃদয় সহিষ্ণু-সুজন বলে তারিফ করা উচিত।
জাতীয়তা
০১.
দার্শনিক পরিভাষায় প্রতিটি মানুষ হচ্ছে বিশিষ্ট দ্বৈতাদ্বৈত সত্তা। সামান্য তাৎপর্যে, দেশ, কাল, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, নীতি ও আদর্শের অভিন্নতা যেমন বিশেষ দেশ, ধর্ম ও রাষ্ট্ৰান্তৰ্গত মানুষকে অদ্বৈত বর্ণে ও গুণে প্রতীয়মান করে; তেমনি আবার ঘরের, দেশের, সমাজের, ধর্মের কিংবা আদর্শের প্রভাব প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র রাখে। বর্ণে ও অবয়বে, চলনে ও বলনে কিংবা স্বভাবে ও আচরণে যেমন প্রতিটি মানুষ অনন্য, তেমনি আবার আপাত অভিন্ন জীবন-রীতি মানুষকে করেছে সমষ্টির নিরূপ অংশ। প্রথমটির নাম ব্যক্তিত্ব (Personality) এবং দ্বিতীয়টি জাতিত্ব (Nationality)। এভাবে ব্যষ্টি (individual) নিয়ে গড়ে উঠে সমষ্টি (Nation)। অতএব, প্রতি মানুষের রয়েছে এই দ্বৈতসত্তা। একটি ব্যক্তিসত্তা, অপরটি জাতি-পরিচয়। একটির জন্যে অপরটি অস্বীকার বা অবলুপ্ত করবার প্রয়োজন হয় না। একাধারে এই দ্বৈতসত্তার নির্দ্বন্দ্ব সহাবস্থান বা সংস্থিতি সম্ভব। এ জাতীয়তা অবশ্যই অভিন্ন দেশ, ধর্ম, ভাষা ও সমাজ ভিত্তিক।
.
০২.
আধুনিককালে অভিন্ন গোত্র, ভাষা, সমাজ, ধর্ম ও ভৌগোলিক সংস্থান নিয়ে যেসব রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, সেখানকার সমস্যা ভিন্নতর। সেখানে দ্বন্দ্ব জনকল্যাণ সম্পর্কিত আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগত। আর বিভিন্ন গোত্র, ভাষা, সমাজ ধর্ম ও ভৌগোলিক-চেতনা ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোর সমস্যা মূলত রাষ্ট্রিক-চেতনাজাত অভিন্ন জাতির পরিচয়, বিশ্বাস ও সংস্কার দৃঢ়মূল করার উপায় ও প্রয়াস পদ্ধতির। আজকের পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র ও এ অসমাধ্য সমস্যায় পীড়িত। বস্তুত এ সমস্যা এ যুগেরই। আগের কালে রাজা-প্রজার সম্পর্ক ছিল শাসক ও শাসিতের, প্রবলের ও দুর্বলের, শোষক ও শোষিতের, সেজন্যে সে-যুগে এ সমস্যা ছিল না। শাসকের শক্তির তারতম্যে রাজ্য-সাম্রাজ্যের স্থিতি ও ভাঙা-গড়া চলত। এ যুগ গণতন্ত্রের ও জাতীয়তার এবং রাজ্যের নয়–রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রে প্রতি মানুষের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের স্বীকৃতিতে জাতি-চেতনা ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ও স্থিতি। অনেকাংশে এ এক সমবায় সংস্থা। এজন্যেই একক অভিন্ন জাতি-চেতনায় জাতীয়তাবোধ না জন্মালে, এ যুগে কোনো রাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় বাস করা ও স্বাভাবিক আনুগত্য রাখা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই রাষ্ট্রমাত্রেই হবে mono-national state-এক জাতি এক রাষ্ট্র।