- বইয়ের নামঃ ততোধিক
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. আলোর শেষ কণিকাটুকু
আলোর শেষ কণিকাটুকুও গেল মিলিয়ে। ছায়াচ্ছন্ন হয়ে গেল চরাচর। থেমে গেল বিশ্বের সমস্ত গান। যে-গান সুর সংগ্রহ করেছে কোটি কোটি মানুষের কলরব আর পাখির কলস্বর থেকে, বাতাসের দীর্ঘশ্বাস আর মর্মরিত অরণ্য থেকে, মহাসমুদ্রের গর্জন আর নদীর ঝিরিঝিরি থেকে; সুর সংগ্রহ করেছে গাড়ির শব্দ, যন্ত্রের শব্দ, মাটির গায়ে গাঁইতি শাবল আর লোহার গায়ে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ থেকে,—সে-গান আর কোনোদিন ওর কাছে সত্য হয়ে উঠবে না। ওর ঘুম ভাঙাতে পারবে না।
নির্বাণহীন এক বয়লারের উত্তাপে তরল হয়ে যাওয়া রুপোর স্রোত প্রবাহিত হয়ে চলেছে অনন্তকালের পৃথিবীর ওপর দিয়ে, সে-স্রোত হার মেনে মাথা হেট করল শুধু ওই ঘুমন্ত চোখজোড়ার কাছে।
অথচ এই কিছুক্ষণ আগেও আলোর জন্যে কী ব্যাকুল আকুতি ফুটে উঠেছিল ওর কণ্ঠস্বরে।
জানলাটা খুলে দাও না, আলো আসুক।
বিকৃত সেই স্বরটা একটা আর্তনাদের মতো আছড়ে পড়েছিল বাতাসের গায়ে, তার থেকে ঘরের মেঝেয়। অন্তত তাই মনে হয়েছিল কমলাক্ষর।
তারপর সেই শেষ একটা মোচড়।
রাত্তির হয়ে গেল, আলো জ্বালছ না কেন?
উঠতে চেষ্টা করেছিল, উঠতে পারেনি। আলোর জন্যে আকুলতাও করেনি আর। গত সন্ধ্যার মতো হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে খোঁজেনি-কোথায় বসে আছ তুমি? আমি যে দেখতে পাচ্ছি না।
কমলাক্ষ উঠে দাঁড়ালেন।
বসে থাকবার সময় নয়। এখন তো এই এতবড়ো বিপদের দায়িত্বটা সমস্ত নিতে হবে তাকে। উপায় কি, মানুষের চামড়া রয়েছে যখন গায়ে। নিথর হয়ে যাওয়া মানুষটার দিকে তাকালেন একবার। অদ্ভুত রকমের অচেনা লাগছে।
কিন্তু অচেনা ছাড়াই বা কি? সাতটা দিন আগেও তো পৃথিবীর শত শত কোটি অদেখা লোকের দলেই ছিল ও। মাত্র কয়েকটা দিনের জন্যে এসে কী আশ্চর্য রকম জড়িয়ে পড়লেন, ভেবে অবাক লাগছে কমলাক্ষর।
বন্ধু নয়, আত্মীয় নয়, হোটেলওয়ালা। সম্পর্ক শুধু পয়সার লেনদেনে। তবু আর একটা হিসেবও রাখতে হয় বইকি। পৃথিবীর কাছেও একটা ঋণ থাকে যে মানুষের। মানুষ হয়ে জন্মানোর ঋণ।
কমলাক্ষ বিছানার পাশের টুলটা ছেড়ে উঠলেন। সদ্যমৃতের মাথার কাছে প্রায় মৃতের মতোই নিথর হয়ে বসেছিল যে-মানুষটা, তাকে উদ্দেশ করে আস্তে প্রায় অস্ফুটে বললেন, কোথায় কোথায় টেলিগ্রাম করতে হবে, তার ঠিকানাটা–
পাথরের দেহে সাড়া জাগল না, শুধু পাথরের মুখে স্বর ফুটল, কোথাও না। একটা যান্ত্রিক স্বরে উচ্চারিত হল কথাটা।
কোথাও না। মানে আপনাদের আত্মীয়স্বজনদের
যন্ত্রের মধ্য থেকে যন্ত্রের শব্দের মতোই ভাবহীন, আবেগহীন, নিতান্ত নির্লিপ্ত উত্তরটা কমলাক্ষকে বিমুঢ় করে দেয়। আমাদের কোনো আত্মীয় নেই।
বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কমলাক্ষ, সত্যিই বিমূঢ় হয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।
এরপর আর কোন প্রশ্ন করবেন?
তবু তো করতেই হবে। নইলে কী করবেন? একটা কোনো ব্যবস্থা তো করা চাই।
এখানে কোনো কেউ চেনাশোনা–
এখানে? পাথরের প্রতিমা মুখ তুলল এবার। বুঝি বা একটু হাসলই। তারপর বলল, এখানের বাসিন্দারা কেউ আমাদের মুখ দেখে না। শুধু আপনাদের মতো এই বাইরের বোর্ডারদের নিয়েই দিন চলে যায় আমাদের। হঠাৎ আর একটু সত্যি হাসিই হাসল বোধ হয় ও বলল, মানে চলে যেত।
চলে যেত!
এরপর আর কিভাবে দিন চলবে, আদৌ চলবে কি না—সে-কথা জানা নেই ওর। কমলাক্ষ এই সাত দিনেও যার নাম জানেননি, জানবার চেষ্টাও করেননি। জানা দরকার একথা ভাবেনইনি।
এখনও ভাবলেন না। শুধু ভাবলেন, তাই তো! আমি কেবলমাত্র এদের প্রবাস বোর্ডিঙের বাইরের বোর্ডার, তা ছাড়া আর কি?
কমলাক্ষ কি তবে এদের বিপদ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না? কমলাক্ষ এ-ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘর থেকে সুটকেসটা হাতে তুলে নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে যাবেন? সম্ভব নয়?
একেবারে অসম্ভব? কমলাক্ষ তো জীবনে আর কখনও এই পলাশপুরে আসবেন না। ওই যে মানুষটা সম্পূর্ণ ভাবলেশশূন্য মুখ নিয়ে যান্ত্রিক স্বরে শুধু জানিয়ে দিল, ওদের কোনো আত্মীয় নেই, এখানে কেউ ওদের মুখ দেখে না, কমলাক্ষকেও তো জীবনে কখনও আর তাকে মুখ দেখাতে হবে না।
তবে কেন এই অনাসৃষ্টি অদ্ভুত অবস্থাটার মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছেন কমলাক্ষ?
কেন দাঁড়াচ্ছেন, কেন দাঁড়াবেন, সেকথা ভাবতে পারলেন না কমলাক্ষ। দাঁড়াতে হবেই, এই চরম সিদ্ধান্তটা জেনে নিলেন। তাই খুব ধীরে বললেন, আমি তো এখানের কিছুই জানি না। কোনো সমিতি-টমিতি আছে কি?
সকার সমিতি কথাটা মুখে বাধল। শুধু বললেন সমিতি।
ও এবার বিছানার ধার থেকে উঠে এল। তেমনি কেমন এক রকম হাসির মতো করেই বলল, আছে কি না আমিও ঠিক জানি না, দরকার হয়নি তো-তবে আমি বলি কি—নিজেরাই কোনো রকমে–
নিজেরাঅ্যা মহিলাটি কি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেলেন নাকি?
স্পষ্ট সে-সন্দেহ প্রকাশ না করলেও বিস্ময় প্রকাশ না করে পারলেন না কমলাক্ষ, বিস্ময়টা হয়তো বা একটু উত্তেজিতই হল। নিজেরা নিজেরা মানে? বলছেন কি আপনি?
মহিলাটির সর্বাঙ্গে এখনও সধবার ঐশ্বর্যরেখা, তবু ভয়ানক রকমের বিধবা বিধবা লাগছিল ওকে। ওর ঠোঁটের রেখায় যেন বালবিধবার শুষ্ক বিষণ্ণতা।
কমলাক্ষর মনে পড়ল ভদ্রমহিলা সেই পরশু সকাল থেকে এই দুদিন রোগীর বিছানা ছেড়ে ওঠেননি, জলবিন্দুটি পর্যন্ত মুখে দেননি। পুরো দুরাত ঘুমোননি। তার ওপর এই দুর্ঘটনা। শুকনো তো লাগবেই।