- বইয়ের নামঃ দার্জিলিং জমজমাট
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, ফেলুদা সমগ্র
০১. লালমোহনবাবু ঘরে ঢুকতেই
সুখবর বলে মনে হচ্ছে?
লালমোহনবাবু ঘরে ঢুকতেই ফেলুদা তাঁকে প্রশ্নটা করল। আমি নিজে অবিশ্যি সুখবরের কোনও লক্ষণ দেখতে পাইনি। ফেলুদা বলে চলল, দু বার পর পর বেল টেপা শুনেই বুঝেছিলাম, আপনি কোনও সংবাদ দিতে ব্যগ্র, তবে সেটা সুসংবাদ না দুঃসংবাদ বুঝতে পারিনি। এখন স্পষ্ট বুঝছি সুসংবাদ।
কী করে বুঝলেন? বললেন লালমোহনবাবু, আমি তো হাসিনি।
এক নম্বর, আপনার মাঞ্জা দেওয়া চেহারা; হলদে পাঞ্জাবিটা নতুন, দাড়ি কামিয়েছেন। নতুন ব্লেড দিয়ে, আফটার-শেভ লোশনের গন্ধে ঘর মাতোয়ারা, তারপর আপনি সচরাচর নটার আগে আসেন না; এখন নটা বাজতে সতেরো।
লালমোহনবাবু হেসে ফেললেন। ঠিকই ধরেছেন মশাই! আপনাকে ব্যাপারটা না বলা অবধি সোয়াস্তি পাচ্ছিলাম না। সেই পুলক ঘোষালকে মনে আছে তো?
চিত্র পরিচালক? যিনি আপনার বোম্বাইয়ের বোম্বেটে থেকে হিন্দি ছবি করেছিলেন?
শুধু ছবি নয়, হিট ছবি। তখন থেকেই বলে রেখেছিল ভবিষ্যতে আবার আমার গল্প থেকে ছবি করবে। অ্যাদ্দিনে সেটা ফলেছে।
এটা কোনটা?
সেই কারাকোরামের গল্পটা। অবিশ্যি কারাকেরাম আর নেই; সেখানে হয়ে গেছে। দাৰ্জিলিং।
কোথায় কারাকেরাম, আর কোথায় দাৰ্জিলিং!
তবু নেই মামার চেয়ে তো কানা মামা ভাল মশাই ] আর আমার রেটও তো বেড়ে গেছে। অনেক। ফর্টি থাউজ্যান্ড!
বলেন কী? আমার দু বছরের রোজগার।
তা, যেখানে ছাপ্পান্ন লাখ টাকা বাজেট-সেখানে রাইটারকে ফটি থাউজ্যান্ড দেবে না? ওখানে টুপ অভিনেতারা কত পায় জানেন?
তা মোটামুটি জানি বইকী?
তবে? আমার। এ ছবিতে হিরো করছে রাজেন রায়না। সে নিচ্ছে বারো লাখ। আর ভিলেন করছে মহাদেব ভার্মা। এর রেট আরও বেশি। সবে পাঁচখানা ছবি করেছে, কিন্তু পাঁচখানাই সিলভার জুবিলি হিট।
তা, পুলক ঘোষাল আপনার এত পেয়ারের, আপনাকে দার্জিলিং-এ ডাকল না?
সেইটে বলতেই তো আসা! ডাকবে না। মানে? ওর গ্র্যাণ্ডফাদার ডাকবে। আর আমাকে এক নয়, আমাদের তিনজনকেই ডেকেছে। অবিশ্যি আমি বলিচি ইনভিটেশনের দরকার নেই-আমরা এমনিই যাব। কী-ঠিক বলিনি?
শেষ কবে গেছি। দাৰ্জিলিং? মনেই নেই; শুধু এইটুকু মনে আছে যে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির শুরু দাৰ্জিলিং-এ। আমি ছিলাম খুব ছোট, আর ওর নরম-গরম ধমক প্রায়ই শুনতে হত। এখন ফেলুদা আমাকে ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে পরিচয় দেয়। তখন সেটা করতে গেলে লোকে হাসত। বেশ কিছু দিন থেকেই মনে হয়েছে যে আবার দাৰ্জিলিং গেলে বেশ হয়, কিন্তু গত পাঁচ-ছ বছরে ফেলুদার পসার বেড়েছে অনেক! সেই সঙ্গে অবিশ্যি রেটও বেড়েছে। আজকাল ওর দিব্যি চলে যায়; গত ছ। মাসে পাঁচটা তদন্ত করতে হয়েছে ওকে। তার মধ্যে চন্দননগরের একটা জোড়া খুনের কেস ছাড়া সব কটাতেই ও সফল হয়েছে, তারিফ পেয়েছে, পয়সা কমিয়েছে। তিন মাস আগে একটা কালার টি ভি কিনেছে। ও। তা ছাড়া ওর পুরনো বইয়ের শখ, সেই সব বই বিস্তর কিনে ও তাক ভরিয়েছে। এটা আমি বুঝেছি যে ফেলুদা খরুচে লোক। টাকা জমানোর দিকে ততটা আগ্রহ নেই। যা ঘরে আসে তার বেশির ভাগই খরচ হয়ে যায়, আর সেটা যে শুধু নিজের পিছনে, তা নয়। লালমোহনবাবু আমাদের জন্য এত করেন বলে ফেলুদা সুযোগ পেলেই তাঁকে কিছু না কিছু দেয়। আফটার-শেভ লোশনটা ওরই দেওয়া। সেটা স্পেশাল আকেশনে লালমোহনবাবু ব্যবহার করেন। বোঝাই যাচ্ছে আজকে সে রকমই একটা দিন।
সামনে পুজো, ফেলুদা ঠিকই করেছিল মাস কয়েক আর কোনও কাজ নেবে না। কাজেই দাৰ্জিলিং যাওয়ায় তার আপত্তির কোনও কারণ থাকতে পারে না। এমনিতেই দাৰ্জিলিং ওরা খুব প্রিয় জায়গা; ও বলে, বাংলা দেশটা ভারতবর্ষের কটিদেশে হওয়াতে এখানে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে-বাংলার উত্তরে হিমালয় আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এটা ভারতবর্ষের আর কোনও প্রদেশে নেই। এটা নাকি একটা অ্যাক্সিডোন্ট অফ জিয়োগ্রাফি।এত বৈচিত্ৰ্য আর কোনও একটা প্রদেশে পাবি না, বলে ফেলুদা! শস্য-শ্যামলাও পাবি, রুক্ষতাও পাবি, সুন্দরবনের মতো জঙ্গল পাবি, গঙ্গা পদ্মা মেঘনার মতো নদী পাবি, সমুদ্র পাবি, আবার উত্তরে হিমালয় আর কাঞ্চনজঙ্ঘাও পাবি।
বলুন মশাই, যাবেন কি না, শ্ৰীনাথের আনা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে এক মুঠো চানাচুর মুখে পুরে বললেন লালমোহনবাবু।
দাঁড়ান, আর একটা ডিটেল জেনে নিই।
বলুন কী জানতে চান।
গেলে কবে যাওয়া?
ওদের একটা দল অলরেডি দাৰ্জিলিং পৌঁছে গেছে। তবে আগামী শুক্রবারের আগে কাজ আরম্ভ হচ্ছে না। আজ হল রবি।
শুটিং দেখার ব্যাপারে আমার তেমন কোনও উৎসাহ নেই। কাজটা কি মাঠে-ঘাটে হচ্ছে, না বাড়ির ভিতর?
বিরূপাক্ষ মজুমদারের নাম শুনেছেন?
বেঙ্গল ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর?
ছিলেন, ঐখন আর নেই। একটা মাইল্ড সেরিব্রাল ষ্ট্রোকের পর বাহান্ন বছর বয়সে রিটায়ার করেন।
তা ছাড়া ওঁর তো আরও অনেক গুণাপনা আছে না? ভদ্রলোক স্পোর্টসম্যান ছিলেন তো।
এককালে ভারতবর্ষের বিলিয়ার্ড চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। শিকারও বোধহয় করতেন।
ওঁর একটা শিকারূকাহিনী একটা পত্রিকায় পড়েছি।
খুব বড় ফ্যামিলির ছেলে। এঁর পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গে নয়নপুরের জমিদার ছিলেন। দাৰ্জিলিং-এ ওঁদের একটা পুরনো বাড়ি আছে। একতলা বাংলো টাইপের ছড়ানো বাড়ি, ষোলটা ঘর। বিরূপাক্ষ মজুমদার রিটায়ার করার পর সেখানে গিয়েই থাকেন। ওঁদের বাড়ির দুখানা ঘরে কিছু শুটিং হবে। পারমিশন হয়ে গেছে। বাকি শুটিং বাইরে নানান জায়গায় ছড়িয়ে। এরা মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে রয়েছে। আমরা অন্য কোনও হোটেলে