- বইয়ের নামঃ বিভীষিকার প্রহর
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
বিভীষিকার প্রহর
এক
লম্বা, গা ছমছমে পথটা ধরে হেঁটে চলেছি আমি। চারপাশ থেকে
ঘিরে রেখেছে বড় বড় গাছ।
আমি এখানে একা।
আমার বন্ধুরা কোথায় গেল?
‘কিশোর?’
‘মুসা?’
চিৎকার করে ডাকলাম।
কিন্তু ফিরে এল শুধু আমার ডাকের প্রতিধ্বনি।
কেউ জবাব দিল না।
মরিয়া হয়ে আবার চারপাশে তাকালাম।
কাউকে দেখলাম না।
নেই ওরা।
গায়ে কাঁপুনি শুরু হলো আমার।
সামনে উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ল। মোড়ের কাছে।
কীসের আলো?
জানি না! হয়তো এখান থেকে, এই জঘন্য ভয়াল জগৎ থেকে বেরোনোর পথ।
আলোর দিকে এগোলাম।
হাসির শব্দ শোনা গেল! অট্টহাসি!
‘কিশোর! মুসা!’ চিৎকার করে আবার ডাকলাম।
এবারও কোন জবাব পেলাম না।
আশ্চর্য! গেল কোথায় ওরা? আমিই বা এখানে এলাম কী করে? ছিলাম তো শহরের সবচেয়ে আধুনিক শপিং মলটাতে! সেখান থেকে এসে পড়েছি এই ঘন বনে! কী করে?
জোরাল একটা কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, ‘রবিন! রবিন মিলফোর্ড! আমার হাত থেকে মুক্তি নেই তোমার। হাহ্ হাহ্ হাহ্!’
‘না, ছাড়ো আমাকে! রেহাই দাও! কী চাও তুমি?’ আতঙ্কিত চিৎকার দিয়ে চারপাশে তাকালাম।
‘রবিন! রবিন! অ্যাই, রবিন!’
আরেকটা কণ্ঠ। বহুদূর থেকে আসছে। তবে অনেক মোলায়েম, স্নেহ আর মায়াভরা পরিচিত কণ্ঠ।
‘রবিন, ওঠো!’
চোখ মেললাম। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। চারপাশে তাকালাম। আমার শোবার ঘরে, আমার বিছানায় শুয়ে আছি। ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। সকাল সাতটা তিরিশ। স্কুলে যাবার সময় হয়েছে।
‘আবার একটা বিচ্ছিরি দুঃস্বপ্ন দেখেছ, তাই না?’ মা বলল।
‘হ্যাঁ।’ বিছানায় উঠে বসে, আড়মোড়া ভেঙে দেহের জড়তা আর মাথা থেকে দুঃস্বপ্নের রেশ তাড়ানোর চেষ্টা করলাম।
মা হেসে বলল, ‘আসলে তোমার মধ্যে সৃজনশীলতা আছে, কল্পনার ক্ষমতা অনেক বেশি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, কোন একদিন বড় লেখক হবে, কিংবা চিত্র পরিচালক।’
হাত-মুখ ধুয়ে এসে, স্কুলে যাবার পোশাক পরতে পারতে মা’র কথাটা নিয়ে ভাবলাম। কয়েক দিন থেকে লক্ষ করছি, দুঃস্বপ্নগুলো অতিমাত্রায় বাস্তব হয়ে ওঠে আমার। সব সময়ই দেখি ভয়াল কোনও বিপজ্জনক জায়গায় রয়েছি, আজকের এই শপিং মলটার মত। মা হয়তো ঠিকই বলেছে। আমার অতি কল্পনা হয়তো একদিন আমাকে বিখ্যাত করে তুলবে।
মা, বাবা আর আমার এগারো বছরের খালাত বোন নিনার সঙ্গে টেবিলে নাস্তা খেতে বসলাম। টেবিল ঘিরে বসলাম। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে নিনা। এবারের জন্মদিনটা আমাদের সঙ্গে কাটাবে। ওর বাবা-মা বিশেষ কাজে দেশের বাইরে চলে গেছে, ফিরতে কিছুদিন দেরি হবে। নিনার মা তাই মেয়েকে বোনের কাছে, অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে রেখে গেছেন।
বাবা কাগজ পড়ছে, নাস্তার টেবিলে সবসময় যা করে থাকে। আর মা সবার প্লেটে খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে। আমার স্কুলে যাবার তাড়া, তাই গপ্প্ গিলে চলেছি। অনর্গল কথা বলছে নিনা, একটা মুহূর্তের জন্যও মুখ বন্ধ রাখতে পারে না ও।
‘স্কুলে যদি ম্যাডাম জিজ্ঞেস করেন, বড় হয়ে আমি কী হতে চাই,’ নিনা বলছে, ‘বলব, অ্যারোপ্লেনের পাইলট হব।’
‘আর তোমার সেই প্লেন থেকে দশ হাত দূরে থাকব আমি,’ জবাব না দিয়ে পারলাম না। কোনমতে খাবারগুলো নাকেমুখে গুঁজে, তিন ঢোকে গ্লাসের দুধ শেষ করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ‘আমি যাই,’ বলে প্রায় ছুটে বেরোলাম বারান্দায়।
‘রবিন,’ আমার পিছন পিছন বেরিয়ে এল মা।
‘কী, মা?’ পায়ে স্কেটস বাঁধলাম। প্ল্যাস্টিকের হেলমেট মাথায় দিলাম। হাঁটুতে পরলাম নি-প্যাড। তারপর স্কুল ব্যাগটা পিঠে বেঁধে নিলাম। বয়ে নেয়ার সুবিধের জন্য বড় একটা ব্যাকপ্যাককে স্কুলব্যাগ বানিয়েছি। স্কেটিং করতে খুব ভাল লাগে আমার। হাঁটার চেয়ে অনেক দ্রুত চলা যায়। প্রতিদিন তাই স্কেট করেই স্কুলে যাই, আসি। ‘আগামী কাল কী, মনে আছে তো?’ আমার দিকে তাকিয়ে মা জিজ্ঞেস করল।
‘তা আর থাকবে না,’ জবাব দিলাম। ‘আগামী কাল শনিবার, সারাদিন স্কেটিং করে বেড়াতে পারব।’
‘কাল নিনার জন্মদিন।’
‘তো আমি কী করব?’ জবাব দিলাম। ‘আগামীকাল বারোয় পা দিচ্ছে ও। বড় হয়েছে, এখন থেকে তাই বড়দের মত আচরণ করতে বোলো ওকে।’
‘একটা উপহার আনতে হবে ওর জন্য,’ আমার খোঁচাটা এড়িয়ে গেল মা।
‘উপহার? কী উপহার?
‘পুতুল কী রকম ভালবাসে ও, জানো তুমি। নতুন একটা সুপার কিড এভিয়েটর ডল পেলে ভীষণ খুশি হবে। টিভিতে ওই পুতুলের বিজ্ঞাপন দিলে যেভাবে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে।’
‘কিন্তু আমাকে হাতখরচের টাকা যা দাও, তা থেকে তো এভিয়েটর ডল হবে না।’
‘নাও,’ আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল মা। ‘এবার হবে।’
‘কোথায় পাওয়া যায় ওই পুতুল?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘ওয়েভারলি মলে। দোকানটার নাম ডল এম্পোরিয়াম।’
‘কিন্তু, মা, আজ তো আমার বেসবল প্র্যাকটিস আছে, স্কুল ছুটির পর। পাঁচটার আগে শেষ করতে পারব না। আর তারপর শপিং মলে যেতে তো রাত হয়ে যাবে?’
‘রবিন, তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি আমি,’ গম্ভীর স্বরে মা বলল। ‘নিনা আমাদের মেহমান। নিজের বাড়ি ফেলে আমাদের এখানে জন্মদিন পালন করতে এসেছে। বুঝলাম, বাধ্য হয়েই। কিন্তু ওর জন্য একটা পুতুল কিনতে যাওয়াটা কি এতই কষ্টের? তোমার জন্মদিনে ও তোমাকে কী পাঠিয়েছিল, ভুলে গেছ?’