কেননা ব্যক্তিস্বার্থে ও আদর্শে কোনো বিরোধ নেই। মৌল ও বৃহত্তর অর্থে যা ব্যষ্টির তাই রাষ্ট্রের আর যা রাষ্ট্রের তাই ব্যষ্টির। এ উপলব্ধি থেকেই আজকাল কেবল সার্বভৌমত্বই রাষ্ট্রের চরম ও পরম লক্ষ্য বলে গণ্য হয় না, নাগরিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকেও সমগুরুত্ব দেয়া হয়। এজন্যেই সার্বভৌমত্বের অভিযান ত্যাগ করে কোনো কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র জনকল্যাণের খ্যাতিরে অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত বা যৌথ সংস্থাও গঠন করেছে। বিশেষ দৃষ্টিতে UNO-ও রাষ্ট্র কল্যাণের বনামে জনকল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান।
এখন একটি কঠিন প্রশ্ন জাগছে : রাষ্ট্রের আদর্শ নির্ণয় ও নির্ধারণ করবে কে? যারা ভোট পেয়ে রাষ্ট্র পরিচালক হন তাঁরা, না যারা ভোট দেয় সেই জনসমাজ? এর সহজ জবাব হয়তো এই যে যেহেতু জনসাধারণ তাদের পছন্দসই লোককে রাষ্ট্র পরিচালনের ভার দেয়, অর্থাৎ তাদের পক্ষ হয়ে চিন্তা ও কর্ম করবার দায়িত্ব অর্পণ করে, অন্যকথায় তাঁদের রাষ্ট্রিক চিন্তায় ও কর্মে প্রতিনিধিত্ব করবার অধিকার দেয়, সেজন্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রাদর্শ নির্ধারণ ও শাসন পরিচালন ব্যাপারে সার্বিক ক্ষমতার অধিকারী। আপাতদৃষ্টিতে এ জবাব যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও এ একান্তই স্কুলবোধ প্রসূত। কেননা, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি নির্বাচকরা শিক্ষিত হলেও প্রয়োজনানুরূপ দায়িত্ব সচেতন ও চৌকশ নয় এবং নির্বাচিত ব্যক্তি মাত্রেই যোগ্য নয়। কাজেই এ ব্যাপারে ভোটাধিক্যে গুরুত্ব দেয়া যাবে না, মেধা-মাহাত্মে তথা মনীষাকেই মূল্য দিতে হবে। তাহলে সমাজের চিন্তানায়ক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, মনীষী প্রভৃতি গুণী-জ্ঞানী বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের মতামতকে জনমত বলে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হয়। এঁদের নির্ভরযোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব এই যে এঁরা বাক-চাতুর্যে, চিন্তার প্রাখর্যে, বুদ্ধির দীপ্তিতে দূর ও অখণ্ড দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় বর্তমানের স্বরূপ এবং ভবিষ্যতের দিশা সহজেই খুঁজে পান, আর সহজেই মন ও মত গঠন করতে পারেন। জনমত সৃষ্টি ও পুষ্টি সাধনে বা বিনষ্ট করণে, কিংবা সভা, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বা ভাঙ্গনে এঁদের জুড়ি নেই। এঁরা যথার্থ অর্থে জনগণ মন অধিনায়ক। পৃথিবীর ইতিহাস-ধৃত চিন্তানায়কগণের কথা স্মরণ করলেই এর যাথার্থ বোঝা যাবে। কাজেই রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই দেশের ঐতিহাসিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী প্রভৃতি গুণী-জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীদের অবাধ চিন্তার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক।
পাকিস্তানে একজন রাষ্ট্রপতি একবার এর ন্যায্য গুরুত্ব উচ্ছ্বাসবেশে উচ্চারণ করেছিলেন : Feel free in your mind, act freely in your expression and react freely to the environments around you. Let not the edge of your sensitivity be blunted by any sense of fear or expediency. On my behalf I cannot do better than assure you in the spirit of Voltair, that I may differ, even protest, against what you say but I will defend your right to say it unless it is directed against the very existence of our homeland.
এ উদাত্তবাণী কেবল শ্লাঘ্য নয়, যুগান্তকরও। এ নীতি সরকার কর্তৃক অনুসৃত হলে জীবনে ও সমাজে শান্তি ও মুক্তির স্বাচ্ছন্দ্য আসত।
জাতিবৈর ও বাঙলা সাহিত্য
আদিম মানুষের মন-বুদ্ধির বিকাশের ফলে তাদের মধ্যে জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই প্রয়োজন-বুদ্ধিই তাদের সংহতি দান করে। সেদিনকার হাতিয়ার-বিরল অজ্ঞ মানুষ জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে সংহতি ও সহযোগিতার মধ্যেই সন্ধান পায় নতুন শক্তির ও সম্ভাবনার। স্বনির্ভর অসহায় জীবনে এভাবে নতুন ভরসা ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে প্রসারিত জীবন সম্ভাবনায় আশ্বস্ত হল মানুষ।
তখন জনসংখ্যা ছিল কম। পৃথিবী ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। মানুষের জীবন ছিল অঞ্চলের সীমায় আবদ্ধ। এভাবে তাদের এক একটি দল নিজেদের খণ্ড ক্ষুদ্র জগতে যাপন করত স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর জীবন। কুলপতিই ছিল তাদের নেতা–শাসন-পোষণ ও দণ্ডমুণ্ডের মালিক—-ভয়-ভরসার আকর।
এই গোত্রীয় সংহতি এককালে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের ছিল শ্রেষ্ঠ উপায়। তারপর ক্রমে বেড়ে গেছে জনসংখ্যা। জীবনবোধ হয়েছে প্রসারিত। প্রয়োজন গেছে বেড়ে। জীবিকা হয়েছে দুর্লভ। প্রয়োজনের তাগিদে তখন অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করতে শিখেছে মানুষ। তখন গোত্রে গোত্রে জীবিকার অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হল শুরু। কেননা তখনও জাগেনি গোত্রীয় সহঅবস্থান এবং সহযোগিতার সুবিধা ও সুফলের চেতনা। কাজেই অন্য গোত্রের প্রতি বিরূপতা ও বিমুখতা এবং বিগ্রহই আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের একমাত্র উপায় বলে হত বিবেচিত। অনেক কাল হল সেই গোত্রীয় গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়েছে। তার ঠাই নিয়েছে ধর্মীয় সম্প্রদায়। স্বাধৰ্ম গোত্রীয় চেতনারই আর এক রূপ। তাই গৌত্রিক বিরোধ-বিদ্বেষের ঠাঁই নিয়েছে ধর্মমতবাদীর বিরোধ, বিদ্বেষ ও স্বাতন্ত্র চেতনায়। এজন্যে আজো মানুষের সেই আদিম মনোভাবের ও জীবন-চেতনার পরিবর্তন দুর্লক্ষ্য। ধর্মীয় ঐক্য সংহতি দেয় আর অনৈক্য বিরোধ ও হানাহানি ঘটায়–এ-ই হচ্ছে মানুষের কয়েক হাজার বছরের ব্যবহারিক জীবনের ইতিহাসের সারকথা। কাজেই পাক-ভারতের হিন্দু-মুসলানের সম্পর্কের ইতিহাসও স্বতন্ত্র হতে পারেনি। তার উপর সম্পর্কটি বিজিত-বিজেতার বলেই বিদ্বেষ বিরূপতাও ছিল তীব্রতর।