বাঙলা দেশেও হিন্দু-মুসলমানে যে আন্তরিক সম্প্রীতি ছিল না, তার প্রমাণ রয়েছে বাঙলা সাহিত্যে। এতে কিন্তু অস্বাভাবিক বা নিন্দনীয় কিছু দেখতে পাইনে আমরা। কেননা সাধারণ মানুষের জীবন চিরকালই ধর্ম নিয়ন্ত্রিত। ধর্ম হচ্ছে সাধারণের জন্যে বিধি-নিষেধের সমষ্টি; ইহলোকে পরলোকে প্রসারিত জীবনের দিশারী। স্থূলবুদ্ধি ও অজ্ঞ সাধারণ মানুষ যুক্তি ও চেতনা দিয়ে জীবনোপভোগ করে না–লব্ধ নিয়ম-নীতির অনুসরণেই সে যাপন করে জীবন। বিধি নিষেধের বেড়ার সীমিত পরিসরে বিবেক-বুদ্ধিকে সে-সব নীতির অনুগত রেখে সে থাকে আশ্বস্ত ও নিশ্চিত। সে হয়ে উঠে পোষমানা প্রাণী–তার জীবনও তাই যান্ত্রিক। সেজন্যে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে ধার্মিক তথা আস্তিক মানুষের একটিমাত্র মতই আছে–তা হচ্ছে ধর্মমত। ধর্ম তার ঐহিক ও পারত্রিক জীবনে কল্যাণ ও শ্রেয়সের উৎস। এর বাইরে কোনো ভাল থাকতে পারে কিংবা তার ধর্মবিধানে কোনো ত্রুটি থাকা সম্ভব, তা সে ভাবতেও পারে না। এমনকি তা ভাবা পাপও। যেহেতু মানুষের ধর্মবুদ্ধি গোত্রীয় সংহতি ও কল্যাণ চেতনায় আচ্ছন্ন, সেহেতু ভিন্ন ধর্মের লোককে সে পর ও শত্রু না ভেবেই পারে না। এবং শক্রর প্রতি প্রীতি কেবল আত্মধ্বংসী অকল্যাণই যে আনে তা নয়, সে-কারণে স্বধর্মে নিষ্ঠাহীনতার পাপও স্পর্শ করে। তাই পরধর্ম ও বিধর্মী বিদ্বেষ বা ঘৃণাই ধার্মিক মানুষের স্বধর্ম নিষ্ঠার এবং আদর্শজীবনের লক্ষণ। এজন্যেই সাধারণত ধার্মিকেরা গোড়া, অনুদার ও বিবেক-বুদ্ধিহীন। স্বাধীন চিন্তা, উদার দৃষ্টি ও নিরপেক্ষ বিচার-বুদ্ধি কিংবা বিশুদ্ধ মানবতাবোধ জন্মাতেই পারে না তাদের রুদ্ধদ্বার মনে।
বাঙলা সাহিত্যেও তাই দেখতে পাই, ধার্মিক মানুষেরাই বিধর্ম ও বিধর্মী বিদ্বেষী। এক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যিকদের সমভাবেই উৎসাহী দেখি। মধ্যযুগে নিরঞ্জনের রুম্মাতেই প্রথম বৌদ্ধ-হিন্দুর বিদ্বিষ্ট সম্পর্কের সংবাদ পাই। বিজয়গুপ্ত প্রভৃতির মনসামঙ্গলে, বৃন্দাবনদাস, জয়ানন্দ, লোচনদাস প্রভৃতির চৈতন্যচরিত গ্রন্থে, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে, কৃষ্ণরামের অন্নদামঙ্গলে, সহদেব চক্রবর্তীর অনিল পুরাণ প্রভৃতিতে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। আবার জায়নুদ্দীনের রসুলবিজয়ে, শাবারিদ খানের রসুলবিজয়ে ও হানিফার দিগ্বিজয়ে, সৈয়দ সুলতানের জয়কুম রাজার লড়াই-এ, গরীবুল্লাহর সোনাভানে, সৈয়দ হামজার জৈগুনের কিস্সাতে এবং কোনো কোনো পীরপাচালীতে হিন্দু ও হিন্দুয়ানীর, কাফের ও পৌত্তলিকতার প্রতি অবজ্ঞা অসৌজন্য সুপ্রকট।
আধুনিক কালে প্যারীচাঁদ মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, যোগীন্দ্রনাথ বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ অনেকের রচনায় যেমন মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, বিদ্রূপ ও অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ (অমিয় ধারার তিনটে কবিতায় অশ্লীল ভাষায় হিন্দুর নিন্দা করা হয়েছে), ইসমাইল হোসেন শিরাজী, ডাক্তার আবুল হোসেন, শেখ ইদরিস আলী প্রভৃতির রচনায় হিন্দু বিদ্বেষ সুপ্রকট। এছাড়া প্রায় সব হিন্দু ও মুসলমান লেখকের রচনায় প্রতিবেশী বিধর্মীর প্রতি কটাক্ষ, অশ্রদ্ধা কিংবা অবহেলা দৃশ্যমান।
এসব লেখকদের কেউ নাস্তিক নন, তাঁরা ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী। তাঁদের জীবন গোত্রীয় সংহতি চেতনার আধুনিক রূপান্তর ধর্মীয় ঐক্যবোধে নিয়ন্ত্রিত। তাই বাঙালি হিন্দু প্রেরণা খুঁজেছে উত্তর ভারতের আর্য ও রাজপুত ঐতিহ্যে এবং বাঙালি মুসলমানের প্রেরণার উৎস হয়েছে আরব ইরানীর ঐতিহ্য। দেশগত জীবন ও ঐতিহ্য বিশেষ শ্রদ্ধা পায়নি কারো। এই মনে বিধর্মী-বিদ্বেষ না থেকেই পারে না, কেননা তাদের স্বাজাত্য দেশগত নয়, ধর্মগত। কাজেই তাদের স্বাজাত্য স্বাধর্মেরই নামান্তর। মনের দিক দিয়ে কোনো আস্তিক মানুষই স্বাধীন ও স্বস্থ নয়। তাই বিবেক, বুদ্ধি ও বিচারশক্তির স্বাধীন ও যৌক্তিক তথা নিরপেক্ষ মানবিক প্রয়োগ তাদের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই এঁদের এই মানস অভিব্যক্তির মধ্যে নিন্দনীয় কিছু নেই–মোহপাশবদ্ধ মানুষের আত্মিক অপমৃত্যুর জন্যে আমরা কেবল বেদনাবোধ করতে পারি, তাদের জড় বিবেকে চেতনা সঞ্চারের চেষ্টাও হয়তো করা সম্ভব, কিন্তু সাফল্যের আশা সামান্য। গোত্রীয় উত্তন্মন্যতা, ধর্মীয় জাতীয়তা, রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা কিংবা আধুনিক মতবাদ প্রসূত ঐক্যবোধ তথা গোষ্ঠী-চেতনা আজ বিশ্বমানবের স্বস্তি ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে এক মারাত্মক হুমকি। আজ পৃথিবীব্যাপী এ সমস্যা দুষ্ট ক্ষতের মতো বিরাজমান। বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্র-চেতনা এই তিনটেই মানবিকতা ও মানবতার দুশমন। আজকের দুনিয়াব্যাপী খুনোখুনি ও কাড়াকাড়ির মূল কারণ। অধিকাংশ মানুষ এই বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্যবোধের ঊর্ধ্বে না উঠলে অর্থাৎ এসব ব্যাপারে স্বাতন্ত্র্যবোধ পরিহার না করলে অশান্তি ও বিপর্যয় থেকে আজকের পৃথিবীর মুক্তি নেই।
মানুষের এই শোচনীয় অবস্থায় সব দেশেই কিছু সংখ্যক মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিক, মানবতাবাদী ও মানবদরদী জ্ঞানী-মনীষী ও কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক কল্যাণের পথে, শ্রেয়সের দিকে, উদারতার খোলা প্রাঙ্গণে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন শান্তি, প্রীতি ও মানবতার নামে। কিন্তু তাদের প্রভাব দুর্লক্ষ্য।