- বইয়ের নামঃ আমি এবং আমরা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, দর্শন, রহস্যময় গল্প
মিসির আলি দু শ গ্রাম পাইজং চাল কিনে এনেছেন
মিসির আলি দু শ গ্রাম পাইজং চাল কিনে এনেছেন। চাল রাখা হয়েছে একটা হরলিক্সের কোটায়। গত চারদিন ধরে তিনি একটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন। চায়ের চামচে তিন চামচ চাল তিনি জানালার পাশে ছড়িয়ে দেন। তারপর একটু আড়াল থেকে লক্ষ করেন-কী ঘটে। যা ঘটে তা বিচিত্র। অন্তত তার কাছে বিচিত্র বলেই মনে হয়। দুটা চড়ুই পাখি চাল খেতে আসে। একটি খায়, অন্যটি জানালার রেলিঙে গভীর ভঙ্গিতে বসে থাকে। ব্যাপারটা রোজই ঘটছে। পক্ষী সমাজে পুরুষ স্ত্রী পাখির চেয়ে সুন্দর হয়, কাজেই ধরে নেওয়া যায় যে পাখিটি চাল খাচ্ছে সেটা পুরুষ পাখি। গভীর ভঙ্গিতে যে বসে আছে, সে তার স্ত্রী কিংবা বান্ধবী। পক্ষী সমাজে বিবাহ প্রথা চালু আছে কিনা মিসির আলি জানেন না। একটি পুরুষ পাখি একজন সঙ্গিনী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে, না সঙ্গিনী বদল করে-এই ব্যাপারটা মিসির আলির জানতে ইচ্ছা করছে। জানেন না। পক্ষী বিষয়ক প্রচুর বই তিনি যোগাড় করেছেন। বইগুলোতে অনেক কিছুই আছে, কিন্তু এই জরুরি বিষয়টা নেই।
পাবলিক লাইব্রেরিতে পুরোনো একটি বই পাওয়া গেল-ইরভিং ল্যাংষ্টোনের The Realm of Birds. সেখানে পাখিদের বিচিত্র স্বভাবের অনেক কিছুই লেখা, কিন্তু কোথাও নেই একটি পাখি খাবে, অন্যটি দূরে দাঁড়িয়ে দেখবো। রহস্যটা কী? এই পাখিটির কি খিদে নেই? নাকি সে এক ধরনের উপবাসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে? পক্ষী বিশারদরা কী বলেন? বিশারদদের ব্যাপারে মিসির আলির এক ধরনের এ্যালার্জি আছে। বিশেষজ্ঞদের কিছু জিজ্ঞেস করলেই তাঁরা এমন ভঙ্গিতে তাকান যেন প্রশ্নকর্তার অজ্ঞতায় খুব বিরক্ত হচ্ছেন। প্রশ্ন পুরোপুরি না শুনেই জবাব দিতে শুরু করেন। সেই জবাব বেদবাক্যের মতো গ্ৰহণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের জবাবের ওপর প্রশ্ন করা যাবে না। বিনয় নামক সদগুণটি বিশেষজ্ঞদের নেই। দীর্ঘদিন পড়াশোনা করে তাঁরা যা শেখেন। তায় চেয়ে অনেক বেশি শেখেন–অহংকার প্রকাশের কায়দাকানুন। পাখির ব্যাপারটাই ধরা যাক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একজন অধ্যাপকের কাছে গিয়েছিলেন। সেই ভদ্রলোক সমস্যা পুরোপুরি না শুনেই বললেন, এটা কোনো ব্যাপার না। খিদে নেই তাই খাচ্ছে না, পশু ও প্রাণিজগতের নিয়ম হল খিদেয় খাদ্য গ্ৰহণ করা। একমাত্র মানুষই খিদে না থাকলেও লোভে পড়ে খায়।
মিসির আলি বললেন, প্রতিদিন একটা পাখির খিদে থাকবে না, অন্য একটার থাকবে-এটা কি যুক্তিযুক্ত?
একটা বিশেষ পাখিই যে খাচ্ছে না। তাইবা আপনি ধরে নিচ্ছেন কেন? সব পাখি দেখতে এক রকম। একদিন একটা খাচ্ছে, অন্যদিন আরেকটা খাচ্ছে।
আমি পাখি দুটাকে চিনি। খুব ভালো করে চিনি। অসংখ্য চড়ুই পাখির মধ্যেও আমি এদের আলাদা করতে পারব ।
অধ্যাপক ভদ্রলোক অনেকক্ষণ গা দুলিয়ে হাসলেন। তারপর ছোট শিশুকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন—একটা মশা আপনার গায়ে কামড় দিল, তারপর সেটা উড়ে গিয়ে অন্য মশাদের সঙ্গে মিশল। আপনি কি সেই মশাটিা আলাদা করতে পারবেন?
না।
যদি না পারেন তা হলে চড়ুই পাখিও আলাদা করতে পারবেন না। পুরুষ চড়ুই এবং মেয়ে চড়ুই দেখতে এক রকম। ভাই, এখন আপনি যান। এগারোটার সময় আমার ক্লাস, আমি কিছুক্ষণ পড়াশোনা করব।
ভদ্রলোক মিসির আলিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ডিকশনারি সাইজের এক বই খুলে পড়তে শুরু করলেন। ভাবটা এরকম যে আজেবাজে লোকের সঙ্গে কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় তার নেই। দেখা যাচ্ছে, সবাই ব্যস্ত। সবারই সময়ের টানাটানি। একমাত্র তঁরই অফুরন্ত সময়। সময় কাটানোই তার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুই করার নেই। মিসির আলির ডাক্তার তাঁকে বলেছেন—একজন মানুষের শরীরে যত ধরনের সমস্যা থাকা সম্ভব তার সবই আপনার আছে। লিভারের প্রায় পুরোটাই নষ্ট করে ফেলেছেন। অগ্ন্যাশয় থেকে সিক্রেশন হচ্ছে না। রক্তে ডাবলিউ বিসি-র পরিমাণ খুব বেশি। আপনার হার্টেরও সমস্যা আছে, ড্রপ বিট হচ্ছে। আপনাকে যা করতে হবে তা হল।–দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে থাকা। বুঝতে পারছেন?
পারছি।
সিগারেট ছেড়েছেন?
এখনো ছাড়ি নি। তবে শিগগিরই ছাড়ব।
উপদেশ দিতে হয় বলে দিচ্ছি। মনে হয় না। আপনি আমার উপদেশের প্রতি কোনো রকম গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারপরেও বলি-মন থেকে সমস্ত সমস্যা বেঁটিয়ে দূর করুন। যা করবেন তা হল বিশ্রাম। গান শুনবেন, পার্কে বেড়াবেন, হালকা বইপত্র পড়তে পারেন। রাত জাগা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মনে থাকবে?
জি থাকবে।
আমি জানি আপনি এর কোনোটাই করবেন না।
মিসির আলি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, আমি আপনার উপদেশ মেনে চলব। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্যে যে উপদেশ মানব তা না। শরীরটা সত্যি সত্যি সারাতে চাচ্ছি। অসুস্থত অসহ্য বোধ হচ্ছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি মুখে বলছেন। কিন্তু আসলে কিছুই করবেন না। কিছু কিছু মানুষ আছে অন্যের উপদেশ সহ্য করতে পারে না। আপনি সেই দলের।
ডাক্তারের কথা ভুল প্রমাণিত করে মিসির আলি ডাক্তারের উপদেশ মতোই চলছেন। রাত নটার মধ্যেই ভাত খান, দশটা বাজতেই শুয়ে পড়েন। সমস্যা হল–ঘুম আসে না। মানুষ কম্পিউটার না। নির্দিষ্ট সময়ে তাকে ঘুম পাড়ানো সম্ভব না। মিসির আলি গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। এক এক রাতে এক এক ধরনের বিষয় নিয়ে ভাবেন। ইচ্ছে করে যে ভাবেন তা না। ভাবনাগুলোর যেন প্ৰাণ আছে, তারা নিজেরাই আসে। মিসির আলিকে বিরক্ত করে তারা যেন এক ধরনের আনন্দ পায়। ইদানীং তিনি চড়ুই পাখি দিয়ে ভাবেন! পাখি মানুষ চিনতে পারে কি পারে না। এই তাঁর রাতের চিন্তার বিষয়। কোনো মানুষ যদি রোজ রোজ পাখিকে খাবার দেয় তা হলে সেই পাখিগুলো কি ঐ মানুষটিকে চিনে রাখবে?